দ্বিতীয় চরিতাষ্টক/রামদুলাল সরকার
রামদুলাল দে[১]।
দমদমার অনতিদূরে রেক্জানি নামক এক খানি অতি ক্ষুদ্র গ্রাম ছিল। উহা এত ক্ষুদ্র যে, কলিকাতার আধিবাসিগণ উহার নামও জানিতেন না। ঐ গ্রামের সমস্ত অধিবাসীই কৃষিকার্য্য দ্বারা জীবিকা নির্ব্বাহ করিত। খৃষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্য ভাগে বলরাম সরকার নামক এক জন গ্রাম্য গুরু মহাশয় ঐ গ্রামে বাস করিয়া কৃষক বালকদিগকে শিক্ষা দিতেন। পরিস্কৃত, হস্তাক্ষরই, তাঁহার এক মাত্র বিদ্যা ছিল। এই শিক্ষাদানের উপর্জ্জন, কিঞ্চিৎ শস্য ব্যতীত আর কিছুই হইত না। তিনি কিছু নগদ অর্থ উপার্জ্জনের প্রত্যাশায় বলদের পিঠে খড় বোঝাই দিয়া সপ্তাহের মধ্যে দুই দিন কলিকাতায় গমন করিতেন। ঐ খড় অতি অল্প মূল্যে বিক্রীত হইত। পূর্ব্বোক্ত শস্য এবং এই যৎকিঞ্চিৎ অর্থ দ্বারা অতি ক্লেশে কালযাপন করিতেন। সময় দোষে এতাদৃশ দুঃখের ভাতও, সুখে খাইতে পরিতেন না। যন্ত্রনাদায়ক দারিদ্র্য ক্লেশের সহিত যুদ্ধের মহাভয় সংযোজিত হইয়াছিল। সেই সময়ে এই দেশ, বর্গীর হঙ্গামে সতত উপদ্রুত হইতেছিল। ১১৪৮-৪৯ সালের মধ্যে মহারাষ্ট্রীয় সৈন্য বঙ্গদেশ আক্রমণ করে। তাহদের এই অত্যাচার, ক্রমাগত দশবৎসর চলিয়াছিল। ১১৫৮-৫৯ সালে যখন তাহারা বঙ্গদেশকে শেষ আক্রমণ করে; তখন বলরাম অবশিষ্ট গ্রামবাসিগণের সহিত প্রাণ রক্ষার্থ পলায়ন করেন। তাঁহার সম্পত্তি কিছুই ছিল। না, কেবল এক গর্ভবতী স্ত্রী সঙ্গে ছিল। অত্যাচারিদলের অধিকার হইতে বহু দূরস্থিত এক প্রান্তরে উপস্থিত হইয়া ঐ গর্ভবতী স্ত্রী আকবরের ন্যায়; এক পুত্র প্রসব করিলেন। এই পুত্রের নামই রামদুলাল।
বলরাম, রামদুলালকে শুভঙ্করী বাঙ্গালা কি তাঁহার সুন্দর হস্তাক্ষর কিছুই শিখাইতে পারেন নাই; যেহেতু পুত্র জন্মের কয়েক বৎসরের মধ্যেই তাঁহার মৃত্যু হয়। রামদুলালেয় পিতার মৃত্যুর কিঞ্চিৎ পুর্বেই তাঁহার মাতার মৃত্যু হইয়াছিল। রামদুলালের পিতা মাতা যে, কেবল তাঁহাকেই নিরাশ্রয় করিয়াছিলেন তাহা নহে, আর একটি পুত্র এবং আর একটী কন্যার প্রতিপালনের ভারও তাঁহার উপর দিয়া গিয়াছিলেন। এই তিন অপোগণ্ড সাহায্যার্থী হইয়া কলিকাতানবাসী মাতামহ রামসুন্দর বিশ্বাসের কুটীরে উপস্থিত হইল। তখন কলিকাতার অবস্থা আর এক প্রকার ছিল; তখন উহা এখনকার ন্যায় সমৃদ্ধিশালিনী রাজধানী হয় নাই, তখন উহা ইংরাজ বণিকগণের বাণিজ্য স্থান মাত্র ছিল।
হিন্দু জাতির সামাজিক ব্যবস্থা এমনই চমৎকার যে, কোন আত্মীয় অন্নকষ্টে পতিত হইলে কোন হিন্দুই তাহাকে সাহায্য না দিয়া থাকিতে পারেন না। “আমি এক মুষ্টি পাইলে—তুমিও পাইবে।” এ কথা হিন্দুমাত্রেরই চিরাভ্যস্ত। হিন্দুজাতি এইরূপ সদয় ব্যবহারে চিরশিক্ষিত। অন্নার্থী ভিক্ষু, দ্বার হইতে বিমুখ হওয়া হিন্দুজাতির বিষম গালি স্বরূপ। এই জন্যই, রামসুন্দর বিশ্বাসের অবস্থা অতি হীন, এমন কি দৈনন্দিন মুষ্টিভিক্ষা তাঁহার উপজীবিকা হইলেও তিনি সেই অপোগণ্ডদিগকে সাদরে বহুমধ্যে গ্রহণ করিলেন। তাঁহার মুষ্টিভিক্ষা দ্বারা নিজ সন্ততিগণের ভরণপোষণ হওয়াই কঠিন হইত; এখন আবার কন্যার সন্ততিগণও তাঁহার পোষ্য মধ্যে গণিত হওয়ায়, রামসুন্দর দ্বিগুণ উৎসাহ ও ক্লেশের সহিত ভিক্ষায় প্রবৃত্ত হইলেন।
রাম দুলালের মাতামহীও শ্রমকাতর ছিলেননা। তিনি ভাড়ানীর কর্ম্ম দ্বারা কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ উপার্জ্জন করিয়া স্বামীর সাহায্য করিতেন। ভিনি, তাঁহার স্বোপার্জিত তণ্ডলের সমুদায়ই যে, আপনার ও আত্মপরিবারের ভরণ পোষণে ব্যয় করিতেন তাহা নহে; প্রত্যহ গঙ্গাস্নানে যাইবার সময় পথি পার্শ্বস্থ বহুসংখ্য ভিক্ষুগণকে ঐ তণ্ডুল বিতরণ করিতেন। যদিও তিনি নিজে যার পর নাই দুঃখিনী ছিলেন, তথাপি বিস্মৃত হইতেন না। যে, এই সৃষ্টিতে তাঁহার অপেক্ষাও অধিকতর দয়ার পাত্র সকল বর্ত্তমান আছে! যাহাদিগকে প্রাত্যহিক আহারের জন্য কঠিন পরিশ্রম করিতে হয়, তাহাদের এক দিনের মরণান্তিক ক্লেশ, উচ্চ শ্রেণীস্থ লোকেরা সমস্ত জীবনেও কল্পনা করিতে পারে না। তিনি এই উচ্চ শ্রেণীস্থলোক। ছিলেন না, তিনি সামান্য ভিক্ষুপত্নীমাত্র ছিলেন। এই জন্যই দারিদ্রের স্থৈর্য্যনাশক ও ধর্ম্মভ্রংশক ক্লেশের সহিত উত্তমরূপে পরিচিত ছিলেন। এই জন্যই দেবতার ন্যায় দরিদ্র সেবায় নিযুক্ত হইয়াছিলেন; এই জন্যই, ধান ভানার বিষম পরিশ্রম অবলম্বন করিয়াছিলেন এবং এই জন্যই, আপনার ভাগ্য নিতান্ত নিকৃষ্ট হইলেও, দুঃখরূপে পতিত দুর্গত ব্যক্তির ক্লেশনাশে তাদৃশ যত্নবতী হইয়াছিলেন। এতাদৃশ মাতামহী, আমাদের পরমজ্ঞানী শিক্ষক ও উপদেশপূর্ণ পুস্তক অপেক্ষাও অধিক কার্য্যকারিণী। যাহা হউক, তাঁহার সদ্গুণ প্রযুক্ত, পরিশেষে তাঁহার ভাগ্য প্রসন্ন হইল।
রামদুলালের মাতামহী, তাঁহাদের ভরণ পোষণের ভার লওরার কতিপয় বৎসর পরে কলিকাতার অতি সম্ভ্রান্ত ও সম্পন্ন মদনমোহন দত্তের অন্তঃপুরে পাচিকার কর্ম্ম গ্রহণ করেন। যদিও এই কর্ম্ম অতি ছােট এবং উহার আয় যৎসামান্য তথাপি তাঁহার সেই পরিবারস্থ গৃহিণীগণের ন্যায় সম্মান ছিল। সুতরাং রামদুলালকে সেই বাড়ীর পোষ্য বর্গের মধ্যে প্রবিষ্ট করিতে তাঁহার কিছু মাত্র ক্লেশ হয় নাই। বঙ্গদেশে যে সকল গৃহস্থের অবস্থা তাদৃশ উৎকৃষ্ট নহে, চাকরের সন্ততিগণের প্রতিপালনে অসমর্থ হওয়া তাঁহাদিগের পক্ষেও নিন্দাজনক, অতএব যে মদনমোহন দত্ত বহুসংখ্য বাণিজ্যাগারের অধ্যক্ষ ছিলেন এবং ধন বিষয়ে রাজা নব কৃষ্ণ অপেক্ষা নিকৃষ্ট ছিলেন না, রামদুলাল যে অতি সহজেই তাঁহার পোষ্যগণের মধ্যে গণ্য হইয়াছিলেন, তাহাতে সন্দেহ নাই।
রামদুলাল তাঁহার অন্নদাতার বাড়ীতে শিক্ষাসাধন করিতে লাগিলেন। শিক্ষাবিষয়ক অনুরাগ ও উৎসাহ; তাঁহাকে অবিলম্বে এক উৎকৃষ্ট লেখক ও উৎকৃষ্ট মুহরি করিয়া তুলিল। মদনদত্তের বালকগণের শিক্ষক, রামদুলালকেও শিক্ষা দিতে আদিষ্ট হইয়াছিলেন। এখন যেমন একমাত্র স্লেট প্রথম শিক্ষার্থিগনের সকল অবস্থাতই ব্যবহৃত হয়, তখন তালপাত, বটপাত, কলাপাত প্রভৃতি দ্বারা ঐ কার্য নির্ব্বাহিত হইত; তখন শ্লেট্ পেন্সিল ছিল না, তখন পেন্ ছোট লোকের কলম বলিয়া অনাদৃত হইত। রামদুলাল তালপাত সারিয়া কলাপাত ধরিলেন। তাঁহার মাতামহীর অবস্থা এমন ছিলনা যে, তিনি প্রতি দিন তাঁহাকে তাড়া তাড়া কলাপাত কিনিয়া দেন। সুতরাং প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে লেখনীয় পাত পাইবার সুবিধা দেখিতে লাগিলেন। বালক কালেই তাহার মন, উপায় উদ্ভাবনে সমর্থ হইয়াছিল। দত্তবাড়ীর বালকগণের লিখিত ও ইতস্ততঃ পরিত্যক্ত পাত ধৌত করিয়া লওয়া স্থির করিলেন। যে অধ্যবসায় পরিণামে সেই পিতৃহীন বালককে কলিকাতার প্রধান বণিক্ ও অপরিমিত অর্থের অধিকারী করিয়াছিল; বাল্য কালের একটী সামান্য ঘটনায় সেই অধ্যবসায়ের মূল দৃষ্ট হয়। তিনি মধ্যাহ্ন রৌদ্রে অনাবৃতমস্তকে গঙ্গাস্রোতে আজানু মগ্ন হইয়া সেই সকল পত্র ধৌত করত ব্যবহারযােগ্য করিতেন। সামান্য কলাপাতের জন্য তিনি এত ক্লেশ করেন, মদনমােহনদত্ত জানিতে পারিলে অবশ্যই দুঃখিত ও বিরক্ত হইতেন। কিন্তু রামদুলালের প্রতিভা যেস্থলে তাঁহার অভাবপূরণে সমর্থ হইত, সে স্থলে তিনি অপরের নিকট প্রার্থনা জানাইতে সম্মত হইতেন না। অধিকন্তু ইহাও তাঁহার মনে ছিল যে, মদনমােহন তাঁহার জন্য যথেষ্ট করেন, তাঁহাকে আর অধিক ভারগ্রস্ত করা, তাঁহার। উচিত নহে। যাহা হউক, ক্রমে রামদুলাল উৎকৃষ্ট রূপে বাঙ্গালা লেখা পড়া শিখিলেনও তীক্ষ্ণবুদ্ধিশালী মুহরী হইলেন এবং জাহাজের কাপ্তেন ও কর্ম্মচারিগণের সহিত কার্যোপযোগী ইংরাজী কথোপকথনে সমর্থ হইলেন। যখন পশ্চিম দেশীয় জ্ঞানতরঙ্গ ভারত উপকূলে আসিয়া পৌঁছে নাই, যখন সমুদায় দেশ অজ্ঞানাচ্ছন্ন ছিল, যখন সমস্ত ভারতবর্ষ যুদ্ধধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত হইতেছিল; যখন ইংরেজ শাসনকর্ত্তারা উদার কর্তব্যতা, —অধিক কি স্বার্থ পরতামূলক গভীর দূর দর্শন শালীও হন নাই; যখন বিদ্যালয় সকল উৎকৃষ্ট শাসনকার্যের উপাদান বলিয়া বিবেচিত হয় নাই, যখন দেশীয় লোকের জ্ঞান, সামান্য বাঙ্গালা ও ইংরাজী ভাষার দুই একটী অপশব্দকে অতিক্রম করিত না; তখন রামদুলালের শিক্ষা বিষয়ে উহাপেক্ষা অধিক আর কি আশা করা যাইতে পারে?
রামদুলাল ষোল বৎসর বয়ঃক্রম কালে নিরাশ্রয় নাবালক ভ্রাতার প্রতিপালন এবং জরাজীর্ণ বৃদ্ধ মাতামহের ভিক্ষা ক্লেশ নিবারণার্থ পূর্ব্বোক্তরূপ জ্ঞানাস্ত্রে সজ্জিত হইয়া কষ্টকর ও নিষ্ঠুরতর জীবনযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। প্রতিপালকের অনুমত্যনুসারে নন্দকুমার বসু নামক আর একটী বন্ধুর সহিত তাঁহার অফিসে কার্য্য শিক্ষার্থীরূপে নিমুক্ত হইলেন। প্রতি দিন নিয়মিত কালে আফিসে যাইতে লাগিলেন। এক দিন প্রখর রৌদ ও ঝটিকা প্রযুক্ত অফিসে যাইতে না পারিয়া আবাসে ফিরিয়া আসিলেন এবং ক্লেশে অবসন্ন হইয়া গভীর নিদ্রায় আভিভূত হইলেন। মদনমোহন অফিস হইতে প্রত্যাগত হইয়া বালকদ্বয়কে তাদৃশবস্থ দেখিয়া মনে করিলেন হয় ত তাহাদের কোন পীড়া হইয়াছে। রামদুলাল গায় হাত দিয়া ডাকিতে লাগিলেন। রামদুলাল চকিত হইয়া একবারে দণ্ডায়মান হইলেন এবং ভয়ে কাঁপিতে লাগিলেন। পরিশ্রমী ও কষ্টসহিষ্ণু বলিয়া তাঁহার একটু খ্যাতি হইয়াছিল, এবং সেই খ্যাতির উপর সমস্ত ভবিষ্যৎ উন্নতি নির্ভর করিতে ছিল। এখন। সেই খ্যাতি বিলোপের সম্ভাবনা উপস্থিত। এমন স্থলে একটা মিথ্যা কথা দ্বারা সহজেই এই খ্যাতি রক্ষিত হইতে পারে এবং বোধ হয় এমন স্থলের মিথ্যাকথার প্রলোভন অনেকের পক্ষে অপরিহার্য। কিন্তু মিথ্যার প্রতি রামদুলালের স্বাভাবিক বিদ্বেষ ছিল। তিনি, আবাসে ফিরিয়া আসিবার এবং নিদ্রিত হইবার প্রকৃত কারণ যথার্থ বলিলেন। ইহাতে মদনমোহন বিরক্তি সহকারে একটু হাসিয়া কহিলেন, রামদুলাল যদি রৌদ্র ও ধূলাকে ভয় করেন তাহা হইলে তাঁহার কখনই কর্ম্ম পাইবার সম্ভাবনা নাই। এই কথা শুনিয়া তিনি আপনার ক্ষমতা প্রদর্শনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হইলেন।
যাহা হউক, রামদুলাল ক্রমে শ্রম ও অস্বাচ্ছন্দ জনক এক সামান্য বিল সাধার কর্ম্ম পাইলেন। তিনি বর্ণনাতীত শ্রম ও দক্ষতা সহকারে ঐকার্য্য করিতে লাগিলেন। মদনমোহনের সুবৃহৎ কার্য্য সম্বন্ধে কলিকাতা প্রদেশের সকল অংশেই উহার দেনা পাওনা হইয়াছিল। ঝড় নাই, বৃষ্টি নাই, রৌদ্র নাই, ঐ পাওনা আদায়ের জন্য প্রতিদিনই রামদুলালকে পদব্রজে নানা স্থান ভ্রমন করিতে হইত। কলিকাতা হইতে বারাকপুর কিম্বা টিটেগড় ইহা তাঁহার সামান্য ভ্রমণ ছিল। রামদুলালের আনীত বিলের প্রতি, যদি এই সকল স্থানের কোন দেন্দারের কিছু সন্দেহ উপস্থিত হইত, রামদুলাল তৎক্ষণাৎ দ্রুতপদে গমন করিয়া আপনার নিয়োগ কর্তার নিকট হইতে তাহার খোলাসা আনিয়া সেই দিনই দেন্দারকে বুঝাইয়া দিতেন। এক দিন দমদমার কোন সৈনিক পুরুষের নামে অনেক টাকার এক খানি বিল হিল। সাহেবেরা সচরাচর গরীবের দুঃখ বুঝিতে পারেন না। সুতরাং ঐ সাহেব রামদুলালকে টাকা দিতে বিলম্ব করিলেন। প্রথমাবস্থায় রামদুলালের বীরের ন্যায় সাহস ছিল; সেই এক রাশি টাকা লইয়া সন্ধ্যার পর কলিকাতাভিমুখে যাত্রা করিলেন।
এই সময়ে কলিকাতার উপনগর সকলে অত্যন্ত দস্যুভয় হইয়াছিল। পলাশীর যুদ্ধে অপরাধী হইয়া যে সকল সৈন্য তাড়িত হইয়াছিল, তাহারাই এই স্থানে অত্যাচার করিত, দমদমা হইতে কলিকাতার পথ অদ্যাপি নিরাপদ নহে। রামদুলাল কিয়দ্দূর গিয়া আশ্রয় গ্রহণে ইচ্ছুক হইলেন। কিন্তু তিনি তৎকালীন সমাজের দূষিত অবস্থা উত্তমরূপে অবগত ছিলেন। ভাবিতে লাগিলেন যদি কাহার বাড়ী যাই, আর হঠাৎ সে আমার টাকার কথা জানিতে পারে, তাহা হইলে রাতারাতি বড় মানুষ হইবার আশয়ে সহজেই আমার প্রাণ নাশ করিয়া অর্থ গ্রহণ করিবে। অতএব তিনি কাহারও বাড়ী গমন করিবার ইচ্ছা ত্যাগ করিলেন। অতিরিক্ত বস্ত্রাদি পরিত্যাগপূর্ব্বক ফকির বেশে টাকার থলি মাতায় দিয়া তরুতলে শয়ন করিলেন। নয়নে নিদ্রা নাই; পেচক ও শৃগালের ভীষণ চীৎকার শুনিতে শুনিতে রজনী প্রভাত হইল। নিশার নৈরাপদনিবন্ধন জগদীশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়া গাত্রোথান করিলেন।
এই সকল কার্য্য দ্বারা রামদুলালের সদ্গুণ বিষয়ে মদনমোহন দত্তের দৃঢ় বিশ্বাস হইল। এখন রামদুলালের বেতন পাঁচ টাকামাত্র ছিল; কিন্তু তিনি বিলসরকারের এই সামান্য বেতন হইতেও অসাধারণ মিতব্যয়িতা দ্বারা এক শত টাকা সঞ্চয় করিয়াছিলেন। এক শত টাকা কিছু দুঃখীর পক্ষে নিতান্ত অল্প নহে। তিনি যে কেবল আপনার সুখসচ্ছন্দতা বৃদ্ধি জন্য তাদৃশ ক্লেশ স্বীকার করিয়া অর্থ সঞ্চয় করিয়াছিলেন, তাহা নহে তিন বাগবাজারের কোন কাঠের আড়তে ঐ টাকা জমা রাখিয়াছিলেন। এত কাজের মধ্যেও প্রতিদিন এক এক বার আড়তে যাইবার সময় করিয়া লইতেন। উহার লাভাংশ দ্বারা জরাজীর্ণ মাতামহ ও মাতামহীর প্রতিপালন করিতেন। যখন তাঁহার বয়ঃক্রম পাঁচ বৎসর মাত্র, তখন যাঁহারা ভিক্ষালব্ধ অন্ন দ্বারা তাঁহাকে এবং তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা ভগ্নীদিগকে পোষণ করিয়াছিলেন, কদাচ তাঁহাদিগকে বিস্মৃত হওয়া উচিত নহে, ইহা তাঁহার অন্তঃকরণে সতত জাগরূক ছিল। এই জন্য নিজে অর্দ্ধাশন করিয়াও, তাহাদিগের জন্য কিছু সঞ্চয় করিয়াছিলেন।
মদনমোহন দত্ত তাঁহার এই রূপ চরিত্র দর্শনে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইলেন এবং তাঁহার বুদ্ধি ও শ্রমশক্তির যথেষ্ট প্রশংসা করিয়া তাঁহাকে সিপ্সরকারের কর্ম্মে নিযুক্ত করিলেন। ইহা বিলসাধার কর্ম্মাপেক্ষা উৎকৃষ্ট; ইহার মাসিক বেতন দশ টাকা। কিন্তু এই কর্ম্মে যেমন মধ্যে মধ্যে পরিতোষিকের প্রত্যাশা ছিল; তেমনি জাহাজের নাবিক ও কাপ্তেন্দিগের নিকট হইতে প্রহারের সম্ভাবনাও বড় অল্প ছিল না। নিরন্তর এই রূপ কষ্টসহিষ্ণুতায় তাঁহার প্রতিভার ঔজ্জ্বল্য, বৃদ্ধি হইয়াছিল। তাঁহার কৃচ্ছ্রসহিষ্ণুতা, সাহস, সুক্ষদর্শন, এবং প্রস্তুতবুদ্ধি, তাঁহাকে এক অদ্বিতীয় সিপ্সরকার করিয়াছিল। সিপ্সরকারদিগকে সর্ব্বদাই জাহাজের কর্ম্মচারিগণের সহিত ভয়ানকরূপে বিবাদ করিতে হইত। রামদুলাল যদিও ইংরাজী ভাষায় লিখিতে শিখেন নাই, কিন্তু পরিস্কৃত রূপে কহিতে পারিতেন। সুতরাং জাহাজীয়দিগের সহিত বিবাদ করার, তাঁহার বেশ সুবিধা ছিল। তাঁহাকে সকল ঋতুতেই নদীমুখে গমন করিয়া জাহাজের দ্রব্যাদির পর্য্যবেক্ষণ করিতে হইত। বস্তার সংখ্যা লইয়া বিবাদের আরম্ভ হইত। প্রায়ই ঘুঁসো ঘুঁসি না হইয়া এ সকল বিবাদের শেষ হইত না।
এই কার্যের একদিকে যেমন বিবিধ অসুবিধা, অন্য দিকে সেই রূপ লাভের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তিনি এরূপ লাভের প্রত্যাশায় কখন অন্যায় পথে পদার্পণ করেন নাই। নদীমুখে গমনোপলক্ষে তিনি মধ্যে মধ্যে বিপদে পড়তেন। এক দিন নৌকা ডুবিয়া জলে পড়েন, এবং সাত ক্রোশ পথ সন্তরণ পূর্ব্বক খিদিরপুর গিয়া আত্মরক্ষা করেন। ঐ রূপে আর এক দিন তিনি এবং তাঁহার বন্ধু নন্দকুমার বসু বিপদাপন্ন হইয়া নদীতীরবর্ত্তী কোন ধীবরের গৃহে আশ্রয় লন। ধীবর তাঁহাদিগের শয্যার নিমিত্ত একটি ঝেঁতলা মাত্র প্রদান করে। ঐ শয্যায় শয়ন করিয়া সে রাত্রি তাঁহারা এতাদৃশ সুখানুভব করিয়াছিলেন যে, ঐশ্বর্য্যের সময় তাঁহারা উভয়েই আপন আপন শয্যাতলে সর্ব্বদা ঝেঁতলা ব্যবহার করিতেন। যাহা হউক এই রূপে পুনঃ পুনঃ ডায়মণ্ডহারবারে গমন ও তত্রত্য জাহাজের ব্যাপার দর্শনে তিনি একটি অতি প্রয়োজনীয় গুণ উপার্জ্জন করিয়াছিলেন, যদ্দ্বারা তাঁহার ভবিষ্যৎ পুরস্কারের পথ সুপরিস্কৃত হইয়াছিল। যে সকল ভগ্ন ও মগ্ন জলযান টালার আফিসে নীলাম হইত, তিনি সহজেই তাহার মূল্যাদি নির্ণয় করিতে পারিতেন।
এক দিন রামদুলাল ভাগীরথীর মুখভাগে এক খানি জলমগ্ন জাহাজ দেখিয়াছিলেন এবং দর্শন মাত্রেই তৎসংক্রান্ত সমুদয় বিষয় অনুমান করেন। এমন কি! জাহাজ কিরূপে জল হইতে উদ্ধার করা যাইবে, তাহাতে কত দ্রব্য আছে, তাহার কত অংশ পাওয়া যাইতে পারে এবং তাহার মূল্যই বা কি ইহার কিছুই অনুমান করিতে অবশিষ্ট ছিল না। এই ঘটনার অল্পকাল পরেই মদনমোহন দত্ত কিছু টাকা দিয়া কোন নির্দ্দিষ্ট নীলম ক্রয় করিবার জন্য তাঁহাকে টালা কোম্পানির বাটিতে প্রেরণ করেন। রামদুলাল নীলাম অফিসে গমন করিবার কয়েক মিনিট পূর্ব্বে লক্ষিত নীলাম হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু পরক্ষণেই শুনিতে পাইলেন যে, বোঝাই দ্রব্য সহিত এক খানি জলমগ্ন জাহাজ নীলামে ধরা হইয়াছে। এই নীলমে ধৃত জাহাজ খানি যে, তাঁহার পূর্ব্বদৃষ্ট জাহাজ ইহা অতি সহজেই স্থির করিলেন। কৌতুহলাক্রান্ত হইয়া নীলাম স্থলে উপস্থিত হইলেন এবং তাঁহার অনুমতি মূল্য অপেক্ষা অতি অল্প ডাক হইতেছে দেখিয়া সেই নীলাম ক্রয়ে নিতান্ত প্রলোভিত হইলেন। তাঁহার ডাক সর্ব্বাপেক্ষা অধিক হওয়ায় তাঁহার প্রভু মদনমোহন দত্তের নামে ১৪০০০ হাজার মূল্যে নীলাম ক্রয় করা হইল। তিনি সমস্ত কার্য্য শেষ করিয়া কোন গৃহে বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। এমন সময়ে এক জন ইউরোপীয় ঐ নীলাম ক্রয় করিবার আশয়ে অতিশয় ব্যস্ততা সহকারে টালার অফিসে উপস্থিত হইলেন; কিন্তু তাঁহার অভিলষিত বিষয় এক জন বাঙ্গালী সরকারের হস্তগত হইয়াছে, অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলেন। তিনি দুঃখিত হইয়া চতুর্দ্দিক অবলোকন করিতে লাগিলেন। তাঁহার ভাব দর্শনে অনুমিত হইয়াছিল যে, ঐ জাহাজের সহিত তাঁহার কোন সম্বন্ধ আছে এবং তাহার বোঝাই দ্রব্যের বিষয় তিনি সবিশেষ অবগত আছেন। ক্ষণকাল অনুসন্ধানের পর রামদুলালের সাক্ষাৎ পাইলেন। তাঁহাকে প্রচুর গালিবর্ষণ পূর্ব্বক বিবিধ ভয়প্রদর্শন করিতে লাগিলেন। রামদুলাল তাহাতে ভীত হইবার লোক ছিলেন না। তিনি আপনার স্বত্ব উত্তমরূপ বুঝিতেন। ইউরোপীয় ভদ্রলোক, যখন বন্যজন্তুর ন্যায় ক্রোধপ্রকাশ করিতে ছিলেন, রামদুলাল তখন হাসিতে ছিলেন। প্রথমোক্ত যখন দেখিলেন, ক্রোধ ও ভয়প্রদর্শনে রামদুলালের মন বিচলিত হইল না, তখন তিনি আপনার স্বর পরিবর্ত্তন করিলেন। জাহাজ খানি লইবার জন্য রামদুলালকে লাভ দিতে চাহিলেন। রামদুলালের, ইহাতে অপিত্তি করিবার কারণ ছিল না। তিনি ইচ্ছানুরূপ লাভ পাইলে নীলাম ফিরাইয়া দিবেন স্বীকার করিলেন। সাহেব অনেক কস কসির পর ১৪,০০০ হাজার টাকার উপর প্রায় লক্ষ টাকা লাভ দিয়া জাহাজ লইলেন।
যে টাকা দ্বারা এতাদৃশ লাভ হইল, রামদুলালের প্রভু সে টাকার অধিকারী। যদিও মদনমোহন দত্ত স্বপ্নেও দেখেন নাই যে তিনি যে টাকা, কোন দ্রব্য ক্রয়ার্থ নিয়োজিত করিয়াছিলেন, তাঁহার সরকার সেই টাকা দ্বারা তাঁহার নামে এক জাহাজ ক্রয় করিয়াছে, যদিও রামদুলাল এখন এমন অবস্থাপন্ন হইয়া ছিলেন যে, লাভংশ গোপন করিয়া প্রভুর সমস্ত টাকা ফিরাইয়া দিতে পারিতেন; যদিও রামদুলালকে মাসিক দশ টাকা বেতনের জন্য প্রতিদিন বিবিধ বিপদের মুখে পড়িতে হইত; যে প্রলোভনে সামান্য লোককে নিশ্চয়ই বিপর্য্যস্ত করিয়া ফেলে, হঠাৎ বড় মানুষ হইবার সেই প্রলোভন, হতেও প্রচুর পরিমাণে ছিল; তথাপি এ লাভ মদনমোহন দত্ত ভিন্ন অন্য ব্যক্তির হওয়া উচিত কি না! ক্ষণকালের জন্যও এ চিন্তা রামদুলালকে আন্দোলিত করিতে পারে নাই। কারণ তাঁহার ধর্ম্মনীতি অত্যন্ত বলবতী ছিল, তাঁহার অন্তঃকরণ সকল প্রকার প্রবঞ্চনাকেই ঘৃণা করিত। তাঁহার ধর্ম্মনীতির পবিত্রতা বয়সের পরিপাকাবস্থায় একাদৃশ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইয়াছিল যে, তদ্দর্শনে উচ্চশ্রেণীস্থ ইউরোপীয়েরাও লজ্জিত হইতেন।
যাহা হউক, তিনি প্রাগুক্ত লাভ আত্মসাৎ করিবেন, এক বার মনেও করেন নাই; বরং প্রভুর অনুমতি ব্যতিরেকে তাঁহার অর্থ বিপদে ফেলিয়াছিলেন এবং এই ব্যাপারে তাঁহার দোষী হইবার সম্ভাবনা ছিল; এই রূপ ভাবিয়া অনুতাপিত হৃদয়ে অপরাধীর ন্যায় প্রভুসমীপে গমন করিলেন। কৃতাঞ্জলিপুটে সমুদয় যথাযথ নিদেন করিয়া স্বকীয় অবাধ্যতা প্রযুক্ত ক্ষমা প্রার্থনা করিলেন। এবং এক তাড়া ব্যাঙ্ক নোট্ তাঁহার চরণে নিক্ষেপ করিলেন। মদনমোহন পরপীড়নকারী সর্ব্বভুক্ ছিলেন না। তিনি ঐশ্বর্য্য-দর্শনসুখ ভোগ করিবার জন্য কোষপূর্ণ করিতেন না; তাঁহার অন্তঃকরণ ঔদার্য্যে পূর্ণ ছিল, তিনি কিয়ৎক্ষণ বিস্মিতভাবে রামদুলালের সরলতা দর্শন ও তাঁহার অসামান্য মহত্ত্ব চিন্তা করিয়া তাঁহাকে আশীর্ব্বাদ পূর্ব্বক কহিলেন;— “রামদুলাল, এ অর্থ তোমার, তোমার সৌভাগ্যই ইহা প্রেরণ করিয়াছে। তুমি বীজ বপন করিয়াছ, তুমিই তাহার ফল ভোগ কর।” রামদুলাল অত্যন্ত আহ্লাদের সহিত এ পুরস্কার গ্রহণ করিলেন। কিন্তু কিয়ৎ কাল তাঁহার মুখ হইতে কোন বাক্য নিঃসারিত হয় নাই। দশ টাকা মাহিয়ানার এক জন সরকারের পক্ষে ইহা কিছু কম ব্যাপার নহে। কিন্তু এতাদৃশ ভাগ্য পরিবর্ত্তনে তাঁহার মন পরিবর্ত্তিত হয় নাই। তিনি এই মূল ধন অবলম্বন করিয়া কলিকাতার মধ্যে অদ্বিতীয় ধনী হইয়াছিলেন; তথাপি মদনমোহন দত্ত যত দিন জীবিত ছিলেন, সামান্য চাকরের মধ্যগত হইয়া তাঁহার নিকট হইতে সেই দশ টাকা বেতন লইয়া আসিতেন। এবং এক দিনের জন্যও পূর্ব্ববৎ ভক্তি ও কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনে ত্রুটি করেন নাই। এমন কি! তিনি অত্যন্ত উন্নতির সময়েও পাদুকা ত্যাগ ও হস্তদ্বয় বক্ষবদ্ধ করিয়া মদন দত্তের গৃহে প্রবেশ করিতেন। ঐশ্বর্য লাভ বিষয়ে তাঁহার মনের ভাব এই রূপ ছিল যে, সৌভাগ্যের সময়ে দুর্ভাগ্যের দিন সকল মনে করা সকলেরই উচিত।
এই লক্ষ টাকাই রামদুলালের সকল সৌভাগ্যের মূল। তিনি এই টাকাটী, কেবল একটি বিশ্বাসের কার্য্য দ্বারা উপার্জ্জন করিয়াছিলেন, যে বিশ্বাস অধুনাতন বণিক সমাজে উপন্যাস হইয়াছে। বিবেচনা পূর্ব্বক ব্যবসায় দ্বারা তিনি ঐ টাকা এত বাড়াইয়াছিলেন যে, প্রতিদিন রাজার ন্যায় ব্যয় করিয়াও মৃত্যু কালে এক কোটি তেইশ লক্ষ টাকা রাখিয়া গিয়াছিলেন। কিন্তু এই বিপুল বিভব, তাঁহার উত্তরাধিকারিগণের অনভিজ্ঞতা, অক্ষমতা, এবং বিলাসলালসায়, এক্ষণে কয়েক লক্ষ টাকায় পেঁছিয়াছে। তাঁহার ভদ্রতা প্রযুক্ত, ক্রমে তিনি বণিক্ সম্প্রদায়ে প্রধান হইয়া উঠিলেন। তাঁহার উৎকৃষ্ট চরিত্র, মনুষ্যোচিত বিনয় এবং সূক্ষ্মতর দূর দর্শন অচিরকাল মধ্যে তাঁহাকে সকলের সম্মান ও অনুরাগের পাত্র করিয়া তুলিল। পূর্ব্বে তিনি যাহাদিগের সম্মুখে সামান্য চাকর ভাবে গমন করিতেন, এক্ষণে তাহাদিগের সমকক্ষ ভাবে বাণিজ্যাদি করিতে লাগিলেন।
এই সময়ে ১১৯০ সালে আমেরিকার প্রজাগণ ইংলণ্ডের অধীনতা ত্যাগ করিয়া স্বদেশে সাধারণতন্ত্র রাজ্যপ্রণালী স্থাপিত করে। এই উপলক্ষে যে ভয়ানক যুদ্ধ হয়, সেই যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই আমেরিকান্ নাবিকগণ ধন ও খ্যাতি লাভের প্রত্যাশায় সমুদ্র যাত্রা করে। রামদুলালই বঙ্গদেশে মার্কিন বাণিজ্যের পথ প্রদর্শক ছিলেন। এই সময়ে তিনি বাঙ্গালার বন্দর সকলে আমেরিকার মিলিত রাজ্যের বাণিজ্য আকর্ষণ করিবার জন্য অতিশয় কার্য্যদক্ষতা প্রকাশ করিতে লাগিলেন। তিনি আমেরিকার কাপ্তেনদিগকে রাশি রাশি অর্থ অগ্রিম দিতে লাগিলেন। সুবিবেচনা পূর্ব্বক বাণিজ্য দ্রব্য নির্ব্বাচন করিয়া তাহাদিগের জাহাজ পূর্ণ করিয়া দিতে লাগিলেন এবং অধিকতর লাভে তাহাদের আমদানী সকল বিক্রয় করিয়া দিতে লাগিলেন। এই সকল কার্য্যে এত লাভ হইতে লাগিল যে, তিনি শীঘ্রই বড় মানুষ হইয়া উঠিলেন। তিনি ক্রমে আমেরিকাস্থ সমস্ত বাণিজ্যাগারের এক মাত্র প্রতিনিধি হইয়া ছিলেন। তিনি কলিকাতানগরীতে নিজের না যে বিস্তৃত বাণিজ্যাগার স্থাপন করিয়াছিলেন, কি তাহা অদ্যাপি তাঁহার দৌহিত্র আশুতোষ দেবের তত্ত্বাবধানে বর্তমান আছে। বাণিজ্য বিষয়ে আমেরিকার সহিত তাঁহার কিরূপ সম্বন্ধ হইয়াছিল, পাঠক, গণের বিরক্তিকর হইবার শঙ্কায় এস্থলে তাহার বিশেষ বিবরণ দেয়য়া হইল না; কেবল তৎসংক্রান্ত দুই একটা গল্প করিয়া ক্ষান্ত হওয়া যাইবে।
আমেরিকায় তাঁহার এতাদৃশ সম্মান হইয়াছিল যে, এক জন পোতাধিকারী তাঁহার নামে নিজ জাহাজের নামকরণ করিয়াছিলেন এবং সেই জাহাজ খানি রামদুলালের জীবিত কালের মধ্যে তিন বার তাঁহার নিকট প্রেরিত হইয়া ছিল।
কোন সময়ে আমেরিকার কতকগুলি প্রধান বণিক্ তত্রত্য প্রধান সেনাপতি ওয়াসিংটনের শরীর পরিমিত এক চিত্র, সম্মান ও স্নেহের চিহ্ন স্বরূপ রামদুলালকে উপহার দিয়াছিলেন। এই চিত্র অদ্যাপি আশুতোষ দেবের আফিসে দেখিতে পাওয়া যায়। কোন বাঙ্গালী কস্মিন্ কালে কোন মহাদেশের বণিক্ সম্প্রদায় কর্ত্তৃক এরূপে সমাদৃত হন নাই।
রামদুলাল বিবিধ গুণগ্রামে সকল সময়ের সকল শ্রেণীস্থ লোকের অনুরাগ ভাজন হইয়াছিলেন। তাঁহার জন্যই আমেরিকার অধিবাসিগণ, হিন্দু জাতির প্রতি প্রথম সন্মান করিতে শিক্ষা করেন। তিনি যে কেবল আমেরিকার নিকটেই এত সম্মান লাভ করিয়া ছিলেন, তাহা নহে। ইংলণ্ড ফিলিপাইন, চীন্ প্রভৃতি বহুতর প্রদেশীয় বণিক্ সম্প্রদায়ের মাননীয় প্রতিনিধি হইয়া ছিলেন। ইহা ব্যতীত তাঁহার নিজের কাজ ও বিলক্ষণ বিস্তৃত ছিল। কি আশ্চর্য! এত কার্যের মধ্যেও তিনি তৎকালীন সর্ব্বপ্রধান ইউরোপীয় বাণিজ্যাগারের মুচ্ছদ্দি হইয়াছিলেন। ঐ ফার্লি ফরণ্ডসন কোম্পানির হাউসের কার্য্য বিবরণ শ্রবণ করিলে বিস্মিত হইতে হয়। ঐ কোম্পানি এক এক করে লক্ষ বস্তা চাউল জাহাজ বোঝাই করিতেন। চিনি রপ্তানি করিলে এদেশীয় চিনির বাজার নিঃশেষিত হইয়া যাইত। ঐ হাউসের দালালেরা বাজারে কোন দ্রব্য ক্রয় করিতে গেলে, ঐ দ্রব্য ক্রয় করিতে তৎকালীন আর কোন হাউসের সাহস হইত না। এখন কলিকাতায় যে সকল ইউরোপীয় বাণিজ্যাগার বর্ত্তমান আছে, তাহার পঞ্চাশটীর কার্য্য একত্রিত করিলে যত হয়; তাদৃশ কার্য্যবিশিষ্ট তিন চারিটী হাউস্ তৎকালে কলিকাতায় ছিল; কিন্তু রামদুলাল যে হাউসের মুচ্ছদ্দি ছিলেন, তাহা সে সমুদায় অপেক্ষাও প্রধান ছিল। রামদুলাল যে সে বাজারে ঋণ করিতেন; তাঁহার কথাকেই লোকে স্ট্যাম্পলিখিত খতের স্বরূপ মনে করিত। তাঁহার কিঞ্চিন্মাত্র অমনোযোগে বাজার বিশৃঙ্খল হইত। তাঁহার পরামর্শ লইয়া কাজ করিত না, তৎকালে এমন বণিক্ প্রায় ছিল না।
তৎকালের অন্যতম হাউসের এক জন ক্লার্ক আশুতোষ দেবকে এক পত্র লিখিয়াছিলেন। তাহাতে এইরূপ লেখা আছে যে, তিনি হাউসের অংশিগণকে, রামদুলালের আগমনে চেয়ার ছাড়িয়া উঠিতে এবং তাঁহার সহিত সকল বিষয়ের পরামর্শ করিতে দেখিয়াছেন। তিনি আরও বলেন যে, রামদুলালের ন্যায় মুচ্ছদ্দি, কাজের লোক, দয়ালু ও বদান্য তৎকালে কেহই ছিল না। কোন ব্যক্তি আপনার নিমিত্ত তাঁহাকে যাহা করিতে বলিত, তিনি তাহার নিমিত্ত তাহাই করিতে প্রস্তুত হইতেন।
রামদুলাল জাতিবিশেষের প্রতি বদান্য ছিলেন না; তাঁহার অন্তঃকরণ এত প্রশস্ত ছিল যে, সমস্ত বিশ্বের উপকার করিয়াও পরিতৃপ্ত হইতনা। ইহার প্রমাণ পক্ষে ইহা বলিলেই পর্য্যাপ্ত হইবে যে এক ইউরোপীয় দিগকেই তিনি ৩৩০০০০০ তেত্রিশ লক্ষ টাকা কর্জ দিয়াছিলেন। উহা আদায়ের জন্য কখন কোন পীড়া পীড়ি করা হয় নাই। উহার অধিকাংশ অদ্যাপি অনাদায় রহিয়াছে। তিনি সমস্ত পৃথিবীর নিমিত্ত জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন, তদন্তর্গত কোন ক্ষুদ্রাংশের নিমিত্ত নহে। পৃথিবীই তাঁহার গৃহ এবং সৃষ্টিই তাহার জাতি। সাইথিয়ান দূতমহাবীর আলেক্ জাণ্ডরের নিকট একটী অদ্ভুত মনুষ্যের বর্ণনা করিয়াছিলেন। তাহার দক্ষিণ হস্ত পশ্চিম সমুদ্র এবং বামহস্ত পূর্ব সমুদ্র স্পর্শ করিয়া আছে, মস্তক উত্তর মেরুভেদ ও পদ দক্ষিণ মেরু দলন করিয়াছে। রাম দুলাল সেইরূপ মনুষ্য। এতাদৃশ ব্যক্তির চরিত্র পর্য্যালোচনায় অমানুষেও মনুষ্যত্বের সঞ্চার হয়।
যে অপোগন্ত বালককে তাহার মাতামহ দৈনিক মুষ্টি ভিক্ষার দ্বারা প্রতিপালন করিতেন, এক্ষণে সেই বালক বঙ্গ রাজ্যের এক জন প্রধান হইলেন। তাঁহার নিজের চারি খানি বানিজ্য জাহাজ ছিল। তন্মধ্যে এক খানি আপনার নামে, এক খানি প্রিয়তমা জ্যেষ্ঠা কন্যা বিমলার নামে, এক খানি ফার্লি ফরগুসন্ কোম্পানির এক জন প্রধান অংশী ডেবিড ক্লার্কের নামে অভিহিত হইত। চতুর্থ জাহাজ খানির কোন বিশেষ নাম ছিলনা। কিন্তু সেখানি, আমেরিকা, ইংলণ্ড চীন্ এবং মাল্টা এই সকল স্থানে দ্রব্য লইয়া যাতায়াত করিত। বাজারে তাঁহার সম্মানের সীমাছিল না। সমকালীন প্রধান ২ বণিকেরা তাঁহার পরামর্শ ও সাহায্য, যত্ন পূর্ব্বক গ্রহণ করিতেন। কোন সময়ে কলিকাতার কয়েকটি বড় ২ হাউস্ দেউলিয়া হইয়াছিল। ঐ সময়ে রাম দুলালেরও ২৫০০০০০ পচিশ লক্ষ টাকা ক্ষতি হয়। কিন্তু ঐ ক্ষতিতে তাঁহার কারবারের কোন হানি হয় নাই। এই বিষয় উপলক্ষে ইংলণ্ডের কোন সম্পাদক রাম দুলালের পুত্র দিগকে বাঙ্গালার রথ চাইল্ড্[২] বলিয়াছিলেন। রাম দুলাল যাহা স্পর্শ করিতেন, তাহাই স্বর্ণ হইত। বোধ হয়, রাম দুলালের নিকট যথার্থই স্পর্শমণি ছিল।
কোন সময়ে তিনি কতক গুলি কাচের বাসন ক্রয় করিয়াছিলেন। উহা ক্রয় করিয়া যে, লাভ হইবে, কলিকাতার কোন বণিক তাহা এক বার মনেও করেন মাই। হঠাৎ মান্দ্রাজে ঐ দ্রব্যের অত্যন্ত প্রয়োজন হওয়াতে, রাম দুলাল ইচ্ছানুরূপ লাভ লইয়া উহ বিক্রয় করিলেন।
আর এক সময় অনেক টাকার গোল মরিচ ক্রয় করিয়াছিলেন। ঐ সময়ে, ঐ জিনিসের বাজার অত্যন্ত নরম ছিল। কিছু দিন পরে কোন বিদেশে উহার অধিক দর উঠিল। রাম দুলাল চারি গুণ লাভে সমস্ত মরিচ বিক্রয় করিয়া ফেলিলেন। এই বাণিজ্য ব্যাপারের সহিত সংসৃষ্ট একটা গল্প প্রসিদ্ধ আছে, যদ্বারা, রামদুলাল কি ধাতুর মানুষ ছিলেন এবং সত্যের প্রতি তাঁহার কীদৃশ গড়ানুরাগ ছিল, তাহা উত্তম রূপে জানা যাইবে।
যখন রামদুলাল আপনার ক্রীত রাশীকৃত মরিচ। বিক্রয়ার্থ রক্ষা করিতেছিলেন, এবং যাহা বিক্রয় হইবে কিনা সে বিষয়ে লোকে সংশয় করিতেছিল; সেই সময়ে এক জন ইউরোপীয় তাঁহার নিকট বহু সহস্র মন মরিচ বন্ধক রাখিয়া টাকা ঋণ লইবার প্রস্তাব করেন। রাম দুলাল বলিলেন, উপযুক্ত মূল্যে সাহেবের সমস্ত মরিচ তিনি ক্রয় করিতে প্রস্তুত আছেন, বন্ধক রাখিয়া টাকা দিবেন না। কারণ তিনি ভাবিয়া ছিলেন যে, সাহেবের মরিচ গুলি কোষসাৎ করিতে পারিলেই মরিচের বাজার তাঁহার একচেটে করা হইবে। তাদৃশ ক্ষমতাপন্ন ও চতুর বণিকের মুখে ঐ কথা শুনিয়া মরিচ ছাড়িতে সাহেবের সাহস হইল না। তিনি অনেক ক্ষণ ভাবিয়া শেষে, বিবেচনা করিবার সময় লইয়া প্রস্থান করিলেন। ইতিমধ্যে কলিকাতায় মরিচের বাজার উঠিল। রামদুলাল, মরিচে যে টাকা নিয়োজিত করিয়াছিলেন, তাহার চার গুণ লাভ লইয়া সমস্ত মরিচ বিক্রয় করিয়া ফেলিলেন। কিছু দিন পরে, পূর্ব্বোক্ত সাহেব রামদুলালের নিকট আসিয়া পূর্ব্ব বাজারদরে তাহার সমস্ত মরিচ বিক্রয় করিলেন। এই বিক্রয়, এমন যথা বিহিত রূপে হইয়াছিল যে, রামদুলাল তাঁহার মরিচ হইতে যথেষ্ট লাভ করিয়াছেন সাহেব পরে ইহা জানিতে পারিলেও, কিছু করিতে পারিতেন না। যাহা হউক সাহেব যখন দেখিলেন যে, তাহার হিসাবে যত টাকা প্রাপ্য; রামদুলাল, তাঁহাকে তদপেক্ষা অধিক টাকা দিতেছেন; তখন তিনি বিস্মিত হইয়া, রামদুলালের ভ্রম হইতেছে কিনা এই বিষয় পুনঃ২ জিজ্ঞাসা করিতে নাগিলেন। রামদুলাল অবিলম্বে তাহার ভ্রম ভঞ্জন করিয়াদিলেন। তখন সাহেব বহু লক্ষ টাকা লাভ করিয়া রামদুলালকে শত ২ ধন্যবাদ দিয়া প্রস্থান করিলেন। রামদুলালের এই সাধুতা সমস্তু স্বদেশে ব্যাপ্ত হইয়া পরিশেষে সমুদ্রে তরঙ্গায়িত হইয়াছিল।
রামদুলাল নিজে যেরূপ চরিত্রের লোক ছিলেন, তাঁহার সহকারী ও সহচর গণের মধ্যেও দুই একজন সেরূপ লোক দেখা যাইত। কাশীনাথ ঘোষ নামক কোন ব্যক্তি তাঁহার প্রধান সহকারী ছিলেন। তিনি একদা গবর্ণমেণ্টের সুরতিতে ৫০০০০ পঞ্চাশ হাজার টাকা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। রামদুলাল বন্ধুর সৌভাগ্যে আনন্দ প্রকাশ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, তিনি এই টাকা কোন্ কার্য্যে নিয়োজিত করিবেন। কাশীনাথ বলিলেন, ঐ টাকার কেবল চতুর্থাংশ আমার, অবশিষ্ট তিন অংশ, আমার তিনজন মোহরের পাইবেন। কারণ তাঁহাদিগের নিকট ঋণ করিয়া টিকিট্ ক্রয় করিয়াছিলাম। কিন্তু ঐ মোহরের তিনজন ইহার বিন্দু বিসর্গ অবগত ছিলেননা।
বোধ হয়, কাশীনাথ কেবল মাত্র আপনার ভাগ্যের উপর নির্ভর না করিয়া, চারিজনের নামে টীকিট ক্রয় করিয়াছিলেন। ইহার মধ্যে একজনের ভাগ্য অবশ্য প্রসন্ন হইবে, তাঁহার মনে এরূপ বিশ্বাস ছিল। রামদুলাল কাশীনাথের সত্যানুরাগ দেখিয়া বিস্মিত হইলেন। এই সকল প্রাচীন বাঙ্গালিদিগের চরিত্র সর্ব্বদা সকলেরই অনুকরণীয়।
যে জলমগ্ন জাহাজ ক্রয় হইতে রামদুলালের ঐশ্বর্য্য হইতে আরম্ভ হয়, সেই, জাহাজ ক্রয়ের কয়েক মাস পূর্ব্বে মূলা যোড়ের কোন সর্ব্বলক্ষণ সম্পন্না রমণীর সহিত তাঁহার বিবাহ হয়। বঙ্গদেশে ‘‘স্ত্রী ভাগ্যে ঐশ্বর্য্য ও স্বামী ভাগ্যে পুত্র লাভ হয়।” এইরূপ একটি প্রবাদ আছে। বিবাহের পর হইতেই রামদুলালের অনবরত ঐশ্বর্য্য লাভ হুইতে দেখিয়া ঐ প্রবাদের সত্যতায় লোকের বিশ্বাস হইল। রামদুলাল যেমন অপরিমিত অর্থ উপার্জ্জন করতে লাগিলেন, গৃহিণী সেই রূপ পরিমিত ভাবেই ব্যয় করিতে আরম্ভ করিলেন।
কোন সময়ে রামদুলাল অনেক বস্তা উৎকৃষ্ট বনাত ক্রয় করিয়াছিলেন। ঐ বনাতের দুই পৃষ্ঠা, ভিন্ন২ রং বিশিষ্ট। বিলাতের সঙ্গে, বঙ্গদেশের বাণিজ্য আরম্ভ হইয়া অবধি এদেশে আর কখন এরূপ বনাতের অমদানি হয় নাই। রামদুলাল ঐ বনাতের একচেটে করিয়া মনে সঙ্কল্প করিলেন যে, যখন ইচ্ছা তখন আপনার অভিপ্রেত দরে উহা বিক্রয় করিবেন। এইরূপ স্থির করিয়া আপনার গৃহ স্থিত নিরাপদ ভাণ্ডারে উহা রাখিয়া দিলেন। ঐ বনাতের গজ ৩০ ত্রিশ টাকা। যখন এদেশীয় লোক দিগের টাকা কড়ি তত অধিক ছিলনা, তখন একখানা বনাতের দাম ৯০ নব্বই টাকা, ইহা কিছু কম কথা নহে। যাহা হউক, কিছু দিন পরে একদা শীতকালের প্রত্যুষে রামদুলাল বারেণ্ডায় মুখ প্রক্ষালন করিতে হিলেন, দেখিলেন, কয়েক জন ব্রাহ্মণ প্রাতঃস্নান করিয়া উক্ত বনাতে গাত্র আবরণ পূর্ব্বক তাঁহার সম্মুখবর্ত্তী পথে গমন করিতেছে। রামদুলালের স্থির বিশ্বাস ছিল যে, তিনি উহার একচেটে করিয়াছেন। এখন হঠাৎ অন্য লোকের গাত্রে ঐ বনাত দেখিয়া উদ্বিগ্ন হইলেন। সে দিন অফিসে গিয়াই দালাল দিগকে ডাকিলেন। কার্য্যে অমনোযোগ নিবন্ধন তাঁহাদিগকে তিরস্কার করিলেন এবং এই বলিয়া বাজারে পাঠাইয়া দিলেন, এ বনাতের যতটুকু যেখানে যে মূল্যে পাইবে, সমুদায় ক্রয় করিয়া আনিবে। কিন্তু দালাল গণ সমস্ত দিন বৃথা ভ্রমণ করিয়া সন্ধ্যাকালে প্রত্যাগত হইল। কহিল, বাজারের কুত্রাপি অঙ্গুলি পরিমিত এ বনাত পাওয়া যায়না; এবং বিগত তিন মাস হইতে পাওয়া যাইতেছেনা। রামদুলাল, আপন চক্ষুকে অবিশ্বাস করিতে পারেননা। সুতরাং বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “যদি ইহা বাজার হইতে না আসিল, তবে কি আকাশ হইতে পড়িল?”
