দেওয়ানা/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

 এই সময়ে কে যেন তাহার এই কথা গুলি লুফিয়া লইয়া প্রত্যেক কথার প্রতিধ্বনি করিয়া বলিল, —“সত্যই সেই মঙ্গলময় বিধাতার অপার মহিমা। আমিও বলি, তাঁহার ইচ্ছা পূর্ণ হউক!”

 আনার সম্মুখে চাহিবা মাত্রই দেখিল, মীর লতিফ্ তাহার কক্ষদ্বারের নিকট দাঁড়াইয়া।

 আনার প্রফুল্লমুখে বলিল,—“এস মীর সাহেব! পরের মত বাহিরে দাঁড়াইয়া কেন? আমরা আজকাল একটু গরীব হইয়াছি বলিয়া নাকি?”

 লতিফ কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিয়া সহাস্য মুখে বলিল, “আমি যে তোমাদের চেয়েও গরীব— আনার উন্নিসা!”

 আনার বলিল,—“তাহা হইলেও তোমার উপর বিধাতার অনুগ্রহ আমাদের চেয়েও বেশী!”

 লতিফ। সত্যই তাই!

 আনার। আচ্ছা,—কিসে বুঝিলে?

 লতিফ। বুঝিলাম অনেক—কারণে। প্রথম,—আজ “একশতী মন্সবদাবের” নিয়োগ পত্র দরবারে পাইয়াছি। বুঝিলাম, বিধাতা আমায় খুবই কৃপা করেন, কেননা তোমরাও যথেষ্ট ভালবাস। যার এ সংসারে আপনার বলিবার কেহ নাই,— অথচ যাকে তোমরা এত আপনার বলিয়া বোধ কর— স্নেহ কর—আদর কর,—তার চেয়ে ভাগ্যবান্ কে আছে আনারউন্নিসা?”

 আনার। কই তোমার মন্সবদারীর পরোয়ানা খানা একবার দেখাও দেখি।

 লতিফ—এ্যস্ত-ব্যস্তে তাহার উষ্ণীষমধ্য হইতে এক খণ্ড কাগজ বাহির করিয়া, আনারের হাতে দিয়া বলিল,—“পড়িয়া দেখ। ইহাতে কি লেখা আছে।”

 সুরূপসী আনার উন্নিসা তাহার পিতার নিকট সে সময়ের প্রথামত, প্রয়োজনানুরূপ শিক্ষালাভ করিয়াছিল। সুতরাং মীর লতিফের মন্সবদারী পরোয়ানা খানির মর্ম্ম গ্রহণ করিতে তাহার কষ্ট বোধ হইল না। বরঞ্চ সেখানি পড়িয়া সে খুবই একটা আনন্দ বোধ করিয়া বলিল,—“খোদা তোমার মঙ্গল করুন লতিফ,! তোমাকে আরও বড় করুন।”

 লতিফ বলিল,—“তোমার অন্তরের এই প্রার্থনা নিশ্চয়ই বিফল হইবে না। বাল্যকাল হইতে আমরা দুইজনে একত্রে মানুষ হইয়াছি। এক পিতৃমাতৃহীন অনাথ আমি। তোমার স্বর্গগত জননী না থাকিলে, স্নেহবশে নিজের সন্তান বলিয়া আমাকে তাঁহার বুকে টানিয়া না লইলে, এই নির্ম্মম স্বার্থপর সহানুভূতিহীন দুনিয়ার প্রচণ্ড স্রোতে যে কোন অজানা রাজ্যে আমার মত হতভাগা চলিয়া যাইত, তাহাও জানি না।”

 আনার, লতিফের মুখ চাপিয়া ধরিয়া সহাস্যমুখে বলিল,—“চুপ কর লতিফ,—চুপ কর! ও পুরাণো কাহিনী শুনিতে শুনিতে আমার কাণ ঝালাপালা হইয়া গিয়াছে। নূতন আর কিছু বলিবার থাকে ত বল।

 লতিফ্ অগত্যা থামিয়া গেল। আনার উন্নিসা লতিফকে তাহার পার্শ্বে বসাইয়া বলিল— “কিছু খাইবে কি? আঙ্গুরের সরবৎ আনিব?”

