ধম্মপদ (সতীশচন্দ্র মিত্র)/মার্গ বর্গ

বিংশতিতম সর্গ―মার্গবর্গ।

 মার্গের ভিতর শ্রেষ্ঠ অষ্টাঙ্গিক হয়,[]
সত্য মধ্যে শ্রেষ্ঠ হয় বাক্য চতুষ্টয়
ধর্ম্মের ভিতরে শ্রেষ্ঠ বৈরাগ্য প্রধান
মনুষ্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হয় চক্ষুম্মান॥১॥
পবিত্র অষ্টাঙ্গ মার্গ ধর সবে তাই,
জ্ঞানের বিশুদ্ধি তরে অন্যপথ নাই।
এ মার্গে মারের মোহ ছিন্ন ভিন্ন হয়,
সর্ব্বজনে এই পথ কর সমাশ্রয়॥২॥

 এই পথ ধরি ক্রমে পারিলে চলিতে,
সংসারে দুঃখের অন্ত পারিবে করিতে।
শোক শল্য পূর্ণ ধরা করিয়া বিচার,
করিয়াছি এ মার্গের ব্যবস্থা প্রচার॥৩॥[]
বুদ্ধগণ দিয়াছেন ধর্ম্ম উপদেশ,
তোমাকে করিতে হ’বে উদ্যম বিশেষ।
পথপ্রাপ্ত ধ্যানরত যে মানব হয়
মারের বন্ধন হ'তে সেই মুক্তি পায়॥৪॥
সংস্কার অনিত্য সব,―একথা যখন[]
সম্যক জ্ঞানেতে কেহ করয়ে দর্শন,
সর্ব্বদুঃখে বিনির্ম্মুক্ত সেই জন হয়,
বিশুদ্ধির এই মার্গ জানিবে নিশ্চয়॥৫॥
সংস্কার সকল হয় দুঃখের আকর―
একথা সম্যক্‌জ্ঞানে বুঝে যেই নর

সর্ব্বদুঃখে বিনির্ম্মুক্ত সেই নর হয়
বিশুদ্ধির এই মার্গ জানিবে নিশ্চয়॥৬॥
সকল পদার্থ[] ভবে অনাত্ম সবার—
যেজন বুঝিবে জ্ঞানে এই তত্ত্ব সার
সর্ব্বদুঃখে বিনির্ম্মুক্ত সেই জন হয়,
বিশুদ্ধিলাভের এই সুপথ নিশ্চয়॥৭॥
উত্থানের কালে যেই না করে উখান
হইয়া যুবা ও বলী, অলস প্রধান
অবসন্ন চিত্ত যার সংকল্প বিহীন
স্ফ‌ুর্ত্তিহীন ভাবে যায় জীবনের দিন,
এ হেন নির্ব্বীর্য্য আর অলস যে জন
জ্ঞানমার্গ লাভ নাহি করে কদাচন॥৮॥২৮০॥
বাক্য আর চিত্তে সদা সংযত রাখিবে,
অপবিত্র কার্য্য কোন দেহে না করিবে,—

এই তিন কর্ম্মপথ বিশুদ্ধ রাখিবে
ঋষি প্রদশিত মার্গে ভ্রমণ করিবে॥৯॥
মনের সংযোগ হ'তে জ্ঞান লাভ হয়,
অযোগ[] হইতে জ্ঞান ক্রমে পায় ক্ষয়;
লাভালাভ বিষয়ের এই পথদ্বয়
সম্যক্‌ বুঝিয়া কার্য্য করিবে নিশ্চয়;
হেনভাবে নিবেশিত চিত্তকে করিবে
যাহাতে তোমার জ্ঞান বর্দ্ধিত হইবে॥১০॥
কামনার বনভাগ করহ ছেদন
সদ্বৃত্তি পাদপ কিন্তু ক'রোনা কর্ত্তন।
বন হইতে ভয় জন্মে ওহে ভিক্ষুগণ!
বন উপবন সব করিয়া ছেদন
বনহীন হ’য়ে লভহ নির্ব্বাণ॥১১॥[]

স্ত্রীলোকে আসক্তিশূন্য যাবত না হয়
তাবৎ মানবগণ বদ্ধচিত্ত রয়;―
স্তন্যপায়ী বৎস যথা গাভী পানে চায়,
তেমতি মানব মতি আকৃষ্ট মায়ায়॥১২॥

শারদ-কুমুদ সম আত্ম-অনুরাগ
স্বহস্তে ছেদন করি ফেলহ সত্বর;
উন্মুক্ত নির্ব্বাণপথ বুদ্ধের কৃপায়
সেই দিব্য শান্তিমার্গে হও অগ্রসর॥১৩॥
ইহলোকে বর্ষাকালে থাকিব জীবিত
হেমন্তে বা গ্রীষ্মে দিন হইবে যাপিত―
মুর্খগণ এ চিন্তার সদা ব্যস্ত রয়
বুঝেনা আছয়ে তায় কত অন্তরায়॥১৪॥
পুত্র ধন জনে[] মতি ব্যাসক্ত যাহার
শমনের হাতে তা'র নাহিক নিস্তার;

মহাবন্যা সুপ্ত বনে করয়ে প্লাবন
তেমতি অলক্ষ্যে যম করে আক্রমণ॥১৫॥
পুত্র বলো, পিতা বলো, কিম্বা বন্ধুগণ
কেহই করিতে ত্রাণ পারে না কখন;
যাহাকে করাল কাল করয়ে গ্রহণ
সাধ্য কি তাহাকে ত্রাণ করে জ্ঞাতিগণ?॥১৬॥
যেজন পণ্ডিত আর যেজন নিয়ত
পরিশুদ্ধি চতুষ্টয় শীলে সংরক্ষিত,[]
সে জন অষ্টাঙ্গ মার্গে করিবে আশ্রয়
নির্ব্বাণ প্রাপ্তির যাহা প্রকৃষ্ট উপায়॥১৭॥


  1. অষ্টবিধ নিয়ম সঙ্কলিত যে মার্গ দ্বারা নির্ব্বাণ লাভ হয়, তাহারই নাম অষ্টাঙ্গ মার্গ। এই অষ্টাঙ্গের নামঃ—সম্যক্‌ দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্‌, সম্যক কর্ম্মান্ত, সম্যক আজীব, সম্যক ব্যায়াম, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি। চারিটি সত্য বা সত্যসূচক বাক্যচতুষ্টয় এইঃ―(১) দুঃখ, (২) সমুদয় (দুঃখের উৎপত্তি), (১) নিরোধ (দুঃখের নিরোধ) এবং (৪) মার্গ (নির্ব্বাণের পথ)।
  2. বুদ্ধদেব স্বয়ং শোকশল্যহর্ত্তা নামে অভিহিত হন।
  3. এখানে সংস্কার ও সঙ্কল্প একই অর্থে প্রযুক্ত হইয়াছে। রূপ বেদনাদি পঞ্চস্কন্ধের বিষয় পূর্ব্বে উল্লিখিত হইয়াছে।
  4. মূলে “ধর্ম্ম” শব্দ আছে, উহা এস্থলে পদার্থবোধক। ১ম সর্গের ১ম শ্লোক দ্রষ্টব্য।
  5. চিত্তের স্থৈর্য্যই যোগের লক্ষণ। চিত্তকে বিষয় সমূহ হইতে ফিরাইয়া আনিয়া একাগ্র করাই যোগ। এবং চিত্তের অস্থিরতা বা অনবধানতাই অযোগ।
  6. একটি বিখ্যাত শ্লোক। বনকে ছেদন কর, কিন্তু বৃক্ষকে ছেদন করিও না। প্রবৃত্তি সকল দ্বারা প্রণোদিত হইলে সংসারে যে অত্যাসক্তি এবং তজ্জনিত দুঃখ হয়, তাহাই বন বা উপক্লেশ। এবং পূর্ব্বজন্ম ও পরজন্মার্জ্জিত যে অভ্যাসক্তি তাহাকেই বন ও উপবন বলা হইয়াছে। বৃক্ষ বলিতে চিত্ত বৃত্তিকে বুঝায়। কামনার বন ধ্বংস কর, কিন্তু চিত্তবৃত্তি ধ্বংস করিও না; বৃত্তির ধ্বংস না করিয়া, তাহার অপব্যবহার নিবারণ কর―ইহাই তাৎপর্য্যার্থ এস্থলে নির্ব্বাণ শব্দের ব্যুৎপত্তিগতা অর্থ লইয়া আলোচনা হইয়াছে; যাহাতে বান বা অভিলাষ নাই, তাহাই নির্ব্বাণ, অর্থাৎ সমস্ত অভিলাষ ত্যাগ করিলে নির্ব্বাণ লাভ হয় এবং নির্ব্বাণ লাভ হইলে কোন অভিলাষ থাকে না। বনকে অভিলাষ বা কামনার সমষ্টি স্বরূপ ধরিয়া বলা হইয়াছে যে বনহীন বা নির্ব্বণ হইলে নির্ব্বাণ পাইবে। নির্ব্বণ ও নির্ব্বাণ এই দুইটি শব্দার্থে শ্লেষ হইয়াছে। মোক্ষমুলরের অনুবাদে আছে “cut down the whole forest (of lust) not a tree only” অর্থাৎ একটি বৃক্ষ নয়, সমস্ত বৃক্ষরাজি সমন্বিত বনভূমিকে ধ্বংস কর। কিন্তু এইরূপ অর্থই শ্লোকের উদ্দেশ্য কিনা সন্দেহ স্থল।
  7. মূলে “পুত্র ও পশুতে আসক্ত”—এইরূপ আছে। সে স্থলে পুত্র শব্দ দ্বারা পুত্র কন্যা আত্মীয় স্বজন এবং “পশু” শব্দে ধন সম্পত্তি বুঝাইতেছে। অতি প্রাচীনকালে পশুই মানুষের অর্থ ছিল; তখন মুদ্রার প্রচলন ছিল না। পরস্পরের প্রয়োজনানুসারে যে সকল দ্রব্যের বিনিময় হইত, পশু দ্বারাই তাহাদের মূল্য নির্দ্ধারিত হইত। এইরূপে পশু হইতে pecus ও pecuniary শব্দের উৎপত্তি হইয়াছে। বর্ত্তমান শ্লোকে সম্ভবতঃ “পশু” শব্দ এইরূপেই “সম্পদ” অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে।
  8. প্রথম সর্গের দশম শ্লোক দ্রষ্টব্য।