ধম্মপদ (সতীশচন্দ্র মিত্র)/ক্রোধ বর্গ

সপ্তদশ সর্গ—ক্রোধ বর্গ।

ছাড় ক্রোধ হে মানব! ছাড় অভিমান,
অতিক্রম কর ভবে সকল বন্ধন;
নাম আর রূপে যেই অনাসক্ত রয়[]
অকিঞ্চন সেজনের দুঃখ নাহি হয়॥১॥২২১॥
সংসারে সঞ্জাত ক্রোধে বলে যেইজন
ধারমান রথ প্রায় করয়ে ধারণ—
প্রকৃত সারথি বলি’ তার সমাদর
রশ্মিধারী মাত্র হয় সারথি অপর॥২॥[]
ক্রোধকে করিবে জয় অক্রোধের বলে,
অসাধুকে কর জয় সাধুূতার ফলে,

ধন দান করি জয় করিবে কৃপণে
সত্যদ্বারা কর জয় মিথ্যাবাদী জনে॥৩॥[]
করিও না ক্রোধ, সদা কহ সত্যবাণী
অন্ন পদার্থও যদি চাহে কোন প্রাণী
যাচ্ঞা মাত্র তা’রে তাহা করিবে প্রদান,—
এ তিন উপায়ে পাবে দেবলোকে স্থান॥৪॥
হিংসা না করেন কা’রো যেই মুনিগণ
জীবন সংযত দেহে করেন যাপন,
গমন করেন তাঁ’রা শাশ্বত সে স্থানে
যে দেশে শোকের বার্ত্তা কেহ নাহি জানে॥৫॥

সতত সতর্ক যাঁ’রা থাকেন ধরায়
যাঁহাদের দিবানিশি শিক্ষালাভে যায়,
নির্ব্বাণ লাভের তরে যাঁ’দের প্রয়াস
তাঁ’দের সকল দোষ পাইবে বিনাশ॥৬॥
মৌনী, অল্পভাষী কিম্বা বহুভাষী জনে
নিন্দা করে সমভাবে লোকে সর্ব্বক্ষণে,
অনন্দিত কোন লোক নাহিক ধরায়—
অতুল[] এ পূরা বাক্য অদ্যকার নয়॥৭॥
একান্ত নিন্দিত কিম্বা একান্ত বন্দিত
ছিল না, হবে না কেহ, নাহি অবস্থিত॥৮॥
বিজ্ঞ যদি প্রতিদিন বিচার করিয়া,
নিম্পাপ, মেধাবী, প্রাজ্ঞ সজ্জন বলিয়া—

প্রশংসা করেন কা’রো, কেহ সেই নরে
সুবর্ণ নিষ্কের মত নিন্দা নাহি করে;[]
প্রশংসা করেন সদা তা’রে দেবগণ।[]
ব্রহ্মার নিকটে তিনি প্রশংসিত হন॥৯-১০॥২৩০॥
দেহের প্রকোপ যত করিবে বারণ;
সংযত শরীরে কাল করিবে হরণ;
দেহের দুষ্কার্য্য যত করিয়া বর্জ্জন,
তদ্বারা সৎকর্ম্ম সব করিবে সাধন॥১১॥
বাক্যের প্রকোপ যত কর নিবারণ;
বাক্যেতে সংযতভাবে রহ সর্ব্বক্ষণ;

বাক্যগত অপকার্য্য করিয়া বর্জ্জন,
তদ্দারা সৎকর্ম্ম সব করিবে সাধন॥১২॥
মনের প্রকোপ যত করিবে বারণ;
মনকে সংযতভাবে রাখ সর্ব্বক্ষণ;
মনের দুষ্ক্রিয়া যত করিয়া বর্জ্জন,
তদ্দ্বারা সৎকর্ম্ম সব করিবে সাধন॥১৩॥
কায়মনোবাক্যে যা'রা সংযত সতত―
সেই ধীর ব্যক্তিগণ সত্য সুসংযত॥১৪॥


  1. এখানে নাম ও রূপ এই দুইশব্দ দ্বারা সমগ্র বাহ্যজগৎ বা অভিব্যক্ত জগৎকে বুঝাইতেছে। অকিঞ্চন ও অনাসক্ত একই অর্থবোধক।
  2. রম্মি— লাগাম। অন্য লোকে শুধু রশ্মিই ধারণ করে, কিন্তু তিনিই প্রকৃত চালক বা সারথি।
  3. একটি শ্লোকে এরূপ কতকণ্ডলি মহানীতির সারসংগ্রহ অতীব বিরল। ভারতবর্ষে এ মহানীতি নূতন নহে; হিন্দুদিগেরসমস্ত ধর্ম্মশাস্ত্রে এই সকল নীতি নানা ভাবে নানা সময়ে গীত হইয়াছে।মহাভারতে আছে “অসাধুং সাধুনা জয়েৎ” ইত্যাদি। এইরূপ উদারনীতি পূর্ণ শ্লোক ভারতবাসীর কণ্ঠে কণ্ঠে গীতহওয়া উচিত।
  4. কেহ কেহ বলেন “অতুল” বুদ্ধের জনৈক শিষ্যের নাম; বুদ্ধ তাহাকে সম্বোধন করিয়াই এইশ্লোক বলিতেছেন। বস্তুতঃ এখানে “অতুল” শব্দ “অনুপম”—অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। See Max Muller's Dhammapada, Sacred Books of the East Vol. X.
  5. একপ্রকার সুবর্ণমুদ্রাকে নিষ্ক বলে। “চতুঃসৌবর্ণিকো নিষ্কঃ” অর্থাৎ চারিটি সুবর্ণমুদ্রায় এক নিষ্ক হয়। কিন্তু চাইল‍্ডার্স সাহেব অন্যরূপ বলিয়াছেন:—“A weight of gold edual to five Suvannas”-Childers' Dictionary, p. 283.
  6. দ্বাদশসর্গের ৪র্থ শ্লোকের টীকা দ্রষ্টব্য।