 লতিফ বলিল,—“সরবৎ বা খাবার তোমাদের কোনু ঘরে থাকে তাও আমি জানি, আর তোমাদের সংসারের কর্ত্রী জুমেলিও আমার অপরিচিত নয়। দরকার হইলে আমি নিজেই গিয়া খাইতে পারিব।”

 আনার বলিল,— তা’ত পারই! তবে নূতন মন্সবদারের সম্মান চিহ্ণ স্বরূপ আজ আমারিই এই সরবৎটা বহিয়া আনা দরকার।”

 আনার উঠিতে যাইতেছিল। লতিফ তাহার হাত ধরিয়া বসাইল বলিল,—“আর একটা কথা আমার বলিবার আছে। সেটা শুনিলে বোধ হয় সুখী হইবে না।”

 আনার। এমন কি কথা?

 লতিফ। নূতন মন্সবদার হইয়াছি। এজন্য বোধ হয়, আমাকে শীঘ্রই রাজকুমার দারার সহিত আজমীরে যাইতে হইবে। এইরূপ একটা জনরব ত আজ শুনিয়া আসিলাম। এটাকে একেবারে অবিশ্বাস করিতেও পারি না। কেননা—যাঁহার মুখে কথাটা শুনিলাম, তিনি আমার উপরওয়ালা কর্ম্মচারী।

 আনার। তাহা হইলে উপায়?

 লতিফ। সহজে কি তোমাদের ছাড়িয়া বিদেশে যাইতে পারিব? একবার চেষ্টা করিয়া দেখিতে হইবে, যাহাতে এ ব্যবস্থা নাকচ, করাইতে পারি। আর চেষ্টা করিলে যে কৃতকার্য্য হইব না, তাহারও সম্ভাবনা নাই।

 আনার উন্নিসা একটা তৃপ্তির সহিত দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, “তাই ভাল! তা তুমি আমাকে তোমার পরোয়ানা খানা তো পড়াইয়া লইলে,— এবার আমি তোমাকে আমার একখানা পরোয়ানা পড়িতে দিব।”

 এই কথা বলিয়া, আনার সুজাবেগের সেই পত্রখানি মীর লঙিফের হাতে দিল। সাগ্রহে পত্রখানি আদ্যোপান্ত পাঠ করিবার পর মীর লতিফ শুষ্ক মুখে বলিল,— “এ পত্রের কি উত্তর দিয়াছ তুমি?”

 আনার। একটা দিয়াছি বই কি।

 লতিফ। কি লিখিলে?

 আনার। লিখিয়াছি—যখন, নারীরূপে দুনিয়ায় জন্মিয়াছি, তখন স্বামী ত আমার একজন চাই। আপনার মত আমীর লোক যদি আমাকে পত্নী-বলিয়া দয়া করিয়া গ্রহণ করেন,—সেটা আমার সৌভাগ্য বই আর কিছুই নয়।”

 মীর লতিফ এই কথাটা শুনিয়া খুবই দমিয়া পড়িল। শুষ্ক মুখে, কম্পিত হৃদয়ে বলিল,—“সত্যই তাই লিখিয়াছ নাকি? বল কি—আনার উন্নিসা?”

 আনার, তাহার মুখখানা একটু গম্ভীর করিয়া বলিল,—“সত্য নয় তো কি মিথ্যা বলিতেছি। এ সব সাংঘাতিক ব্যাপারে কি রহ্স্য চলে লতিফ?”

 মীর লতিফ ম্লানমুখে একটী মর্ম্মভেদী দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল,—“একবারও আমার মুখের দিকে চাহিলে না আনার উন্নিস! আমার যে সব গেল! ইহজীবনের আশা, উৎসাহ, অস্তিত্ব, সবই যে তুমি আমার!

 লতিফ আর বলিতে পারিল না। মর্ম্মবেদনায় তাহার কণ্ঠস্বর ভারি হইল। প্রাণের ভিতর তাহার যে একটা যাতনা হইতেছিল,—তাহা অশ্রুধারা রূপে তাহার চোখে ফুটিয়া উঠিল।

 আনার, মীর লতিফের এ অবস্থা সহ্য করিতে পারিল না। সে এতক্ষণ লতিফের সহিত একটু রহস্য করিতেছিল মাত্র। কিন্তু সে বুঝিতে পারে নাই, যে এই ব্যাপারে লতিফের চোখ দিয়া জল বাহির হইবে।

 আনার তাহার ওড়নার এক প্রান্ত দিয়া লতিফের চোখের জল মুছাইয়া দিয়া বলিল,—“তোমার সহিত একটু রহস্য করিতেছিলাম মাত্র লতিফ! এ সোজা কথাটাও তুমি আমার কথার ভাব-ভঙ্গী দেখিয়া বুঝিতে পারিলে না? তাজ্জব বটে!”

 লতিফ—মৃদু হাসিয়া বলিল— “হা রহস্যের সময়ই এই বটে! ব্যাধ যেমন মৃগের উপর শর নিক্ষেপ করিয়া রহস্য করে, তোমার রহস্যটা অনেকটি সেই ধরণের।”

 আনার উন্নিসা মীর লতিফের চিবুক ধরিয়া স্নেহময় স্বরে বলিল,—“এতেই তুমি এতটা কাতর, কিন্তু আমি যদি মরিয়া যাই মীর লতিফ?”

 লতিফ এক মর্ম্মভেদী দীর্ঘ-নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিল, বিধাতার ইচ্ছা যদি তাই হয়, তাহা হইলে আমিও জানি কি উপায়ে তোমার সহিত মরণের পরেও মিলিত হইবে। যাক, আনার, একটা কথা তোমায় জিজ্ঞাসা করি। তাহা হইলে নবাবজাদার এ পত্রের উত্তর তুমি দাও নাই এটা ঠিক?”

 আনার। নিশ্চয়ই।

 লতিফ। কি উত্তর দিবে?

 আনার। আমার পিতা যখন বর্ত্তমান, তখন এ পত্রের উত্তর দিবার কোন অধিকারই আমার নাই। কোন স্বাধীনতাই আমার নাই। এ পত্রের যাহা সঙ্গত উত্তর, তাহা আমার পিতাই দিবেন। তবে এ ভাবে একটা অতিরিক্ত স্বাধীনতা লইয়া আমাকে স্বতন্ত্র ভাবে পত্র লেখাই, সুজা বেগের খুব অন্যায় কাজ হইয়াছে।”

 আনারের এই কথা শুনিয়া লতিফের প্রাণের ভিতর হইতে যেন একটা পাষাণের ভার নামিয়া গেল। তাহার জীবনের আশার উজ্জ্বল আলোকটি নিরাশার প্রমত্ত বায়ুতে নিবিয়া যাইবার মত হইয়াছিল। খুব একটা জমাট অন্ধকার তাহার চোখের সম্মুখে ঘনীভূত হইয়া উঠিতেছিল। সেটা যেন খুব দূরে সরিয়া গেল।

 লতিফ আনন্দ-উদ্ভাসিত চিত্তে বলিল,—“জীবনে-মরণে তুমি আমার। সুখে দুঃখে—তুমি আমার! সম্পদে বিপদে তুমি আমার। তুমি যে আমার হৃদয় আলো করিয়া আছ আনার উন্নিসা! এ হৃদয়ের মধ্যে ভাল বাসার হৈম সিংহাসনে বসাইয়া রাখিয়াছি যে—আমি তোমাকে। একটা সুখস্বপ্নের ঘোর, যাহার উন্মত্ততায় অভিভূত হইয়া, সংসারের একটা পিচ্ছিল ও বন্ধুর পথে, অসম্ভব অদম্য উৎসাহের সঙ্গে চলিয়া আসিয়াছি, করুণাময় বিধাতা, যে আমার সেই অতি দূর্ল্লভ সুখ-স্বপ্ন চূর্ণ করিয়া দিবেন,—এমন কোন পাপ তো আমি তাঁর কাছে করি নাই। তবে ভবিতব্য যদি অন্যরূপ হয়,—সে স্বতন্ত্র কথা। তাহা হইলে তোমার ধ্যান, তোমার চিন্তা, আমি এ জীবন থাকিতে ছাড়িব না। খোদা সাক্ষী—তুমি আমার। আমার এই একপ্রবণ প্রেম জ্যোতির্ম্ময় হৃদয় সাক্ষী—তুমি আমার! জানিও তুমি আনার উন্নিসা- আমার এ অস্তিত্ব কেবল তোমারই জন্য। এ দুনিয়ায় যাহা কিছু স্পৃহনীয়, ভোগ্য, ইপ্সিত, সবই আমি হেলায় বিসর্জ্জন করিতে পারি, কিন্তু এ প্রাণ থাকিতে তোমাকে নয়, তোমার চিন্তাকেও নয়।”

 প্রাণের উচ্ছ্বাসে, লতিফ আজ অনেক কথা বলিয়া ফেলিয়াছিল। এতটা প্রাণ খুলিয়া, সে আর কখনও তাহার মনের কথা আনারউন্নিসাকে বলে নাই, বা বলিবার কোন অবসর পায় নাই।

 আর কিছু না বলিয়া লতিফ দ্রুতবেগে সেই কক্ষ ত্যাগ করিল। আর তাহার জাগ্রত আবেগময় প্রাণের কথাগুলি, আনারের কাণে তখনও যেন অতি তীব্র ঝঙ্কারের সহিতপ্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল।