দেওয়ানা/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
এই বাহার বাহুর প্রকৃত পরিচয় একটু দেওয়া প্রয়োজন। বাহারবানুর প্রকৃত নাম হইতেছে আর্জ্জমন্দবানু। তাহার আদি বাসস্থান পারস্য বা ইরান। তাহার পূর্ব্ব পরিচয় কি, তাহা কেউই জানে না। সে কোন্ ধর্ম্মাবলম্বী, তাহাও কেউ জানিত না। তবে তাহার আচার ব্যবহার ধরণ ধারণ দেখিয়া, তাহাকে মুসলমান ধর্ম্মাবলম্বী বলিয়াই বোধ হইত। অতি দুঃস্থ পিতা মাতার সঙ্গে সে ইরান ত্যাগ করিয়া কেবল মাত্র রূপ লইয়া এই হিন্দুস্থানে ভাগ্য পরীক্ষার্থে আসে। সে বিবাহিতা কি অবিবাহিতা, তাহাও কেহ জানে না। আর বাহারবানু নামেই সে আগরায় পরিচিত। নৃত্য গীতে সে খুবই পটীয়সী। কলকণ্ঠী গায়িকা হিসাবেই তাহার নাম ডাক আরও বেশী। খেয়াল ধ্রুপদ গাহিতে, আগরার কোন গায়িকাই তাহার সমকক্ষ ছিল না। বড় বড় নামজাদা ওস্তাদেরা, তাহার নিকট হারি মানিয়া যাইতেন। বাণা, এসরার, সুরবাহার প্রভৃতি যন্ত্রবাদনে এই আরামবানুর কৃতিত্ব খুবই ছিল। আর তাঁহার বিশেষত্ব এই, ওমরাহ, আমীর ও সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর লোকের সহিত সে বেশী মেলামেশা করিত। তাঁহাদের বিলাসোদ্যানে কিম্বা আরামগৃহে, আরামবানুর নাচ গানের মজলিস্ বসিত। মোটের উপর সাধারণ লোকে তাঁহার কাছে পৌঁছিতে পারিত না। আর সেও পরদানশীন জেনানার মত, নিজের আবরু সম্ভ্রম বজায় রাখিয়া চলিত।
সে ইতিপূর্ব্বে একজন উচ্চপদস্থ আমীরের রক্ষিতা ছিল। তিনিই সখ্ করিয়া তাহার সাবেক আর্জ্জমন্দ নামচী পরিবর্ত্তন করিয়া বাহারবানু নাম রাখেন।
বাহারবানুর গুণের ন্যায়,রূপের ও একটা খুব যশ ছিল। তাহার মদিরালসময় আঁখি দুটীর কেমন যে একটা অপূর্ধ্ব আকর্ষণী শক্তি ছিল যে, অতি সহজেই সে লোকের চিত্তের উপর একটা শক্তি বিকাশ করিত। যে ওমরাহের কথা বলিতেছি, তাঁহার অধীনস্থা হইয়া থাকিবার সময়ই এই বাহারবানুর যথেষ্ট ভাগ্য পরিবর্ত্তন হয়। কিন্তু তাহার দরিদ্র পিতা মাতা, এই হতভাগিনী বিপথগামিনী কন্যার তখনকার সুখসমৃদ্ধির অবস্থা দেখিয়া যাইতে পারেন নাই। কেন না— এই অবস্থা পরিবর্ত্তনের এক বৎসর পূর্ব্বেই, তাঁহারা পরলোকের পথিক হন।
মানবের ভাগ্যটা যেন নদীর মত জোয়ার ভাঁটার নিয়মের অধীন। পূর্ব্বোক্ত ধনী ওমরাহের আশ্রয়াধীনে থাকিবার সময় এই কুহকময়ী বাহারবানুর অদৃষ্টের সমূহ উন্নতি হইয়াছিল। এক ক্ষুদ্র প্রাসাদতুল্য বাটিতে সে বাস করিত। দাসী বাঁদী, যান বাহন, এলবাব পোষাক, প্রভৃতি বড়মানুষির যে সব চিহ্ন, তাহার সবই হইয়াছিল। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, ওমরাহ মহলে তাহার খুবই পসার হইয়াছিল। এমন কি, অনেক সময়ে মোগল শাহজাদাগণ, এই সংগীতকুশলার সঙ্গীত-চাতুর্যা শুনিবার জন্য, ছদ্মবেশে এই বাহারবাহুর আলয়ে উপস্থিত হইতেন।
যে নামজাদা আমীরের আশ্রয়ে, সে রাজরাণীর মত সুখ ভোগ করিতেছিল, একদিন এই রূপসী বাহারবানুর কক্ষ মধ্যেই, প্রভাতসূচনার সঙ্গে, সেই আমীরের মৃতদেহ পাওয়া গেল। অবশ্য এই ব্যাপার ঘটায়, আগরা সহরে দিন কয়েকের জন্য একটা হুলস্থুল পড়িয়া যায়। কেননা এই ওমরাহ,খুব একজন নামজাদা ধনী ছিলেন। বাহারবানুর শত্রুপক্ষ, এই হত্যা ব্যাপারে বাহারবানুকে জড়াইবার জন্য অনেক চেষ্টা করিয়াছিল। কিন্তু শত্রু অপেক্ষা তাহার অনুগ্রহ-প্রার্থী মিত্র সংখ্যাই খুব বেশী। আর এই মিত্রগণ আবার গণনীয় ওমরাহ শ্রেণীর লোক। সুতরাং এই হত্যা-কাণ্ডের জন্য, বাহারবানুকে কোনরূপ জখমে পড়িতে হইল না বটে, তবে এই শোচনীয় ব্যাপারের পর হইতে, তাহার সৌভাগ্যের প্রবল স্রোতে যেন একটা ভাঁটা পড়িতে আরম্ভ হইল। তাহার পসার প্রতিপত্তি কমিয়া আসিল।
এই দুনিয়ায় যেমন কোন জিনিষই চিরদিন থাকে না, কালক্ষয়ের সহিত বাহারবানুর নামে এই হত্যার কলঙ্কটাও ক্রমশঃ সেইরূপ লোকের স্মৃতি হইতে বিলুপ্ত হইয়া গেল। মাস কয়েকের জন্য সহর ত্যাগ করিয়া, সে আগরার প্রান্তসীমায় এক ক্ষুদ্র উদ্যান বাটীতে প্রচ্ছন্নভাবে বাস করিতে লাগিল।
কোন এক ওমরাহের গৃহে এক সঙ্গীতের মজলেসে, নবীন নবাব সুজাবেগ, এই বাহারবানুর রূপ দেখিয়া, গান শুনিয়া, বড়ই মোহিত হইয়া পড়েন। ক্রমশঃ যাতায়াতে আর মেশামেশিতে উভয়ের মধ্যে একটা বেশীগোছের অন্তরঙ্গ ভাব জন্মিয়া যায়। এই ছলনাময়ী নারীর কৌশল জালে পড়িয়া, নবাব সুজাবেগ এতটা আত্মহারা হইয়া পড়েন যে, জননীর পুনঃ পুনঃ নির্ব্বন্ধ স্বত্বেও তিনি বিবাহ-বন্ধনে কোন রূপেই আবদ্ধ হইতে চাহিলেন না। এই জন্যই তাহার মাতা, এই সুন্দরী-শ্রেষ্ঠা আনার উন্নিসার সহিত তাঁহার পুত্রের বিবাহ ঘটাইতে অতটা ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িয়া ছিলেন। এই চেষ্টা কতদূর অগ্রসর হইয়াছিল, তাহাও পাঠক দেখিয়াছেন। কিন্তু সহসা তাঁহার মৃত্যু ঘটায়, এই বিবাহ ব্যাপার সম্বন্ধে অনেক গোলযোগ বাধিয়া যায়।
কাণাবূষার সুজাবেগ একদিন শুনিলেন যে, আমীরউদ্দৌলা নামক একজন হীন প্রকৃতির নগণ্য লোক বাহারবানুর বড়ই অন্তরঙ্গ হইয়াছে। তাহার এতটা সাহস বৃদ্ধি হইয়াছে, যে গুপ্তভাবে সে তাহার বাটীতেও যাতায়াত করে।
এই আমার-উদ্দৌলার কথা তুলিয়া, তিনি মধ্যে মধ্যে বাহারবানুকে রহস্য করিতেন। পাকে প্রকারে, নানা রকমে জেরা করিয়া তাহার মনোভাব জানিবার চেষ্টা করিতেন। কিন্তু চতুরা বাহারবানু নবাবের এ সন্দেহটা যে অলীক ও কল্পিত, এইটীই নানা কৌশলে প্রমাণ করিয়া দিত। তাহার মধুর অপাঙ্গে বিদ্যুতের মত উজ্জ্বল কটাক্ষ ছিল, ভাষায় ভালবাসার ছলনা ছিল— ভুবনমোহন রূপ ছিল, ওষ্ঠাধরে মধুর হাসি ছিল, আর তার অম্বুজলাঞ্ছিত নেত্রে অতি সামান্য চেষ্টাতেই অশ্রুধারা বাহির হইত। এ সম্বন্ধে কাজেই তাহাকে বেশী কষ্ট পাইতে হইত না। এমন কি অনেকবার সুজাবেগ এই আমীরউদ্দৌলাকে ধরিবার জন্য, অতি গভীর নিশীথেও সহসা বাহারবানুর কক্ষ মধ্যে উপস্থিত হইয়াও তাঁহার এই সন্দেহের প্রত্যক্ষ প্রমাণ সংগ্রহে কৃতকার্য্য হন নাই।
আনারউন্নিসার পূর্ব্বের ছবিখানা, সুজার মাতা রুকিনা বিবিই, তাঁহাকে আনাইয়া দেন। যাহাতে আনারের এই ভরা যৌবনে, সুজার সহিত তাঁহার অন্তরঙ্গতা হয়, এজন্য মাসের মধ্যে দুই একবার তিনি আনারকে ইদানীং প্রায়ই নিমন্ত্রণ করিতেন। হিতাকাঙ্ক্ষিণী জননীর, বিপথগামী এই পুত্রকে গৃহবাসী করিবার এ চেষ্টা, যে একাবারে নিষ্ফল হয় নাই, তাহা পাঠক দেখিয়াছেন।
সুন্দরীশ্রেষ্ঠা আনারের গুণের কথা পড়সীরা সকলেই জানিত। তাঁহার রূপেরও একটা খুব প্রশংসা ছিল। আর আনারউন্নিসার নিষ্কলঙ্ক রূপমাধুরী, যে এই বাভিচার-কলুষিত নবাব সুজা বেগের হৃদয়ে একটা দাগ কাটিয়া দিয়াছিল, আর তিনি যে এই আনারকে পত্নীরূপে লাভ করিবার জন্য খুবই উংসুক হইয়াছিলেন, তাহা তাঁহার লিখিত পূর্ব্বের পত্র হইতেই প্রকাশ!
মাতার মৃত্যুর পর, বিষয়াদির সুশৃঙ্খলা সম্বন্ধে নানারূপ গোলযোগ উপস্থিত হওয়ায়, তিনি এতদিন বিবাহ সম্বন্ধে কোন মনোযোগ দিতে পারেন নাই। তাঁহার প্রাণে পবিত্র দাম্পত্য জীবন উপভোগের যে ক্ষীণ স্বল্পোজ্জ্বল রশ্মিটুকু ধীরে ধীরে ফুটিয়া উঠিতেছিল, এই ছলনাময়ী শয়তানী বাহারবানু সে টুকুকে এক ফুৎকারে নিভাইয়া দিবার চেষ্টা করিতেছিল। কিন্তু পারিয়াছিল কি না, তাহা আমরা ঠিক বলিতে পারি না।
রূপজ মোহ ঠিক যেন ধাতু পাত্রে কলঙ্কের দাগের মত। বিশেষ কোন কারণে প্রাণে আঘাত না লাগিলে, মনটাকে এ কলঙ্ক হইতে ভালরূপে ঘষিয়া মাজিয়া না লইলে, এ মোহ সহজে অপসারিত হয় না। অর্থাৎ সোজা কথায় যাহাকে দাগা পাওয়া বলে, সেইরূপ কোন কিছু সাংঘাতিক ব্যাপার একটা হওয়া চাই।