রামদুলাল অনেক ক্ষণ গঢ়রূপে এই বিষয় চিন্তা করিয়া গৃহে গমন করিলেন এবং কোষ পর্য্যবেক্ষণার্থ গমন করিবা মাত্র সব জানিতে পারিলেন। রামদুলাল যখন বনাত বিক্রয়ের লাত গণনা করিতেছিলেন, তখন তাঁহার দয়াশীলা গৃহিণী শীতার্ত্ত ব্রাহ্মণ গণের ক্লেশ ভাবিতেছিলেন। মাঘ মাসের প্রাতঃকালে স্নান করিয়া ব্রাহ্মণেরা কত ক্লেশ পান এবং তৎকালে এই বনাত গায় দিতে পাইলে কত সুখানুভব করেন, রামদুলালের গৃহিণী তখন তাহাই ভাবিতেছিলেন। এইরূপ ভাবিয়া, সেই ধর্ম্মবীরা রমণী একদা স্বামীর, এমন কি দাস দাসী গণের ও অজ্ঞাতে কোষ হইতে কয়েকটা বস্তা বাহির করিলেন এবং স্বহস্তে এক২ খণ্ড চার কাটিয়া প্রতিবেশবাসী এক শত ব্রাহ্মণকে দান করিলেন। রামদুলাল সেই সকল ব্রাহ্মণকেই বনাত গায় দিয়া যাইতে দেখিয়াছিলেন। যাহা হউক, তিনি এই বিষয় অবগত হইয়া স্ত্রীকে একটা কথাও বলিলেন না। রামদুলাল যেমন মহানুভব, স্ত্রীও সর্বাংশে তাঁহার অনুরূপ ছিলেন। তাঁহার অজ্ঞাতে এই স্ত্রী কর্ত্তৃক যে মহৎ কার্য্যের আরম্ভ হইয়াছিল, তিনি পর দিন প্রাতে তাহা সম্পূর্ণ করিলেন; সেই মূল্যবান ও উৎকৃষ্ট বনাতের অবশিষ্ট, প্রতিবেশী ও বন্ধুগণের মধ্যে বিতরণ করিয়া দিলেন।
আর এক সময়ে রামদুলাল অনেক টাকা দিয়া ৬০০ শত বস্তা উৎকৃষ্ট চিনি ক্রয় করিয়া পূর্বোক্ত কোষে রাখিয়া ছিলেন। ইহার কিছু দিন পরে তাঁহার স্ত্রী তিন মাস ক্রমাগত পুরাণ পাঠ করান। এই উপলক্ষে তাঁহার গৃহে প্রতিদিন সহস্র ২ স্ত্রী লোক উপস্থিত হইতে লাগিলেন। তিনি এই বহুসংখ্য শ্রোত্রীকে তিনমাস যাবৎ উক্ত চিনির সরবৎ পান করালেন। প্রায় সমুদায় চিনিই এই ব্যাপারে জলসাৎ হইল। কেবল ৪০ বস্তামাত্র অবশিষ্ট রহিল।
এ দিকে সুবিধা পাইয়া রামদুলাল সমস্ত চিনি বিক্রয় করিয়া ফেলিলেন। এবং ক্রেতাকে ঐ চিনি ওজন দিবার নিমিত্ত বাড়ীতে দালাল পাঠাইলেন প্রেরিত ব্যক্তি, অবিলম্বে প্রত্যাগত হইয়া তাঁহাকে জানাইল যে, ভাণ্ডারে ৪০ বস্তার অধিক চিনি নাই, অবশিষ্ট ৫৬০ বস্তা গৃহস্বামিনী নষ্ট করিয়াছেন। রামদুলাল বিস্মিত হইলেন। যদিও গৃহিণী কি প্রকৃতির লোক, বনাতের সময় বেশ জানা ছিল, তথাপি এবার তাঁহার বিরক্ত হইবার প্রচুর কারণ উপস্থিত হয়। যেহেতু ঐ চিনি অন্যের নিকট বিক্রয় করিয়াছিলেন, এবং ঐ স্বীকৃতি পালনে অসমর্থ হইয়া। ক্রেতার ক্ষতিপূরণ করতে বাধিত হইয়াছিলেন। এই জন্য অফিসের পর সন্ধ্যাকালে গৃহে গমন করিয়া বরাবর স্ত্রীর নিকটে গেলেন এবং তিনি অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করিয়াছেন বলিয়া ক্রোধভরে তাঁহাকে তিরস্কার করিতে লাগিলেন। ক্রোধের আতিশয্যে তিরস্কার করিতে ২ তাঁহাকে সৌভাগ্যের শণি বলিয়াছিলেন। গৃহিণী স্বামীকৃত পূর্ব্ব তিরস্কার সমস্ত সহ্য করিয়াছিলেন। কিন্তু “সৌভাগ্যের শণি” এটী তাঁহার সহ্য হইল না। কারণ তিনি বিশ্বাস করিতেন, তাঁহার ভাগ্যই, রামদুলালকে সিপ্সরকারের ঘৃণিত পদ হইতে তাদৃশ গৌরবান্বিত পদে উন্নত করিয়াছে। সুতরাং পূর্ব্বোক্ত তিরস্কার বাক্যটা তাঁহার অন্তরে ছুরিকাবিদ্ধ হইল। অবিলম্বে তাঁহার লোচনদ্বয় অশ্রুপূর্ণ হইল;—“আমি তোমার সৌভাগ্যের শণি?” অনুচ্চৈঃস্বরে পুনরাবৃত্তি করিয়া ক্রোধোন্মত্তার ন্যায় শয়ন গৃহে গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিলেন।
রামদুলাল পূর্ব্বোক্ত ঘটনায় যাদৃশ ক্রোধান্ধ হইয়াছিলেন, তাঁহার ৭৩ বৎসর পরিমিত দীর্ঘ জীবনের মধ্যে কখনই সেরূপ হয়েন নাই। যে বয়সে সামান্য লোকেরা স্বভাবতঃ ক্রোধন ও দুর্বৃত্ত হয়, রামদুলাল সে সময়ে সম্পূর্ণ বিনয়ী, কোমল ও সাধু স্বভাব ছিলেন। সর্ব্বপ্রকার গালির মধ্যে তিনি কেবল “মহাপাত্র”এই তিরস্কার বচনটী জানিতেন। কাহার প্রতি অত্যন্ত ক্রোধান্ধ হইলে তাহাকে “মহাপাত্র” বলিয়া গালি দিতেন। সুতরাং দুর্ব্বাক্য দ্বারা স্ত্রীর মনে ব্যথা দিয়া পরিশেষে স্বয়ং যার পর নাই ক্ষুব্ধ ও অনুতাপিত হইলেন। যাহা হউক, অনেক যত্নে এবং নগদ একলক্ষ টাকা দিয়া তাহাকে শান্ত করলেন।
ঐ রমণীর চরিত্র পাঠে বোধ হয়, তিনি যেন কোন উৎকৃষ্ট কাব্যের কল্পিত নায়িকা। বাস্তবিক তাদৃশী নারী জীবিতা ছিলেন কিনা সন্দেহ উপস্থিত হয়। একদা কোন ব্যক্তি তাঁহার রত্নাভরণ চুরি করিয়া ধৃত হয়। তিনি, চোর নিতান্ত জ্বালায় না পড়িয়া চুরি করে নাই, এইরূপ অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়া সমস্ত স্তেয়ের সহিত তাহাকে ছাডিয়া দিতে আদেশ করিলেন। রামদুলালের স্ত্রীর চরিত্র সম্বন্ধে এইরূপ আখ্যান অনেক আছে; কিন্তু সংক্ষিপ্ততা এই গ্রন্থের একটি উদ্দেশ্য বলিয়া সে সকল পরিত্যক্ত হইল। কেবল যে সকলের সহিত রামদুলালের সংস্রব আছে, সেই রূপ দুই একটা অখ্যায়িকা লিখিত হইয়াছে; এবং পরে আবশ্যক হইলে আরও দুই একটি লিখিত হইবে।
রামদুলাল দারান্তর গ্রহণে বাধিত হইয়াছিলেন, যেহেতু তাঁহার প্রথম স্ত্রীর গর্ভে একটী কন্যা এবং অন্ধ পুত্র মাত্র জম্মিয়া ছিল। ঐ অন্ধ পুত্রটাও সাত বৎসর বয়সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এই সময়েই তাঁহার ঐশ্বর্য্য আরও অধিক বাড়িয়া উঠে। তাঁহার প্রথমা ও প্রিয়তমা পত্নীই তাঁহাকে পুনর্ব্বার পুত্র সন্তান দান করিবেন, তাঁহার এরূপ আশা ও বিশ্বাস ছিল। কিন্তু সে আশা বিফল হইল। তাঁহার মরণান্তে এই বিপুল বিভব পরের হস্তগত হইবে এবং পুত্রাভাবে পুন্নাম নরকে পতিত হইবেন, এই চিন্তা ও ভয়ে তাঁহাকে ব্যাকুল করিয়া তুলিল। অনন্তর শাস্ত্রবিদ্ ও বন্ধুবর্গের পরামর্শে প্রথমা স্ত্রীর অজ্ঞাতে দ্বিতীয় দারগ্রহণ করিয়া তাঁহাকে স্বতন্ত্র গৃহে রাখিয়া দিলেন। তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রীর গর্ভে যে সকল সন্তান হইয়াছিল, সকলই ঐ পৃথক বাটিতে জন্ম গ্রহণ করে। প্রথমা, ক্রমে এই সকল ব্যাপার অবগত হইয়া কখন স্ত্রীত্ব, কখন মনুষ্যত্ব প্রকাশ করিয়া অবশিষ্ট জীবন যাপন করিয়াছিলেন।
রামদুলালের চাল চলন অতি সামান্য ছিল। তাঁহার প্রাত্যহিক আহার দিনমানে অন্ন, তরকারী, অল্প পরিমিত দুগ্ধ ও মিষ্ট। রাত্রে ভাতের বদলে কয়েকখান রুটী মাত্র। কলিকাতার প্রধান বণিকের আসন ত্যাগ করিয়া যাঁহার সম্মান করিতেন, সেই রামদুলালের পরিচ্ছদ অতি সামান্য ছিল। সামান্য ধুতি, ফানেলের ব্যানিয়ন, লংক্লথের ছোট চাপ্ কান্ এবং মাতায় জড়াইবার কয়েক গজ কাপড়, এই মাত্র তাঁহার পরিচ্ছদ ছিল। বর্ত্তমান কালের বড় মানুষের যে অবস্থায় ছয় বা আট ঘোড়ার গাড়ী রাখেন, তিনি সে অবস্থায় পালকী ব্যবহার করিতেন। কোন ব্যক্তি একদা তাঁহাকে গাড়ী রাখিতে অনুরোধ করায় তিনি বলিলেন যে, নিকৃষ্ট পশু অপেক্ষা মনুষ্য পোষণের উপায় বিধান করা অগ্রে কর্ত্তব্য। পরিশেষে পরিজন গণের অনুরোধে যখন গাড়ী রাখা হয়, তখন পথিকের পীড়া শঙ্কায়, চালককে কখনই কোচ্বাক্সে বসিয়া গাড়ী চালাইতে দিতেন না। কোচ্ম্যান্ অশ্বের বলগা ধারণ পূর্ব্বক নগর পথে শকট চালন করিত। তিনি নিকৃষ্ট জীবগণের প্রতি সদয় ব্যবহার করিতেও উদাসীন ছিলেন না। একদিন লিখিতেছেন, হটাৎ শুনিতে পাইলেন, জনৈক পরিজন অশ্বগণের প্রতি অত্যাচার করিতেছে। লেখনী পরিত্যাগ পূর্ব্বক তৎক্ষণাৎ মন্দুরায় গমন করিলেন; দেখিলেন, একটী অশ্বের প্রতি অত্যাচার কৃত হইয়াছে, আর একটি রজ্জু বদ্ধ হইয়া ভূপতিত আছে। তাঁহার পদশব্দ পাইবা মাত্র, অত্যাচারী ব্যক্তি পলায়ন করিল। রামদুলাল স্বহস্তে ঐ অশ্বকে বন্ধনমুক্ত করিলেন এবং পরিজনের এতাদৃশ নৃশংসাচার ও অধঃপতন ভাবিয়া সমস্ত দিন ক্রন্দন করিলেন।
রামদুলালের বদান্যতাও অসামান্য। অধিকতর সুখ্যাতির বিষয় এই, রাশি ২ দান করিতেন, তাহার কোন আড়ম্বর ছিল না। তাঁহার সময়ে মান্দ্রাজে একবার ভয়ানক দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হয়। ঐ দুর্ভিক্ষে সাহায্য দিবার জন্য কলিকাতা মহানগরীতে চাঁদা সংগ্রহের এক সভা হয়। রামদুলাল ঐ সভায় লক্ষ টাকা দান করেন। হিন্দুকলেজ প্রতিষ্ঠাকালে তিনি ৩০০০ তিন হাজার টাকা দান করেন। এতদ্ব্যতীত তিনি প্রতিদিন অফিসে বসিয়া ৭০ টাকা দান করিতেন। প্রায় চারিশত দরিদ্র প্রতিবেশীকে প্রতিদিন আহার দিতেন। তাঁহার নিকট সর্ব্বদাই অনেক কর্ম্মার্থী উপস্থিত থাকিত। তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সহিত ঐ উমেদার গণের অভাব অনুসন্ধান করিতেন। কোন ২ ব্যক্তিকে পরিবার পালনে সমর্থ করিবার জন্য তাহাদের বাসায় ব্যাঙ্কনোট্ প্রেরণ করিতেন; কিন্তু নোট্ কোথা হইতে আসিল, তাহারা তাহার কিছুই জানিতে পারিত না। কখন বা কাহার হাতে, তাহার বাড়ী হইতে আসিয়াছে বলিয়া, একখানি পত্র দিতেন। সে পত্র খুলিতে উদ্যত হইলে, শান্তভাবে কহিতেন;—“এই পত্র মধ্যে মন্দ সম্বাদ থাকিতে পারে, বিদেশীয় গণের সম্মুখে শোকমোহ জনক সম্বাদ পাঠ করা উচিত নহে। বাসায় গিয়া পত্র পাঠ করিও।” বাসায় গিয়া ঐ ব্যক্তি পত্র খুলিবামাত্র দেখিতে পাইত তন্মধ্যে ৫০, ৬০ কিম্বা ১০০ এক শত টাকার ব্যাঙ্ক নোট রহিয়াছে। তাহার বিস্ময়ের সীমা থাকিত না। কোন ব্যক্তিকেই রামদুলালের নিকট বিফল প্রার্থনা করিতে হইত না। পরদুঃখ মোচনের ইচ্ছা, তাঁহার এত বলবতী ছিল যে, তিনি পরের দুঃখ অনুসন্ধান জন্য বেতন-ভুক্ চাকর নিযুক্ত করিয়াছিলেন। তিন জন দেশীয় চিকিৎসক, রামদুলালের ব্যয়ে পল্লীর পীড়িত গণের চিকিৎসা ও ঔষধ দানে নিযুক্ত ছিল। তিনি স্বয়ং প্রতি রবিবারে সহচরগণ সমভিব্যাহারে প্রতিবেশী ও ভৃত্যগণের গৃহে ২ ভ্রমণ করিয়া তাহাদের অভাব ও দুঃখ দেখিতেন। এইরূপ অসাধারণ সদয় ব্যবহার দ্বারা তিনি সকল শ্রেণীর প্রিয় ও প্রতিবাসিগণের পিতা স্বরূপ হইয়াছিলেন।
ক্ষুধার্ত্তকে অন্ন ও পীড়িতকে ঔষধ পথ্য দান এবং বিপন্নকে বিপদুর্দ্ধার করা ইত্যাদি বিষয়ে অর্থ ব্যয়কেই সচরাচর লোকে উৎকৃষ্ট দান বলিয়া থাকে। যাহার সৎকার্য্যে দান করিবার ইচ্ছা থাকে, তিনি উপরি উক্ত বিষয় সকলেই দান করিয়া থাকেন। রামদুলালের দানপ্রণালী ইহাপেক্ষাও উদার ছিল। এ সকলত ছিলই; ইহা ব্যতীত অন্যান্য স্থায়ী বিষয়েও তাঁহার অনেক দান ছিল। ইহার কয়েকটি উদাহরণ পূর্ব্বে দেওয়া গিয়াছে। আর একটা এই; তাঁহার জনৈক বন্ধু ও কর্ম্মচারী কাশীনাথ ঘোষ নামক কোন ব্যক্তি রামদুলালের গৃহ পুষ্করিণীর ধারে একটি একফুট মাত্র প্রশস্ত কোটার ভিত্ নির্ম্মণ করিতেছিলেন। রামদুলাল তদ্দর্শনে কাশীনাথকে অধিকতর দৃঢ় করিয়া ভিত্তি নির্ম্মণ করিবার পরামর্শ দিলেন। কাশীনাথ, তাঁহার পরামর্শানুরূপ কাজ করিতে অসমর্থ, এই অভিপ্রায় প্রকাশ করায়, তিনি নিজ ব্যয়ে কাশীনাথের যাবতীয় নিম্ন-ভিত্তি রচনা করিয়া দিলেন। উহাতে তাঁহার প্রায় ৫০০০ পাঁচ হাজার টাকা ব্যয় হয়।
বরফ প্রস্তুত করিবার জন্য বর্ণ-হীন শরাবে জল রাখিয়া শীতকালের রজনীতে উপযুক্ত স্থানে রাখা হয়। কখন ২ ঐ জল উপযুক্ত পরিমাণে শীতল হইয়াও কঠিন হয় না। হটাৎ জলটী নাড়িয়া দিলে তৎক্ষণাৎ জমিয়া। যায়। রামদুলালের চরিত্রে ঠিক এইরূপ একটি উদাহরণ আছে। যেন তাঁহার মন, একটি মহৎ কার্য্য সাধনে উন্মুখ হইয়াও কোন অপরিজ্ঞাত কারণে তাহা হইতে নিবৃত্ত ছিল; পরে একটি আকস্মিক ঘটনাসূত্রে কার্য্য সাধনে প্রবৃত্ত হইল। তিনি একদিন আপন বাড়ীর খোলা ছাদে বসিয়া আছেন। কাশী সরকার নামক একজন বাতুল আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার পিতার নামও রামদুলাল সরকার। এ রামদুলাল, নুতন রামদুলালের পূর্ব্বতন অধিবাসী। প্রতিবেশীগণ, নূতন রামদুলাল হইতে পৃথক্ করিবার জন্য তাহাকে পচা রামদুলাল বলিত। বাতুল ক্রোরপতিকে কহিল,— “রামদুলাল, ও—রামদুলাল, তুমিই আমার পিতাকে পচা রামদুলাল করিয়াছ। তুমি খ্যাতি ও সম্পত্তি উপার্জন করিয়াছ। এই দিকে দেখ! দেখি! আমার পদতলে কি?” অসংখ্য পিপীলিকা ধরিয়াছে, এমন একটি মৃত কপোত পথে পড়িয়াছিল, বাতুল তাহাই দেখাইল। রামদুলালের জনৈক পারিসদ বলিয়া উঠিলেন, “তুই পাগল, দেখিতেছিস না;—এ,—একটা মৃত কপোত?” বাতুল উত্তর করিল,—“পাজি, তুই চুপকর; তোকে আমি জিজ্ঞাসা করি নাই।” রামদুলাল, উত্তম রূপে দেখিয়া স্মিত মুখে কহিলেন,—“কাশী এটি মৃত কপোত নয় ত কি?”, বাতুল পুনর্ব্বার উত্তর করিল,—“এই কপোত মৃত? তুমি ইহাকে মৃত বলিতে পার! যে লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত্তের মুখে আত্ম শরীর দান করিতেছে, সে মৃত? আর তুমি নিভৃত বারেণ্ডায় বসিয়া নিশ্চিন্ত ভাবে মুখ ধুইতেছে, তুমি জীবিত?” রামদুলাল যেন পাগলের এই কথার অপেক্ষা করিতেছিলেন। তিনি সেই দিনই বেলগাছিয়ায় এক অতিথি শালা স্থাপন করিলেন। ঐ স্থানে অদ্যাপি সহস্র ২ ব্যক্তি প্রতিদিন রামদুলালের ব্যয়ে আহার পাইতেছে। সেখানে, এমন সুব্যবস্থা আছে যে, চণ্ডাল হইতে ব্রাহ্মণ পর্যন্ত কাহারই তথায় আতিথ্য গ্রহণে আপত্তি হইতে পারে না। এতদ্ব্যতীত রামদুলালের নিজ গৃহে প্রত্যহ পাঁচশতেরও অধিক লোক আহার করিত। তাঁহার ভৃত্যগণের প্রতি এইরূপ আদেশ ছিল, কোন ভিক্ষু এক মুষ্টি চাহিলে, তাহাকে ভিক্ষাভাজন পূর্ণ করিয়া ভিক্ষা দিবে। কোন ব্যক্তি কন্যা ভারগ্রস্ত কি পিতৃমাতৃ হীন হইয়া তাঁহার নিকট সাহায্যার্থী হইলে তিনি এককালে পাঁচশত টাকা দান করিতেন।
রামদুলাল তাঁহার সন্ততি গণকে, অন্যান্য শিক্ষার মধ্যে বিশেষ রূপে বিনয় গুণের শিক্ষা দিতেন। তাঁহার একটি কন্যা কোন দরিদ্র কুলীন কুমার কর্ত্তৃক পরিণীতা হইয়াছিলেন। তিনি শ্বশুর গৃহে গমন করিয়া অতি সামান্য কাজ গুলিও স্বহস্তে করিতেন; বড় মানুষের মেয়ে বলিয়া হাত কোলে করিয়া বসিয়া থাকিতেন না। তিনি পিতৃ দত্ত স্বর্ণাভরণ সকল এই বলিয়া ত্যাগ করিয়াছিলেন যে, যতদিন তাহার যাতৃগণেরও ঐ রূপ আভরণ না হইবে, তত দিন তিনি নিজের আভরণ ব্যবহার করিবেননা। রামদুলাল শুনিয়া যার পর নাই সন্তুষ্ট হইয়া, নিজ কন্যার ন্যায়, কন্যার যাদিগকেও কতকগুলি স্বর্ণাভরণ প্রদান করিলেন।
রামদুলালের বিনয় গুণই, তাঁহাকে সকলের ভক্তি ভাজন করিয়াছিল। তাঁহার প্রকৃতিতে অহঙ্কারের লেশ মাত্র ছিলনা। অপমান-ক্লেশ, তাঁহার মনে বৈরসাধন প্রবৃত্তি উত্তেজিত করিতে পারিত না। অপরিমিত শান্তি, ক্ষতি কারকের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন, দুর্ব্বল ও প্রপীড়িতের রক্ষা করা, ইত্যাদি তাঁহার স্বাভাবিক গুণ ছিল। তিনি তাঁহার প্রত্যেক পুত্রের বিবাহে তিন ২ লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়াছিলেন, কিন্তু তাহা বৃথাড়ম্বর ও ঐশ্বর্য্য প্রদর্শনার্থ নহে। তদ্বারা কেবল তাঁহার দানের আধিক্য ও সার্থকতা প্রদর্শিত হইয়াছিল। বিবাহোপলক্ষে নিমন্ত্রিত নবদ্বীপের অধ্যাপক গণের প্রত্যেককে এক ২ শত টাকা দান করিয়া ছিলেন। নিমন্ত্রিত গণের ভোজনার্থ উচিতধিক আয়োজন হইয়াছিল। প্রতিবেশিগণকে একপক্ষ স্ব ২ গৃহে রন্ধনাদি করিতে দেন নাই। ফলে সে ব্যয় ও ব্যয়ের সুপ্রণালী এখন উপন্যাস হইয়াছে।
সুশৃঙ্খলা রক্ষার্থরামদুলালের জামাতা একদল সিপাই পাহারা নিযুক্ত করিয়াছিলেন। সিপাহিরা ঐ ক্রোর পতিকে কখন স্বচক্ষে দেখে নাই। পরিচ্ছদাদির দ্বারা তাঁহাকে, তিনি বলিয়া চিনিবারও কোন উপায় ছিল না। একদিন বহির্ব্বাটির আয়োজন পর্য্যবেক্ষণ করিয়া যেমন গৃহমধ্যে প্রবেশ করিবেন, একজন সিপাহি ধাক্কা মারিল। রামদুলাল পড়িয়া গেলেন। তাঁহার আপন বাটির দ্বার রক্ষকেরা ঐ সিপাহিকে আক্রমণ করিবার চেষ্টা করিল। কিন্তু রামদুলাল দৃঢ় রূপে আদেশ প্রচার করিলেন যেন, এই উপলক্ষে তাহাকে কিছু না বলা হয়।
তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র আশুতোষ দেব অত্যন্ত আমোদ প্রিয় ছিলেন। সর্ব্বদা সঙ্গিগণের সহিত নৃত্য গীতাদি বিষয়ক আমোদ করিতেন। একদা কোন উৎসবোপলক্ষে নিজ বাড়ীর কোন গৃহে নাচ দেখতে ছিলেন। ঠিক ঐ ঘরের নিম্নতলে রামদুলালের লিখিবার ঘর ছিল। নাচ তমসার গোলযোগে রামদুলাল বড় বিরক্ত হইলেন। তৎক্ষণাৎ পুত্রকে ডাকাইয়া শান্তু ভাবে কহিলেন, ইহা কাজের লোকের বাড়ী, ওমরাওর বাড়ী নহে।
ঐ আশুতোষ দেব অন্য কোন সময়ে বিখ্যাত কূটকারী রাজকিশোর দত্তের সহিত একটি ভয়ঙ্কর বিবাদের সূচনা করিয়াছিলেন। রামদুলাল ইহা জানিতে পারিয়া স্বয়ং রাজকিশোরের নিকট গমন এবং বিনয় নম্র ভাবে তাঁহার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ফলে রামদুলালের অসামান্য বিনয় গুণেই এই গুরুতর বিবাদের ভঞ্জন হয়।
একদা কোন পর্ব্বাহোপলক্ষে কালীনাথ শান্যাল নামক কোন দুর্ব্বৃত্ত রামদুলালের সম্বন্ধীর চকে আবির দিয়াছিল। সম্বন্ধীর হাতে আবির না থাকায় সে পথের ধূলা লইয়া কালীনাথের চকে দেয়। এই অপরাধে কালীনাথ তাহাকে একটা গৃহ মধ্যে আবদ্ধ করিয়া এমন ভয়ানক রূপে প্রহার করিল যে, তাহার নাসিকা ও মুখ-বিবর হইতে শোণিত-স্রাব হয়। রামদুলাল অফিস্ হইতে আসিয়া ইহা অবগত হইলেন। দুরাচারের অত্যাচারে তাঁহার মন অত্যন্ত চঞ্চল হইল; এবং ইহাও দেখিলেন যে, ইহার উপযুক্ত প্রতিশোধ দিতে তাঁহার যথেষ্ট ক্ষমতা আছে। কিন্তু তিনি পরিশেষে এক নূতন বিধ প্রতি শোধের উপায় স্থির করিয়া অপেক্ষাকৃত স্থিরতা লাভ করিলেন। এদিকে আশুতোষ দেব ইহার প্রত্যক্ষ প্রতি শোধার্থ উপযুক্ত আয়োজন করিয়া সুযোগ প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। অপর দিকে, কালীনাথের জ্যেষ্ঠ মথুরানাথকে তাঁহার কতকগুলি ইংরজি বন্ধু, কনিষ্ঠের দুরাচারীতার জন্য রামদুলালের নিকট স্বয়ং গিয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিতে পরামর্শ দিলেন। মথুরানাথ ইহাতে সম্মত হইলেন। কিন্তু রামদুলাল মথুরানাথের আগমনবার্ত্তা পূর্ব্বে জানিতে না পারিলে, হয়ত তাঁহাকে আশুতোষের হস্তে জীবন সমর্পণ করিতে হইত।
রামদুলাল পুত্রগণের অভিপ্রায় জানিতে পারিয়া স্বয়ং মথুরানাথকে প্রত্যুদ্গমন করিয়া আপনার উপবেশগৃহে আনিলেন। সজল-নয়নে কাতর স্বরে অঞ্জলি বন্ধপূর্ব্বক মথুরানাথকে কহিলেন যে, তিনি কি কলিকাতায় বাস করিতে পাইবেন? না কাশীনাথের অত্যাচারে তাঁহাকে ভিটা ছাড়া হইতে হইবে? আরও কহিলেন, “তোমার পিতা আমার বন্ধু ছিলেন, মৃত্যু কালে তোমাদের দুইটীকে আমার হস্তে সমর্পণ করিয়া গিয়াছেন। তজ্জন্য আমি তোমাদিগের প্রতি স্নেহ মমতা ব্যতীত আর কোন ভাবই প্রকাশ করিতে পারি না। মথুরানাথ, এই কি তাহার পুরস্কার?” এই সময়ে মথুরানাথ ও কালী উভয়েই, রামদুলালের অনুগ্রহ-প্রদত্ত একটা বাটীতে বিনাভাড়ায় অনির্দ্দিষ্ট কালের জন্য সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে বাস করিতে ছিলেন। রামদুলালের অশ্রু ও বিনয়, মথুরানাথের মর্ম্ম ভেদ করিল। যদি যথা সময়ে রামদুলাল বাধা না দিতেন, তাহা হইলে মথুরানাথ নিশ্চয়ই তাঁহার পদতলে পতিত হইতেন। এই রূপে অপমানের আশ্চর্য্য প্রতিশোধ হইল। রামদুলাল পুনরায় তাঁহাকে, তাঁহার বিরুদ্ধে দলবদ্ধ-ব্যক্তিগণের মধ্য দিয়া লইয়া গেলেন। রামদুলালের পুত্রের মনোমত প্রতি বিধান না দেখিয়া বড় অসন্তুষ্ট হইলেন। রামদুলাল এই চিরস্মরণীয় বাক্য দ্বারা তাঁহাদিগকে সান্ত্বনা করিয়াছিলেন। “যদি ষাঁড়ে এক খানি হীরা খাইয়া ফেলে, তবে কি তাহা বাহির করিবার জন্য, যাঁড়ের পেট চিরিয়া ফেলিতে হইবে?” এই ব্যাপারে রামদুলালের অসামান্য মনুষ্যত্ব প্রকাশিত হইয়াছে। তাদৃশ ক্রোধ সম্বরণ ও তাদৃশ অপমান সহ্য করা সাধারণ ক্ষমতার কর্ম্ম নহে। মনোবৃত্তির উত্তেজনায় কার্য্য করা যেমন সহজ, কোন বৃত্তির উত্তেজনাকালে মনকে কর্ত্তব্য পথে লইয়া যাওয়া, অথবা নুতন কিছু স্থির করিতে সমর্থ হওয়া তেমনি কঠিন। রামদুলাল, এই কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন।
ঐ কালীনাথ শান্যাল অন্য কোন সময়ে রামদুলালের একজন প্রিয় ও নিরীহ প্রতিবেশীর প্রতি ভয়ানক অত্যাচার করিয়াছিলেন। আমরা পূর্ব্বে দেখাইয়াছি, তাঁহার নিজের প্রতি ও তাঁহার প্রিয়পত্নীর ভ্রাতার প্রতি যে সকল অত্যাচার সংঘটিত হইয়াছিল, তাহা কি রূপে অগ্রাহ্য করিয়াছিলেন এবং কেমন দূরদর্শন ও সুকৌশলের সহিত সে সকলের প্রতিবিধান করিয়াছিলেন। কিন্তু এই নুতন অত্যাচার তাঁহাকে এককালে অসহিষ্ণু করিয়াছিল। তিনি মনে করিলেন, এতাদৃশ পশু প্রকৃতি দুরাচার কর্ত্তৃক জন সমাজের ভয়ানক অনিষ্ট হইতে পারে। এই জন্য তিনি চেষ্টা করিয়া মাজিষ্ট্রেট্ দ্বারা কালীনাথকে নগর বহিষ্কত করিলেন। তদবধি কালীনাথ যাবজ্জীবন আর কলিকাতায় প্রবেশ করিতে পারেন নাই।
যখন রামদুলাল তত বড় মানুষ হন নাই, তখন তাঁহার অন্তঃপুরিকাগণের, বাহির হইতে জলের কলসী কাঁকে করিয়া আনা অভ্যাস ছিল। পরে কলিকাতার মধ্যে প্রধান সম্ভ্রান্ত ও সম্পন্নের মধ্যে গণ্য হইয়াও, পুর-কামিনী গণের ঐ অভ্যাস প্রচলিত রাখিবার চেষ্টা করেন কিন্তু তাঁহার পুত্রগণ সে চেষ্টা সফল হইতে দেন নাই। ইহা দ্বারা প্রতিপন্ন হয়, তাঁহার নম্রতা, কি অসামান্য প্রকারের ছিল। অসামান্য ছিল তাহার সন্দেহ নাই; কিন্তু তাদৃশ উন্নতাবস্থ লোকের পক্ষে ইহা কিয়ৎ পরিমাণে, অসঙ্গতও ছিল।
রামদুলাল প্রকৃত হিন্দু। সুতরাং ব্রাহ্মণের প্রতি ভক্তি ছিল। তাহার জীবনে এই ভক্তিমূলক কতকগুলি সুন্দর আখ্যান প্রথিত আছে। একজন ব্রাহ্মণ অনেক দিন হইতে চেষ্টা করিয়াও তাঁহার নিকট কোন কর্ম্ম পায় নাই। একদিন রামদুলাল কুঠি যাইতেছেন, হঠাৎ ঐ ব্রাহ্মণ তাঁহার পালকীতে স্কন্ধারোপ করিল। রামদুলাল বিষম বিপদ উপস্থিত দেখিয়া লাফাইয়া পড়িলেন এবং সেই দিনই তাঁহার কোন কর্ম্মের বন্দোবস্ত করিয়া দিলেন।
আমেরিকার জাহাজ, উপস্থিত হইলে অনেক অতিরিক্ত সরকারের প্রয়োজন হইত। এই জন্য ঐ সকল জাহাজ উপস্থিত হইবামাত্র একজন প্রধান কর্ম্মচারী তাঁহার সম্মুখে একটী উমেদারের তালিকা ধরিত। যাহারা মনোনীত হইত, তদ্ব্যতীত অপরের নাম তিনি স্বয়ং কাটিয়া দিতেন। একজন ব্রাহ্মণের নাম, এইরূপে অনেক বার কাটা যায়। ব্রাহ্মণ বারং এইরূপ দুর্ঘটনা দেখিয়া তালিকা লেখক কর্ম্ম চারী দ্বারা আপন নামের সহিত “ষাঁড়” এই শব্দটী লেখাইয়া রাখিলেন। সময়ানুসারে ঐ তালিকা রামদুলালের হস্তে, পতিত হইল। তৎকালে যণ্ড উপাধিধারী ব্রাহ্মণ পশ্চাতে দণ্ডায় মান ছিলেন। রামদুলাল অন্যান্য নাম কাটিয়া যখন এ বিচিত্র নামের উপরে লেখনী সঞ্চালন করিলেন, তখন ঐ ব্রাহ্মণ বলিয়া উঠিলেন, “কাটিয়া ফেলুন, মহাশয়, কাটিয়া ফেলুন, বার ২ ব্রাহ্মণ কাটিয়া ছেন, এখন গোরুও কাটুন। ইতস্ততঃ করেন কেন?” রামদুলাল হাসিলেন। এবং ব্রাহ্মণকে একটী সিপ্সরকারের কর্ম্ম দিলেন।
অপর এক জন ব্রাহ্মণ টাকা পাইবে বলিয়া তাঁহার নামে লালিস করে। তিনি কাহার নিকট এক কপর্দ্দকও ঋণী ছিলেন না; বরং ঐ ব্রাহ্মণের নিকট হইতে তিনিই অনেক টাকা পাইতেন। রামদুলাল ব্রাহ্মণকে জাল খৎ ও মিথ্যা সাক্ষী দ্বারা মোকর্দ্দমা চালাইতে দেখিয়া বাদীর প্রার্ত্থিতসমুদায় টাকা অবাধে প্রদান করিতে চাহিলেন। ঐ টাকার পরিমাণ ২৪০০০ হাজার। তাঁহার আত্মীয়গণ, অকারণে এত অর্থ অপব্যয় করিতে নিষেধ করিলে রাম দুলাল কহিলেন, “আমি এমোকর্দ্দম চালাইলে নিশ্চয়ই ব্রাহ্মণ জালিয়াতে পড়িবে। ব্রাহ্মণের অনিষ্ট হয়, আমি এরূপ করিতে পারিব না। ২৪০০০ হাজার টাকা প্রদত্ত হইল। এক জন পৌরাণিক হিন্দু, ব্রাহ্মণের প্রতি ঐরূপ অসীম ভক্তি প্রদর্শন না করিয়া থাকিতে পারেন না। কিন্তু সকল ব্যাপারের যথা স্থানে সীমা নির্দ্দিষ্ট হওয়া উচিত। নচেৎ বহুবিধ অনিষ্ট সংঘটন হয়।
দেনা পাওনার মোকর্দ্দমায় কেহ তাঁহাকে সাক্ষী মানিলে, তিনি কদাচ আদালতে উপস্থিত হইতেননা; বাদীর প্রার্ত্থিত সমস্ত টাকা নিজে অর্পণ করিতেন। বলিতেন,—“গঙ্গাজল স্পর্শপুর্ব্বক সাক্ষীর আসনে দণ্ডায়মান হওয়াপেক্ষা টাকা দেওয়া ভাল। তাঁহার এই মত জানিতে পারিয়া জুয়াচোরের সময়ে২ তাঁহার অর্থ নষ্ট করিতে লাগিল। পরস্পর বিবাদের ভাণ করিয়া তাঁহাকে মধ্যস্থ স্বীকার করিত। মধ্যস্থতা সূত্রে তিনি কল্পিত মোকর্দ্দমার বিষয় অবগত হইলেই তাহারা আদালতে লালিস করিয়া রামদুলাল কে সাক্ষী মানিত। তিনি সাক্ষ্য না দিয়া টাকা দিতেন। পরে জুয়াচোরেরা এইরূপে প্রাপ্ত টাকা অংশ করিয়া লইত।
রামদুলাল অতিশয় কৃতজ্ঞ ছিলেন। যে ব্যক্তি তাঁহার দুঃখের সময় বিন্দুমাত্র উপকার করিত, তিনি তাহা যাবজ্জীবন স্মরণ রাখিয়া উন্নতির সময় এত অধিক পরিমাণে তাহার প্রতিশোধ দিতেন যে, লোকে সেরূপ প্রতিশোধকে অনাবশ্যক জ্ঞান করিত। কোন সময়ে দোল পর্ব্বাহোপলক্ষে রামদুলালের মাতামহের কুটম্ব বাটী তত্ত্ব পাঠাইবার প্রয়োজন হয়, কিন্তু কিছুমাত্র। সংগতি না থাকায় তাঁহার অত্যন্ত কষ্ট হইতে লাগিল। রামদুলাল তখন নিতান্ত শিশু, দোকানে ধার করিবার অনেক বিফল চেষ্টা পাইলেন। হতাশ্বাসে রামদুলালের মুখ মলিন হইয়া গেল। অবশেষে কোন দয়ালু ব্যক্তি, তাদৃশ নিরাশ্রয় শিশুকে ধার দিলে পাওয়া যাইবে কি না সে চিন্তা না করিয়া তাঁহাকে যথেষ্ট সাহায্য করিলেন। রামদুলালের অন্তরে ইছা যাবজ্জীবন জাগরূক ছিল সম্পদের সময় ঐ ব্যক্তির পরিজন দিগকে সন্ধান করিয়া মাসিক ১৫৲ টাকা বৃত্তি অবধারিত করিয়া দেন।
হালা নামক কোন পোর্টুগীজের অধীনে তিনি প্রথমে লাভবান হন। এইজন্য তাঁহার যাবতীয় কাজ কর্ম্মের সহিত ঐ তাগ্য শালীব্যক্তির নাম সংসৃষ্ট রাখিয়া ছিলেন; এবং হালার মরণান্তর তাঁহার পরিবারের দুরবস্থায় পড়িলে তাহাদিগকে বৃত্তি দিতেন।
কৃতজ্ঞতা সম্বন্ধে রামদুলাল যে সকল কার্য্য করিয়া ছিলেন, বর্ত্তমান কালে তাহা প্রশংসার বিষয়, সন্দেহ নাই। আমরা ভরসা করি, তাঁহার কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থ অর্থ অপব্যয়িত হয় নাই। কিন্তু তাঁহার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রণালী, সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ বলিয়া স্বীকার করা যায় না। প্রয়োজন না থাকিলেও, উপকারীর উপকার করিতেই হইবে, বোধ হয়, বিশুদ্ধ কৃতজ্ঞতার লক্ষণ এরূপ নহে। কাহার নিকট হইতে উপকার প্রাপ্ত হইয়া যদি মানুষের উপচিকীর্ষা বৃত্তির স্ফুর্ত্তি হয়, তবেই বলা যাইতে পরে প্রকৃত কৃতজ্ঞতার কার্য্য হইল। যেমন মনুষ্য শরীরের প্রত্যঙ্গ সকল, কোন কারণেই প্রত্যঙ্গ বিশেষের নিকট বাধিত নহে, সকল শরীরের নিকট ঋণী, শরীরের যেখানে যখন যে কার্য্যের প্রয়োজন হইবে, প্রত্যঙ্গ তাহাই করিবে, সে স্থান হইতে কোন উপকার পাইয়াছে কিনা ভাবিবে না; প্রত্যেক ব্যক্তিই সমাজ-শরীরের নিকট সেইরূপ ঋণী;—সমাজের যেখানে যখন যে অভাব হইবে, তৎক্ষণাৎ তৎপুরণের চেষ্টা করিবে। এই কথাটা অধিকতর স্পষ্ট করিবার জন্য, একটী উদাহরণ দেওয়া গেল। মনে কর, দক্ষিণ হস্ত, বাম হস্তে কণ্ডূয়ন করিল, যদি কোন কালে দক্ষিণ হস্তে কণ্ডূয়নের প্রয়োজন না হয়, তবে কি বাম হস্তের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের স্থল নাই। অবশ্য আছে। সে, দক্ষিণ পদের কণ্ডূয়ন করুক। তাহাতেই তাহার কার্য্য হইবে। ফলে, উপকৃত হইয়া, উপকারী হইবার শিক্ষা লাভ করাই, বিশুদ্ধ কৃতজ্ঞতা।
এইবার আমরা রামদুলালের একটা অধিকতর সমুজ্জ্বল কীর্ত্তির উল্লেখ করিব। তিনি যেখানকার অন্ন বস্ত্রে দুঃখের সময় প্রতিপালিত হইয়াছিলেন, যেখান হইতে লেখা পড়া শিখিয়াছিলেন, যেখান হইতে তাহার সমস্ত উন্নতির সুত্রপাত হইয়াছিল, সেই মদনমোহন দত্তের বাড়ীর কালী প্রসাদ দত্ত নামক কোন ব্যক্তি প্রকাশ্যরূপে নিষিদ্ধাচার করতে জাতিচ্যুত বা সমাজ বহির্ভূত হইয়াছিলেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের বড় ২ কর্ত্তারা সকলেই কালী প্রসাদের বিপক্ষ। রামদুলাল তাঁহার সমন্বয় করা কর্ত্তব্য জ্ঞান করিলেন। তাঁহার বিলক্ষণ বিশ্বাস ছিল, টাকার দ্বারা সকল কার্য্যই সাধন করা যাইতে পারে। এই জন্য সগর্ব্বে অনেকের সমক্ষে বাক্সের উপর চপেটাঘাত করিয়া কহিলেন, “জাতি ইহার মধ্যে আছে।” তিনি মদনমোহন দত্তের বংশীয় বলিয়া কালী প্রসাদকে, প্রাণপণ যত্নে এবং তিন লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়া জাতিতে তুলিলেন।
