নব্য জাপান ও রুষ জাপান যুদ্ধের ইতিহাস/ঐতিহাসিক বৃত্তান্ত/নবযুগ

নবযুগ।

 বলিতে গেলে, সােগানাধিপত্য অবসানের পর বৎসরে—১৮৬৮ খৃঃ অব্দে—প্রাচীন জাপান নবজীবন প্রাপ্ত হয়। এই বৎসরে “মেইজি” অব্দের প্রবর্ত্তন হয়। এই বৎসরে রাজধানী কিয়াটো নগর হইতে জেডো নগরে স্থানান্তরিত হয়। এই বৎসরেই জেডো নাম পরিবর্ত্তিত হইয়া উহা টোকিয়ো অর্থাৎ প্রাচ্য রাজধানী নামে অভিহিত হয়।

 প্রথম মেইজি অব্দে মিকাডো মেঘমুক্ত প্রভাকরের ন্যায় সিংহাসনে প্রতিভাত হইয়া, একখানি ঘোষণা পত্র প্রচার করেন। এই পত্রে নিম্নলিখিত পাঁচটী বিষয় লিখিত হইয়াছিল। যথা,— (১) রাজ্যের যাবতীয় কার্য্য দেশের বিদ্বান সম্প্রদায় কর্ত্তৃক পরিচালিত হইবে। (২) প্রাসাদবাসী সম্রাট হইতে পর্ণকুটীরবাসী কৃষক পর্য্যন্ত সকল ব্যক্তিকেই জাতীয় উন্নতির জন্য আত্মােৎসর্গ করিতে হইবে। (৩) দেশের অধিবাসী মাত্রেই দেশীয় শিল্পের সহায়তা করিবেন। (৪) প্রাচীন রাজনীতির সংস্কার হইবে। (৫) জাতীয় সঞ্জীবন শক্তির অনুকূল শিক্ষাপ্রণালী প্রবর্ত্তিত হইবে।

 এই ঘােষণা প্রচারের কতিপয় বৎসর পরে, ১৮৮৯ খৃঃ ১১ই ফেব্রুয়ারী তারিখে সম্রাট আর একটী ঘােষণা প্রচার দ্বারা জাতীয় মহা সমিতি গঠন করেন। সভ্যতাভিমানী ইয়ুরােপীয় রাজন্যবর্গ নররুধিরে বসুন্ধরা সিক্ত হইতে দেখিয়াও প্রজা সাধারণকে যে অধিকার প্রদান করিতে সঙ্কোচ বােধ করেন, জাপান সম্রাট স্বয়ং উদ্যোগী হইয়া প্রজাগণকে সেই অধিকার প্রদান করিলেন।

 এসিয়া খণ্ডে জাপানেই সর্ব্বপ্রথমে রাজার শাসনদণ্ড প্রজার হস্তগত হয়। এই প্রাচ্য মহাসাগরের ক্ষুদ্রদ্বীপের অধীশ্বরকে যুদ্ধে পরাস্ত করিয়া তাঁহার প্রজারা শাসনদণ্ড গ্রহণ করে নাই। রাজা স্বেচ্ছায়, উপযাচক হইয়া প্রজাদিগের হস্তে শাসন ক্ষমতা প্রদান করিয়াছিলেন। এরূপ মহানুভবতা জগতের ইতিহাসে অতি বিরল। যে শাসনক্ষমতা লাভ করিবার জন্য রুষিয়ার কোটী কোটী প্রজা বহু বৎসর হইতে প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছে, নরশােণিত ধারায় পৃথিবী কর্দ্দমাক্ত করিতেছে, সেই শাসনদণ্ড জাপানীরা অযাচিত ভাবে প্রাপ্ত হইয়াছে। জাপান সম্রাট মৎসুহিতো দেখাইয়াছেন যে, এক কালে যে বৌদ্ধ নরপতিগণ পরের সেবার জন্য আপনার যথাসর্ব্বস্ব দান করিয়া ভিক্ষুক হইতেও কুণ্ঠিত হইতেন না, তিনি সেই শ্রেণীর বৌদ্ধ নৃপতিগণেরই অন্যতম। তিনি পরের কল্যাণ কামনায় সুদুর্লভ রাজশক্তি পরিত্যাগ করিতে মুহূর্ত্ত মাত্র ইতস্ততঃ করিলেন না। জাপান সম্রাট এখন প্রজাবৃন্দের হস্তে রাজদণ্ড সমর্পণ পূর্ব্বক তদ্বিনিময়ে প্রজার নিকট হইতে অনন্যসুলভ শ্রদ্ধা ও ভক্তি প্রাপ্ত হইয়াছেন। প্রজার শ্রদ্ধাভাজন হইয়া তিনি কেবল রাজমুকুট ও রাজ সিংহাসন লইয়াই সন্তুষ্ট আছেন।

 অদ্য উনচত্বারিংশৎবর্ষ মাত্র হইল, মেইজি অব্দ প্রবর্ত্তিত হইয়াছে। এই অনতিদীর্ঘসময়মধ্যে নব্য জাপান যে অনন্যসাধারণ উন্নতিলাভ করিয়াছে, তাহা পৃথিবীর ইতিহাসে অপূর্ব্ব। এই স্বল্পসময় মধ্যে পৃথিবীর কোনও জাতি এতাদৃশ উন্নতিলাভে সমর্থ হয় নাই। এই উন্নতির গুঢ়তত্ত্ব সম্বন্ধীয় সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমরা যথাক্রমে লিপিবদ্ধ করিতেছি।


জাপানের প্রসিদ্ধ ব্যক্তিগণ।

রাজ পরিবার।

 জাপানের বর্ত্তমান সম্রাট মৎসুহিতো ১৮৫২ খৃষ্টাব্দের ৩রা নবেম্বর তারিখে কিয়াটো নগরে জন্মগ্রহণ করেন। ইনি নিপণের সর্ব্বপ্রথম সম্রাট জীমূতমনু হইতে ১২০ পুরুষ অধস্তন। ইঁহার পিতার নাম কেমিয়ামনু ও মাতার নাম অশােকা। ইনি ১৮৬৬ খৃঃ অব্দের ১৩ই ফেব্রুয়ারি তারিখে মিকাডো অর্থাৎ দেবতার প্রতিনিধি উপাধি ধারণ করিয়া জাপানের রাজসিংহাসনে আরােহণ করেন। এই অব্দের ১২ই অক্টোবর তারিখে মহাআড়ম্বর সহকারে সম্রাটের মুকুটোৎসব সম্পন্ন হয়।

 মৎসুহিতো মিকাডোর ন্যায় বুদ্ধিমান, কার্য্যতৎপর, শান্তিপ্রিয়, অশেষগুণসম্পন্ন, প্রজারঞ্জক নরপতি পৃথিবীতে অধিক দৃষ্ট হয় না। মিকাডো রাজকোষ হইতে প্রতিবর্ষে ৪৫ লক্ষ মুদ্রা পাইয়া থাকেন। ইহা ভিন্ন পূর্ব্বপুরুষ-সঞ্চিত প্রচুর স্বর্ণমুদ্রায় ও মণি মাণিক্যে তাঁহার ভাণ্ডার পরিপূর্ণ। জনৈক ইয়ুরােপীয় পরিব্রাজক বলেন, এই সঞ্চিত ধনের মুল্য দুই শত কোটী টাকার ন্যূন হইবে না। সম্রাট অশ্বারােহণে ভ্রমণ করিতে বড় ভাল বাসেন। তাঁহার মন্দুরায় নানাদেশীয় অতি উৎকৃষ্ট অশ্ব আছে। সদগ্রন্থ ও সংবাদপত্র পাঠে সম্রাটের সমধিক অনুরাগ দৃষ্ট হয়। তিনি মধ্যে মধ্যে কবিতা রচনা করিয়া সময়ের সদ্ব্যবহার করিয়া থাকেন। সম্রাট প্রজামাত্রকেই সন্তানের ন্যায় দর্শন করিয়া থাকেন।[]

 সম্রাটমহিষী হারুকো ১৮৫০ খৃঃ ২৪শে মে তারিখে ভূমিষ্ঠ হয়েন। ১৮৬৯ অব্দের ৯ই ফেব্রুয়ারি তারিখে মিকাডোর সহিত ইহাঁর উদ্বাহক্রিয়া সম্পন্ন হয়। মিকাডো মহিষী পতিব্রতা, বিদুষী ও কার্য্যপ্রিয়া বলিয়া বিখ্যাত। অসংখ্য দাসদাসীতে রাজপ্রাসাদ পরিপূর্ণ থাকিলেও, ইনি স্বহস্তে সংসারের বিবিধকার্য্য সম্পাদন করিয়া থাকেন। সাম্রাজ্যের হিতকর যে কোন কার্য্যেই সম্রাটমহিষীর সহানুভূতি দৃষ্ট হয়। রাজ্যের কত দীন, পীড়িত ও নিরন্ন পরিবার যে সাম্রাজ্ঞীর অর্থসাহায্যে রক্ষা পাইতেছে, কেহ তাহার সংখ্যা করিতে পারে না। সম্রাটের ন্যায় ইনিও সুকবি বলিয়া প্রসিদ্ধ।

 বহু সন্ততির জনক জননী হইলেও সম্রাটদম্পতির সন্তান ভাগ্য প্রসন্ন নহে। তাঁহাদের প্রথম পুত্র ও প্রথমা কন্যা ভূমিষ্ঠ দিবসেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। ২য়, ৪র্থ ও ৫ম পুত্র এবং ২য়, ৩য়, ৪র্থ, ৫ম ও ১০ম কন্যা ভূমিষ্ঠের অল্পদিবস মধ্যেই ইহলােক হইতে অপসারিত হয়। এক্ষণে তৃতীয় পুত্র এবং ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী কন্যা জীবিত আছেন। মাসাকো, ফুসাকো, নবুকো ও একিকো নাম্নী রাজকন্যা চতুষ্টয় জননীর ন্যায় বিদ্যাবতী ও গুণবতী বলিয়া পরিচিতা।

 সম্রাটের তৃতীয় পুত্র যশােহিত হারুনোমিয়া বহু পরিমাণে পিতৃগুণসম্পন্ন। ১৮৭৯ খৃষ্টাব্দের ৩১শে আগষ্ট তারিখে ইহাঁর জন্ম হয়। ১৮৮৮ খৃঃ ৩রা নবেম্বর তারিখে ইহাঁকে “কৌতেসী” অর্থাৎ জাপানের যুবরাজ বলিয়া ঘােষিত করা হয়। ১৯০০ অব্দের ১০ই মে তারিখে সাদাকো নাম্নী জনৈকা গুণবতী আভিজাতকুমারীর সহিত যুবরাজের বিবাহ হয়। পর বৎসর ২৯শে এপ্রেল তারিখে যুবরাজদম্পতির প্রথম পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। তাহার নাম হিরােহিত। যুবরাজের দ্বিতীয় পুত্র বাশুহিত ১৯০২ খৃঃ ২৫শে জুন তারিখে ভূমিষ্ঠ হয়েন। তৃতীয় পুত্র নবুহিত, গত ১৯০৫ অব্দের ৩রা জানুয়ারি তারিখে জন্মগ্রহণ করেন।


 মার্কুইস হিরােবুমি আইটো।——ইনি জাপানের চাণক্য বলিয়া পরিচিত। ইহাঁর ন্যায় মন্ত্রণানিপুণ ও রাজনীতিবিশারদ ব্যক্তি সমগ্র জাপান-মধ্যে দৃষ্টিগােচর হয় না। ইনি ১৮৬৩ খৃঃ গোপনে জন্মভূমি পরিত্যাগ পূর্ব্বক সর্ব্বপ্রথমে ইংলণ্ডে গমন করেন। আইটো এই সময় “ন্যাভিগেশন” “ষ্টীমার” প্রভৃতি দুই চারিটী শব্দ ব্যতীত ইংরেজী ভাষার কিছুই জানিতেন না। ইনি স্বদেশে প্রত্যাগত হইয়া সর্ব্বপ্রথমে ইয়ুরােপের অনুকরণে জাপানে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপন করেন। এই বিদ্যালয় এক্ষণে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিত সংযুক্ত হইয়াছে। ইহাঁরই অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রাচীন জাপান জীর্ণবাস পরিত্যাগ করতঃ নূতন বস্ত্র পরিধান করিয়াছে।

 আইটো রাজনীতি ও শিক্ষাপ্রণালীর সংস্কার সাধনে উদ্যোগী হইলে জাপানের রক্ষণশীলদল তাঁহার ভীষণ শত্রু হইয়া উঠে। পরিশেষে এই শত্রুতা এত প্রবল হইয়াছিল যে একদিন অপরাহ্নে চা-গৃহে গমনকালে ইনি পথিমধ্যে শত্রুগণের হস্তে আক্রান্ত হন। একটী জাপানীবালিকা নিজ কুটীরে আশ্রয় দিয়া সে যাত্রা তাঁহার জীবন রক্ষা করে। আশ্চর্য্যের বিষয় আইটো কিছুদিন পরে এই দয়াবতী রমণীকে পত্নীরূপে প্রাপ্ত হয়েন।

 মার্কুইস মহােদয় এক্ষণে প্রাচীন হইয়াছেন। জাপানবাসিরা ইহাঁকে দেবতার ন্যায় ভক্তি ও শ্রদ্ধা করিয়া থাকে। ইনি এক্ষণে সম্রাটের বিশেষ অনুরােধে কোরিয়া রাজ্যে জাপান রাজপ্রতিনিধির কার্য্য করিতেছেন।

 মার্কুইস আরিযোশী ইয়ামাগাটা।——জাপানের সর্ব্বপ্রথম সেনাপতি। ইহাঁর বিদ্যা, বুদ্ধি ও বিক্রম অসাধারণ। বয়ষ ৭২ বৎসর হইলেও মার্কুইসের দেহের ও মনের তেজ অদ্যাপিও হ্রাস হয় নাই। ইনি এক্ষণে ফিল্ডমার্শাল উপাধি ধারণ করিয়া স্বদেশের সৈন্যগঠন কার্য্যে নিযুক্ত আছেন।

 কাউণ্ট কাটসুরা।——গত রুষ জাপান যুদ্ধের সময়ে ইনি জাপানের “দৈজো-দেজিন”, অর্থাৎ প্রধান মন্ত্রিপদে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। যুদ্ধবিদ্যায় ইনি ইয়ামাগাটার প্রিয়শিষ্য এবং কুটমন্ত্রণায় আইটোর সমকক্ষ। ইহাঁর কৌশল ও সুমন্ত্রণায় জাপান সাম্রাজ্য অল্প দিবসেই সভ্যজগতের মধ্যে পরিগণিত হইয়াছে।

 মার্কুইস সৈয়নজি কিনমৎসু,—— বর্ত্তমান বৎসরে (১৯০৬ খৃ) ইনি জাপানের প্রধান মন্ত্রীপদে অধিষ্ঠিত হইয়াছেন। এই অল্প সময়ের মধ্যে ইনি জাপানের অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্য সম্বন্ধে যেরূপ অসাধারণ উন্নতি সাধন করিয়াছেন, তাহাতে ইহাঁর বুদ্ধিমত্বা ও কার্য্যতৎপরতার সম্যক পরিচয় পাওয়া গিয়াছে।