নির্ব্বাণোন্মুখ দীপে তৈলদান করিলে, তাহা যেমন সহসা জ্বলিয়া উঠে, বা আরও কিছুক্ষণ জ্বলে, নবাব সুজা বেগের অবস্থাটাও এখন ঠিক সেইরূপ। তিনি বাহারবানুকে সম্মুখে দেখিলে, কাছে পাইলে, যেন হাতে স্বর্গ পাইতেন। আবার কিয়ৎক্ষণ তাহার সাহচর্য্যে থাকিলেই যেন আনন্দের পরিবর্ত্তে একটা বিরক্তি আসিয়া দেখা দিত।
আর একটী গৃহ্য ব্যাপার, যাহাতে এই বাহারবানু আর নবাব সুজা বেগ, অবিচ্ছেদ ভাবে জড়িত ছিলেন। সেটা আমরা বলিব না ভাবিয়াছিলাম। কিন্তু আমাদের এই উপন্যাসের সহিত তাহার একটু সম্বন্ধ আছে বলিয়া, তাহা বলিতে হইল।
তখন আগরা সহরে “প্রমারা” খেলার খুবই প্রচলন ছিল। ইহার প্রতিকারের জন্য সম্রাটের আইন কানুন অবশ্য খুবই কঠোর ছিল। কিন্তু সহরের অতি নিভৃত গুপ্ত স্থানে, এমনভাবে এই সব সর্ব্বনেশে খেলা চলিত যে, অতি সুচতুর রাজকর্মচারীরাও কোনমতে তাহার সন্ধান পর্যন্ত পাইতেন না। আবার তাঁহাদের মধ্যে যাঁহারা এই সব গুপ্ত আড্ডার সন্ধান জানিতেন, তাঁহারাও কোন কথাই প্রকাশ করিতেন না। কেননা, তাঁহারাও ক্রীড়ক দলের মধ্যে। বিশ্বাসঘাতকতা করিলে মৃত্যু নিশ্চয়, তাহাও তাঁহারা বুঝিতেন।
আমাদের যুবক নবাব সুজা বেগ ও বাহারবানু উভয়েই শ্রেষ্ঠদরের জুয়াড়ি। প্রেমের অভিনয়ে তাঁহাদের মধ্যে বিশ্বাস আর প্রীতির অভাব ঘটিলেও, এই প্রমারা খেলার সময়ে আত্মীয়তার বাঁধনটা খুবই জমিয়া যাইত।
আগরায় এই বাহারবানুর উত্থান-বাটীর নীচের কক্ষে, আর “ইস্মালিয়া” কাফিখানার একটী অতি গোপনীয় স্থানে, প্রমারার দুইটী প্রধান আড্ডা ছিল। এই আড্ডাতে বাজে লোকের প্রবেশের কোন উপায়ই ছিল না। জনকয়েক বিশেষ পরিচিত সম্ভ্রান্ত ওমরাহ, অতি গভীর নিশীথে এক গুপ্ত দ্বার দিয়া আড্ডায় প্রবেশ করিয়া খেলা জমাইতেন। বলা বাহুল্য, আমাদের নবাব সুজা বেগ ও এই বাহারবানু, এই দুই আড্ডার দলভুক্ত।
বাহারবানু, প্রমারার একজন পাকা খেলোয়াড়। নবাবেরও এই খেলার উপর ভারি ঝোঁক। কাজেই প্রেমের ব্যাপারে উভয়ের মধ্যে একটা বাঁধাবাঁধির শিথিলতা ঘটিলেও, প্রমারার ব্যাপারে উভয়ের মধ্যে, একটা খুব মাথামাখি সম্পর্ক ও একান্ত বিশ্বাসের ভাব ছিল।
বাহারবানু প্রায়ই বাজি জিতিত। দুদশ টাকার নয়, বারে বারে দুশো, পাঁচশো, হাজার দুহাজার টাকার বাজী। উভয়ের মধ্যে বন্দোবস্ত ছিল, বাহারবানু, নবারের টাকা লইয়া খেলিয়া যে বাজী জিতিবে, তাহার মুনফার অর্দ্ধেক্ টাকা, সে নবাবের নিকট পুরষ্কার বলিয়া আদায় করিবে। বাকী অর্ধেক নবাবের।
যে সময়ের কথা আমরা বলিতেছি, সেই সময়ে বড় লোকের মধ্যে আর এক রকমের আমোদের প্রচলন ছিল। এটা বাজ্ শিকরী, ও কবুতরের লড়াই। ইহাতেও প্রমারার মত টাকা লইয়া বাজির খেলা হইত। তবে প্রমাণ এক সঙ্গে দশজনে বসিয়া খেলিতে পারিত, দান ফেলিতে পারিত। এ খেলাতে সেরূপ নিয়ম ছিল না। দুই জনের মধ্যেই ইহা সীমাবদ্ধ ছিল, আর ইহার প্রত্যেক বারের বাজির পরিমাণ, দুই হাজার আসরফির নীচে ছিল না।
এই খেলার নিয়ম এই —যে দুই জনের মধ্যে ক্রীড়া চলিবে, তাঁহারা দুইদিকে বসিতেন। চিড়িয়াদের লড়াই করিবার জন্য খুব খানিকটা ফরদা জায়গা মাঝে রাখিয়া মণ্ডলাকারে তাঁহারা চারি দিক ঘেরিয়া থাকিতেন। বাঙ্গীর টাকা সকলের সম্মুখে রাখিয়া দেওয়া হত। যাঁর পাখী জিতিত,তিনিই পুরষ্কারের টাকাটা লইতেন।
নবাব সুজা বেগের এই পাথীর লড়াইয়ের ব্যাপারে খুব একটা ঝোঁক ছিল। এজন্য তিনি অনেকবার অনেক টাকা খেসারত দিয়াছেন। কিন্তু যে বারে তিনি বাহারবানুর শিক্ষিত বাজ ও শিকরী লইয়া খেলিতেন, সেইবারে তাঁহার নিশ্চয়ই জিত হইত।
এই প্রেম ও প্রমারাই তাঁহাকে বাহারবানুর সহিত বিশেষভাবে কিছুদিনের জন্য জড়িত রাখিয়াছিল প্রেমের নেশার জমাটী ভাবটা ক্রমশঃ ছুটিয়া আসিতেছিল বটে, কিন্তু এক সঙ্গে প্রেমারা খেলিবার নেশাটা ঠিক সেইরূপই ছিল।
অতুল ঐশ্বর্য —নবাব সুজা বেগের। তাঁহার পিতা যাহা রাখিয়া গিয়াছিলেন, তাঁহাতে তিনি চিরদিনই নবাবী চাল বজায় রাখিয়া চলিতে পারিতেন। সেকালে এই সব বাজী রাখিয়া খেলা, এইভাবে উপনায়িকা পালন, বড় মানুষির একটা অঙ্গ ছিল বলিয়া, নবাব সুজা বেগ খুবই অপব্যয়ে মাতিয়া উঠিলেন।
অপ্রচ্ছন্নভাবে থাকিয়া, অনেক আমীর ওমরাহই এই প্রমারা ও গুপ্তপ্রেমের অভিনয় ব্যাপারে লিপ্ত থাকিত। আর সকলেই একই শ্রেণীর পাপী বলিয়।, কেহ কাহাকে ঘৃণা করিত না, কেহ কাহার কুৎসা কীর্ত্তন করিত না। ধরিতে গেলে, এই প্রমারা খেলাটা যেন পুরুভূজের মত অমর। কেন না, এই বিংশ শতাব্দীতেও ইহা পরিবর্ত্তিত আকারে, আজও পর্য্যন্ত নিউইয়র্ক, লণ্ডন, প্যারি ও বার্লিন প্রভৃতি পাশ্চাত্য জগতের রাজধানীতে এখনও প্রচলিত। এখনকার খেলার প্রণালী অবশ্য বিভিন্ন, কিন্তু মহাধনীর ধ্বংশ সাধন, একই নিয়মে হইয়া থাকে।
ধনী ওমরাহ, নবাব সুজা বেগের ও বাহারবানু সম্বন্ধে আমরা উপরে যে পরিচয় টুকু দিয়াছি, এই আখ্যায়িকার সঙ্গে অগ্রসর হইবার পক্ষে, তাহাই যথেষ্ট। পরের আর সব অদ্ভূত ঘটনার পরিচয়, পাঠক ক্রমশঃ পাইতে থাকিবেন।
বাহারবানুকে সেদিন বিদায় করিয়া দিবার পর হইতে, সুজা বেগ তাঁহার মনে কেমনতর একটা যন্ত্রণা অনুভব করিতে লাগিলেন। তাঁহার হৃদয়টা যেন একাবারে শূন্য হইয়া পড়িল। বর্ষার মেঘের মত, চিত্ত সর্ব্বদাই যেন ঘোর বিষণ্নতায় সমাচ্ছন্ন। সেই চন্দ্রালোকিত নিশীথে, প্রকৃতি অনন্ত সৌন্দর্য্য বিভূষিতা হইয়া হাসিতেছিল, কিন্তু তাঁহার চক্ষে তাহা বড়ই তিক্ত বলিয়া বোধ হইতেছিল।
সেরাজির আধার সম্মুখেই ছিল। সুজা বেগ—চিত্তের অশান্তি দূর করিবার জন্য, আর এক পাত্র পান করিলেন। তার পর চারিদিকে চাহিয়া, এক গোপনীয় স্থান হইতে আনারের সেই তস্বীর খানি বাহির করিয়া, সন্মুখবর্ত্তী আলোকে পূর্ব্বদিনের মত সতৃষ্ণনেত্রে দেখিতে লাগিলেন। তাঁহার বিরস চিত্তটার মধ্য হইতে, পূর্ব্বের সেই অবসন্নভাবটা যেন একটু সরিয়া গেল।
সুজা বেগে, সেই চিত্রখানি কিয়ৎক্ষণ মনোযোগের সহিত দেখিয়া অস্ফূটস্বরে বলিলেন—“শান্তির আশায়, সুখের আশায়, এ দুনিয়ায় পাপ পাথারে মগ্ন হইয়াছি, কিন্তু সুখ ও শান্তি পাইয়াছি কি? পাইয়াছি—কেবল আশার বদলে—নিরাশা, সুখের পরিবর্ত্তে—দুঃখ, আনন্দের বিনিময়ে—বিষাদ! আনারউন্নিসা! কি সুন্দর রূপ বিধাতা তোমাকে দিয়াছেন? খালি কি রূপ? শুনিয়াছি, গুণও ত তোমার কম নয়! তোমার সঙ্গে সেই উৎসব রাত্রে যতটুকু ছিলাম, বোধ হইতেছিল যেন স্বর্গ সুখ ভোগ করিতেছি। কি সুমিষ্ট কথা! কি বীণানিন্দিত স্বর! কি প্রেম ও সরলতাময় সলজ্জ চাহনী, আর কথা বলিবার কি সুন্দর ভঙ্গি!
এস শান্তিদায়িনী আমার এই আলাময় গৃহ কক্ষে! আমার এ পাপকলুষিত গৃহে পূণ্যের চিরবসন্ত ফুটিয়া উঠুক। এস আমার এই তাপিত বক্ষে, আমার এ অগ্নিময় হৃদয় শান্ত হউক।
আঃ! কি তৃপ্তি এখনি অনুভব করিতাম, যদি চিত্রে চিত্রিত এই মূর্ত্তি, এই মূহুর্ত্তে জীবনময়ী, ভাষাময়ী হইয়া উঠিত! আমার সর্ব্বস্ব একদিকে। আর আনার! তুমি একদিকে। আমার এ অতুল ঐশ্বর্যা, পদগৌরব, সমাজে সম্ভ্রম, রাজদ্বারে প্রতিষ্ঠা, সবই যদি তোমার রাতুল চরণে সমর্পণ করি, তাহা হইলেও কি তোমাকে আমি পূণ্যময়ী পত্নী রূপে পাইব না?
তুমি আমার প্রতিবেশিনী। প্রথম কিশোরে কতবার তোমায় দেখিয়াছি, কিন্তু তখন ত তোমার এ বিশ্ব বিমোহন সৌন্দর্য্য ছিল না। তোমার কিশোর-যৌবনের সন্ধিস্থলে, আবার দেখিয়াছি, তখনও আমার এ হৃদয় কপাট রুদ্ধ ছিল, নেত্র অন্ধ ছিল। দেখার মত করিয়া তখন ত কিছুই দেখি নাই! তোমাদের অবস্থা এখন মন্দ হইয়াছে, এজন্য অনেক সময় তোমাদের অবজ্ঞার চক্ষে দেখিতাম। এক সর্ব্বনাশিনী মোহিনীর মায়ার ফাঁদে পড়িয়া, আমি যে একেবারে অন্ধ হইয়া আছি!
