নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/উপক্রমণিকা
উপক্রমণিকা।
সুখ।
উপক্রমণিকা।
কিসের উৎসব?
ধূলগ্রামের দত্তগৃহে আজ যেন মহোৎসব। শরতের প্রভাতরবিকরে উৎফুল্ল গৃহ যেন আসন্ন উৎসব সূচিত করিতেছে। এখনও অধিক খেলা হয় নাই; এখনও রবিকরে গৃহপ্রাঙ্গণে অপরিণত তমালের শাখায় বিস্তৃত ঊর্ণনাভের জালে রজনীর সঞ্চিত শিশির শুকায় নাই; গৃহপ্রাচীরকোটরে শালিক-শাবক এইমাত্র জাগিয়া আহারের জন্য ব্যাকুলতা জানাইতেছে; একটি বুলবুল আহারের সন্ধানে বাহির হইয়া তমালশাখায় বসিয়া প্রাঙ্গণে দূর্ব্বাদলে হরিৎতনু পতঙ্গের সন্ধান করিতেছে; রাখালবালকগণ গোপাল লইয়া মাঠে গিয়াছে, গোক্ষুরোত্থিত ধূলিরাশি এখনও রাজপথের উপর বাতাসে ভাসিয়া বেড়াইতেছে; বালকগণ আসনে তালপত্র জড়াইয়া ও প্রকোষ্ঠে মস্যাধার ঝুলাইয়া গ্রাম্য পাঠশালায় যাইতেছে; গ্রামের নবীনধনী চৌধুরীদিগের গৃহে পূজার প্রভাতীনহবৎধ্বনি কেবল শাস্ত হইয়াছে।
গৃহের সম্মুখে রোয়াকে দাঁড়াইয়া নবীনচন্দ্র: চণ্ডীমণ্ডপের পূর্ব্বদিকস্থ প্রকোষ্ঠের বাতায়নগুলি মুক্ত করিবার জন্য ভৃত্যকে আদেশ করিতেছেন। কক্ষমধ্যে তক্তপোষের উপর অমল শ্বেত আসন; এক পার্শ্বে একখানি সঙ্কীর্ণ উচ্চ চৌকী। নবীনচন্দ্র ধূমপান করিতে করিতে ভৃত্যকে আদেশ দান করিতেছেন, এমন সময় চণ্ডীমণ্ডপের পশ্চিমপার্শ্বস্থিত কক্ষের দ্বার হইতে কন্যা কমল ডাকিল,—“বাবা!” কন্যার বয়স সপ্তদশ; পিতার চত্বারিংশৎ।
নবীনচন্দ্র ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। কমল বলিল, “বাবা, আমি গত সন্ধ্যা হইতে শ্যামের মা'কে বলিতেছি, আজ সকালে উঠিয়াই মাছ আনিতে হইবে। সে এখনও গেল না। এত বেলায় কি আর কিছু পাওয়া যাইবে?”
কমল আপনার আগ্রহের আতিশয্যে ভুলিয়া গিয়াছিল যে, শ্যামের মা'ই তাহার দাদাকে 'মানুষ' করিয়াছিল; দাদার আগমনসম্ভাবনায় তাহারও আনন্দ অল্প হয় নাই। ভালবাসা মানুষকে বড় স্বার্থপর করে।
নবীনচন্দ্র হাসিয়া উঠিলেন; মুখমুক্ত ধূমরাশি বাতাসে ছড়াইয়া পড়িল। তিনি বলিলেন, “শ্যামের মা প্রত্যুষ হইতেই আমাকে তাগিদ দিতেছে। আমিই তাহাকে যাইতে দিই নাই।”
কমল অভিমানের সুরে বলিল, “কেন?”
“জেলেদের সংবাদ দিয়াছি! আর একটু পরে আমিই যাইয়া পুষ্করিণীতে মৎস্য ধরাইয়া আনিব। দেখিব, তুই আজ কেমন রাঁধিস্। জেলেদের জন্য, তৈল, চিঁড়া ও মুড়কী বাহির করিয়া রাখিস্। তাহারা এখনই আসিবে।”
কমলের মুখ আনন্দোৎফুল্ল হইয়া উঠিল।
এই সময় নবীনচন্দ্রের জ্যেষ্ঠ শিবচন্দ্র অন্তঃপুর হইতে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি, নবীন?”
জ্যেষ্ঠকে দেখিয়া নবীনচন্দ্র ত্রস্তে হুঁকা নামাইয়া রাখিলেন। নূতন সভ্যতা ও নূতন ভাবের সঙ্গে সঙ্গে নূতন আকারে পরিণত তাম্রকূটের বহুল প্রচারের পূর্ব্বে বাঙ্গালার লোক প্রণম্যদিগের সম্মুখে ধূমপান করিত না।
হুঁকা নামাইয়া নবীনচন্দ্র বলিলেন, “এখনও মাছ আইসে নাই, তাই আমার উপর আর শ্যামের মা'র উপর রাগ হইয়াছে।”
শিবচন্দ্র হাসিয়া কমলকে বলিলেন, “কেন, মা, আমরা ত নিত্য গৃহে আহার করি, আমাদের জন্য ত কোন দিন এমন আয়োজন হয় না।” তাহার পর ভ্রাতাকে বলিলেন, “ও দিকে বাড়ীর ভিতরে দিদি বড় বধূকে তিরস্কার করিয়াছেন। দিদিকে ঘরের সব তরকারী কুটিতে উদ্যতা দেখিয়া তিনি বলিয়াছিলেন, ‘ঠাকুরঝি, হাটের এখনও দুই দিন বিলম্ব আছে, আজই সব তরকারী কুটিবে?' ইহাতে দিদি বড় রাগ করিয়াছেন।”
নবীনচন্দ্র হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করিলেন, “দিদি কি বলিলেন?”
“বলিলেন, ‘সাতটা নহে—পাঁচটা নহে—একটা ছেলে। কত দিন পরে বাড়ী আসিতেছে;—আজ যদি দুইটার স্থানে চারিটা ব্যঞ্জন না করিব, তবে কবে করিব? তরকারী কি পরলোকে সঙ্গে যাইবে? হাটের বিলম্বের ভাবনা আমি ভাবিব; তুমি রাঁধিতে যাও।’ আজ বৃহৎ আয়োজন।”
দুই ভ্রাতা হাসিতে লাগিলেন।
এই সময় কমল কর্তৃক দারুণ অভিযোগে অভিযুক্তা শ্যামের মা একখানি জলচৌকি ও একবাটী সর্ষপ-তৈল দিয়া গেল। শিবচন্দ্র তৈলম্রক্ষণ করিতে বসিলেন। তাঁহার তৈলমর্দ্দন শেষ হইতে না হইতে একটি ধীবরবালক আসিয়া সংবাদ দিল, ধীবরগণ ডিঙ্গি ও জাল লইয়া পুষ্করিণীতে গিয়াছে। শিবচন্দ্র ভ্রাতাকে বলিলেন, “নবীন, তৈল মাখিয়া লও।”
নবীনচন্দ্র উত্তর করিলেন, “আমি এখন পুষ্করিণীতে যাইব।”
“চল, পুষ্করিণী হইয়া ঘাটে যাইবে।”
“না। আমি মাছ ধরাইয়া বাড়ী ফিরিব। প্রভাত আসুক, এক সঙ্গে স্নান করিতে যাইব!”
শিবচন্দ্র বুঝিলেন, আজ তাঁহাকে একান্তই একক স্নানে যাইতে হইবে; নবীনচন্দ্র ভ্রাতুষ্পুত্রের জন্য অপেক্ষা করিবেন। তিনি অগত্যা বাহির হইলেন। নবীনচন্দ্র ধীবরবালকের সঙ্গে পুষ্করিণীতে চলিলেন।
পুষ্করিণীতে বহুদিন জাল ফেলা হয় নাই; মৎস্যকুল নিঃশঙ্ক হইয়া ছিল। জেলেরা ডিঙ্গিতে উঠিয়া জাল ফেলিতেই একটা মৎস্য জালে বাধিল। জেলেরা জাল টানিয়া তুলিল; সলিল হইতে সদ্য-উত্থিত মৎস্য জালবদ্ধ হইয়া ধড়ফড় করিতে লাগিল। সেটা তেমন বৃহৎ নহে বলিয়া নবীনচন্দ্রের আদেশে জেলেরা সেটাকে ছাড়িয়া দিয়া পুনরায় জাল ফেলিল। উত্তোলনকালে জাল গুরুভার বোধ হইতে লাগিল, জেলেরা বলাবলি করিতে লাগিল, “ভারি মাছ বাধিয়াছে।” সত্য সত্যই জালে দুইটি বৃহদাকার মৎস্য উঠিল,—একটি রোহিত, অপরটি মৃগেল। তাহারা বেগে পুচ্ছ সঞ্চালন করিতে লাগিল। নবীনচন্দ্র তীর হইতে বলিলেন, “মৃগেলটা ছাড়িয়া দে।” জেলেরা মৃগেলটা ছাড়িয়া দিয়া রোহিৎমৎস্যটি ডিঙ্গির খোলে ফেলিল, তাহার পর জাল গুটাইয়া তীরে আসিল।
নবীনচন্দ্র গৃহাভিমুখগামী হইলেন। এক জন ধীবর মৎস্যটির কণ্ঠাস্থিতলে অঙ্গুলি প্রবিষ্ট করাইয়া ঝুলাইয়া লইয়া তাঁহার পশ্চাৎগামী হইল। গৃহে আসিয়া নবীনচন্দ্র চণ্ডীমণ্ডপের পশ্চিমদিকস্থ কক্ষ অতিক্রম করিয়া অন্তঃপুরে আসিয়া ডাকিলেন,—“দিদি!”
অন্তঃপুরে পূর্ব্বে ও পশ্চিমে তিনটি করিয়া ছয়টি প্রকোষ্ঠ; পূর্ব্বের অংশ দ্বিতল; পশ্চিমাংশে দ্বিতলে একটিমাত্র প্রকোষ্ঠ—ঠাকুরঘর; উত্তরে পাকশালা ও ভাণ্ডার। নবীনচন্দ্রের কণ্ঠস্বর শুনিয়া পাকশালা হইতে এক জন বিধবা রমণী বাহিরে আসিলেন। তাঁহাকে দেখিলে বয়স পঞ্চাশের অধিক বলিয়া বোধ হয় না। সংযমে ও পূতাচারে হিন্দুবিধবার স্বাস্থ্য সহজে ক্ষুণ্ণ হয় না। তিনি মৎস্য দেখিয়া বিশেষ সন্তোষ প্রকাশ করিলেন, ডাকিলেন, “বড় বৌ, বাহিরে আইস।” বড়বধূও মৎস্য দেখিয়া প্রশংসা করিলেন। কমল ও শ্যামের মা পূর্ব্বেই আসিয়াছিল। কমল ভাণ্ডার হইতে ডালায় চিঁড়া ও মুড়কী এবং সরায় তৈল আনিয়াছিল। ধীবর বসনের একাংশে চিঁড়া মুড়কী বন্ধন করিল,—তