দেওয়ানা/পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
উল্লিখিত ঘটনার পর একমাস কাটিয়া গিয়াছে। এর মধ্যে নবাব সুজাবেগের বাড়ীতেও একটী মহা দুর্ঘটনা ঘটিয়া গিয়াছে। সেটি তাঁহার জননী রুকিনা বেগমের আকস্মিক মৃত্যু!
জামাল থাঁ.—অর্থাৎ আনার উন্নিসার স্নেনময় পিতা কন্যার এই বিবাহ সম্বন্ধে বিবেচনা করিবার জন্য একমাস সময় লইয়াছিলেন। সেই সময় উত্তীর্ণ হইয়া গেলেও, যখন নবাব সুজাবেগ এ সম্বন্ধে তাঁহাকে আর কোন জরুর তাগিদ দিলেন না, তখন জামাল খাঁ মনে মনে ভাবিলেন,— “হয়তো—রুকিনা বিবির মৃত্যুর সহিত, বিবাহ ব্যাপারটা এই খানেই খতম হইয়া গেল।” কেন না তিনি খুব ভাল রূপই জানিতেন, এ বিবাহ ঘটাইবার জন্য রুকিনা বিবিরই খুব আন্তরিক আগ্রহ ও চেষ্টা ছিল।
মাতার মৃত্যুর পর, সুজাবেগ অপরিমেয় সম্পত্তির স্বাধীন অধিকারী হইলেন। যমুনার পর পারে, আগরা হইতে তিন চারি ক্রোশ দূরে, “আরাম-মঞ্জিল” বলিয়া তাঁহার এক প্রকাণ্ড উদ্যান বাটী ছিল, মাতার মৃত্যুর পর, তিনি সহর ছাড়িয়া এই “আরাম-মঞ্জিলেই” বাস করিতে লাগিলেন।
সুজাবেগের স্বভাব চরিত্র বড় ভাল ছিল না। রুকিনা বিবি—অর্থাৎ তাঁহার মাতা, যে তাঁহার কতক কতক জানিতেন না—তাহাও নয়। আর সুজার এই নষ্ট চরিত্রের কথা লইয়া তাহার সমাবস্থাসম্পন্ন প্রবীণ আমীর-ওমরাহদের মধ্যে যে একটা কাণাঘুসা ও গল্প গুজব হইত না, তাহাও নহে। তাহাদের মধ্যে দুই চারি- জনের বিবাহযোগ্যা পরমাসুন্দরী কন্যা ছিল, কিন্তু সুজাবেগের চরিত্র সম্বন্ধে গূ্হ্য কথাগুলি তাঁহারা জানিতেন বলিয়া, রুকিনা বিবি বহুবার তাঁহাদের কন্যার সহিত তাঁহার পুত্রের বিবাহের প্রস্তাব করিলেও, তাঁহারা একটা না একটা সঙ্গত ওজর দেখাইয়া, সে প্রস্তাবটা উড়াইয়া দিয়াছিলেন।
কোন বড় ঘরানার সহিত, বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপনে এই ভাবে অকৃতকার্য্য হওয়াতেই, রুকিনা বিবি তাঁহার অপেক্ষা ধনে মানে অপেক্ষাকৃত নীচু ঘরে, পুত্রের জন্য সুপাত্রী খুঁজিতে লাগিলেন। অনেকের কন্যাকেই তিনি দেখিলেন—কিন্তু সকলের সঙ্গে তুলনায়,রূপেগুণে শ্রেষ্ঠা এই আনারউন্নিসাকেই তাঁহার পছন্দ হইল। এই জন্যই তিনি নিজপুত্রের জন্মোৎসবকার্য্য উপলক্ষ্য করিয়া আনারকে সেই বহুমূল্য রত্নহার উপহার দিয়াছিলেন।