না—না, আনারউন্নিসা! আমি তোমায় চাই। যে উপায়ে পারি, তোমায় আমি আপনার করিব। তোমাকে আমার জীবনের সঙ্গিনী করিব। আরাধ্য দেবী করিব।”
আবেগভরে নবাব সুজা থাঁ, শেষের এই কথাগুলি খুব উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠিয়াছিলেন। সে কথাগুলি লুফিয়া লইয়া কে যেন দ্বার পার্শ্ব হইতে বলিল—“বটে বিশ্বাসঘাতক! এই তোমার ভালবাসা! এই তোমার প্রতিশ্রুতির মূল্য?”
নবাব সুজা বেগ দেখিলেন— বাহারবানু তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া। একটা উপেক্ষার হাসি তাহার ওষ্ঠাধরে ফুটাইয়া তুলিয়া, স্থিরভাবে সে তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছে।
বাহারকে দেখিয়া, নবাব সুজা বেগ একটু চমকিত হইয়া উঠিলেন। পরক্ষণেই মুখের সে ভাবটা পরিষর্ত্তন করিয়া, হাস্য মুখে বলিলেন,—“আবার কি মনে করিয়া আজ আবার আসিলে?”
বাহারবানু সেই স্থানে দাঁড়াইয়াই বিদ্রূপপূর্ণ স্বরে বলিল— “কেন আসিয়াছি, তাহা কি বুঝিতে পারিলে না নবাব সুজা বেগ?”
সুজা বেগ বাহারের হাত ধরিয়া তাহাকে কাছে বসাইতে গেলেন। সে বসিল না। বলিল—“এই আগরা সহরের একজন ধনীশ্রেষ্ঠ ওমরাহের প্রতিশ্রুতির মূল্য কতটা অল্প, সেটা যতক্ষণ না জানিতেছি, ততক্ষণ তোমার কোন কথাই শুনিব না?”
নবাব সুজা বেগ, একথায় বড়ই বিরক্ত হইয়া উঠিলেন। একটু রুষ্ট স্বরে বলিলেন—“যে প্রতিশ্রুতি করিতে পারে, সে প্রয়োজন হইলে সে প্রতিশ্রুতি পালন না ও করিতে পারে?”
বাহারবানু একটু ভ্রুকুটীভঙ্গি করিয়া বলিল—“আর এই প্রতিশ্রুতি অপালনে, যাহার অনিষ্ট ঘটিবার সম্ভাবনা হইবে, সে তাহার স্বার্থের অনিষ্টকারীর কার্য্যে বাধা দিতেও সক্ষম, এটাও ত ঠিক্ নবাব সাহেব!”
নবাব সুজা বেগ, এই বাহারবানুকে চিনিতেন। তাঁহার হৃদয়ের অনেক দুর্ব্বলতা, তাঁহার অনেক গুপ্ত ব্যাপার, এই বাহারবানু জানে। তিনি একদিন, তাহার রূপ দেখিয়া মজিয়া, তাহাকে যে সব প্রেম পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহাতে অনেক পদস্থ ওমরাহের কুৎসা আর সাংসারিক গূহ্য কথা বর্ণিত ছিল। এই পত্রগুলিও বাহারের হস্তগত। বিশেষতঃ সম্রাটের বিরুদ্ধে উত্থান করিতে ইচ্ছুক, দুই জন শাহজাদাকে তিনি গোপনে অর্থ দিয়া সাহায্য করিবার যে প্রতিশ্রুতি করেন, তাহাও বাহারবানুর গুপ্ত গৃহে হইয়াছিল। নানা বিষয়ে তিনি বাহারবানুর শক্তির অধীন! সহসা এ শক্তিপাশ ছিন্ন করা, তাঁহার পক্ষে অতি অসম্ভব। এই সমস্ত কারণেই তিনি এদানীং বাহারবানুকে বাহিরে ভালবাসা দেখাইলেও, অন্তরে একটা বিরক্তির ভাব পোষণ করিতেন। কিসে তাহার কবল হইতে কৌশলে মুক্ত হইবেন, তাহাই ভাবিতেন।
নবাব সুজা বেগ দেখিলেন, তখন তাঁহার হারকাতের বাজি পড়িয়াছে। আর বেশী বাড়াবাড়ি করিলে, হয়তঃ তাঁহার পুরা মাত্রায় হার হইয়া যাইবে।
এজন্য তিনি আসন হইতে দ্রুতপদে উঠিয়া, বাহারকে কঠিন আলিঙ্গন নিপীড়িত করিয়া, তাঁহার কাছে আনিয়া বসাইলেন। বাহার জোর প্রকাশ করিয়াও, নবাবের সেই প্রেমালিঙ্গন হইতে মুক্তি লাভ করিতে পারিল না।
সুজা বেগ নানা মিষ্ট কথায়, বাহারকে শান্ত করিলেন। ছলনাময়ী বাহারবানু বুঝিল, যতদূর ফাঁস টানিয়াছি তাহাই এখন যথেষ্ট। আর বেশী কষাকষি করিলে হয়তঃ হিতে বিপরীত হইবে। কাজেই সেও ঠাণ্ডা হইয়া গেল।
বাহারকে লইয়া, নবাব সুজা বেগের সেই রাত্রিটা এক রকম আনন্দে কাটিয়া গেল। প্রভাতে, বাহার নবাবের নিকট বিদায় লইয়া, অপেক্ষাকৃত প্রসন্ন মুখে আরাম মঞ্জিল ত্যাগ করিল।
এই ঘটনার পর, পূর্ণ একটী সপ্তাহ কাটিয়া গিয়াছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আর কোন কিছুই ঘটে নাই।
বাহার ইহার পর এক সপ্তাহ “আরাম মঞ্জিলে” আসে নাই বটে, তাহা হইলেও নবাব সুজা বেগ তাহার বাটীতে গিয়া তাহাকে খুবই আপ্যায়িত করিয়া আসিয়াছেন। বাহারকে সন্তুষ্ট রাখিবার জন্য এর মধ্যে একদিন তাহাকে লইয়া “ইসমালিয়ার” প্রমারার আড্ডায় গিয়াছিলেন। ঘটনাক্রমে নবাব সুজা বেগের টাকাতে খেলিয়া, বাহারবানু সেদিন পাঁচ শত আসরফি জিতিয়া ফেলিয়াছে। সুতরাং সেও নবাব সুজা বেগের আদরের মাত্রা পূর্ব্বের চেয়েও বাড়াইয়া দিয়াছে।
কিন্তু যাহার সাহচর্য্যে তৃপ্তি নাই, তাহার উপাসনা করিতে সুজা বেগ আর প্রস্তুত নহেন। বাহারের ব্যবহারে তাঁহার মনটা খুবই ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল। তবে তিনি, প্রকাশে পূর্ব্ববৎ খুব একটা আনুরক্তি ও সোহাগের ভাব দেখাইয়া, অন্তরে সর্ব্বদাই ভাবিতেন, কিসে এই সর্ব্বনাশিনী ছলনাময়ী বাহারবানুর কবল হইতে মুক্ত হওয়া যায়। সেই গুপ্ত পত্রগুলি আদায় করা যায়।
মানুষ যে কাজে বাধা পায়, সে কাজ সিদ্ধ করিতে সে প্রাণপণে চেষ্টা করে। নবাব সুজা বেগ বড়ই নির্ব্বন্ধবান লোক। নানাদিক দিয়া ভাবিয়া চিন্তিয়া, তিনি স্থির করিলেন—“পবিত্র দাম্পত্য জীবনের সূচনা না করিতে পারিলে, এ মহাপাপের প্রলোভন হইতে মুক্তি পাইবার কোন সম্ভাবনাই নাই।”
এই সব ভাবিয়াই, তিনি আনার উন্নিসার পিতা জামাল খাঁকে এই দীর্ঘকাল পরে আর একখানি পত্র লিখিয়া ছিলেন। সে পত্রে আনার উন্নিসার সহিত তাঁহার বিবাহ কার্য্যটা যাহাতে শীঘ্র হইয়া যায়, সে সম্বন্ধে এক নির্ব্বন্ধ পূর্ণ অনুরোধ ছিল।
কিন্তু ইতিমধ্যে এমন একটী ব্যাপার ঘটিল, যাহার সম্বন্ধে আনারের পিতা বা মীর লতিফ্ কেহই কোন কথা জানিতে পারিলেন না।