ধম্মপদ (সতীশচন্দ্র মিত্র)

ধম্মপদ

ধম্মপদ ৷

“ধম্মপদ” নামক পালি গ্রন্থের

বঙ্গানুবাদ।

শ্রীসতীশচন্দ্র মিত্র বি,এ. প্রণীত।

THE STUDENT'S LIBRARY,

67, COLLEGE STREET.

Printed by Kunja Bihari De at the

Keshab Printing Works,

7, Santiram Ghose's Street, Calcutta.

1905.

মূল্য ৷৵৹ ছয় আনা।

মুখবন্ধ।

 দৌলতপুর কলেজের অধ্যাপক মদীয় সুহৃদ শ্রীযুক্ত বাবু সতীশচন্দ্র মিত্র মহাশয়ের অনুবাদিত ধম্মপদ গ্রন্থ প্রকাশিত হইল। যাঁহাদের উদ্যমে বাঙ্গালা ভাষা ও বাঙ্গালা সাহিত্য দিন দিন পরিপুষ্টি ও সমৃদ্ধি লাভ করিতেছে সতীশবাবু তাঁহাদের অন্যতম। মূল ধম্মপদ গ্রন্থ পালি পদ্যে লিখিত। এই গ্রন্থ সতীশ বাবু বাঙ্গালা পদ্যে অনুবাদিত করিয়া সাধারণের কৃতজ্ঞতাভাজন হইলেন। অনুবাদ বিশুদ্ধ ও সরল হইয়াছে এবং ছন্দেরও বিলক্ষণ মাধুর্য্য আছে। প্রকৃত অর্থের পাছে ব্যতিক্রম ঘটে এই ভয়ে গ্রন্থকার স্থানে স্থানে দুই একটী পরিভাষিক শব্দ অবিকৃতভাবে রাখিয়া দিয়াছেন। ধম্মপদ উচ্চ দার্শনিক ভাবে পরিপূর্ণ। এই গ্রন্থ সহজ পদ্যে অনুবাদিত করিয়া সতীশবাবু স্বীয় কৃতিত্বের বিশেষ পরিচয় দিয়াছেন। আশা করি তাঁহার অনুবাদিত গ্রন্থ বিদ্বৎসমাজে বহুল প্রচার লাভ করিবে।

 ইতিপূর্ব্বে সুহৃদ্বর শ্রীযুক্ত বাবু চারুচন্দ্র বসু মহাশয় বঙ্গাক্ষরে বাঙ্গালা ও সংস্কৃত অনুবাদ সহ মুল পালি ধম্মপদের এক উৎকৃষ্ট সংস্করণ বাহির করিয়া ছিলেন। সংপ্রতি তিনি ঐ গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণও প্রকাশিত করিয়াছেন। ইহার কতিপয় বৎসর পূর্ব্বে রায় শ্রীযুক্ত শরচ্চন্দ্র দাস বাহাদুর সি, আই, ই, মহাশয়ের উদ্যোগে ও সিংহল দেশীয় মহাস্থবির শীলস্কন্ধের সহকারিতায় আমরা বুদ্ধঘোষের টীকা সহ মূল পালি ধম্মপদের একটী সংস্করণ দেবনাগর অক্ষরে কলিকাতা বুদ্ধিষ্ট টেক্‌স্‌ট সোসাইটী দ্বারা প্রকাশিত করিয়াছিলাম। আমরা যখন ধম্মপদ গ্রন্থে হস্তক্ষেপ করি তখন ভারতবর্ষে ইহার কোন সংস্করণই বিদ্যমান ছিল না। বড়ই সুখের বিষয় গত আট বৎসরের মধ্যে ইহার অনেক সংস্করণ প্রচারিত হইয়াছে। চারুবাবু ও সতীশবাবুর গ্রন্থ ব্যতীত কপিলাশ্রম হইতে ধম্মপদের একটা সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে। ইহাতে মূলগ্রন্থের আক্ষরিক সংস্কৃতানুবাদ ও বাঙ্গালা অনুবাদ লিপিবদ্ধ আছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বৌদ্ধ পত্রিকায় ধম্মপদের পদ্যানুবাদ প্রকাশিত হইতেছে। পাঁচ অধ্যায় ইতি পূর্ব্বেই মুদ্রিত হইয়াছে। কবিবর শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহোদয়ও বাঙ্গালা পদ্যে ধম্মপদ অনুবাদ করিবেন—এরূপ আশা দিয়াছেন।

 সংপ্রতি বঙ্গদেশে বৌদ্ধসাহিত্য কিরূপ দ্রুতবেগে প্রচারিত হইতেছে ধম্মপদের সংস্করণ সমূহের প্রতি দৃষ্টি করিলে তাহা সহজেই বুঝিতে পারা যায়। ধম্মপদ অমূল্য গ্রন্থ। ইহার বিশ্বজনীন উপদেশ সমূহ কোন ধর্ম্মেরই বিরোধী নহে। ইহা হিন্দু, মুসলামান, খৃষ্টান, বৌদ্ধ প্রভৃতি সকলেরই পাঠ্য। আজিও বৌদ্ধদেশ মাত্রেই শ্রমণগণ এই গ্রন্থের আবৃত্তি ব্যতীত উপসম্পদা (ordination) গ্রহণ করিতে পারেন না।

 ভারতে প্রধানতঃ দুইটী ধর্মের উদ্ভব হইয়াছে, যথা ব্রাহ্মণ্যধর্ম্ম ও বৌদ্ধধর্ম্ম। প্রথমটী ভারতের লোকের ধর্ম্ম, দ্বিতীয়টা পৃথিবীর লোকের ধর্ম্ম। বুদ্ধদেব যে সকল মহামূল্য উপদেশ প্রদান করিয়া সমস্ত জগৎ আয়ত্ত করিয়াছিলেন, তাহার কতিপয় উপদেশ ধম্মপদে লিপিবদ্ধ আছে। অশোকের অনুশাসনের স্থানে স্থানে ধম্মপদের বচন দৃষ্ট হয়, ইহা দ্বারা অনুমিত হয় যে প্রথম ধম্মপদ গ্রন্থ অশোকের সময়ে বা তৎপূর্ব্বে বিরচিত হইয়াছিল। বৌদ্ধগণ বিশ্বাস করেন খৃঃ পূঃ ৫৪৩ অব্দে আষাঢ় মাসে প্রথম বোধিসঙ্গম কালে রাজগৃহ নগরে ভিক্ষু মণ্ডলী সমবেত হইয়া বুদ্ধের মুখনিঃসৃত বচনসমূহ সঙ্কলন পূর্ব্বক ধম্মপদ গ্রন্থ বিরচন করেন। বুদ্ধঘোষ স্বরচিত অৎথকথা নামক টীকায় লিখিয়াছেন মূল ধম্মপদে সর্ব্বশুদ্ধ ২৬ অধ্যায় ও ৪২৩ শ্লোক বিদ্যমান। ছিল। খৃঃ পূঃ ৪৪ অব্দে রাজা কনিষ্কের রাজত্বকালে চতুর্থ বােধিসভার অধিবেশন হয়। এই সভায় ধর্ম্মত্রাত নামক কোন পণ্ডিত পালি ধম্মপদের কিঞ্চিৎ পরিবর্ত্তন ও পরিবর্দ্ধন করিয়া সংস্কৃত ভাষায় একখানি অভিনব ধম্মপদ গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই সংস্কৃত ধম্মপদ গ্রন্থ এ পর্যন্ত আমাদের হস্তগত হয় নাই; কিন্তু ইহার আক্ষরিক অনুবাদ চীন ও তিব্বতীয় ভাষায় দৃষ্ট হয়। চীন ভাষায় চারিখানি ধম্মপদ গ্রন্থ বিদ্যমান আছে। ২৪৪ খৃঃ অব্দে বিঘ্ন ও লুহযেন নামক পণ্ডিতদ্বয় চীন ভাষায় ধম্মপদের প্রথম অনুবাদ প্রকাশিত করেন। এই অনুবাদ গ্রন্থে সর্ব্বশুদ্ধ ৩৯টী অধ্যায় ও ৭৫২টী শ্লোক বিদ্যমান আছে। ২০৯ হইতে ৩০৬ খৃঃ অব্দে কা-চু ও কা-লি নামক দুইজন শ্রমণ ধম্মপদের দ্বিতীয় অনুবাদ প্রকাশিত করেন; ইহাতেও ৩৯টা অধ্যায় ও ৭৫২টা শ্লোক বিদ্যমান আছে। এই দুই অনুবাদের প্রতি দৃষ্টি করিলে অনুমান হয় ধম্মত্রাত সঙ্কলিত সংস্কৃত ধম্মপদে ৩৯টী অধ্যায় ও ৭৫২ শ্লোক বিদ্যমান ছিল। ৩৯৮-৩৯৯ খৃঃ অব্দে ধম্মপদের তৃতীয় অনুবাদ এবং ৯৮০-১০০১ খৃ: অব্দে উহার চতুর্থ অনুবাদ প্রকাশিত হয়। এই দুই অনুবাদ গ্রন্থে সর্ব্বশুদ্ধ ৩৩টী অধ্যায় বিদ্যমান আছে। অপর ৬ অধ্যায় কিরূপে নষ্ট হইল জানা যায় না। রেভারেণ্ড বীল মহোদয় চীন ভাষা হইতে ধম্মপদ গ্রন্থ ইংরাজীতে অনুবাদিত করিয়া অনেক ঐতিহাসিক রহস্য উদঘাটন করিয়াছেন।

 খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে ধম্মপদ গ্রন্থ তিব্বতীয় ভাষায় অনুবাদিত হয়। ১৮৭৮ খৃঃ অব্দে সুপ্রসিদ্ধ জার্ম্মান্ পণ্ডিত সীফনার তিব্বতীয় ধম্মপদের জার্ম্মান্ অনুবাদ প্রকাশিত করেন। গত বৎসর তিব্বত যুদ্ধের সময়ে তিব্বতের সুপ্রসিদ্ধ ও সুপ্রাচীন গ্যাংচী বিহার হইতে মূল তিব্বতীয় ধর্ম্মপদ কলিকাতায় আনীত হয়। আমি ইণ্ডিয়া গবর্ণমেণ্টের অনুমতি লইয়া কলিকাতা মিউজিয়মে বসিয়া তিব্বতীয় ধম্মপদের প্রত্যেক শ্লোকের তুলনা করি। এই উভয় গ্রন্থের মধ্যে অনেক প্রভেদ দৃষ্ট হইল। সংপ্রতি এই তিব্বতীয় ধম্মপদ গ্রন্থ লণ্ডনের বৃটিশ মিউজিয়মে প্রেরিত হইয়াছে। আশা করি ঐ গ্রন্থের আক্ষরিক ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশিত হইলে প্রত্নতত্ত্ববিদগণের বহু উপকার হইবে।

 ইংরাজী, ফরাসী, জার্ম্মান্ প্রভৃতি ভাষায় পালি ধম্মপদের যে সকল অনুবাদ প্রকাশিত হইয়াছে তাহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ অনেকেই অবগত আছেন। ১৮৭৯ খৃঃ অব্দে অধ্যাপক মোক্ষমূলর স্বানুবাদিত ধম্মপদের ভূমিকায় এই সকল গ্রন্থের পরিচয় কিয়ৎ পরিমাণে প্রদান করিয়াছেন। শুনিতে পাইতেছি সংপ্রতি ব্রহ্মদেশে জেমস্ গ্রে নামক পণ্ডিত ধর্ম্মপদের একটী উৎকৃষ্ট ইংরাজী অনুবাদ প্রকাশিত করিয়াছেন; এই অনুবাদে নাকি তিনি মূলের ভাব যথাযথ ভাবে রক্ষিত করিয়াছেন।

 কথিত আছে মহারাজ অশোকের পুত্র যুবরাজ মহেন্দ্র খৃষ্ট পূর্ব্ব তৃতীয় শতাব্দীতে পালি ধম্মপদ গ্রন্থ সিংহল দেশে লইয়া গিয়াছিলেন। ঐ স্থান হইতে ক্রমে ব্রহ্ম, শ্যাম প্রভৃতি দেশে উক্ত গ্রন্থের প্রচার হয়। খৃষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর প্রারম্ভে বুদ্ধঘোষ পালি ভাষায় ধম্মপদের টীকা বিরচন করেন। তিনি প্রত্যেক শ্লোকের ব্যাখ্যার সঙ্গে সঙ্গে এক একটী উপাখ্যান উল্লিখিত করিয়াছেন। কথিত আছে স্বয়ং বুদ্ধদেব ঐ সকল উপাখ্যান তাঁহার শিষ্যগণের নিকট বর্ণন করিয়াছিলেন। বুদ্ধঘোষের জন্মভূমি মগধদেশ; তিনি ভারতবর্ষে সংস্কৃত ও পালি সাহিত্যে বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়া অনুমান ৪৩২ খৃঃ অব্দে সিংহল দ্বীপে গমন করেন। মহাবংশ প্রভৃতি পালি গ্রন্থ পাঠে জানা যায়, বুদ্ধঘোষ ধম্মপদের যে টীকা বিরচন করিয়াছিলেন উহার নাম অৎথকথা এবং উহা সিংহলী ভাষায় ধম্মপদের যে টীকা বিদ্যমান ছিল তাহার পালি অনুবাদ মাত্র। বুদ্ধঘােষুপ্পত্তি নামক গ্রন্থে দৃষ্ট হয় বুদ্ধঘােষ ব্রহ্ম দেশের অন্তর্গত সুবর্ণ ভূমিতে (Thaton) জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন; কিন্তু ইহা সম্পূর্ণ অপ্রামাণিক কথা। ব্রহ্মবাসিগণ স্বদেশের গৌরব বৃদ্ধির জন্যই ঐ সকল প্রবাদের সৃষ্টি করিয়াছেন। বুদ্ধঘোষ অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন পণ্ডিত ছিলেন। তাঁহারই অধ্যবসায়ে ব্রহ্ম প্রভৃতি দেশে পালি গ্রন্থসমূহের বহুল প্রচার ঘটিয়াছিল। ব্রহ্মদেশ। হইতে যে সকল অমূল্য পালি গ্রন্থ অধুনা আবিষ্কৃত হইতেছে উহার অধিকাংশেরই রচয়িতা বা সংগ্রহকর্ত্তা বুদ্ধঘোষ

ধম্মপদ গ্রন্থের প্রাচীনতা, প্রামাণিকতা ও বিশুদ্ধি সম্বন্ধে বাক্যব্যয় নিষ্প্রয়ােজন। অদ্যাপি সহস্র সহস্র মানব এই গ্রন্থের পূজা করিয়া থাকেন। বৌদ্ধগণের যে সুপ্রসিদ্ধ ত্রিপিটক বিদ্যমান আছে, ধম্মপদ গ্রন্থ তাহারই অন্তর্গত। সূত্র পিটকের মধ্যে ইহা এক খানি পবিত্রতম গ্রন্থ। মহাভারত, মনুসংহিতা পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ প্রভৃতি অনেক হিন্দু গ্রন্থের শ্লোকের সহ ধম্মপদ গ্রন্থের শ্লোকের সৌসাদৃশ্য বিদ্যমান আছে। অন্য দিকে খৃষ্টান দিগের পূজ্য বাইবেল গ্রন্থে ও ধম্মপদের অনেক উপদেশ দৃষ্ট হয়। এই সকল সৌসাদৃশ্যের কারণ নির্দ্দেশ করা নিতান্ত সহজ নহে। বৌদ্ধগণ বিশ্বাস করেন ধম্মপদের উপদেশ সকলই মৌলিক ও প্রাচীন।

প্রেসিডেন্সি কলেজ,
 কলিকাতা।
শ্রীসতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ।
৬ই সেপ্টেম্বর, ১৯০৫।

ভূমিকা।

 ধম্মপদ বা ধর্ম্মপদ বৌদ্ধ-ধর্ম্ম শাস্ত্রের নীতি সংগ্রহ গ্রন্থ। খৃঃ পূঃ ৪৭৭ অব্দে বুদ্ধদেব দেহত্যাগ করেন। উহার অব্যবহিত পরে অজাতশত্রুর রাজত্বকালে রাজগৃহের নিকটবর্ত্তী একটি পর্ব্বত গুহায় বৌদ্ধদিগের একটি মহাসভা হয়। ঐ সভার অধিনায়ক কাশ্যপের আদেশে বৌদ্ধদিগের ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ধর্ম্ম তত্ত্ব ও ধর্ম্মনীতি বিষয়ক নীতিমালা একত্র সংগৃহীত ও সুপ্রণালীতে সংরক্ষিত হয়। সমগ্র বৌদ্ধশাস্ত্রকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়া উহার নাম দেওয়া হয়—ত্রিপিটক। এই তিন শ্রেণী বা পিটকত্রয়ের নাম—সূত্র (সুত্ত), বিনয় ও অভিধর্ম্ম (অভিধম্ম)। আনন্দ কর্ত্তৃক সূত্রপিটকের, উপালি কর্ত্তৃক বিনয় পিটকের এবং স্বয়ং কাশ্যপকর্ত্তৃক অভিধর্ম্ম পিটকের সম্পাদন ক্রিয়া নির্ব্বাহিত হয়। বহুবিধ পরিবর্ত্তন ও পরিবর্দ্ধনের পরে খৃঃ পূ: ২৫০ অব্দে পাটলিপুত্রের মহাসভায় ত্রিপিটকের শেষ সংস্করণ লিপিবদ্ধ হয়।[] সূত্রপিটকে বুদ্ধদেব কর্ত্তৃক ধর্ম্মতত্ত্বালোচনের বিষয়, বিনয়পিটকে সংযম (Discipline) ও অভিধর্ম্মে আধ্যাত্মিক তত্ত্বাবলী (Metaphysics) আলোচিত হইয়াছে। এতন্মধ্যে সূত্রপিটকে ধর্ম্মতত্ত্বসন্ধন্ধীয় বুদ্ধোক্তিসমূহ নিবদ্ধ হয়। এইজন্য সূত্রপিটকের অন্য নাম বুদ্ধবচন ও “মূলগ্রন্থ”। এই উক্তি সমূহ হইতে সারনীতি সংগ্রহ করিয়া যে সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ সম্পাদিত হয়, তাহারই নাম ধম্মপদ। বুদ্ধদেব কখন কোথায়, কোন্ অবস্থায় কাহার সহিত কথােপকথনচ্ছলে কোন্ কথা বলিয়াছিলেন, সেই সমস্ত সূত্র পিটকে সংরক্ষিত হইয়াছে। ধম্মপদ গ্রন্থ ঐ সকল বাক্য হইতে নীতিমালা সংগ্রহ করিয়া শ্রেণীবদ্ধ ভাবে সম্পাদিত হইয়াছে। অন্যান্য বৌদ্ধ ধর্ম শাস্ত্রের ন্যায় ইহাও পালিভাষায় লিখিত। ধম্মপদ শব্দের সাধারণ অথ ধর্ম্মের পথ বা সােপান।

 বৌদ্ধ জগতে ধম্মপদ মহাগ্রন্থ বলিয়া পৃজিত। হিন্দুদের যেমন গীতা, মুসলমানের যেমন কোরাণ, খৃষ্টানের যেমন বাইবেল, বৌদ্ধের সেইরূপ ধম্মপদ। ভারতবর্ষের নানাস্থানে যেরূপ গীতা, চণ্ডী বা চৈতন্য চরিতের পূজা পদ্ধতি প্রচলিত আছে, বৌদ্ধমঠে ধম্মপদেরও সেইরূপ পূজা হয়। ইহার সার্ব্বজনীন নীতিমালা সর্ব্বদেশীয় সর্ব্বধর্মাবলম্বী লােকের নিকট সমাদর প্রাপ্ত হইয়াছে।

 সূত্রপিটক হইতে কাহার দ্বারা প্রথম “ধম্মপদ” রূপ সার সংগ্রহ হয়, তাহা জানা যায় নাই। চীন পরিব্রাজক হুয়েন সাঙ্ বলেন প্রথম মহাসমিতির পর কাশ্যপের তত্ত্বাবধানে বৌদ্ধ ধর্ম্মশাস্ত্রীয় গ্রন্থ সকল তাল পত্রে[] লিখিত হয়। সেই সময় হইতে উহা লোক পরম্পরায় অধীত ও কণ্ঠস্থ হইয়া আসিতেছিল। অশোকের বহু পূর্ব্বে ধম্মপদ ছিল। কথিত আছে, ন্যগ্রোধ নামক পণ্ডিতের মুখে ধম্মপদের ব্যাখ্যা শুনিয়া অশোকের মতি পরিবর্ত্তিত হয়। মহাবংশে আছে যে অশোক পুত্র মহিন্দ (মহেন্দ্র) সিংহলে গিয়া তিন বৎসর বসিয়া ত্রিপিটক এক গুরুর নিকট হইতে মুখস্থ করিয়া আসিয়াছিলেন এবং পরে তৎকর্ত্ত‌ৃক বুদ্ধঘোষ প্রণীত “অত্থকথা” (অর্থকথা) নামক ব্যাখ্যা সিংহল দেশে নীত ও মুখে মুখে প্রচারিত হয়। কালক্রমে দেশ দেশান্তরে যেরূপ বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচারিত হইতে ছিল, ধম্মপদ গ্রন্থ ও সেইরূপে নানা দেশে নানা ভাষায় অনুবাদিত হইতে লাগিল।

 চীনদেশীয় পুস্তকের উপক্রমণিকায় দেখিতে পাওয়া যায় যে আর্য্য ধর্ম্মত্রাত নামক একজন ভারতবর্ষীয় বৌদ্ধপণ্ডিত ধর্ম্মপদের সংগ্রাহক। বুদ্ধদেব, ঘোষক, ধর্ম্মত্রাত ও বসুমিত্র এই চারিজন মনীষী বৈভাষিকদিগের মধ্যে প্রধান আচার্য্য বলিয়া সন্মানিত হইয়াছেন।[] ধর্ম্মত্রাত উপরোক্ত বসুমিত্রের পিতৃব্য। বসুমিত্র কনিষ্কের রাজত্ব সময়ে বৌদ্ধ সমিতিতে সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। ইহা দ্বারা স্থিরীকৃত হয় যে আর্য্য ধর্মত্রাত খৃঃ পূঃ প্রথম শতাব্দীতে প্রাদুর্ভূত হন। তিনি প্রচলিত ধম্মপদ গ্রন্থ অনেক পরিমাণে পরিবর্দ্ধত করেন। ধর্ম্মপদের সেই নূতন সংস্করণ বসুমিত্রের মহাসমিতিতে ত্রিপিটকের সারাংশ বিশেষ বলিয়া গৃহীত ও স্থিরীকৃত হয়।[] পরে সেই ধম্মপদ চীন প্রভৃতি দেশে দূরবর্ত্তী প্রদেশে ভারতবর্ষীয় পণ্ডিতদিগের দ্বারা নীত হয় এবং তাঁহাদেরই তত্ত্বাবধানে তত্তদ্দেশীয় লোকদিগের দ্বারা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়।

 মহাপণ্ডিত বুদ্ধঘোষ প্রথম ধর্ম্মপদের সুবিস্তৃত টীকা প্রণয়ন করেন। বুদ্ধঘোযের পূর্ব্বে এদেশে ধম্মপদের বহু সংস্করণ প্রচলিত ছিল। বুদ্ধঘোষ বহুসংখ্যক পুথি দেখিয়া, তাঁহার টীকা পুস্তক সম্পাদিত করেন। তিনি অনেক স্থলে বিভিন্ন পাঠ বা মতের উল্লেখ করিয়াছেন। বুদ্ধঘোষ ধম্মপদের প্রায় প্রত্যেক শ্লোকের ব্যাখ্যায় এক একটি উপাখ্যান সংযোজিত করিয়াছেন। বুদ্ধদেবের ধর্ম্মজীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা হইতে এই সকল উপাখ্যান সংগৃহীত হইয়াছিল।[] পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ বিবেচনা করেন যে ধম্মপদ গ্রন্থে বর্ণিত বিষয় গুলির সহিত উপাখ্যান বর্ণিত ঐতিহাসিক তত্ত্ব সমূহের কোন সম্বন্ধ নাই; বরং ধর্ম্মনীতি সকল পরিষ্ফুটরূপে সাধারণকে বুঝাইবার জন্যই উপাখ্যান সকল রচিত ও প্রচারিত হইয়াছিল। উপাখ্যান দ্বারা শিক্ষার পথ সহজ করিবার প্রণালী অতি প্রাচীন কাল হইতে ভারতবর্যে প্রচলিত ছিল। উপাখ্যান সাহায্যেই সার্ব্বজনীন ধর্ম্মনীতিগুলি প্রাচীন-এশিয়া খণ্ডের নানা প্রদেশে প্রসার লাভ করিতে সক্ষম হইয়াছিল।

 বৌদ্ধগণ বলেন যে, ধম্মপদের উক্তিগুলি বুদ্ধদেবের স্বমুখনিঃসৃত। হিন্দুগণ যেরূপ শ্রীভগবদগীতার প্রত্যেক পংক্তিকে ভগবদ‍্বাক্য বলিয়া বিশ্বাস করেন, ধম্মপদের শ্লোক গুলি সম্বন্ধে ও বৌদ্ধদিগের সেইরূপ ধারণা আছে। ইহা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস করিবার ও কোন কারণ আছে বলিয়া বোধ হয় না। কারণ, ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ বা বুদ্ধদেব ছন্দোবন্ধে কবিতাকারে অবিকল গীতা বা ধম্মপদের শ্লোক গুলি বলিয়াছিলেন—একথা সত্য না হইতে পারে। কিন্তু গীতোক্ত বা ধম্মপদোক্ত উক্তি সমূহ যে শ্রীকৃষ্ণ বা বুদ্ধদেবের সম্পূর্ণ অনুমোদিত এবং তাঁহাদেরই ধর্ম্মমতের সারাংশ তদ্বিষয়ে সন্দেহ নাই।[]

 পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে অতি প্রাচীনকালে ধম্মপদ বহু বৈদেশিক ভাষায় অনুবাদিত হইয়াছিল। সকল স্থানের পুস্তকেই বহুবিধ পরিবর্ত্তন ও পরিবর্দ্ধনাদি দেখা যায়। ভারতবর্ষীয় পালি ভাষার ধম্মপদে ২৬টি অধ্যায়ে ৪২৩টিমাত্র শ্লোক আছে। [বর্ত্তমান পুস্তকে এই ৪২৩টি শ্লোকের অনুবাদ প্রদত্ত হইয়াছে]। চীন দেশীয় ধম্মপদের উপক্রমণিকায় উল্লেখ আছে যে, ধম্মপদের শ্লোকসংখ্যা ৫০০। এখানে মোটামুটি হিসাব ধরা হইয়াছে, অর্থাৎ চারিশতের অধিক ও পঁচিশতের অনধিক সংখ্যাকে পাঁচশত বলিয়া গৃহীত হইয়াছে। কিন্তু চীন দেশীয় ধম্মপদের কোন খানির শ্লোক সংখ্যা এক্ষণে সাতশতের অধিক হইয়াছে। সীফনার (Scheifner) সাহেব তিব্বৎ দেশীয় ধম্মপদে সহস্রশ্লোক দেখিয়াছেন। এই সকল অতিরিক্ত শ্লোক বহুশতাব্দীপরে বিভিন্ন ব্যক্তি দ্বারা সংগৃহীত বা বিরচিত হইয়াছে।

 মহামান্য সামুয়েল বীল সাহেব চীনদেশে প্রধানতঃ চারি প্রকারের ধম্মপদ দেখিয়াছেন। উহার (১) প্রথম খানির নাম ফা-থিউ—কিং বা ধর্ম্মগাথাসূত্র। ইহা খৃষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে পালি হইতে অনুবাদিত হয়। ইহার অধ্যায় সংখ্যা ৩৯, শ্লোক সংখ্যা ৭৬০। পালিভাষার মূলগ্রন্থ হইতে ইহাতে ১-৮, ৩৩ এবং ৩৬-৩৯ এই তেরটি সর্গ নূতন সংযোজিত হইয়াছে এবং এতদ্ব্যতীত যে সকল শ্লোক পালি ও চীন উভয় ভাষার পুস্তকে আছে, তাহার মধ্যে ও শ্লোক সংখ্যা ৭৯টি বৃদ্ধি হইয়াছে। (২) দ্বিতীয় খানির নাম ফা—থিউ—পিউ বা ধম্মপদের উপাখ্যানমালা। ইহা সিন‍্বংশীয় দুইজন শ্রমণদ্বারা চতুর্থ শতাব্দীতে ভাষান্তরিত হয়। ইহাতে শ্লোক সংখ্যা অপেক্ষাকৃত অল্প। বীল সাহেব ইহারই ইংরাজী অনুবাদ প্রচার করিয়াছেন। (৩) তৃতীয় খানির নাম চু—যউ—কিং বা অবদান সূত্র। এই গ্রন্থের উপক্রমণিকায় দৃষ্ট হয় যে কাবুল (উদয়ন) দেশীয় জনৈক পণ্ডিত ভারতবর্ষ হইতে একখানি ধর্ম্মপদ লইয়া চীনদেশে যান এবং তথায় জনৈক চৈনিক পণ্ডিতের সাহায্যে উহার অনুবাদ প্রচার করেন। ইহার অধ্যায় সংখ্যা —৩৩। ইহাতে উপাখ্যানের ভাগ অত্যন্ত অধিক। (৪) চতুর্থ খনির ও গ্রন্থকার ধর্ম্মত্রাত বলিয়া উক্ত হইয়াছেন। কিন্তু ইহার সহিত অন্য পুস্তক গুলির সাদৃশ্য বা সামঞ্জস্য নাই।

 ধম্মপদ নীতিগ্রস্থ। নানাজনে ধম্মপদশব্দের নানা ব্যাখ্যা করিয়াছেন। গ্রন্থমধ্যে ও ধম্ম বা ধর্ম্মশব্দ বিভিন্ন অর্থে প্রযুক্ত হইয়াছে। কিন্তু এস্থলে ধর্ম্মের সাধারণ অর্থ গ্রহণ কাই সঙ্গত। পুস্তকের নামের অর্থ ধর্ম্মপথ, ধর্ম্মগাথা, ধর্মগ্রন্থ প্রভৃতি যিনি যাহাই করুন না কেন প্রকৃত উদ্দেশ্য সহজেই অনুমিত হয়। ইহাকে বৌদ্ধধর্মের নীতিস্তবক বলা যাইতে পারে। ধর্ম্মের মূল নীতিগুলি প্রায় সকল ধর্ম্মেই সমতুল্য। সুতরাং যে উদার নীতিমালার সমাবেশে-ধম্মপদের কলেবর পুষ্ট হইয়াছে, তাহা একমাত্র বৌদ্ধধর্ম্মেরই সম্পত্তি নহে। ইহার সার্ব্বজনীন আদর্শনীতি মালা সর্ব্বদেশেই সমাবৃত হইবার যোগ্য এবং এতদ্দ্বরা সর্ব্বজনেরই ধর্ম্মের ও চরিত্রের পথ সুগম হয়। এই জন্যই ধম্মপদ গ্রন্থ পৃথিবীর সকল দেশের সকল ভাষায় অনুবাদিত হওয়া উচিত। অনুসন্ধিৎসায় ইয়ুরোপীয়গণ জগৎকে পরাজিত করিয়াছেন; পিতৃভূমি ও মাতৃভাষার উন্নতির জন্য তাহাদের উন্নত হৃদয় সতত ব্যাকুল। বহুপূর্ব্বে বহুভাষাভিজ্ঞ ইয়ুরোপীয় পণ্ডিত গণের চক্ষু ধর্ম্মপদের উপর নিপতিত হইয়াছিল। তজ্জন্য তদ্দেশীয় নানাভাষায় ধম্মপদের অনুবাদ ও সমালোচনা প্রকাশিত হইয়াছে। এ পর্য্যন্ত ইয়ুরোপে ও ভারতবর্ষে ধর্ম্মপদ সম্বন্ধে যে সকল পুস্তক বা প্রবন্ধ প্রকাশিত হইয়াছে, নিম্নে তাহার একটি তালিকা প্রদত্ত হইলঃ—

 (১) ডেনমার্কেবাসী ডাক্তার ফজবোল্ (Fausboll) মূলপালি, লাটিন অনুবাদ ও প্রচুর টীকাটিপ্পনী সহ এক সংস্করণ প্রকাশ করেন (১৮৫৫)। পাশ্চত্য পণ্ডিতগণের মধ্যে তিনিই এ বিষয়ে প্রথম।

 (২) বার্ণুফ (Burnouf) গর্গালি (Gogerly), উফাম (Upham) বেবর (Weber) এবং অন্যান্য নানাদেশীয় পণ্ডিত গণের অনুবাদ।

 (৩) মোক্ষমূলরের প্রথম অনুরাদ (১৮৭০)

 (৪) ধম্মপদ সম্বন্ধে চাইল্ডর্স (Childers) সাহেবের বিস্তৃত মন্তব্য। উহা ১৮৭১ খৃষ্টাব্দের মে মাসের রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটীর জার্ণালে প্রকাশিত হয়।

 (৫) ১৮৭৫ অব্দে প্রকাশিত চাইল্ডার্স্ সাহেব কৃত পলি অভিধানে ধম্মপদের অনেক স্থলের ব্যাখ্যাদির সুমীমাংসা হইয়াছে।

 (৬) আচার্য মোক্ষমূলরের ধম্মপদের সমালোচনা করিতে গিয়া জেমস্ ডি অল উইস্ (James D'Alwis) সাহেবের মন্তব্য।

 (৭) ফার্ণণ্ডি হিউ (Fernand Hu) কৃত ধম্মপদের ফরাসী অনুবাদ।

 (৮) স্যামুয়েল বীল কৃত চীনদেশীয় ধম্মপদের অনুবাদ (১৮৭৮)

 (৯) সীফ‍্নার কৃত জার্মাণ অনুবাদ।[]

 (১০) কলিকাতা Buddhist Text Society হইতে দেবনাগর অক্ষরে মুদ্রিত মূল পালি ও বুদ্ধ ঘোষের টীকার সারাংশ সম্বলিত সংস্করণ।

 (১১) মূল পালি, সংস্কৃত অন্বয় ও ব্যাখ্যা এবং বঙ্গানুবাদ সম্বলিত শ্রীযুক্ত চারুচন্দ্র বসু কৃত সংস্করণ।

 ভারতবর্ষ বৌদ্ধ ধর্ম্মের জন্মস্থান এবং শৈশব ও কৈশোর লীলার পবিত্র ক্ষেত্র। কিন্তু অকৃতজ্ঞ ভারতবর্ষ এক সময়ে নববলে বলী হইয়া জরাগ্রস্ত বৌদ্ধধর্ম্মকে দূরদেশে বিদূরিত করিয়াছিল। আজ ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম্মের সজীবতা নাই। নদী প্রথমে শৈলপাদদেশ হইতে নিস্ক্রান্ত হইয়া ক্রমবর্দ্ধিষ্ণু বলে দেশ দেশান্তর ভাসাইয়া সাগরের পানে ছুটে; তখন সে ভাবে আর তাহাকে শৈলপাদমূলে আসিতে হইবে না! কিন্তু চিরদিন কাহারও সমান যায় না; আবার তাহাকে আসিতে হয়; বরং যথন অসিতে হয়, তখন পূর্ণ জোয়ারের প্রবল বন্যায় শৈলপাদমূল অভিষিঞ্চন করিবার জন্য আসিতে হয়। ভারত হইতে বৌদ্ধধর্ম্ম গিয়াছিল; কত দেশ ভাসাইয়া গিয়াছিল, কোথায় ও সে প্রত্যাখ্যাত হয় নাই। সে নীতিমালা এবং উদার ধর্ম্মতত্ত্ব বহুবৈদেশিক ধর্ম্মের অস্থিমজ্জায় প্রবেশ লাভ করিয়াছে এবং বহুভাষী মনীষিগণের প্রশংসাপত্র ও পুষ্পমাল্য লইয়া আজ পুনরায় আমাদের দ্বারে উপনীত হইতেছে। আশার সঞ্চার হয় না কি?

 বৌদ্ধত্রিপিটক ভারতবর্ষেই সংগৃহীত হয়; কিন্তু তাহা প্রথম শ্যামদেশে স্বর্ণাক্ষরে মুদ্রিত হইয়াছে। ধম্মপদ গ্রন্থ ভারতের সহস্র বিহারে শ্রমণদিগের দ্বারা কণ্ঠস্থ ও অধীত হইত; কিন্তু কলিকাতায় বৌদ্ধ গ্রন্থ সমিতি হইতে উহার সংস্করণের সময়ে সিংহল হইতে পুস্তক আনীত হইয়াছিল (১৮৯৮)। একদিন যে ভারতবর্ষ বহুদেশের সহস্র সহস্র ছাত্র অনিয়া নানা ভাষা, নানা ধর্ম্ম ও নানা শাস্ত্র শিক্ষা দিয়াছিল, আজ সে ভারতবর্য নিজের সম্পত্তির তালিকা পরের মুখে শুনিতেছে। এ সকল নৈরাশ্যের কথার মধ্যেও একটু আশার সংবাদ আছে।

 বৌদ্ধসমিতির পুস্তক দেবনাগর অক্ষরে এবং পালি ভাষায় প্রকাশিত বলিয়া দুই এক জন পালি পণ্ডিত ব্যতীত অন্যের নিকট সমাদর পায় নাই। অবশেযে গতবৎসর আমার শ্রদ্ধেয় বন্ধু সুপণ্ডিত যুক্ত বাবু চারুচন্দ্র বসু মহাশয় বঙ্গাক্ষরে বঙ্গানুবাদ সহ ধম্মপদের এক সংস্করণ প্রকাশ করিয়া তাহার স্বদেশীয় ব্যক্তিবর্গের কৃতজ্ঞতাভাজন হইয়াছেন। তাঁহার পুস্তকদ্বারা দেশের এক মহোপকার সাধন করিয়াছে।

 চারুবাবুকে ধন্যবাদ দিবার সময়ে আর একজন মহাত্মাকে ধন্যবাদ দেওয়া একান্ত প্রয়োজনীয়। পালি ভাষার অদ্বিতীয় পণ্ডিত শ্রীযুক্ত সতীশ চন্দ্র বিদ্যাভূষণ এম, এ মহোদয়ই প্রথম ধম্মপদ প্রকাশের কল্পনা করিয়া কার্য্যারম্ভ করেন। তিনি এই সময়ে তিধ্বতীয় ভাষার অভিধান প্রভৃতি কার্য্যে বিশেষ ব্যাপৃত ছিলেন। এমন সময়ে যখন চারুবাবুর ধম্মপদ প্রকাশের অভিপ্রায় বিজ্ঞাপিত হয়, তখন তিনি স্বয়ং ধম্মপদ প্রকাশের কল্পনা পরিত্যাগ করিয়া সর্ব্ব প্রকারে চারুবাবুর সহায়তা করিতে প্রবৃত্ত হন। সেরূপ সাহায্য নাপাইলে ধম্মপদ গ্রন্থ লোকলোচনের পথবর্ত্তী হইত কিনা জানি না।

 কিন্তু চারুবাবুর ধম্মপদ ও সাধারণ বাঙ্গালী পাঠকের জন্য নহে। কারণ তাহাতে পালি ও সংস্কৃত উত্তম ভাষায় অন্বয় ও ব্যাখ্যাদি আছে এবং সংস্কৃতমূলক বঙ্গানুবাদ সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। আমাদের দেশে এখন ও পালিভাষাভিজ্ঞ পণ্ডিতের সংখ্যা অঙ্গুলিগণ্য এবং সংস্কৃতমূলক বর্ণনাদি, পাঠ করিবার প্রবৃত্তি ও সাধারণ পাঠকের নাই। বিশেষতঃ গ্রন্থখানির আকার বড় এবং মূল্য সর্ব্ব সাধারণের পক্ষে কিছু অধিক। এই সকল কারণে বর্তমান পুস্তক প্রকাশে মনস্থ করি। আমার সোদর-প্রতিম পরম বন্ধু শ্রীযুক্ত পঞ্চানন ঘোষাল এম, এ মহোদয় সর্ব্বপ্রথম এ বিষয় আমাকে উৎসাহিত করেন এবং তাঁহার উৎসাহ-বাক্য সর্ব্বদা আমাকে কার্য্যক্ষেত্রে অগ্রসর করিয়া আমাকে তাহার নিকট চির কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ রাখিয়াছে।

 নীতিমালা কবিতাকারে গ্রথিত না হইলে উহা কণ্ঠস্থ করিবার সুবিধা হয় না। এই জন্য আমি পদ্যানুবাদ করিয়াছি। বর্তমান পুস্তকে পালি বা সংস্কৃত কিছুই নাই; ইহাতে মূল শ্লোকগুলি সরল ও প্রাঞ্জল বাঙ্গালা কবিতায় ভাষান্তরিত করিতে চেষ্টা করিয়াছি। মূলগ্রন্থের ভাবগুলি অবিকল রক্ষা করিয়া সরল পদ্যানুবাদ করিতে যত্ন বা পরিশ্রম কিছুরই ত্রুটি করি নাই। ধম্মপদে, উদার নীতিমালা বঙ্গ দেশের আবালবৃদ্ধবনিতার জ্ঞানগোচর হওয়া উচিত। সম্ভবতঃ বর্তমান পুস্তকে যে উপায় অবলম্বিত হইয়াছে, তাহা ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে প্রস্তাবিত উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইতে পারে না। বর্ত্তমান পুস্তকের আকার ক্ষুদ্র ও মূল্য যথাসম্ভব কম। এই সুলভ ও ক্ষুদ্র-কায় পুস্তকখানি সমস্ত বৌদ্ধশাস্ত্রের সূত্রপিটকের সারনীতি সংগ্রহ করিয়া বঙ্গবাসীর দ্বারে দ্বারে উপস্থিত হইল; আশা হয়, বৃদ্ধদেবের পবিত্রনামে এবং বৌদ্ধধর্ম্মের মহিমায় ইহা কোথায় ও প্রত্যাখ্যাত হইবে না। আশা হয়, যাঁহারা আমাদের আশা ভরসাস্থল সেই বঙ্গদেশীয় ছাত্রবৃন্দ কখনও এই পুস্তকান্তর্গত উচ্চভাবসমূহের মর্যাদা রক্ষা করিতে ভুলিবেন না। প্রস্তাবিত উদ্দেশ্য সাধন করিতে আমি কতদূর কৃতকার্য হইয়াছি, তাহা সুবিজ্ঞ ও সহৃদয় পাঠক স্বয়ং বিবেচনা করিবেন।

 অবশেষে গভীর কৃতজ্ঞতার সহিত জানাইতেছি যে স্বনাম ধন্য, পূজ্যপাদ পণ্ডিতপ্রবর শ্রীযুক্ত সতীশ চন্দ্র বিদ্যাভূষণ এম, এ মহাশয় পুস্তকের আদ্যোপান্ত দেখিয়া দিয়া, স্বকীয় মন্তব্যদ্বারা পুস্তকখানিকে অলস্কুত করিয়া এবং সর্ব্বোপরি সর্ব্বদা আমাকে উপদেশ বাক্যে উৎসাহিত করিয়া স্বীয় উন্নত হৃদয়ের পূর্ণ পরিচয় প্রদান করিয়াছেন। তাঁহার সে ঋণ চিরদিন অপরিশোধ্য রহিবে; কারণ, তাঁহার ঋণ হইতে মুক্তি লাভ করিতে আমার সাধ্যও নাই, ইচ্ছা ও নাই।

ইতি।

 দৌলতপুর
হিন্দু একাডেমী
শ্রীসতীশচন্দ্র মিত্র
২৫ শ্রাবণ, ১৩১২

  1. J. B. Saint-Hilaire, the Buddha and his Religion, p. 96. and Ency. Britannica vol. IV. p. 432.  বুদ্ধদেবের মৃত্যুর পর উরুবিল্ব নিবাসী মহাপণ্ডিত কাশ্যপই জ্ঞানগাম্ভীর্য্যে ও ধর্ম্মসাধনায় সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বলিয়া গৃহীত হন। আনন্দ বুদ্ধদেবের নিত্য সহচরও প্রিয় শিষ্য ছিলেন। উপালি নীচ কুলোদ্ভব হইলেও ধর্ম্মজনিত উন্নতি লাভ করিয়া বিনয় বিভাগের প্রধান উপদেষ্টা বলিয়া আদৃত হন।
  2. ধম্মপদ প্রথমে ১৫ খানি পত্রে লিখিত হয়। Turner, “Mahavansha” p.lxxv.
  3. Rev. S. Beal's Translation of Chinese Dhammabada p.13,
  4. Scheifner's German Translation p.68.
  5. Parables of Buddhaghosha, translated from the Burmese by Captain Rogers.
  6. আচার্য্য মোক্ষমুলর ও এইরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেনঃ—
     I can not see any reason why we should not treat the Verses of the Dhammapada, if not as the utterances, at least as what were believed by the members of the council under Asoka in 243 B. C. to have been the utterances of the founder of Buddhism.
     Dhammapada, Sacred Books of the East, Vol x.
  7. এই সকল মহাত্মগণ ব্যতীত রিস্ ডেভিড‍্স্, স্পেন্স হার্ডি প্রভৃতি পণ্ডিতগণও ধম্মপদ সম্বন্ধে বহুমন্তব্য লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন।

সূচী পত্র।

বিষয়
পত্রাঙ্ক।
১০
১৪
১৭
২২
২৭
৩১
৩৬
৪০
৪৪
৪৯
৫৩
৫৬
৬০
৬৫
৬৯
৭২
৭৬
৮২
৮৭
৯৩
৯৯
১০৩
১০৭
১১৭
১২৫