মাতা যে অত শীঘ্র সহসা ইহলোক হইতে চলিয়া যাইবেন, নবাব সুজা বেগ তাহা আদৌ ভাবেন নাই। আনার উন্নিসা তাঁহার প্রতিবাসী কন্যা। বহুবার তিনি আনারকে দেখিবার ও তাহার সঙ্গে কথা কহিবার অবসর পাইয়াছেন। কিন্তু আনারের সুবিমল সৌন্দর্য্য কখনও তাঁহার পাষাণের ন্যায় কঠিন প্রাণে, তখন একটী দাগ পর্যন্ত কাটিতে পারে নাই।
কিন্তু সেই উৎসব রাত্রে বিচিত্র পরিচ্ছদভূষিতা, অপূর্ব্ব রূপশালিনী আনারকে তিনি নুতন চক্ষে দেখিলেন। আনারের লোকবিশ্রুত সৌন্দর্য্য, যেন সেই দিন রাত্রে তাঁহার মনের ভিতর সিঁদ কাটিল।
সুজাবেগ মনে মনে ভাবিলেন,—“অনেক উচ্চপদস্থ ওমরাহের ঐশ্বর্য্যময়ী গরবিনী কন্যার অপেক্ষা, যেন এই আনার উন্নিসা রূপে গুণে, তাঁহার ঘরণী হইবার সর্ব্বাংশে যোগ্যা। এই জন্যই সুজাবেগ আনারের অভিমত জানিবার জন্য খুবই উৎসুক হইয়া তাহাকে পূর্ব্বোক্ত সেই পত্রখানি লিখিয়াছিলেন। পাঠক এ পত্রখানির কথা জানেন।
আনারের পত্রের উত্তর আসিতে দুই এক দিন বিলম্ব হইতে পারে। কেন না —এ সম্বন্ধে তাহার কোন স্বাধীনতাই নাই। সে সম্পুর্ণরূপে তাহার পিতার ইচ্ছার অধীন। এইরূপ একটা অসহিষ্ণুতাময় চিন্তায় অধীর হইয়া, সুজাবেগ আনারের পিতা জামাল খাঁকেও সেই দিন এক পত্র লিখিয়াছিলেন। কিন্তু তারপর এ সম্বন্ধে কোন উচ্চবাচ্য নাই দেখিয়া, জামাল খাঁ মনে যেন একটা শান্তি অনুভব করিলেন। ঐশ্বর্যে্যর বিনিময়ে তিনি তাঁহার কন্যাকে এক চরিত্রহীনের হস্তে অর্পণ করিতে বড়ই নারাজ। তবে ভবিতব্য যদি সুজা বেগের সহিত তাঁহার কন্যার ভাগ্য বিজড়িত করিয়া দেয়, তাহা হইলে তিনি কোনরূপে বাধা দিতে সক্ষম নহেন। কেই বা কবে দিতে পারিয়াছে?
সুজাবেগের প্রকৃত স্বভাব কিরূপ, তাহা দেখিতে হইলে— একবার আমাদের আরাম-মঞ্জিলে প্রবেশ করিতে হইবে।
সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। তাঁহার প্রকাণ্ড উদ্যান বাটীর কয়েকটী কক্ষ—— দীপোজ্জলিত। নবাব সুজাবেগ, উৎসুক চিত্তে যেন কাহারও আগমন প্রতীক্ষা করিতেছেন। কিন্তু—যাহার আশা প্রতীক্ষায় তিনি বসিয়া আছেন— সে ত আসিতেছে না।
সহসা সেই কক্ষের দ্বার খুলিয়া গেল। এক পরমা সুন্দরী যুবতী, সহাস্যমুখে সেই কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিয়া, একটু আদব কায়দার সহিত কুর্ণীশ করিয়। বলিল—“আরজ বন্দেগি! নবাবসাহেব! বাদী হাজির।”
নবাব সুজাবেগ—কৃত্রিম কোপের সহিত বলিলেন—“ছিঃ! ছিঃ! এত নিষ্ঠুর তুমি? এত দেরী করিতে হয়? আমি যে কতই ভাবিতেছি!”
সেই যুবতী, নবাবের পার্শ্বের এক সোফা অধিকার করিয়া বসিয়া, সুরমারঞ্জিত চোখে একটা শাণিত কটাক্ষ হানিয়া বলিল—“এত দূর! এখনও আমার জন্য এত ভাবনা! এর পর সুন্দরী আনার উন্নিসা, তোমার মহল আলো করিয়া বসিলে, হয়তঃ এ বাদীকে তোমার মনেই থাকিবে না।”
নবাব সুজাবেগ,— তাঁহার প্রণয়িনীকে কোমল আলিঙ্গন নিপীড়িত করিয়া বলিলেন—“ও সব রহস্য এখন থাক্। বানু! এত দেরী করিলে কেন বল দেখি? বোধ হয় আজ তোমার প্রাণের অতি অন্তরঙ্গ সেই আমীরউদ্দৌলার সম্বর্ধনায় খুব ব্যস্ত ছিলে।
বাহার বানু মৃদু হাস্যের সহিত বলিল— “আবার সেই কথা। আমাকে জ্বালাইলেই কি তুমি সুখী হও! আচ্ছা তুমি সুখে থাক। আমি চলিলাম।”
এই কথা বলিয়া বাহারবানু দ্বারের কাছে সরিয়া আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার আরক্ত ঠোঁঠ দুখানি অভিমানে ফুলিয়া উঠিল। সে যেন চলিয়া যাইতে উদ্যত।
খাঁসাহেব মনে মনে বুঝিলেন, কথাটা বলিয়া তিনি ভাল কাজ করেন নাই। সুতরাং তিনি বাহারের হাতখানি ধরিয়া টানিয়া আনিয়। কাছে বসাইয়া বলিলেন——“ঐ কথা বলিলে তুমি খুব রাগিয়া যাও, তাই বলিয়াছি।
বাহারের অভিমান ভাঙ্গিয়া গেল। সে দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল—“ওঃ! কি ভয়ানক কন্কনে ঠাণ্ডা রাত্টা আজ নবাব সাহেব! দাও— দাও। একটু সেরাজি দাও। আগে জান্টা সতেজ হউক, তারপর যত পার রহস্য করিও।”
নবাব সুজা বেগ, স্বহস্তে গুলাববাসিত সেরাজি ঢালিয়া বাহারবানুর—সম্মুখে ধরিলেন। বাহার, সহাস্যে বলিল— “তাও কি হয় জনাবালি? হুজুরের প্রসাদ না হইলেও কোন জিনিসই ত আমার ভাল লাগে না।”
সুজাবেগ সহাস্যে বলিলেন—“অতটা ভক্তি ভাল নয়। তুমি যে আমার কতটা ভাল বাস, তা আমি জানি।”
বাহার বানু। আর তুমিও আমাকে কতটা ভালবাস, তাহাও জানিতে আমার বাকি নাই।
সুজাবেগ। বটে! এখন এ কথা বলিবে বই কি? যাক্ সেরাজিটার সুগন্ধ উড়িয়া গেল যে!
এই কথা বলিয়া সুজাবেগ মদিরাপাত্র তাহার ওষ্ঠাধরের কাছে আনিয়া, তাহা হইতে কতকাংশ পান করিয়া তাহার প্রিয়তমার সম্মুখে ধরিলেন।
পান পাত্র নিঃশেষ করিয়া বাহারবানু বলিল —“আজ তোমার সঙ্গে আমি ঝগড়া করিতে আসিয়াছি।”
সুজা। এ বান্দার অপরাধ?
বাহারবানু। অপরাধ খুব!
সুজা। যদি তাই হয়—তাহা হইলে মার্জ্জনাও ত আছে।
বাহারবানু। পিয়ারা মেরে! অপরাধ বিশেষে মার্জ্জনার দাবি চলে, কিন্তু সকল ক্ষেত্রে নয়!
সুজা আবেগভরে বাহারকে বুকে জড়াইয়া ধরিতে গেলেন। সে ক্ষিপ্রগতিতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল— “তুমি যখন আমাকে বুকের ভিতর হইতে দূরে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিবার চেষ্টা করিতেছ, তখন সেই বুকে আমাকে টানিয়া লইবার কোন অধিকারই তোমার নাই।”
এই কথা বলিয়া, সুরমারঞ্জিত অপাঙ্গে বিদ্যুৎলহরী খেলাইয়া বাহারবানু সেরাজি পাত্রটী পূর্ণ করিয়া, সুজা বেগের হাতে দিয়া বলিল—“এই টুকু শেষ করিয়া নাও। তার পর খুব একটা কাজের কথা তোমায় বলিব”
কথাটা যে কি, আর তাহার জন্য বাহারবানু এত ভূমিকা আরম্ভ করিয়াছে কেন, এই টুকু তলাইয়া বুঝিতে সুজাবেগের বড়ই গোলমাল ঠেকিতে লাগিল। যখন বাহারের অর্থের প্রযোজন হইত, তখনই সে এইভাবে কাঁদুনী গাহিয়া কিছু টাকা আদায় করিয়া হাসিমুখে চলিয়া যাইত। সুজা মনে মনে ভাবিলেন—এইবার হয়ত আবার টাকার প্রয়োজন হইয়াছে। তাই তাহার প্রণয়িণী বাহারবানু এতটা দীর্ঘ ভূমিকা আরম্ভ করিয়াছে।
সুজাবেগ পান পাত্র নিঃশেষ করিয়া, বাহারকে আর এক পাত্র পূর্ণ করিয়া দিলেন। এবার আর সে কোনরূপ বাহানা না করিয়া তাহা নিঃশেষ করিয়া বলিল,—“একটা কথা শুনিতেছি,—সত্য কি? তুমি গোপনে গোপনে আমার সর্ব্বনাশের চেষ্টা করিতেছ কেন?”
সুজা চমকিত হইয়া বলিল,—“সে কি কথা!”
বাহারবানু গম্ভীর মুখে বলিল,—“তুমি নাকি বিবাহ করিবে?”
সুজা। কে বলিল? মিথ্যা কথা!
বাহার। কখনই না। যে বলিয়াছে,— সে তোমার ভাবী পত্নীর পিতা, জামাল খাঁর একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু! তুমি বিবাহ করিবার জন্য এতই ব্যস্ত, যে শীলতার নিয়ম না মানিয়া তাহার কন্যা, আনার উন্নিসাকে নাকি প্রেমপত্র পর্য্যন্ত লিখিয়াছ।
সুজাবেগ কথাটা উড়াইয়া দিবার জন্য, উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিলেন। তারপর বাহারবানুর মুখখানি নিজের বুকের উপর টানিয়া লইয়া সহাস্য মুখে বলিলেন,—“এই ব্যাপার! বড়ই দুঃখের বিষয়, যে তুমি দেড়মাস পূর্ব্বের একটা খুব পুরাণ সংবাদ, যাহা এখন অলীকে দাঁড়াইয়াছে, তাহা লইয়া আমার সহিত আজ বিবাদ করিতে আসিয়াছ।”
বাহারবানু বলিল— “সংবাদটা অবশ্য পুরাতন। কিন্তু বোধ হয় তোমার জননী যদি ইহলোক ত্যাগ না করিতেন, তাহা হইলে হয়তঃ জামাল বেগের কন্যা, সুন্দরী শ্রেষ্ঠা আনার উন্নিসার হুকূমে, আজ আমার এই পুরী প্রবেশ করা বন্ধ হইয়া যাইত। তা তুমি যা ভাল বুঝিবে,—তাই করিবে। আমি তোমার আশ্রিতা দাসী বই আর কিছুই নই। লোকে আদর করিয়া টাট্কা ফুল, বুকের উপর গুঁজিয়া রাখে। ফুল বাসি হইলে তাহাকে বুক হইতে টানিয়া লইয়া দূরে ফেলিয়া দিয়া পদদলিত করে। তুমি এখন দেখিতেছি, সেই নীতির অনুসরণ করিতেছ! বল দেখি, কার আশায় আজও আমি বুক বাঁধিয়া চলিতেছি? সেই প্রথম মিলনের দিনে, তুমি আমার অঙ্গ স্পর্শ করিয়া কি প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলে—তাহাও মনে কর নবাব! কোন অপরাধই আমি তোমার কাছে করি নাই। অতি নিষ্ঠুরের মত, অতি হৃদয় হীনের মত, আমাকে পদদলিত করিও না।
এই কথাগুলি বলিতে বলিতে, সেই ছলনাময়ী বাহারবানুর চক্ষুদ্বয় অশ্রুপূর্ণ হইল। দুই এক ফোঁটা উষ্ণ অশ্রুজল— সুজ বেগের হাতের উপর পড়িল।
সুজা বেগ চমকিয়া উঠিয়া, বাহারবানুকে বুকে টানিয়া লইয়া বলিলেন—“ছি! বাহার! এত লঘু তুমি! একটা তুচ্ছ অলীক বিষয়, যার ভিত্তি নাই, যাহার অস্তিত্ব নাই, তুমি কিনা তাহার উপর নির্ভর করিয়া এতটা বিচলিত হইতেছ?”
ছলনাময়ী বাহারবানু, সুজা বেগের কথার অনেকটা শান্ত ভাব ধারণ করিল। সে আদরভরে নবাব সাহেবের দক্ষিণ হস্তটী নিজের ক্রোড়ে তুলিয়া লইয়া, তাহা মৃদুভাবে টিপিয়া দিয়া বলিল—“প্রতিজ্ঞা কর তুমি—আমাকে স্পর্শ করিয়া, যে আর কখনও আনার উন্নিসাকে বিবাহ করিবার চেষ্টা করিবে না।”
সুজাবেগের মনের ভিতর এই সময়ে ঠিক এর বিপরীত ভাবের কথাগুলি জাগিয়া উঠিল। নবাব মনে মনে বলিলেন— “তোমায় চিনিতে আমার বাকি নাই। ছলনাময়ী রাক্ষসী তুমি! আমাকে ধ্বংশ করাই তোমার অভিপ্রায়! কই এতদিন যে তোমার উপাসনা করিতেছি, তোমার প্রাণের কথা যে কি, তাহা কখনও জানিতে পারিয়াছি কি? রাশি রাশি অর্থব্যয় করিয়া, তোমাকে রাজরাণীর মত সুখে রাখিয়া যে আনন্দ পাইব বলিয়া, অলীক সুখস্বপ্নে বিভোর হইয়াছিলাম, তাহাও তুমি চূর্ণ বিচূর্ণ করিয়া দিয়াছ। ছলনার মন্ত্রজালে বেড়িয়া তুমি কত দিন আর আমাকে এ অবস্থায় রাখিবে? কে তুমি, যে তোমার অঙ্গস্পর্শ করিয়া আমাকে প্রতিজ্ঞা করিতে হইবে?”
“যখন দেখিলাম, প্রচুর অর্থ দিয়াও তোমার মন পাইলাম না, এত আদর যত্নেও তোমার হৃদয়ের একটু সামান্য অংশও অধিকার করিতে পারিলাম না— যখন দেখিতেছি, সুখের বদলে দুঃখ, শান্তির বিনিময়ে অশান্তি, আনন্দের বিনিময়ে বিষাদই আমার দানের প্রতিদানরূপে তুমি আমায় আনিয়া দিতেছ, তখন আর কেন তোমার উপাসনা করি? কলুষিত নরকের পথে এতদিন ঘুরিয়া মরিয়াছি। এখন স্বর্গের দ্বার কোথায় তাহা আমাকে একবার খুঁজিয়া দেখিতে হইবে।”
সুব্জাবেগকে এইভাবে চিন্তা করিতে দেখিয়া বাহারবানু বলিল— “ইতস্ততঃ করিতেছ কেন নবাব সাহেব! কি ভাবিতেছ তুমি? আমার এ সামান্য অনুরোধ রক্ষায় কেন এত সন্দেহ? কেন এত সংকোচ?”
সুজাবেগ নিদ্রোত্থিতের ন্যায় চমকিত ভাবে বলিলেন, “না-না—কিসের সংকোচ? কিসের সন্দেহ? যদি কোথাও শান্তি পাই, তাহা তোমার নিকটে। যদি কোথাও আরাম পাই— তাহা তোমার সাহচর্য্যে! এ মরুময় জীবনের শান্তিদায়িনী স্নিগ্ধ স্রোতস্বিনী তুমি! ছিঃ—আমার গভীর প্রেমে অতটা সন্দেহ করিও না! একটা সামান্য বিষয়ে কেন তোমায় স্পর্শ করিয়া শপথ করিতে যাইব— যাহা করিতে আমার এ চিত্ত স্বাধীন ইচ্ছায় সম্পূর্ণ শক্তিবান। আমার কথার উপর কি তোমার একটুও বিশ্বাস নাই বাহারবানু?”
একটা ব্যাকুলতাময় আগ্রহের সহিত বাহারের মুখের দিকে চাহিয়া, এমনভাবে সুজা বেগ এই কথাগুলি বলিলেন—“যে বাহারবানুর মনে একটা ধারণা জন্মিল, এগুলি সত্য সত্যই নবাব সাহেবের মনের কথা।
বাহার আর এক পাত্র সেরাজি ঢালিয়া, নবাব সুজা বেগের হাতে দিল। নিজেও এক পাত্র পান করিয়া প্রফুল্ল মুখে বলিল—“তবে নবাব সাহেব! আজ এ বাদী বিদায় পাইতে পারে কি? রাত খুব বেশী হইয়া পড়িয়াছে।”
আগে আগে নবাব সুজা বেগ এই রূপসী বাহারবানুর সাহচর্য্যে খুবই একটা আনন্দ পাইতেন। কিন্তু এখন যেন সেরূপ আনন্দ আর পান না। এই বাহারের সাহচর্যে কত দিন, কত রাত, অবিচ্ছিন্নভাবে প্রেমলীলায় কাটিয়া গিয়াছে। তবুও তাহাতে বিরক্তি দেখা দেয় নাই। আগে এক মুহুর্ত্তের বিরহ বড়ই কষ্টকর বোধ হইত। এখন ত আর সেই আগ্রহময় ব্যাকুল ভাবটা নাই। এখন বেশীক্ষণ বাহারবানুর সঙ্গে থাকিতে হইলে যেন তাঁহার অতি কষ্টকর বলিয়া বোধ হয়। এখন যেন দীর্ঘ বিরহে একটু তৃপ্তি ও শাস্তি বোধ হয়।
নবাব সাহেব অগত্যা আসন ত্যাগ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বাহারবানুকে বুকের মধ্যে টানিয়া লইয়া বলিলেন—“যদি খুবই প্রয়োজন থাকে যাইতে পার। তবে এখন আদাব!”
বাহারবানু হাসিমুখে নবাবের দিকে চাহিয়া বলিল— “বন্দেগি! যেন এ বাঁদীর উপর চিরদিনই এইরূপ একটা অনুগ্রহ থাকে।”
আর কিছু না বলিয়া, সে একটু মৃদু হাসিয়া সেই স্থান ত্যাগ করিল। তাহার দ্রুতগমন ভঙ্গীতে বোধ হইল, যেন একখানা বিদ্যুৎ সেই কক্ষ হইতে সরিয়া গেল। বাহিরে বাহারের নিজের গাড়ী অপেক্ষা করিতেছিল। সুতরাং সে সেই গভীর রাত্রে গাড়ীতে উঠিয়া চলিয়া গেল।
বাহারবানুকে বিদায় দিয়া নবাব সুজাবেগ কিয়ৎক্ষণ ধরিয়া চিন্তিতভাবে কক্ষমধ্যে পদচারণা করিতে লাগিলেন। তারপর তাঁহার হস্তিদন্তনির্ম্মিত একটী ক্ষুদ্র হাত বাক্সের নিভৃত স্থান হইতে, একখানি চিত্র বাহির করিয়া, কিয়ৎক্ষণ ধরিয়া সেই চিত্রের উপর স্থিরভাবে দৃষ্টি সম্বদ্ধ করিয়া রহিলেন।
কিন্তু অতৃপ্ত নয়নে বহুক্ষণ দেখাতেও যেন তাঁহার তৃপ্তি হইল না। তিনি আলোকের খুব নিকটে আনিয়া, সেই ক্ষুদ্র চিত্রখানি একটা অপূর্ব্ব তৃপ্তির সহিত দেখিতে লাগিলেন।
তারপর সেই চিত্রখানি যথাস্থানে পূর্ব্ববৎ লুকাইয়া রাখিয়া এক সোফার উপর বসিয়া অস্ফুটস্বরে বলিতে লাগিলেন—“এই চিত্রে অঙ্কিত এই আনার উন্নিসা দেবী, আর এই বাহারবানু যে এইমাত্র আমার কক্ষ ত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে, সে পিশাচি! আনারের রূপের তুলনায় এই বাহারবানু? সে যে এর বাঁদী হইবার যোগ্যা নয়! এই বাহার আমার অসংখ্য অযাচিত অনুগ্রহের পরিবর্ত্তে, কেবল জ্বালাই আনিয়া দিয়াছে। আমি কি এই শান্তিময়ী আনারকে পত্নীরূপে লাভ করিয়া আবার বেহেস্তের আলোকময় পথে ধীরে অগ্রসর হইতে পারিব না? আনারের পিতা, এক মাস সময় চাহিয়াছেন। কিন্তু দুই মাস ত উত্তীর্ণ হইয়া গেল। আমি এই দেবতার ভোগ্য, রত্নকে লাভ করিবার জন্য একান্ত চেষ্টা করিয়াছি কই? কালই আমি আনার উন্নিসার পিতাকে এই বিষয়ে এক পত্র লিখিব। এই ছলনাময়ী বাহারবাণুর সাহচর্য্য, দিনে দিনে আমার পক্ষে বড়ই বিরক্তিকর হইয়া উঠিতেছে।
মুক্তবায়ুতে কিছুক্ষণ বসিয়া থাকার জন্য সেরাজির নেশাটা ক্রমশঃ জমাটভাব ধারণ করিতেছিল। নবাব হুজা বেগ অগত্যা চিন্তাসূত্রজাল ছিন্ন করিয়া শয্যা আশ্রয় করিলেন।
কিন্তু নিদ্রাতেও তাঁহার নিস্তার নাই। তিনি স্বপ্নে দেখিলেন এই দেবীদুর্ল্লভ রূপসমন্বিতা আনার উন্নিসা, যেন তাঁহার শয্যা পার্শ্বে বসিয়া সম্মিত বদনে বলিতেছে—“ভয় কি তোমার নবাব সুজা বেগ! এই দেখ আমি তোমার বাঁদী হইতে আসিয়াছি। তোমার ষোল আনা প্রাণ, আর যত্ন মায়া মমতা আমায় দাও, আমি তার পরিবর্ত্তে তোমায় বেহেস্তের পবিত্র শান্তি আনিয়া দিব। যে পথে তুমি এখন চলিতেছ—তাহা তো জাহান্নমের পথ! বাহারবানুর কলুষিত চিত্র তোমার মনঃক্ষেত্র হইতে মুছিয়া ফেল। একবার আমার দিকে ভাল করিয়া চাও। তোমার ষোল আনা প্রাণ আমায় দিয়া দেখ দেখি, মরজীবনের প্রকৃত সুখ কোথায়? জাহান্নমে—না বেহেস্তে!”
নবাব সুজা বেগ যেন সানন্দে হস্ত প্রসারণ করিয়া আনারকে বক্ষে আলিঙ্গন করিতে গেলেন। কিন্তু কোথায় সে আনার উন্নিসা! আনার ত নাই। এ যে তার ছায়ামূর্ত্তি! সেই ছায়া মূর্ত্তি নিমেষ মধ্যে যেন তাঁহার শয্যা পার্শ্ব হইতে সরিয়া গিয়াছে।
নবাব সুজা বেগ চক্ষু উন্মীলন করিবামাত্র দেখিলেন, তাঁহার খাস ভৃত্য মজঃফর, তাঁহার সন্মুখে জোড় হস্তে হুকুম অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া আছে।
নবাব সুজা বেগ মনে মনে বলিলেন—“ইহাকেই বলে অদৃষ্টের কঠোর ব্যঙ্গ! জাগরণে জ্বালায় জ্বলিতেছি। স্বপ্নে একটু সুখ ভোগ করিতেছিলাম। তাহাও আমার নসীব সহ্য করিতে পারিল না। হায়! এমন কি ভাগ্য করিয়াছি, যে আনার উন্নিসা আমার শয্যাপার্শ্বে আসিবে? তাহার সৌরভময় পবিত্র নিশ্বাসে, আমার এ কক্ষ পবিত্র হইবে?”
নবাব শয্যা হইতে উঠিয়া, একটু বিরক্তির সহিত মজঃফরকে বলিলেন—“খপর কি বান্দা?”
মজঃফর প্রথামত কুর্ণীস করিয়া বলিল— “বেলা হইয়াছে শয্যা ত্যাগ করুন। আজ আপনার সম্রাট-দরবারে যাইবার দিন।”