 ব্যারণ কমুরা,——গত মহাযুদ্ধের সময়ে ইনি জাপানের পররাষ্ট্রসচিব ছিলেন। জাপান সাম্রাজ্যের মধ্যে ইনি একজন বিচক্ষণ রাজনীতিক বলিয়া পরিচিত। ইনি আমেরিকার পাের্টস্‌মাউথ নগরে উপস্থিত থাকিয়া রুষ-জাপান যুদ্ধের সন্ধিপত্রে জাপান সম্রাটের পক্ষে নাম স্বাক্ষর করেন। ব্যারণ মহােদয় এক্ষণে জাপানের রাজদূত স্বরূপে ইংলণ্ডে অবস্থান করিতেছেন।

 কাউণ্ট কাটোটাকাকী,——বর্ত্তমান বৎসরে ইনি জাপানের বৈদেশিক মন্ত্রীপদে অধিষ্ঠিত হইয়াছেন।

 কাউণ্ট অকুমা,——ইতিপূর্ব্বে জাপানের রাজস্ব সচিব ছিলেন। ইনি সর্ব্বদাই অকপট চিত্তে দেশের উপকার করিয়া থাকেন। সমগ্র রাজ্যমধ্যে ইহাঁর শত্রু নাই। ইহাঁর ন্যায় সরলভাষী, সুবক্তা ও লেখক জাপান রাজ্যে অধিক দৃষ্ট হয় না।

 ব্যারণ সাকাটানি যশিরো,——জাপানের বর্ত্তমান রাজস্ব-মন্ত্রী। ইনি অল্পদিবস মধ্যে জাপানের রাজস্ববিষয়ক বিবিধ উন্নতি সাধন করিয়াছেন। সাম্রাজ্যের আয়ব্যয় সম্বন্ধীয় প্রত্যেক বিভাগেই ইহাঁর প্রখর দৃষ্টি দেখিতে পাওয়া যায়।

 লেপ্টনাণ্ট জেনারল টেরাউচি,——ইনি এক্ষণে জাপানের যুদ্ধমন্ত্রীর পদে নিযুক্ত রহিয়াছেন। ইহাঁর ন্যায় সুকৌশলী কূটমন্ত্রণানিপুণ সেনাপতি পৃথিবীতে বিরল। ইহাঁর কার্য্য সকল বিদ্যুতের ন্যায় মহাদ্রুতগতিতে সম্পন্ন হয়।

 মার্কুইস ওয়ামা,——বয়ষ ৬২ বৎসর। গত মহাযুদ্ধে ইহাঁর অদ্ভুত রণপাণ্ডিত্য ও অসাধারণ সৈন্য পরিচালনাশক্তি দর্শন করিয়া সভ্যজগৎ স্তম্ভিত হইয়াছিল। গৃহে পরিজনগণের নিকটে ইনি ভদ্র, শান্ত ও হাস্যবদন; কিন্তু রণক্ষেত্রে, শক্রসমক্ষে কালান্তক শমন। ইনি ১৮৯৪ খৃঃ চীনজাপান যুদ্ধে অশীতি সহস্র সৈন্য লইয়া যুদ্ধে জয়লাভ করেন। গত রুষজাপান যুদ্ধে ইনি প্রধান সেনাপতি রূপে অসংখ্য জাপানবাহিনী পরিচালিত করিয়াছিলেন। ইহাঁর দেহের দৈর্ঘ্য প্রায় ৬ ফুট হইবে। মার্কইসের পত্নী জাপান সাম্রাজ্যমধ্যে বিদুষী বলিয়া পরিচিতা। ইহাঁর দুইটী পুত্র ও একটী কন্যা আছে।