রামদুলাল কোন্ কালে মৃত্যুর কন্দরে লুক্কায়িত হইয়াছেন, কিন্তু, তাঁহার কীর্ত্তি কলাপ অদ্যাপি দেদীপ্যমান রহিয়াছে। তিনি কালী প্রসাদ দত্তের উদ্ধারার্থ যাহা করিয়াছিলেন, তাহা, অহঙ্কার বা ঐশ্বর্য্য প্রদর্শনার্থ নহে। কেবল মনুষ্যোচিত দয়া ও কৃতজ্ঞতার উত্তেজনাই তাহার প্রধান কারণ। কেহ ২ বলেন অহঙ্কার তাঁহার প্রকৃতিতে ছিলনা। একেবারে ছিলনা, একথায় আমাদের বিশ্বাস হয় না। কারণ একটী নির্দ্দিষ্ট সীমা বিশিষ্ট অহঙ্কার না থাকিলে মানুষ সংসারী হইতে পারে না। অহং—কার, অর্থাৎ আমি কর্ত্তা, যাঁহার কিয়ৎ পরিমাণে এজ্ঞান না থাকে, তিনি নিশ্চেষ্ট পরম হংস। কোন সংসারী ব্যক্তিকে আমরা সে পরমপদ দিতে প্রস্তুত নহি। তবে অহঙ্কার, আত্ম-গৌরব ইত্যাদি নিকৃষ্ট বৃত্তি সকল তাঁহার খুব কম ছিল। মেথর দিগের ঘৃণিত ব্যবসায়ের বিষয় সকলেই অবগত আছেন। গৌরা নামক নিজ বাটীর মেথরের শ্রাদ্ধ কালে রামদুলাল স্বয়ং তাহার বাটী গিয়া শ্রাদ্ধের তত্ত্বাবধান করেন এবং ঐ শ্রাদ্ধোপলক্ষে গৌরার পুত্রকে ১০০০ এক হাজার টাকা দেন। অহম্মুখেরা এরূপ কাজ করিতে পারেন না।
“যোগ্যং যোগ্যেন যুজ্যতে—” এই মহাবাক্যের নিদর্শন প্রদর্শনার্থই যেন রামদুলালের প্রথম বিবাহ হইয়াছিল। তাঁহার প্রথম পত্নীর চরিত্রেও উপরি উক্ত রূপ ঔদার্য্য দেখা যাইত। গৃহিণী একবার শ্রীক্ষেত্র গমন করেন। পূর্ব্বোক্ত গৌরা তাঁহার সঙ্গে যায়। শ্রীক্ষেত্রের যাত্রিগণ সেই পবিত্র পুরীতে গমন করিয়া এককালে জাতি গৌরব পরিত্যাগ করে। হিন্দুধর্ম্মের কিচমৎকার প্রণালী! তথায় সকলে চির পোষিত কুসংস্কারও জাত্যভি মান ত্যাগ করিয়া এক পিতা মাতার সন্তানের ন্যায় পরস্পর ব্যবহার করে। বিশেষতঃ হিন্দু মলিহাগণের ধর্ম্মানুরাগ এত প্রবল যে, তাঁহারা জীবনকালে যতই কেন কুসংস্কার জালে জড়িত থাকুননা উপযুক্ত কালে কিছুই প্রতি বন্ধক হয়না। গৌরা তাঁহাকে কহিল;—“জননি, নিতান্ত নীচ কার্য্যে আমার এজীবন নিযুক্ত আছে। এই পবিত্র ভূমি ত্যাগ করিলে, আমি আর আপনার নিকটেও আসিতে পারিবনা। অতএব আমাকে এই স্থান-মাহাত্মের অনুসরণে অনুমতি করুন। আমার যে হাত, চিরকাল আপনার কার্য্য করিয়া অশুচি হইয়াছে সেই হাতে এখানকার পবিত্রান্ন আপনার মুখে প্রদান করিতে অনুমতি করুন।” ভিন্নধর্ম্মাবলম্বিনী সুসভ্য রমণী গণ এমন অবস্থায় মেথরের অশিষ্টাচার নিবন্ধন অসন্তুষ্ট হইতেন এবং হয়ত, তাহাকে কশাঘাতের বন্দ বস্তও করিতেন। কিন্তু ঐ ধর্ম্মবীরা হিন্দু রমণী স্মিত-মুখে অসঙ্কুচিত ভাবে গৌরদত্ত মহাপ্রসাদ গ্রহণ করিলেন।
কোন সময়ে রামদুলালের কতক গুলি প্রজা রাজস্ব দানে অসমর্থ হওয়ায় মফঃসাল হইতে তাঁহার নিকট প্রেরিত হইয়াছিল। রামদুলাল তাহাদিগের শরীর ও পরিচ্ছদে দারিদ্র ও দুর্গতির স্পষ্ট লক্ষণ দৃষ্টি করিয়া মনে বড় কষ্ট পাইলেন। তাহাদিগকে উত্তমরূপে আহার করাইতে এবং সকলকে এক ২ খানি নূতন বস্ত্র দান করিতে দেওয়ানের প্রতি আদেশ দিলেন। “যতই কেন ক্ষতি হউক না, কল্য সূর্য্যোদয়ের মধ্যে এই জমিদারি বিক্রয় করিয়া ফেলিব।” এই অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়া দালাল গণকে ক্রেতা উপস্থিত করিতে আদেশ করিলেন। পুত্রগণকে শফথ্ কৱাইলেন যেন কস্মিন্ কালে তাঁহারা জমিদারী ক্রয় না করেন। তিনি বণিক্ ছিলেন, বাজারের গতিক বুঝিয়া অর্থোপার্জ্জন করিতে পারিতেন, প্রজার হৃদয় শোষণ করিতে জানিতেননা। জমিদার হইলে তাঁহার মঙ্গল হইবে না, ইহা যেন তিনি বুঝিয়াছিলেন। পরে তাহার প্রমাণও পাওয়া গিয়াছে। মেদিনীপুরের অন্তর্গত নাড়জোলনামক একটী জমিদারী, বন্ধক সূত্রে তাঁহার পুত্রেরা ক্রয় করিয়াছিলেন। ঐ জমিদারী রক্ষা করিতেই তাঁহাদের সর্ব্বনাশ হইয়া গিয়াছে।
সত্য প্রিয়তা ও বাঙ্নিষ্ঠাই তাঁহার তাদৃশী উন্নতির প্রধান সহায়। তাঁহার সময়ে মুচ্ছদ্দি দিগের বেতন ছিল। তাঁহারা টাকা প্রতি দুই পাই দস্তুরি পাইতেন। এই দস্তুরি হইতেই তাহারা অতুল বিভব উপার্জ্জ্বন করিয়া যাইতেন। রামদুলাল এই রূপে প্রচুর অর্থ উপার্জ্জ্বন করিয়াছিলেন। তাঁহার ধনবত্তার পরিচয়, পূর্ব্বে অনেক দেওয়া গিয়াছে। আর একটী এই, ক্রীত দ্রব্যের মূল্য স্বরূপে তিনি প্রতিদিন প্রায় তিন লক্ষ টাকার বরাত চিটি মহাজন দিগকে দিতেন। মহাজনেরা তাঁহার ব্যাঙ্কের উপর ঐ বরাত দিয়া টাকা লইত। রামদুলাল কত টাকার মানুষ, পরীক্ষা করিবার জন্য মহাজনেরা একদিন পরামর্শ করিল। প্রতিদিন টাকা না লইয়া প্রায় একসপ্তাহের বরাত চিঠি একদিনে রামদুলালের ব্যাঙ্কে উপস্থিত করিল। তিনি ইহা কিছু পূর্ব্বে জানিতে পারিয়া অন্যূন ২৫০০০০০ পঁচিশ লক্ষ টাকা ব্যঙ্কে পাঠাইয়া দেন। মহাজনেরা ব্যাঙ্কে এই টাকার রাশি দেখিয়া বিস্মিত হইয়া গেলেন। মহাজনের বরাত চিঠি দিয়া টাকা না পাইলে তাঁহার সত্যনিষ্ঠায় সংশয় করিবে, এই সংশয় হইতে সম্ভ্রমের হানি, এবং সম্ভ্রমের হানি হইতে কি নিজের কি মার্কিন হাউসের কার্য্য বিশৃঙ্খলা হইবে। সর্ব্বদা এইরূপ দূরদর্শনের সহিত কাজ করায় সকল কার্য্যে অসাধারণ কৃতকার্য্যতা লাভ করিয়াছিলেন।
রামদুলাল যাহা কিছু করিয়া গিয়াছেন, সকলই অদ্ভুত। বেতন, প্রাচীন আমলাদিগের বৃত্তি প্রভৃতিতে তিনি মাসে ১৫০০০ হাজার টাকা ব্যয় করিতেন। তিনি ২২২০০০ দুইলক্ষ বাইশ হাজার টাকা ব্যয় করিয়া কাশীতে —এয়োদশটা শিব-মন্দির প্রতিষ্ঠিত করেন। পাঁচ দিন ধরিয়া কাঙ্গালী বিদায় হয়। এই কার্য্যোপলক্ষে তাঁহার গৃহিণী স্বর্ণাদি ধাতু দ্রব্যের সহিত তুলিত হইয়াছিলেন। উহা তত্রত্য অধ্যাপক গণকে দান করা হয়।
ঐ ক্রোর পতির শ্রমশক্তি অত্যন্ত অধিক ছিল। পূর্ব্বে কথিত হইয়াছে, তিনি ইংরাজী ভাষায় উত্তমরূপে কহিতে পারিতেন, কিন্তু বর্ণাশুদ্ধি নিবন্ধন ইংরাজী লিখিতে পারিতেন না। কাজের গোলে, সে অভাবের পুরণ করিয়াও উঠিতে পারেন নাই। তাহার প্রতীভা কোন রূপেই প্রতিহত হইতনা। বাঙ্গালা অক্ষরে ইংরাজী পত্র লিখিতেন, কেরাণীরা তাহা ইংরাজী অক্ষরে পরিবর্ত্তিত করিয়া লইত। তিনি প্রতিদিন মধ্যরাত্র পর্যন্ত লেখাপড়া করিতেন। রামদুলালের স্বহস্ত লিখিত, একখানি দৈনিক বিবরণ ছিল, সেখানি পাওয়া গেলে তাঁহার চরিত্রের অনেক গুঢ় বিষয় জানা যাইত।
যে পীড়ায় রামদুলালের মৃত্যু হয়, তাঁহার ৬৯ বৎসর বয়ঃক্রম কালে তাহার সূত্রপাত হইয়াছিল। ঐ পীড়ার নাম বাতব্যাধি। একদিন লিখিতে২ হঠাৎ ঐ পীড়া উপস্থিত হইয়া তাঁহার বাক্য রুদ্ধ হইল। ভূতলশায়ী হইয়া ছট্ফট্ করিতে লাগিলেন, যাবতীয় মৃত্যুলক্ষণ প্রকাশিত হইল। চতুর্দ্দিকে হাহাকার পড়িল, পরিজন ও বন্ধু জনে সেইস্থান সমাকীর্ণ হইল, অন্তঃপুরিকগণ রোদন করিতে লাগিলেন। দেশীয় চিকিৎসকের পরামর্শে তাঁহাকে তীরস্থ করা হইল। তীরস্থ হইয়াও তিনি এককালে সংজ্ঞাহীন হন নাই; লৌহ সিন্ধুকের চাবি সবলে ধারণ করিয়াছিলেন। জামাতা রাধাকৃষ্ণ উহা লইবার চেষ্টা করিলে, তিনি অধিকতর বলে উহা চাপিয়া ধরিলেন। পরে পুত্র আশুতোষ ও প্রমথনাথকে সমীপে ডাকিয়া তাহাদের হাতে চাবি দিলেন। এদিকে তাঁহার এই অবস্থার সম্বাদ পাইয়া ফারলি ফরগুসন কোম্পানির অংশী ক্লার্ক ও মেলভিল সাহেব, নিকলসন্ নামক এক জন ডাক্তারকে সঙ্গে করিয়া মৃত্যু শয্যায় শয়ান ক্রোর পতির নিকট উপস্থিত হইলেন, ডাক্তার, তাহার অবস্থা দেখিয়াই সত্বর স্বীয় অঙ্গবস্ত্র মধ্য হইতে একটা ক্ষুদ্র সিসি বাহির করিলেন এবং তাহাহইতে একফোটা আরক রামদুলালের ঘড়ে দিলেন। দিবামাত্র তৎক্ষণাৎ একটী বড় ফোস্কা হইয়া ফাটিয়া গেল। এই ঔষধের এতাদৃশী কার্য কারিতা ইহার পূর্ব্বে দৃষ্ট হয় নাই। রামদুলাল এযাত্রা বাঁচিয়া গেলেন, সুপ্তোত্থিতের ন্যায় উঠিয়া বসিলেন।
রামদুলাল এবার মৃত্যুর নৃশংস কবোল হইতে নিস্কৃতি পাইলেন বটে, কিন্তু ক্রমেই তাঁহার স্বাস্থ্য ভঙ্গ হইতে লাগিল। আরও একবার ঐরূপে গঙ্গাতীর হইতে ফিরিয়া আসেন। কিন্তু ৭৩ বৎসর বয়সে ১২৩১ সালে (১৮২৫ খৃঃ) যে এইরূপে গঙ্গাতীরে গমন করিলেন, আর ফিরিলেননা! সেই বর্ষেই তাহার জীবন ব্রতের উদ্যাপন হইল। তিনি একদিকে যেমন ভাগ্যবান, অন্যদিকে তেমনিই গুণশালী। তিনি দীন হীনের পিতা এবং সহায় হীনের সহায় ছিলেন। তাঁহার ন্যায় মহৎ লোক অল্পই জন্ম গ্রহণ করেন। আশুতোষদেব এবং প্রমথনাথ দেব নামক দুই পুত্র, গিরীশচন্দ্র দেব পৌত্র এবং পাঁচটি কন্যা তাহার শ্রাদ্ধ কালে উপস্থিত ছিলেন। ঐ শ্রাদ্ধে হস্তী, অশ্ব, পালকী, নৌকা প্রভৃতি প্রচুর রূপে দান করা হয়। প্রায় ৩০০ ০০০ তিনলক্ষ টাকা, কাঙ্গালী বিদায়ে খরচ হইয়াছিল। এক টাকার কম কাহাকেই দান করা হয়। নাই। যে সকল দুঃখিনী গর্ভাবস্থায় আসিয়া ছিল, তাহাদের গর্ভস্থ সন্তুতিকেও এক এক টাকা দেওয়া হইয়াছিল। যে ব্যক্তির সঙ্গে একটা পাখী ছিল, সেই পাখীটীও স্বপ্রভুর সঙ্গে সমান ভিক্ষা লাভ করিয়াছিল। ফলে, এই শ্রাদ্ধে প্রায় পাঁচলক্ষ টাকা খরচ হয়।
রামদুলালের জীবন-চরিত পাঠে কি হিন্দু কি খৃষ্টান, কি বালক কি বৃদ্ধ, কি ধনী কি নির্ধন, সকলেই এই কয়টী উপদেশ লাভ করিতে পারেন। সত্যের সামান্য দীপ, ভয়ানক ঝড়েও নির্ব্বাণ হয় না; মহত্ত্ব সহকারে কেহ জন্মগ্রহণ করেনা, কিন্তু চেষ্টা দ্বারা সকলেই মহৎ হইতে পারে। নিজের একটু মনুষ্যত্ব না থাকিলে কেবল মাত্র পরের সাহায্যে কেহই প্রকৃত রূপে বড় হইতে পারে না।
- ↑ ১৮৬৮ খৃষ্টাব্দের ১৪ মার্চ্চ বেলুড়নিবাসী বাবু গিরীশ চন্দ্র ঘোষ ইহাঁর জীবনচরিত অবলম্বন করিয়া হুগলী কলেজ গৃহে ইংরাজী ভাষায় এক দীর্ঘ বক্তৃতা করেন। ঐ বক্তৃতা পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। এ স্থলে ঐ পুস্তকাবলম্বনে রামদুলালের জীবনচরিত লিখিত হইল।
- ↑ রথ চাইণ্ড নামক একজন ইহুদি জাতীয় বণিক লণ্ডন নগরে কারবার করিতেন। তাঁহার সময়ে তত্তুল্য ধনবান প্রায় আর কেহ ছিল না।