দেনা-পাওনা/ষোল
ষোল
চৈত্রের সংক্রান্তি নিরুপদ্রবে কাটিয়া গেল―‘শিব-শম্ভুর’ গাজন-উৎসবে কোথাও কিছুমাত্র বিঘ্ন ঘটিল না। দর্শকের দল ঘরে ফিরিল, দোকানীরা দোকান ভাঙ্গিতে প্রবৃত্ত হইল, বাতাসে তেলে-ভাজা খাবারের গন্ধ ফিকা হইয়া আসিল, এবং গেরুয়াধারীরাও চীৎকার ছাড়িয়া গৃহকর্মে মন দিবার প্রয়োজন অনুভব করিল। চিরদিনের অভ্যস্ত সুরে চারিদিকের আবহাওয়ায় সুখ-দুঃখের আবার সেই পরিচিত স্রোত দেখা দিল, কেবল চণ্ডীগড়ের ভৈরবীর দেহের মধ্যে কি যে রোগ প্রবেশ করিল তাহার সে চেহারা আর ফিরিয়া আসিল না―কি একপ্রকার ভয়ে ভয়ে মন যেন তাহার অহর্নিশি চকিত হইয়াই রহিল। উৎসবের কয়টা দিন যেন নির্বিঘ্নে কাটাই সম্ভব এ আশা ষোড়শীর ছিল, কারণ দেবতার ক্রোধোদ্রেকের দায়িত্ব আর যে-কেহ মাথায় করিতে চা'ক জনার্দন চাহিবে না সে নিশ্চিত জানিত। কিন্তু এইবার?
তুবও দিনগুলা এমনি নিঃশব্দে কাটিতে লাগিল যেন আর কোন হাঙ্গামা নাই, সমস্ত মিটিয়া গেছে। কিন্তু সত্য সত্যই মিটিয়া যে কিছু যায় নাই, অলক্ষ্যে গোপনে কঠিন কিছু একটা দানা বাঁধিয়া উঠিতেছে এ আশঙ্কা শুধু ষোড়শীর নহে, মনে মনে প্রায় সকলেরই ছিল। সেই মাঠসংক্রান্ত কৃষকদের কাছে আজ সে সংবাদ পাঠাইয়া দিয়াছিল। কথা ছিল তাহারা দেবীর সন্ধ্যা আরতির পরে মন্দির প্রাঙ্গণে জমা হইবে, কিন্তু আরতি শেষ হইয়া গেল, রাত্রি আটটা ছাড়াইয়া নয়টা এবং নয়টা ছাড়াইয়া দশটা বাজিতে চলিল, কিন্তু কাহারও দেখা নাই। প্রণাম করিতে যাহারা নিত্য আসে, প্রসাদ লইয়া একে একে তাহারা প্রস্থান করিল, পূজারী অন্তর্হিত হইল, এবং মন্দিরের ভৃত্য দুয়ার রুদ্ধ করিবার অনুমতি চাহিল। আর অপেক্ষা করিয়া ফল নাই, এবং কি-একটা ঘটিয়াছে তাহাতেও ভুল নাই, কিন্তু ঠিক তাহা জানিতে না পারিয়া সে অত্যন্ত উদ্বেগ অনুভব করিতে লাগিল। এমনি সময়ে ধীরে ধীরে সাগর আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাকে একাকী দেখিয়া ষোড়শী ব্যগ্র হইয়া প্রশ্ন করিল, এত দেরি যে সাগর? কিন্তু আর কেউ ত আসেনি? এরা কি তবে খবর পায়নি বাবা?
সাগর কহিল, পেয়েচে বৈ কি মা। আমি নিজে গিয়ে সকলের ঘরে ঘরে তোমার ইচ্ছে জানিয়ে এসেছি।
ষোড়শী শঙ্কিত হইয়া কহিল, তবে?
