পনর

 চৈত্রের সংক্রান্তি আসন্ন হইয়া উঠিল। চড়ক ও গাজন-উৎসবের উত্তেজনায় দেশের কৃষিজীবির দল প্রায় উন্মত্ত হইয়া উঠিয়াছে―এতবড় পর্বদিন তাহাদের আর নাই। নরনারী-নির্বিশেষে যাহারা সমস্ত মাস ব্যাপিয়া সন্ন্যাসের ব্রত ধারণ করিয়া আছে. তাহাদের পরিধেয় বস্ত্রে ও উত্তরীয়ের গৈরিক দেশের বাতাসে যেন বৈরাগ্যের রঙ ধরিয়া গেছে। পথে পথে ‘শিব-শম্ভু, নিনাদের বিরাম নাই, চণ্ডীর দেউলে তাহাদের আসা-যাওয়া শেষ হইতেছে না―প্রাঙ্গণসংলগ্ন শিবমন্দির ঘেরিয়া দেবতার অসংখ্য সেবকে যেন মাতামাতি বাধাইয়া দিয়াছে। পূজা দিতে, তামাশা দেখিতে, বেচাকেনা করিতে যাত্রী আসিতে আরম্ভ করিয়াছে, বাহিরে প্রাচীরতলে দোকানীরা স্থান লইয়া লড়াই করিতে শুরু করিয়া দিয়াছে―চোখ চাহিলেই মনে হয় চণ্ডীগড়ের একপ্রাপ্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত মহোৎসবের সূচনায় বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিতে আর বিলম্ব নাই।

 ষোড়শী মনের অশান্তি দূর করিয়া দিয়া অন্যান্য বৎসরের ন্যায় এবারও কাজে লাগিয়া গেছে―সকল দিকে দৃষ্টি রাখিতে সকাল হইতে রাত্রি পর্যন্ত তাহার মন্দির ছাড়িবার জো নাই। বিকালের দিকে মন্দিরের রকে বসিয়া সে নিবিষ্টচিত্তে হিসাবের খাতাটায় জমাখরচের মিল করিতেছিল, নানা জাতীয় শব্দতরঙ্গ অভ্যস্ত ব্যাপারের ন্যায় তাহার কানে পশিয়াও ভিতরে প্রবেশ করিতেছিল না, এমন সময়ে হঠাৎ একটা অপ্রত্যাশিত নীরবতা খোঁচার মত যেন তাহাকে আঘাত করিল! চোখ তুলিয়া দেখিল স্বয়ং জীবানন্দ চৌধুরী! তাঁহার দক্ষিণে, বামে ও পশ্চাতে পরিচিত ও অপরিচিত অনেকগুলি ভদ্রব্যক্তি। রায়মহাশয়, শিরোমণি ঠাকুর, তারাদাস, এককড়ি এবং গ্রামের আরো অনেকে প্রাঙ্গণে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। আরও তিন চারিজনকে সে চিনিতে পারিল না; কিন্তু পরিচ্ছদের পরিপাট্য দেখিয়া অনুভব করিল ইহারা কলিকাতা হইতে বাবুর সঙ্গে আসিয়াছেন। খুব সম্ভব পল্লীগ্রামের বিশুদ্ধ বায়ু ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করাই অভিপ্রায়। জন-চারেক ভোজপুরী পাইক-পেয়াদাও আছে। তাহাদের মাথায় রঙ্গিন পাগড়ি ও কাঁধে সুদীর্ঘ যষ্টি। অনতিকাল পূর্বে হোলী-উৎসবের সমস্ত চিহ্ন আজও তাহাদের পরিচ্ছদে দেদীপ্যমান। মনিবের শরীর রক্ষা ও গৌরব বৃদ্ধি করাই তাহাদের উদ্দেশ্য। ষোড়শী ক্ষণেকের জন্য চোখ তুলিয়াই আবার তাহার খাতার পাতায় দৃষ্টি সংযোগ করিল, কিন্তু মনঃসংযোগ করিতে পারিল না। জীবানন্দ আর কখনও এখানে আসেন নাই; তিনি সকৌতুকে সমস্ত তন্ন তন্ন করিয়া পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিলেন, এবং সুপ্রাচীন শিরোমণিমহাশয় তাঁহার বহু বৎসরের অভিজ্ঞতা লইয়া সেখানে যা-কিছু আছে―তাহার ইতিহাস, তাহার প্রবাদবাক্য―সমস্তই এই নবীন জমিদার প্রভুটিকে শুনাইতে শুনাইতে সঙ্গে চলিলেন। এইভাবে প্রায় অর্ধঘণ্টাকাল ঘুরিয়া ফিরিয়া, এই দলটি আসিয়া এক সময়ে মন্দিরের দ্বারের কাছে উপস্থিত হইল, এবং মিনিট-দুই পরেই পূজারী আসিয়া ষোড়শীকে কহিল, মা, বাবু তোমাকে নমস্কার জানিয়ে একবার আসতে অনুরোধ করলেন।