 কাউণ্ট নডজু,——বয়স ৬১ বৎসর। সকলের বিশ্বাস ইহাঁর ন্যায় রণনিপুণ সেনাপতি জাপানে আর নাই। কাউণ্ট মহাশয় মহাযুদ্ধ ভিন্ন আনন্দানুভব করেন না। সৈন্যগণ মধ্যে ইহাঁর বিশেষ প্রতিপত্তি আছে। ইনি জাপানিগণ মধ্যে মহাবলশালী ও কুস্তিকুশল ব্যক্তি বলিয়া বিখ্যাত। গত মহাযুদ্ধে ইনি জাপান অনীকিনীর মধ্যভাগ পরিচালন করিয়া অদ্ভুত সমরনৈপুণ্যের পরিচয় প্রদান করিয়াছিলেন।

 ব্যারণ কুরোকী,——বয়ষ ৬১ বৎসর। এইরূপ শুনা যায়, ইহাঁর পিতা রুষাধিকৃত পােলণ্ডদেশ হইতে জাপানে আগমন করিয়াছিলেন। কামানের গভীর গর্জ্জন, আহতের হৃদয়বিদারী আর্তনাদ, মুমূর্ষুর কাতরতা, কিছুতেই ইহাঁর ভ্রুক্ষেপ নাই। ব্যারণ মহােদয় মৃত্যুকে অতি তুচ্ছ বলিয়া মনে করেন। রণক্ষেত্র তাঁহার নিকট ক্রীড়াক্ষেত্র স্বরূপ প্রতীয়মান হয়। গত মহাযুদ্ধে ইনি জাপান চমূর দক্ষিণপার্শ্ব পরিচালনা করিয়াছিলেন।

 কাউণ্ট ওকু,——বয়ষ ৬৫ বৎসর। ইহার মুখশ্রী সুন্দর ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সুগঠিত। কাউণ্টের বেগ প্রতি প্রচণ্ড। ইনি যুদ্ধক্ষেত্রে কোনও বিঘ্ন অনতিক্রম্য বলিয়া বিশ্বাস করেন না। কাউণ্ট মহােদয় জীবনের কোন সময়েই শত্রুগণকে হাস্য করিবার অবসর প্রদান করেন নাই। মহামহিম ভারত সম্রাটের মকুটোৎসব সময়ে ইনি দিল্লী নগরীতে শুভাগমন করিয়াছিলেন। গত মহাযুদ্ধে ইনি জাপান সৈন্যের বামপার্শ্ব রক্ষা করিয়াছিলেন।

 কাউণ্ট নগী,——ইহার ন্যায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও কঠোর অন্তঃকরণবিশিষ্ট সেনাপতি জাপান সাম্রাজ্যে দেখিতে পাওয়া যায় না। এ পর্যন্ত কেহই ইহাঁর নয়নে শােকাশ্রু বহির্গত হইতে দেখে নাই। কাউণ্ট লক্ষপতি হইয়াও অতি দীনপ্রজার ন্যায় জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিয়া থাকেন। সম্রাট ও স্বদেশ ভিন্ন কাহারও উপরে তাঁহার মায়া মমতা নাই। গত মহাযুদ্ধে ইনি আর্থার বন্দর অধিকার করিয়া সমগ্র পৃথিবীবাসীর বিস্ময় উৎপন্ন করিয়াছিলেন। এই কালসমরে তাঁহার দুইটী পুত্রেরই মৃত্যু হয়।

 ভাইস এডমিরাল সেটো মিনরু,——বর্ত্তমান বৎসরে ইনি জাপানের জলযুদ্ধ বিভাগের মন্ত্রীপদে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছেন। ইনি পৃথিবীর নানারাজ্য পরিভ্রমণ করিয়া প্রচুর অভিজ্ঞতা অর্জ্জন করিয়াছেন।

 এডমিরাল টোগো,——ইংরাজেরা ইহাঁকে জাপানের নেলসন বলিয়া অভিহিত করিয়া থাকে। গত মহাযুদ্ধে ইহাঁর জলযুদ্ধকৌশল দর্শন করিয়া সমগ্র সভ্যজগৎ বিস্মিত ও স্তম্ভিত হইয়াছে। ইহাঁর সংকল্প স্থির ও অধ্যবসায় অসাধারণ। মন্ত্রগুপ্তিতে পৃথিবীর কোন সেনাপতিই ইহাঁর সমকক্ষ নহেন। এডমিরাল মহোদয় কোন সময়েই অধিক কথা কহিতে ভাল বাসেন না। ইহাঁর গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলে, তাহা নিতান্ত দীনব্যক্তির কুটীর বলিয়া অনুভব হয়। সম্প্রতি রাজ-চিত্রকর মরূকী জাপানের নানাস্থানে ইহাঁর ছায়াচিত্র বিক্রয় করিতে আরম্ভ করায়, ইনি নিতান্ত দুঃখিত হইয়াছিলেন। ইহাঁর পুত্র ও কন্যাগণও সর্ব্বাংশে পিতৃগুণবিশিষ্ট। এডমিরাল মহোদয় অল্পকাল মধ্যেই ইংলণ্ডে গমন করিবেন বলিয়া সমগ্র ইয়ুরােপ ব্যাপিয়া হুলস্থুল পড়িয়া গিয়াছে। ইনি এক্ষণে জাপানের প্রধান নৌসেনাপতিপদে অবস্থিত রহিয়াছেন।

 এডমিরাল ক্যামিমুরা,——জাপানের দ্বিতীয় নৌসেনাপতি। গত মহাযুদ্ধে ইনি ভ্যালাডিবােষ্টক বন্দর অবরূদ্ধ করিয়া ছিলেন।

 ভাইস এডমিরাল কটাক্ষ,——জাপানের নৌসেনাপতি। ইহাঁরই বুদ্ধিকৌশলে অতি অল্প সময় মধ্যে রুষাধিকৃত সাগালিয়ন জাপান সৈন্যের হস্তগত হয়।

 ব্যারণ শিবসহা,——ইনি জাপান সাম্রাজ্যের কুবের বলিয়া পরিচিত। ইহাঁর মূলধন শতকোটী মুদ্রার অধিক হইবে। ইনি বুদ্ধিমান, সুলেখক ও প্রাচীন বলিয়া সর্ব্বত্র সম্মানিত। অর্থনীতি ও বার্ত্তাশাস্ত্রে ইহাঁর প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে। গত মহাযুদ্ধে ব্যারণ মহােদয় সমস্ত সম্পত্তিই সম্রাটচরণে উৎসর্গ করিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে যাইবার অভিপ্রায় প্রকাশ করিলে, সম্রাট তাঁহাকে ধন্যবাদ দিয়া নিবৃত্ত করেন।

 ইহা ব্যতীত জাপানে আরও বহুসংখ্যক কৃতবিদ্য ও কার্য্যকুশল ব্যক্তি অবস্থিতি করিতেছেন। যাঁহারা পৃথিবীর নানাস্থানে দৌত্যকার্য্যে নিযুক্ত রহিয়াছেন, তাঁহারা সকলেই সুপণ্ডিত ও রাজনীতি বিশারদ। এক্ষণে জাপানে প্রিন্স ১২ জন, মার্কুইস ৩৪ জন, কাউণ্ট ৯০ জন, ভাইকাউণ্ট ৩৬২ জন ও ব্যারণ উপাধিধারী ২৮৭ জন সুশিক্ষিত ও বহুশাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি বিদ্যমান আছেন।


  1. সম্রাট প্রজাদিগকে কিরূপ ভাল বাসেন, তাহা দেখাইবার জন্য সম্রাটলিথিত একখানি গ্রন্থ হইতে কয়েকটী কবিতা অনুবাদসহ স্থানান্তরে প্রদত্ত হইয়াছে।