দেওয়ানা/সপ্তম পরিচ্ছেদ
সপ্তম পরিচ্ছেদ।
ব্যাপারটী হইতেছে এই। আগরা সহরের সীমান্তে, “পীর মহরমের” সমাধি মন্দির। এ স্থান, হিন্দু মুসলমানের চক্ষে অতি পবিত্র। সমাধি মন্দিরের আশেপাশে বিস্তৃত উদ্যান। মধ্যস্থলে পীর সাহেবের মর্ম্মর নিম্মিত বিশাল মসৌলিয়াম। প্রতি জুম্মা অর্থাৎ শুক্রবারে অনেকে শিরণী দিতে, মানত করিতে, পীর সাহেবের কবর স্পর্শ করিয়া পবিত্র হইবার উদ্দেশ্যে, এই স্থানে সমবেত হয়।
মাসের প্রথম ও তৃতীয় জুম্মাবার পুরুষদের জন্য নির্দ্দিষ্ট। দ্বিতীয় ও চতুর্থটী, পরদানশিন রমণীদের জন্য নির্দ্দিষ্ট। সেবার চতুর্থ দিনে, পীর সাহেবের জন্ম দিন পড়িয়া যাওয়ায়, জনতাটা একটু বেশী হইয়াছিল।
এই দিনে আনার উন্নিসা, তাহার নিজের ও পিতার মঙ্গল কামনায়, শিরণী দিবার জন্য এই পবিত্র স্থানে আসিয়াছে। অবশ্য অবস্থার উপযুক্ত যান-বাহন লইয়াই তাহারা আসিয়াছিল। তাহার সঙ্গে ছিল, তাহার প্রিয় সঙ্গিনী জুমেলি আর একজন ভৃত্য।
নবাব সুজাবেগ, দ্বিতীয়বার একটু বেশী জেদ করিয়া তাহার পিতাকে যে পত্রখানি লিখিয়াছিলেন, আনার উন্নিসাকে তিনি তাহা পড়িয়া শুনাইয়াছেন। এই ব্যাপার লইয়া, আনার উন্নিসা, সত্য সত্যই একটা মহা সমস্যার মধ্যে পড়িয়াছিল। কেননা— একদিকে অতুল ঐশ্বর্য্য—অপর দিকে ঘোর দারিদ্র। তাহার পিতাও নানাদিক দিয়া ভাবিয়া, এখন তাহাকে নবাবের সহিত বিবাহিত করিতে খুবই ইচ্ছুক। আবার যখনই এই ঐশ্বর্য্যবান নবাবের কথা সে ভাবে, তাহার ভবিষ্যৎ সুখ সৌভাগের কথা চিন্তা করে, তখনই আনারের হৃদয়ের নিভৃতকেন্দ্রে, মীর লতিফের অফুরন্ত ভালবাসা মাখান মুখখানি জাগিয়া উঠে। তাহাতে তাহার সুখৈশ্বর্য্যের সকল বাসনাই ভাসিয় যায়।
এইরূপ একটা কঠোর সমস্যার মধ্যে পড়িয়া, আনার মনের শাস্তি হারাইয়াছিল। মনের কথা সে কাহারও নিকট প্রকাশ করিত না। এমন কি, যে জুমেলির কাছে সে এ পর্য্যন্ত কোন কথাই গোপন করে নাই, তাহাকেও সে এসম্বন্ধে কোন কথা বলিতে সাহস করিত না।
এই পবিত্র জুম্মাবারে, পীর-মহরমে সিরণী দিবার জন্য সে জুমেলিকে সঙ্গে লইয়া আসিয়াছে। সে দিনটি রমণীগণের জন্য নির্দ্দিষ্ট। সুতরাং সকল অবস্থার মহিলাগণই সে ক্ষেত্রে সমবেত হইয়াছেন। আমীর ওমরাহ, ধনী দরিদ্র, সকল শ্রেণীর নারীগণ সেই উদ্যানের নানাস্থানে ঘুরিতেছেন।
জুমেলি, ও আনার, দুইজনে এক ক্ষুদ্র প্রস্তরাসনে বসিয়া সেই অগণিত জনস্রোত দেখিতেছে। কেহ বা আসিতেছে, কেহ যাইতেছে, কেহ গল্প করিতেছে, আবার কেহবা সেই ক্ষুদ্র মেলার কোন বিপণীর সম্মুখে দাঁড়াইয়া জিনিস পত্র কিনিতেছে।
জুমেলি কিয়ৎক্ষণ আনারের পার্শ্বে স্থিরভাবে বসিয়া গল্প করিবার পর বলিল—“তোমার পিতা মীনার কাজ করা পাথরের বাসন বড় ভাল বাসেন। মেলা হইতে সুধু হাতে আমরা বাড়ী ফিরিয়া যাইব? তাঁহার জন্য একটা কিছু লইয়া যাইব না? আমার কাছে টাকা আছে। আমি তাঁর জন্য কোন কিছু কিনিয়া আনি। তুমি এইখানে একটু বোস—ভিড়ে কোথাও যাইও না। তাহা হইলে আমাকে খুঁজিয়| মরিতে হইবে।”
আনারও তাই চাই। একটু নির্জ্জনে ভাবিতে পাইলে, সে যেন হাঁফ্ ছাড়িয়া বাঁচে। কাজেই সে জুমেলিকে কোনরূপ বাধা দিল না। জুমেলি নিজের কাজে চলিয়া গেল।
একটু দূরে এক বৃক্ষান্তরালে থাকিয়া একজন যে আনারকে একদৃষ্টে লক্ষ্য করিতেছিল, আনারউন্নিসা তাহা দেখিতে পায় নাই। জুমেলি চলিয়া গেলে, সে আনারের কাছে আসিল।
আনার উন্নিসা এতক্ষণ চিন্তামগ্ন অবস্থায় থাকার জন্য, এই আগন্তুক রমণীকে দেখিতে পায় নাই। সহসা মুখ ফিরাইবামাত্র সে দেখিল, তাহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া এক পরমা সুন্দরী সুবেশা, বিচিত্র সাঁচ্চাখচিত ওড়না বিশোভিতা, হাস্যমুখী এক রমণী।
আনার একদৃষ্টে তাহার মুখের দিকে কিয়ৎক্ষণ স্তম্ভিতের ন্যায় চাহিয়া রহিল। সে মনে ভাবিল—হয় তো এই যুবতী কোনও ধনী ওমরাহের কন্যা।
আনার উন্নিসাকে একদৃষ্টে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিতে দেখিয়া, সেই সুন্দরী মৃদুহাস্যের সহিত বীণানিন্দিত স্বরে বলিল—“কি দেখিতেছ একদৃষ্টে তুমি বহিন্!”
আনার স্বপ্নোথিতের মত একটু চমকিত হইয়া, বলিয়া ফেলিল—“তোমার ঐ ভুবন মোহন রূপ!”
সেই রমণী আর কেহই নহে, আমাদের পূর্ধ্ব পরিচিতা বাহারবানু।
রূপসী বাহারবানু সহাস্যমুখে সুমিষ্ট স্বরে বলিল—“তোমার চেয়েও না কি আমার রূপ বেশী? তুমি বোধ হয় দর্পণে যুখ দেখ না, তাহা হইলে হয় তো একথা বলিতে না—বহিন্।”
বাহার, আনারের সম্মুখে দাঁড়াইয়াছিল। এখন অনুরুদ্ধ না হইয়াও তাহার কাছে বসিল। বসিয়া বলিল—“আনারউন্নিসা! সত্য বল—তুমি কি ভাবিতেছিলে? নবাব সুজা বেগের কথা কি?”
সহসা এই অপরিচিতার মুখে, ভিতরের গুহ্য কথা ব্যক্ত হইতে দেখিয়া, আনারউন্নিসা—বিস্ময়বিহ্বল মুখে একবার মাত্র বাহারবানুর দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করিয়া, ব্যগ্রভাবে বলিল—“কে তুমি? এসব কথা জানিলে কিরূপে? আমি যে আনারউন্নিসা এ কথাই বা তোমায় কে বলিল?”
শয়তানী বাহার, একখানি চিত্র তাহার বক্ষবসনের মধ্য হইতে বাহির করিয়া বলিল—“চিনিতে পার কি—এ প্রতিকৃতি কার?”
আনার সে তন্বীর দেখিবা মাত্রই চিনিল। সুজাবেগের মাতা রুকিনা বেগম, এখানি তাহার পিতার নিকট হইতে লইয়া যান। এ চিত্রের অঙ্কন কর্ত্তা— স্বয়ং মীর লতিফ্। কেন না সেই ছবির নীচে তাঁহার নাম স্বাক্ষর পর্য্যন্ত আছে।
মীরলতিফ যে কেবল সৈনিক ব্রতেই সুদক্ষ, তাহা নহে। সুকুমার শিল্পের প্রতি তাহার খুব একটা অনুরাগ থাকায়, আনার উন্নিসার, কিশোরের ও যৌবনের দুইখানি ছবি আঁকিয়া দিয়াছিল। এ ছবি খানি তাহারই অন্যতম।
আনার এই ঘটনায় আরও বিস্মিত হইয়া বলিল—“এই তস্বীর তুমি কোথায় পাইলে?”
বাহারবানু—একট দর্পের সহিত বলিল—“স্বয়ং নবাবউল্-মুলুক সুজাউদ্দৌলা আমাকে এ তস্বীর উপহার দিয়াছেন।”
আনার। কারণ কি?
বাহার। সে কথা শুনিয়া তোমার কাজ নাই। তুমি তাহাতে অনর্থক মন বেদনা পাইবে। তোমার সহিত আমার কোনই মনোমালিন্য নাই। সুতরাং সে কথা বলিয়া আমি তোমার মনে কষ্ট দিতে চাই না।
আনার। না— আমার কোন কষ্টই বোধ হইবে না। তুমি স্বচ্ছন্দে বলিতে পার।
বাহার বলিল—“একটু পরে তাহা বলিতেছি। সত্য বল দেখি, সুজাবেগকে তুমি পছন্দ কর কি না?”
আনার। নবাব সুজা বেগের সহিত আমার বিবাহ প্রস্তাব হইয়াছে। সে প্রস্তাব কার্য্যে পরিণত হওয়া, বা না হওয়া, আমার পিতার ইচ্ছার অধীন। ইহাতে আমার কোন স্বাধীনতাই নাই। আমার পিতা এখনও বর্ত্তমান। তবে আমার স্বাধীন ইচ্ছা, তাঁর অন্যায় কার্য্যে বাধা দিতে অবশ্য খুবই সক্ষম।
বাহার। ভাল—শুনিয়া সুখী হইলাম। তোমার ঐ ক্রোধদীপ্ত নেত্র, বলিবার ভঙ্গী, আমায় বুঝাইয়া দিতেছে, তুমি মনের কথা গোপন করিতেছে না। একটা কথা জিজ্ঞাসা করিব কি? তুমি বন্ধুভাবে আমার সে কথাটি লইবে কি?
আনার। কি কথা!
বাহার। যদি তোমার স্বাধীন অব্যাহত ইচ্ছাই এই বিবাহ ব্যাপার নিষ্পত্তি করিতে সক্ষম হয়, যদি তোমার পিতার ইহাতে প্রকৃত হাত না থাকে, তাহা হইলে আমার অনুরোধ, আমার পরামর্শ এই, যে তুমি নবাব সুজা বেগকে কোন মতেই বিবাহ করিতে স্বীকৃত হইও না।
আনার। কেন? · তাহাতে তোমার স্বার্থ কি?
বাহার। স্বার্থ যে নাই, তাহা বলিতে পারি না। তবে আমি যেমন নবাবকে বুঝিতে না পারিয়া আত্মসমর্পণ করিয়া এখন অনুতাপে জ্বলিয়া মরিতেছি- যাহাতে তোমার মত নিরীহা অবলাকে সেই যন্ত্রণাটা ভোগ করিতে না হয়—সেই কলুষিত চরিত্র শঠের ছলনায় পড়িয়া, ঐশ্বর্য্যের মোহে ভুলিয়া, তোমারও সর্ব্বনাশ না হয়, সেই জন্যই আমি তোমায় সাবধান করিয়া দিতে আসিয়াছি। সাবধান! আনারউন্নিসা! ঐশ্বর্য্য প্রলোভনের উজ্জ্বলবহ্নিমুখে, মুগ্ধা পতঙ্গীর মত পড়িয়া আত্মনাশ করিও না।
আনার এ কথার উত্তরে কি যে বলিবে, তাহ। খুঁজিয়া পাইল না। সে কেবল নির্ব্বাক অবস্থায় বিস্ময়স্তিমিত নেত্রে, বাহারবানুর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। তারপর ধীরস্বরে বলিল—“তুমি নবাবের কে হও? বিবাহিতা পত্নী?”
বাহারবানু, মৃদু হাস্যের সহিত বলিল—“আমি তাঁর যেই হই না কেন, সে কথা এখন নাই বা জানিলে! এর পর প্রয়োজন ঘটিলে তুমি আমার পরিচয় পাইবে!”
আনারউন্নিসা বলিল— “আমি যে এখানে আসিয়াছি, তাহা জানিলে কিরূপে?”
বাহার। তুমি আসিবে বলিয়া আমি আসি নাই। আমিও পীরের নিকট সিরনী দিতে আসিয়াছিলাম। তসবীরে তোমার আকৃতি দেখিয়ছিলাম। সহসা তোমাকে দেখিয়াই চিনিতে আমার কোন কষ্ট হইল না। ওই—তোমার সঙ্গিনী আসিতেছে। আমি চলিলাম। কিন্তু—সাবধান আনারউন্নিসা! সাবধান!
এই কথা বলিয়া বাহারবানু সহসা সেই জনস্রোতের মধ্যে মিশিয়া গেল। আনারউন্নিসা তাহাকে আর কোন কথা বলিবার অবসর পাইল না।
এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায়, আনারউন্নিসার বুকটা বড়ই দমিয়া পড়িল। কে এই অপরিচিতা সুন্দরী, যে তাহার বিবাহ সম্বন্ধে সব কথাই জানে, অথচ ইতিপূর্ব্বে আর কখনও সে তাহাকে চোখে দেখে নাই!
তাহার কথোপকথন হইতে যতটুকু বুঝা সম্ভব, তাহা হইতেই আনারউন্নিসা এইটুকু বুঝিয়া লইল, নবাবের সহিত তাহার বিবাহ সংঘটন যাহাতে না হয়, এই অপূর্ধ্ব পরিদৃষ্টা রমণীর মনের ইচ্ছা সেইরূপ। আর সে এটুকুও বুঝিল, যে সে নবাব সুজা বেগের শত্রু বই আর কিছুই নয়!
আনার যখন এইরূপ একটা মহা সমস্যার মধ্যে পড়িয়াছে, তখন জুমেলি আসিয়া সেই স্থানে দেখা দিল।
জুমেলি বলিল—“কার সঙ্গে তুমি কথা কহিতেছিলে?”
আনার। তুই তা দেখিয়াছিস্ নাকি?
জুমেলি। দেখিয়াছি বই কি? কি বলিতেছিলেন উনি তোমাকে!
আনার প্রকৃত কথা গোপন করিয়া বলিল—“এমন কিছুই নয়, বাজে গল্প হইতেছিল!”
জুমেলি একথা বিশ্বাস করিল কিনা, তাহা বলিতে পারি না। কিন্তু সে মৃহ্ হাস্যের সহিত বলিল— “যার সঙ্গে এতক্ষণ ধরিয়া কথা কহিলে, তার পরিচয় জানিয়াছ কি?
আনার। না। তুই ওকে চিনিস নাকি জুমেলি?
জুমেলি। এর আগে অবশ্য চিনিতাম না। তবে এই মাত্র চিনিয়াছি!
আনার। ওঁর প্রকৃত পরিচয় পাইয়াছিস্?
জুমেলি। নিশ্চয়ই।
আনার। কে উনি?
জুমেলি। উনি বড় যে সে লোক নন। এই আগরা সহরের বিলাসিনীশ্রেষ্ঠা, নামজাদা গায়িকা, বাহারবানুর নাম শুনিয়াছ ত?
আনার। শুনিয়াছি বই কি?
জুমেলি। উনিই সেই বাহারবানু!
আনার এই কথা শুনিয়া, বিস্মিতনেত্রে জুমিলির মুখের দিকে চাহিয়া বলিল—“বাহারবানু! অত রূপ! অত মিষ্ট কথা! তাহা হইলেও ঘোর শয়তানী!”
জুমেলি। কেন?
আনার। ও সব দরের বিলাসিনী নারী, পরের অর্থ শোষণ করা যাদের ব্যবসায়, পরের সর্ব্বনাশে যারা সিদ্ধ হস্ত, তারা কি কখনও ভাল হয়?
জুমেলি এবারও ঠকিল। আনার যে ভিতরের সব কথা গোপন করিয়া, তাহাকে বাজে জবাব দিতেছিল, তাহা সে বুঝিল না। সুতরাং বলিল—“সত্যই তাই।”
আনার। ঐ রূপসী যে সত্যই বাহারবানু, তা তুই জানিলি কিরূপে? তোর ত ভ্রম হইতে পারে।
জুমেলি। কখনই না। তুমি যখন রূপসী বাহারের সঙ্গে কথা কহিতেছিলে, তখন আমি উহার বাঁদীর সহিত আলাপ পরিচয় করিতেছিলাম। তোমাকে নিবিষ্টচিত্তে কথোপকথন করিতে দেখিয়া, আমি এখানে আসিলাম না। উহার বাঁদীও উহার জন্য একটু দূরে অপেক্ষা করিতেছিল।”
আনার ক্ষীণ হাস্তের সহিত বলিল— “যাই হোক্ মেলায় আসিয়া দুনিয়ার একটা নুতনতর স্ত্রীলোককে দেখিলাম। এখন চল্ তবে বাড়ী যাওয়া যাক্।”
তখন দুইজনে বাহিরে আসিয়া, ভৃত্যকে দিয়া তাহাদের আনীত শকটের সন্ধান করিল। আর তাহাতে উঠিয়া স্বগৃহে প্রত্যাবর্ত্তন করিল।