 ষোড়শী মুখ তুলিয়া ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া বলিল, আচ্ছা চল, যাচ্চি? বলিয়া সে তাহার অনুবর্তী হইয়া জমিদারের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। জীবানন্দ মিনিট পাঁচ-ছয় নিঃশব্দে তাহার আপাদমস্তক বার বার নিরীক্ষণ করিয়া অবশেষে ধীরে ধীরে কহিলেন, সকলের অনুরোধে তোমার সম্বন্ধে আমি কি হুকুম দিয়েছি শুনেচ?

 ষোড়শী মাথা নাড়িয়া জানাইল, না।

 জীবানন্দ কহিলেন, তোমাকে বিদায় করা হয়েছে, এবং ওই ছোট মেয়েটিকে নতন ভৈরবী করে মন্দিরের তত্ত্বাবধানের ভার দেওয়া হয়েছে। অভিষেকের দিন স্থির হয়নি, কিন্তু শীঘ্রই হবে। কাল সকালে রায়মশায় প্রভৃতি সকলে আসবেন। তাঁদের কাছে দেবীর সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তি বুঝিয়ে দিয়ে আমার গোমস্তার হাতে সিন্দুকের চাবি দেবে। এ সম্বন্ধে তোমার কোন বক্তব্য আছে?

 ষোড়শী বহু পূর্ব হইতেই আপনাকে সংবরণ করিয়া লইয়াছিল; তাই তাহার কণ্ঠস্বরে কোন প্রকার উত্তেজনা প্রকাশ পাইল না, সহজকণ্ঠে কহিল, আমার বক্তব্যে আপনাদের কি কিছু প্রয়োজন আছে?

 জীবানন্দ কহিলেন, না। তবে পরশু সন্ধ্যার পরে এইখানেই একটা সভা হবে, ইচ্ছে কর ত দশের সামনে তোমার দুঃখ জানাতে পার। ভাল কথা, শুনতে পেলাম তুমি নাকি আমার বিরুদ্ধে আবার প্রজাদের বিদ্রোহী করে তোলবার চেষ্টা করচ?

 ষোড়শী বলিল, তা জানিনে। তবে, আমার নিজের প্রজাদের আপনার উপদ্রব থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করচি।

 জীবানন্দ অধর দংশন করিয়া কহিলেন, পারবে?

 ষোড়শী কহিল, পারা না পারা মা চণ্ডীর হাতে!

 জীবানন্দ কহিলেন, তারা মরবে।

 ষোড়শী কহিল, মানুষ অমর নয় সে তারা জানে।

 ক্রোধে ও অপমানে সকলের চোখ-মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল। এককড়ি ত এমনি ভাব দেখাইতে লাগিল যে, সে কষ্টে আপনাকে সংযত করিয়া রাখিয়াছে।

 জীবানন্দ একমুহূর্ত স্তব্ধ থাকিয়া বলিলেন, তোমার নিজের প্রজা আর কেউ নেই। তারা যাঁর প্রজা তিনি নিজে দলিলে দস্তখত করে দিয়েছেন। তাকে কেউ ঠেকাতে পারবে না।

 ষোড়শী মুখ তুলিয়া কহিল, আপনার আর কোন হুকুম আছে?

 জীবানন্দ স্পষ্ট অনুভব করিলেন বলিবার সময়ে তাহার ওষ্ঠাধর, তাচ্ছিল্যের আভাসে যেন স্ফুরিত হইয়া উঠিল, কিন্তু সংক্ষেপে জবাব দিয়া কহিলেন, না, আর কিছুই নেই।

 ষোড়শী কহিল, তাহলে দয়া করে এইবার আমার কথাটা শুনুন!

 বল।

 ষোড়শী কহিল, কাল দেবীর অস্থাবর সম্পত্তি বুঝিয়ে দেবার সময় আমার নেই এবং পরশু মন্দিরের কোথাও সভাসমিতির স্থানও হবে না। এগুলো এখন বন্ধ রাখতে হবে।

 শিরোমণি অনেক সহিয়াছিলেন, আর পারিলেন না। সহসা চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন, কখনো না, কিছুতেই না। এ-সব চালাকি আমাদের কাছে খাটবে না বলে দিচ্চি―এবং শুধু জীবানন্দ ছাড়া যে যেখানে ছিল ইহার প্রতিধ্বনি করিয়া উঠিল।

 জনার্দন রায় এতক্ষণ কথা কহেন নাই; কলবর থামিলে অকস্মাৎ উষ্মার সহিত বলিয়া উঠিলেন, তোমার সময় এবং মন্দিরের ভেতর জায়গা কেন হবে না শুনি ঠাকরুন?

 ইহার শেষ কথাটার শ্লেষ উপলব্ধি করিয়াও ষোড়শী সহজ বিনীতকণ্ঠে কহিল, আপনি ত জানেন রায়মশাই, এখন গাজনের সময়। যাত্রীর ভিড়, সন্ন্যাসীর ভিড়, আমারই বা সময় কোথায়, তাদেরই বা সরাই কোথায়!

 সত্যই তাই। এবং এই নিবেদনের মধ্যে যে কিছুমাত্র অসঙ্গতি নাই, বোধ করি জীবানন্দ তাহা বুঝিলেন, কিন্তু দেশের যাঁহারা, তাঁহারা নাকি বদ্ধপরিকর হইয়া আসিয়াছিলেন, তাই এই নম্র কণ্ঠস্বরে উপহাস কল্পনা করিয়া একেবারে জ্বলিয়া গেলেন। জনার্দন রায় আত্মবিস্মৃত হইয়া চীৎকার করিয়া উঠিলেন, হতেই হবে। আমি বলচি হতে হবে এবং দলের মধ্য হইতে একজন কটূক্তি পর্যন্ত করিয়া ফেলিল।

 কথাটা ষোড়শীর কানে গেল, এবং মুখের ভাব তাহার সঙ্গে সঙ্গেই অত্যন্ত কঠোর ও গম্ভীর হইয়া উঠিল। পলকমাত্র চুপ করিয়া থাকিয়া জীবানন্দকে বিশেষ করিয়া উদ্দেশ করিয়া কহিল, ঝগড়া করতে আমার ঘৃণা বোধ হয়। তবে ও-সব করবার এখন সুযোগ হবে না, এই কথাটা আপনার অনুচরদের বুঝিয়ে বলে দেবেন। আমার সময় অল্প; আপনাদের কাজ মিটে থাকে ত আমি চললাম।

 এই মুখ, এই কণ্ঠস্বর, এই একান্ত অবহেলা হঠাৎ জীবানন্দকেও তীক্ষ্ণ আঘাত করিল, এবং তাহার নিজের কণ্ঠস্বরও তপ্ত হইয়া উঠিল, কহিলেন, কিন্তু আমি হুকুম দিয়ে যাচ্চি, কালই এ-সব হতে হবে এবং হওয়াই চাই।

 জোর করে?

 হাঁ, জোর করে।

 সুবিধে-অসুবিধে যাই-ই হোক?

 হাঁ, সুবিধে-অসুবিধে যাই হোক।

 ষোড়শী আর কোন তর্ক করিল না। পিছনে চাহিয়া ভিড়ের মধ্যে একজনকে অঙ্গুলি-সঙ্কেতে আহ্বান করিয়া, সাগর, তোদের সমস্ত ঠিক আছে?

 সাগর সবিনয়ে কহিল, আছে মা, তোমার আশীর্বাদে অভাব কিছুই নেই।

 ষোড়শী কহিল, বেশ। জমিদারের লোক কাল একটা হাঙ্গামা বাধাতে চায়, কিন্তু আমি তা চাইনে। এই গাজনের সময়টা রক্তপাত হয় আমার ইচ্ছে নয়, কিন্তু দরকার হলে করতেই হবে। এই লোকগুলো তোরা দেখে রাখ; এদের কেউ যেন আমার মন্দিরের ত্রিসীমানায় না আসতে পারে। হঠাৎ মারিস নে―শুধু গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দিবি। এই বলিয়া সে আর দৃক্‌পাতমাত্র না করিয়া মন্দপদে বারান্দা পার হইয়া গেল। ষোড়শীকে বিশ বছর ধরিয়া লোকে দেখিয়া আসিয়াছে, তাহাকে জানিবার যে কিছু বাকী আছে কেহ মনেও করে নাই। কিন্তু আজ তাহার প্রকৃতির এই অসাধারণ দিকটার প্রথম পরিচয় পাইয়া হুজুর হইতে পেয়াদা পর্যন্ত যেন পাথরের মূর্তির মত স্তব্ধ হইয়া রহিল।