নব্য জাপান ও রুষ জাপান যুদ্ধের ইতিহাস/ধর্ম্মপ্রণালী

ধর্ম্মপ্রণালী।

 আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, শিণ্টোধর্ম্ম জাপানের প্রাচীন ধর্ম্ম। এক্ষণে এই ধর্ম্মাবলম্বী লােকদিগকে সিন্‌জু বলে। সূর্য্যসহধর্ম্মিনী অমতেরাশু বা উষাদেবী সিনজুগণের আরাধ্যা দেবী। দেশের নানাস্থানে মিয়াসিয়া নামে সিনজুদিগের ধর্ম্মমন্দির আছে। মন্দিরের পুরােহিতগণ নেগি ও কানিগি নামে অভিহিত হইয়া থাকে। সিন্‌জুগণ মস্তক মুণ্ডন করে না। ইহারা বিবাহ গৌরবের বিষয় বলিয়া মনে করে। সিন্‌জুদিগের একটী বিশেষত্ব এই যে, ইহারা গাত্রবস্ত্রে ও শিরস্ত্রাণে স্বীয় নাম ও বাসস্থান প্রভৃতি আবশ্যকীয় পরিচয় লিখিয়া রাখে। ইহারা মাসের প্রথম, পঞ্চদশ ও অষ্টাবিংশতি দিবসে উপাসনা ভিন্ন অন্য কোন গৃহকার্য্য করে না। সিনজুগণ রাজাজ্ঞাপালন, তীর্থ ভ্রমণ, ভিখারীভোজন, পুণ্যদিনে দান করণ ইত্যাদি কার্য্য ইহলোক ও পরলোকের কল্যাণপ্রদ বলিয়া বিশ্বাস করে।

 খৃষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে চীনদেশীয় প্রচারকগণ জাপানে বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচার করিতে আরম্ভ করেন। এই সময়ে জাপানে শিণ্টোধর্ম্ম, ভারতীয় তান্ত্রিকধর্ম্ম ও চীনদার্শনিক কনফিউসিয়াস্ প্রবর্ত্তিত একটী প্রাচীন ধর্ম্ম বিদ্যমান ছিল।

 এক্ষণে জাপানের অধিকাংশ ব্যক্তিই বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বী। প্রায় প্রতি পল্লীতেই বৌদ্ধধর্ম্মমন্দির ও যাজক দেখিতে পাওয়া যায়।

 জাপানে প্রত্যেক গৃহস্থের বাটীতে তিনটী পবিত্র স্থান আছে। প্রথম, কামিদানা অর্থাৎ সৃষ্টিকর্ত্তা ভগবানের পূজাস্থান; দ্বিতীয়, বুদসুদান অর্থাৎ বুদ্ধবেদী; তৃতীয়, ইউজি-গেমি অর্থাৎ কুলদেবতা-গৃহ। এই সকল স্থানে প্রত্যহ যথারীতি পূজা হইয়া থাকে। সিনজুগণ দেবতার সম্মুখে দর্পন, শুভ্রবস্ত্র ও পানপাত্র স্থাপন করিয়া চাউল, সাকি ও বিবিধ মৎস্যসহযোগে উপাসনায় প্রবৃত্ত হইয়া থাকে। বৌদ্ধগণ দেবপূজায় মৎস্য ব্যবহার করে না। টৌরীশাখা, কদলীপত্র ও বিচালিনির্ম্মিত রজ্জু দেবকার্য্যে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। পূজাগৃহে প্রত্যহ দীপদান করা হয়।

 রাজ প্রাসাদে তিনটী পবিত্র মন্দির আছে। ১ম,—কাশিকোদোকোরো; এইখানে প্রত্যহ অমতেরাশু অর্থাৎ উষাদেবীর অর্চ্চনা হইয়া থাকে। ২য়,—কোরাইদেন; এই মন্দিরে সম্রাটের পূর্ব্বপুরুষগণের উদ্দেশে প্রত্যহ পূজা হইয়া থাকে। ৩য়,—শিনদেন; এইখানে বহুসংখ্যক দেবদেবীসহ ভগবান অমিতাভ অর্থাৎ বুদ্ধদেবের পূজা হইয়া থাকে।

 জাপানবাসী সিনজু ও বৌদ্ধদিগের মধ্যে কাহারও মৃত্যু হইলে আত্মীয় স্বজনেরা মৃতের ঔর্দ্ধদৈহিক ক্রিয়াদি সম্পন্ন করিয়া থাকে। বৌদ্ধেরা ৭ দিনে প্রথম শ্রাদ্ধ, ১৪ দিনে দ্বিতীয় শ্রাদ্ধ এইরূপে ৪৯ দিনে ৭টী শ্রাদ্ধ করিয়া শুদ্ধ হইয়া থাকে। সিনজুগণের মধ্যে কি-নিচি (দিন-শ্রাদ্ধ) সাে-সুকি (মাসিক-শ্রাদ্ধ) ও লেন-কি অর্থাৎ বার্ষিক শ্রাদ্ধের প্রথা প্রচলিত আছে। বার্ষিক শ্রাদ্ধ সিনজুগণের মধ্যে ১, ৫, ১০, ২০, ৩০, ৪০ ও ৫০ বৎসরে এবং বৌদ্ধগণের মধ্যে ১, ৩, ৭, ১৩, ১৭, ২৩, ২৭, ৩৩, ৩৭, ৪৩, ৪৭, ৫০ ও ১০০ বৎসরে হইয়া থাকে। শ্রাদ্ধকার্য্য নিজগৃহে, কোন তীর্থস্থানে বা দেবমন্দিরে পুরােহিত কর্ত্তৃক সম্পাদিত হইয়া থাকে।