সাগর বলিল, আজ বোধ করি কেউ তার সময় করে উঠতে পারলে না। হুজুরের কাছারি বাড়িতে ষোল আনার পঞ্চায়েতি ছিল, তা এইমাত্র সাঙ্গ হলো। পঞ্চু, অনাথ, রামময়, নবকুমার, অক্ষয় মাইতি, মায় আমাদের বড়ো বিপিনখুড়ো পর্যন্ত তার লাজোয়ান ব্যাটাদের নিয়ে। কেউ বাদ যায়নি মা, আমি একটা বাতাপিনেবুগাছের তলায় দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
ষোড়শী কহিল, ভাল করিসনি সাগর, কেউ দেখে ফেললে―
সাগর হাসিয়া বলিল, একা যাইনি মা, ইনি সঙ্গে ছিলেন, বলিয়া সে বাঁ হাতের দীর্ঘ বংশদণ্ডখানি সস্নেহে সসম্ভ্রমে দক্ষিণ হস্তে গ্রহণ করিল।
ষোড়শী কহিল, কিন্তু এইখানে হবার যে কথা ছিল?
সাগর কহিল, কথাও ছিল, হুজুরের ভোজপুরিগুলোর ইচ্ছেও ছিল কিন্তু গ্রামের কেউ রাজী হলেন না। তাঁরা ত এদিককার মানুষ―আমাদের খুড়ো-ভাইপোকে হয়ত চেনেন!
ষোড়শী ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, সভায় কি স্থির হলো?
সাগর কহিল, তা সব ভাল। এই মঙ্গলেই মেয়েটার অভিষেক শেষ হবে। তবে তোমারও ভাবনা নেই―কাশীবাসের বাবদে প্রার্থনা জানালে শ-খানেক টাকা পেতে পারবে।
ষোড়শী কহিল, প্রার্থনা জানাতে হবে কার কাছে?
সাগর বলিল, বোধ হয় হুজুরের কাছেই।
ষোড়শী জিজ্ঞাসা করিল, আর সকলের? যাদের জমিজমা সব গেল তাদের?
সাগর বলিল, ভয় নেই মা, চিরকাল ধরে যা হয়ে আসছে তা থেকে তারা বাদ যাবে না। এই যে সেদিন প্রজার কক্ষ থেকে পাঁচ হাজারের নজর দাখিল হলো তার খতের কাগজগুলো ত রায়মশাইয়ের সিন্দুক ছাড়া আর কোথাও জায়গা পায়নি, নইলে তিনি একটা হুকুম দিতে না দিতে ভিড় করে আজ সকলে যাবই বা কেন?
ষোড়শী কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল, পরে কহিল, আর তোদের?
সাগর কহিল, আমাদের খুড়ো-ভাইপোর? একটু হাসিয়া বলিল, সে ব্যবস্থাও তিনি করেছেন, সাত-সাতটা দিন কিছু আর চুপ করে বসে ছিলেন না। পাকা লোক, দারোগা-পুলিশ মুঠোর মধ্যে, কোশ-দশেকের মধ্যে কোথাও একটা ডাকাতি হতে যা দেরি। জানো ত মা, বছর-দুই করে একবার খেটে এসেছি, এবার দশ বছরের ত একেবারে নিশ্চিন্ত। খুড়োর গঙ্গালাভ তার মধ্যেই হবে, তবে আমার বয়সটা এখনও কম, হয়ত আর-একবার দেশের মুখ দেখতেও পাবো। বলিয়া সে হাসিতে লাগিল।
ষোড়শী ভয় পাইয়া কহিল, হাঁ রে, এ কি তোরা সত্যি বলে মনে করিস?
সাগর বলিল, মনে করি? এ ত চোখের উপর স্পষ্ট দেখতে পাচ্চি মা। জেলে বাইরে আমাদের রাখতে পারে এ সাধ্যি আর কারও নেই। বেশী নয়, দু’মাস এক মাস দেরি, হয়ত নিজের চোখেই দেখে যেতে পারবে না।
ষোড়শী কহিল, আর যারা ওখানে গেছে, তাদের?
