ধম্মপদ (সতীশচন্দ্র মিত্র)/অর্হদ্‌ বর্গ

সপ্তমসর্গ—অর্হদ্‌বর্গ।

যে জন গন্তব্য স্থানে পৌঁছিয়া সংসারে
হন মুক্ত শোকশূন্য সকল প্রকারে,
সকল গ্রন্থির যা'র হ'য়েছে ছেদন
ইহলোকে নাহি তা'র দুঃখের কারণ॥ ১॥ ৯০॥
যেজন একাগ্রমনে ধর্ম্মাভ্যাসে রত
ভোগসুখে সমাসক্ত নহে যা'র চিত,
সংসার সকাশে তিনি লয়েন বিদায়
মরাল সরসী ছাড়ি যথা চলি' যায়॥২॥
অর্থের সঞ্চয়মাত্র নাহিক যাহার
মানিয়া পরিজ্ঞাত্রয় করেন আহার,[]

শূন্যরূপ অনিমিত্ত পরম নির্ব্বাণ[]
হ'য়েছে গোচরীভূত যার বিলক্ষণ,
দুঃসাধ্য নির্ণয় করা গতিবিধি তাঁ'র―
শূন্যমার্গে বিহগের গতি যে প্রকার॥৩॥

কামাদির দোষ যা’র পাইয়াছে লয়,
আহারের বশীভূত চিত্ত যা’র নয়,[]
অনিমিত্ত শৃন্যাকার পরম নির্ব্বাণ,
হ’য়েছে গোচরীভূত যা’র বিলক্ষণ,
দুর্জ্ঞেয় সংসার ধামে গতিবিধি তা’র
শূন্যমার্গে বিহগের গতি যে প্রকার॥ ৪॥
সারথি অশ্বকে যথা করয়ে শাসন
সেইরূপ বশীভূত যা’র রিপুগণ,
নিষ্পাপ নিরভিমান যেজন সতত
তাহার গৌরবপদ দেবের বাঞ্ছিত॥ ৫॥
গ্রামে ইন্দ্রকীল[] কিম্বা ধরার যেমন
পূজা কিম্বা পদপীড়া উভয় সমান,

সেরূপ সুব্রত জন হয় নির্ব্বিকার,
শুভাশুভ শত্রুমিত্রে সমভাব তা'র;
যেমন কর্দ্দমহীন সরসীর জল,
সেরূপ চরিত্র তা'র শান্ত সুনির্ম্মল॥৬॥
পূর্ণজ্ঞানে মুক্তিলাভ হ'য়েছে যাহার
চিত্ত, বাক্য, কর্ম্ম—সব শান্ত হয় তা'র॥৭॥
গুণের ব্যাখ্যানে যেই অভিরত নয়,
নির্ব্বাণের তত্ত্ব যা'র সুবিদিত হয়,

হইয়াছে ছিন্ন যা’র সংসার বন্ধন,
সদসৎ বিষয়ের অতীত যে জন;
ফুরা’য়ে গিয়াছে যা’র বাসনানিচয়।
সংসারে প্রকৃত সাধু সেইজন হয়॥ ৮॥
গ্রামের ভিতরে কিম্বা বিজন বিপিনে
গভীর সলিলে কি শুষ্ক মরুস্থানে,
যে স্থানেতে অর্হতেরা করেন বিহার।
এ সংসারে রমণীয় সেই স্থান সার॥ ৯॥
অরণ্যানী রমণীয় জানিবে সবায়,
সে স্থানেতে সর্ব্বলোকে আনন্দ না পায়;
কামান্বেষী নহে যত উদাসীনগণ
অরণ্য তাঁ’দের কাছে সুখের সদন॥ ১০॥


  1. বৌদ্ধশ্রমণকে আহার সম্বন্ধে তিনটি বিষয় জ্ঞাত হইয়া চলিতে হয়। এই ত্রিবিধ জ্ঞানই পরিজ্ঞাত্রয়। প্রথমতঃ আহার কোন্ প্রকার তাহা জানিতে হইবে অর্থাৎ নিমন্ত্রিত হইয়া বা পছন্দমত আহার বাছিয়া লওয়া বৗদ্ধ শ্রমণের কর্ত্তব্য নহে। আহারের সময় উপস্থিত হইলে কোন একস্থলে উপস্থিত হইয়া যাহা ভিক্ষা দ্বারা মিলিবে তাহাতেই উদর পূর্ত্তি করা তাহার কর্ত্তব্য দ্বিতীয়তঃ বাহ্য আহার অর্থাৎ অন্নাদি ভোজন অপবিত্র বলিয়া বুঝিতে হইবে। তৃতীয়তঃ আহারের সকল সুখ ত্যাগ করিতে হইবে অর্থাৎ সুখের জন্য যে আহার করিতে হহবে এ ভাবনা বিসর্জ্জন দিতে হইবে। [Childers' Dictionary p 345, Notes of D'Alwis, p.76, চারু বাবুর “ধম্মপদ” ৪৮ পৃঃ দ্রষ্টব্য]
  2. নির্ব্বাণ শূন্যতাময়, অনিমিত্ত ও অপ্রণিহিত― নির্ব্বাণের এই তিনটি প্রকৃতি প্রদত্ত হইয়াছে অর্থাৎ নির্ব্বাণলাভ হইলে জীব শূন্যতায় লীন হয়, তাহার কোন অতীত চিহ্ন থাকে না এবং তাহার রাগদ্বেষাদি নির্ম্মূল হয়। শ্রীযুক্ত সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ এম, এ প্রণীত “শূন্যবাদ” প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য। ভারতী ১৩১১, ২৭১ পৃঃ।
  3. খাদ্য দ্রব্য উদরস্থ করিলেই যে শুধ আহার হয়, তাহা নহে। খাদ্য গ্রহণ, স্পর্শ, চিন্তা ও সংজ্ঞা ভেদে আহার চারি প্রকার।
  4. কোন নগর বা গৃহের দ্বারদেশে ভূপৃষ্ঠে প্রোথিত প্রস্তর- স্তম্ভ। পৃথিবী পৃষ্ঠে বা ইন্দ্রস্তম্ভের গাত্রে পুষ্প বর্ষণ করিলে তাহাতে যেমন তাহার অনন্দ বা নিরানন্দ কিছুই হয় না, জ্ঞানী ব্যক্তিও সেইরূপ নিন্দাস্তুতিতে সমভাব অবলম্বন করিবেন। এখানে ভগবদগীতার ভাবই অভিব্যক্ত হইয়াছেঃ—

    সমঃ শত্রৌ চ মিত্রে চ তথা মানাপমানয়়োঃ—
    শীতোষ্ণসুখদুঃখেষু সমঃ সঙ্গবিবর্জ্জিতঃ।
    তুল্যনিন্দাস্তুতির্মৌনী সম্তষ্টো যেন কেনচিৎ।
    অনিকেতঃ স্থিরমতির্ভক্তিমান্ মে প্রিয়োনরঃ॥

    গীতা, ১২ অধ্যায়।