 বর্ত্তমানে জাপানে একাদশটী মহােৎসব হইয়া থাকে। যথা, সেনসাই, (নববর্ষ) এইদিনে সম্রাট স্বয়ং জীমুতমনু ও নিজপিতা কেমিয়ামনুর পূজা করিয়া থাকেন। ২য় জেনসাই, (শীতোৎসব) ৩য় সিনেন-ক্বোয়াই, (বর্ষপূজা) ৪র্থ কেমিয়াসাই, এই দিনে সম্রাটের পিতার মৃত্যুতিথি পূজা হইয়া থাকে। ৫ম কিজেন সেটসু, জাপানের সর্ব্বপ্রথম সম্রাটের সিংহাসনারােহণ উপলক্ষে প্রতিবর্ষের ১১ই ফেব্রুয়ারি তারিখে এই উৎসব হইয়া থাকে। ৬ষ্ঠ সিউনকি-কোরি, (বসন্তোৎসব) প্রতিবর্ষের ২০ মার্চ্চ তারিখে হইয়া থাকে। ৭ম জীমুতমনু সাই, প্রতিবর্ষের ৩ এপ্রিল তারিখে হইয়া থাকে। ৮ম জিউকি-কোরি-সাই (শরতােৎসব) প্রতিবর্ষের ২৩শে সেপ্টেম্বর তারিখে এই পর্ব্ব উপলক্ষে সকলেই পূর্ব্বপুরুষগণের পূজা করিয়া থাকে। ৯ম কালেম-মাৎসুরি বা সিনশো সাই (নবান্ন) ১০ম তেনচো-সেটসু (বর্ত্তমান সম্রাটের জন্মদিন) ১১শ নমনো মাৎসুরি, ২৩শে নবেম্বর তারিখে নূতনধান্য ছেদন উপলক্ষে এই উৎসব হইয়া থাকে।

 এতদ্ভিন্ন জাপানে আরও কয়েকটী জাতীয়-উৎসব প্রচলিত আছে।

 ভগবান গৌতম বুদ্ধ স্বীয় শিষ্যবর্গের মধ্যে যে কয়টী নিষেধাজ্ঞা প্রচার করিয়াছিলেন, তন্মধ্যে সেসিত (অহিংসা) ফুলতা (চুরি না করা) সিজেন (সৎশীলতা) সেগো (সত্যবাদিতা) প্রভৃতি কয়েকটী অনুশাসন জাপানবাসী বৌদ্ধগণের মধ্যে প্রবল দেখা যায়।

 ১৫৪৯ খৃষ্টাব্দের ১৫ই আগষ্ট তারিখে ফ্রান্সিস জেভিয়ার জাপানে আগমন পূর্ব্বক খৃষ্টধর্ম্ম প্রচার করিতে আরম্ভ করেন। এইরূপ শুনা যায়, তিনি নিংসিট নামক জনৈক অশীতিবর্ষীয় বৌদ্ধ যাজককে তর্কযুদ্ধে পরাস্থ এবং একটী মৃতাবালিকাকে মন্ত্রবলে পুনর্জীবিত করিয়া জাপানে অপূর্ব্ব প্রতিপত্তি লাভ করেন। ফলতঃ জেভিয়ারের যত্নেই জাপানে খৃষ্ট মাহাত্ম্য প্রথম প্রচারিত হয়, তাঁহারই চেষ্টায় আমকুশা দ্বীপস্থ সমগ্র নরনারী খৃষ্টধর্ম্মে দীক্ষিত হয়।

 ১৫৮৭ খৃঃ সেনাপতি টয়োটমার আদেশানুসারে খৃষ্টধর্ম্ম প্রচারকেরা জাপান পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হন। তদবধি বহু বৎসরমধ্যে খৃষ্টধর্ম্ম জাপানে মস্তকোত্তোলন করিতে সাহসী হয় নাই। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে জেসুইট প্রচারকদিগের যত্নে জাপানে পুনরায় খৃষ্টধর্ম্মের প্রচার আরম্ভ হয়। ইহাতে কুপিত হইয়া জাপানের ১১৪শ সম্রাট মিকাডো সাকুরামাচি ১৭৩৮খৃঃ ১২ই এপ্রেল তারিখে রাজ্যের নানাস্থানে ৩৭ হাজার খৃষ্টান প্রজাকে নিহত করিয়া ফেলেন।

 অধুনা জাপানে খৃষ্টশিষ্যগণের সঙ্খ্যা সামান্য নহে।

 আজিকালি জেনারল বুথের মুক্তিফৌজ, কর্ণেল অলকটের থিয়সফি, আনি বেসন্তের বৈজ্ঞানিক ধর্ম্ম প্রভৃতি বিবিধ ধর্ম্মমত জাপানের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান আছে।