সাগর বলিল, তাদের অবস্থা আমাদের চেয়েও মন্দ। জেলের মধ্যে খেতে দেয়, যা হোক আমরা দুটো খেতে পাবো, কিন্তু এরা তাও পাবে না। নালিশগুলো সব ডিক্রি হতে যা বিলম্ব, তার পরে রায়মশায়ের নিজ জোতে জন খেটে দু’মুঠো জোটে ভাল, না হয় আসামের চা-বাগান ত আছে। কেমন মা, তোমার কি মনে পড়ে না ওই বেনের-ডাঙাটায় আগে আমাদের কত ঘর ভূমিজ বাউরির বসতি ছিল, কিন্তু আজ তারা কোথায়? কতক গেল কয়লা খুঁড়তে, কতক গেল চালান হয়ে চা-বাগানে! কিন্তু আমি দেখেচি ছেলেবেলায় তাদের জমিজমা হাল-বলদ। দু-মুঠো ধানের সংস্থান তাদের সব্বায়ের ছিল। আজ তাদের অর্ধেক এককড়ি নন্দীর, অর্ধেক রায়মশায়ের।
ষোড়শী স্তব্ধভাবে দাঁড়াইয়া সমস্ত ব্যাপারের গুরুত্ব উপলদ্ধি করিতে লাগিল। এই সেদিন যাহারা দল বাঁধিয়া তাহার আশ্রয় চাহিতে আসিয়াছিল, আজ অক্ষম জানিয়া প্রবলের চোখের ইঙ্গিতে তাহারই বিরুদ্ধে তাহার মন্ত্রণা করিতে একত্র হইয়াছে―সেদিনের সমস্ত কল্পনা তাহাদের কোথায় ভাসিয়া গেল। যে প্রবল, যে ধনবান, যে ধর্মজ্ঞানবিরহিত, তাহার অত্যাচার হইতে বাঁচিবার কোন পথ দুর্বলের নাই। কোথাও ইহার নালিশ চলে না, ইহার বিচার করিবার কেহ নাই―ভগবান কান দেন না, সংসারে চিরদিন ইহা অবারিত চলিয়া আসিতেছে। এই যে আজ এতগুলি লোক গিয়া একটিমাত্র প্রবলের পদতলে তাহাদের বিবেক, ধর্ম, মনুষ্যত্ব সমস্ত উজাড় করিয়া দিয়া কোনমতে বাঁচিয়া থাকিবার একটুখানি অবাস লইয়া ঘরে ফিরিয়া আসিল, ইহার লজ্জা, ইহার দৈন্য, ইহার ব্যথা যত বড়ই হোক, যতদূর দেখা যায় এই দুঃখীদের এই ক্ষুদ্র কৌশলটুকু ছাড়া পৃথিবীতে আর কিছুই চোখে পড়ে না। যে অন্যায় এতগুলি মানুষকে এমন অমানুষ করিয়া দিল, তাহাকে প্রতিহত করিবার শক্তি এতবড় বিশ্ব-বিধানে কৈ? এই যে সাগর সর্দার সেদিন পীড়িতের পক্ষ গ্রহণ করিয়াছিল, দুর্বলের এতবড় স্পর্ধার সহস্র গুণ বড় দণ্ড তাহার তোলা আছে― অব্যাহতির কোন পথ নাই। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা সাগর, এ-সব তুই শুনলি কার মুখে?
সাগর কহিল, স্বয়ং হুজুরের মুখে।
তাহলে এ-সকল তাঁরই মতলব?
সাগর চিন্তা করিয়া কহিল, কি জানি মা, কিন্তু মনে হয় রায়মশায়ও আছেন।
ষোড়শী একমুহূর্ত স্থির থাকিয়া বলিল, আচ্ছা সাগর, তুই বলতে পারিস, জমিদার আমার উপর অত্যাচার করেন না কেন? আমি ত ভাঙা কুঁড়েয় একলা থাকি, ইচ্ছে করলেই ত পারেন?
সাগর হাসিল, কহিল, কে তোমাকে বললে মা তুমি একলা থাকো? মা, আমাদের নিজেদের পরিচয় নিজে দিতে নেই―গুরুর নিষেধ আছে, বলিতে বলিতে সহসা তাহার বলিষ্ঠ দক্ষিণ হাতের পাঁচটা আঙ্গুল লাঠির গায়ে যেন ইস্পাতের সাঁড়াশির মত চাপিয়া বসিল, কহিল, যার ভয়ে চণ্ডীর মন্দিরে না বসে ষোল আনা বসতে গেল আজ এককড়ির কাছারি-বাড়িতে, তারই ভয়ে কেউ তোমার ত্রিসীমানায় ঘেঁষে না। হরিহর সর্দারের ভাইপো সাগরের নাম দশ-বিশ ক্রোশের লোক জানে, তোমার উপর অত্যাচার করবার মানুষ ত মা পঞ্চাশখানা গ্রামে কেউ খুঁজে পাবে না।
ষোড়শীর দুই চক্ষু অকস্মাৎ জ্বলিয়া উঠলি; কহিল, সাগর, এ কি সত্য!
সাগর হেঁট হইয়া তৎক্ষণাৎ তাহার হাতের লাঠিটা ষোড়শীর পায়ের নীচে রাখিয়া দিয়া কহিল, বেশ ত মা, সেই আশীর্বাদ কর না, যেন কথা আমার মিথ্যে না হয়।
ষোড়শীর চোখের দৃষ্টি একবার একটুখানি কোমল হইয়াই আবার তেমনি জ্বলিতে লাগিল, কহিল, আচ্ছা সাগর, আমি ত শুনেচি তোদের প্রাণের ভয় করতে নেই?
সাগর সহাস্যে কহিল, মিথ্যে শুনেচ তাও ত আমি বলচি নে মা!
ষোড়শী কহিল, কেবল প্রাণ দিতেই পারিস, আর নিতে পারিস নে?
সাগর কহিল, একটা হুকুম দিয়ে আজ রাত্রেই কেন যাচাই কর না মা? এই বলিয়া সে ষোড়শীর মুখের উপর দুই চোখ মেলিয়া ধরিতে ষোড়শী বিস্ময়ে ও ভয়ে একেবারে নির্বাক হইয়া গেল। সাগরের চাহনি এক পলকে বদলাইয়া গেছে। সেই স্বাভাবিক দীপ্তি নাই, সে তেজ নাই, সে কোমলতা কোথায় অন্তর্হিত হইয়াছে―নিষ্প্রভ, সঙ্কুচিত গভীর দৃষ্টি―এ যেন আর সে সাগর নয়, এ যেন আর কেহ। সাগর কথা কহিল। কণ্ঠস্বর শান্ত কঠিন, অত্যন্ত ভারী। কহিল, রাত বেশী হয়নি―ঢের সময় আছে। মা চণ্ডীর কপাট তাই এখনো খোলা আছে মা, আমি তোমার হুকুম শুনতে পেয়েছি। বেশ, তাই হবে মা, পাপের শেষ করে দেব―সকালেই শুনতে পাবে, তোমার সাগর সর্দার মিছে অহঙ্কার করে যায়নি। তাহার পিতৃ-পিতামহের হাতের সুদীর্ঘ লাঠিখানা ত ষোড়শীর পায়ের কাছে পড়িয়াছিল, হেঁট হইয়া তৎক্ষণাৎ তুলিয়া লইয়া সোজা হইয়া দাঁড়াইল।
ষোড়শী কথা কইতে গেল, তাহার ঠোঁট কাঁপিতে লাগিল, নিষেধ করিতে চাহিল, কণ্ঠে স্বর ফুটিল না, ভূমিকম্পের সমুদ্রের মত অকস্মাৎ সমস্ত বুক জুড়িয়া দোলা উঠিল এবং নিমেষের জন্য সাগরের এই একান্ত অপরিচিত ঘাতকের মূর্তি তাহার চোখের উপর হইতে অদৃশ্য হইয়া গেল। সাগর কি যেন একটা কহিল, কিন্তু সে বুঝিতে পারিল না, কেবল এইটুকুমাত্র উপলব্ধি করিল যে, সে ভূমিষ্ট প্রণাম করিয়া দ্রুতবেগে বাহির হইয়া যাইতেছে।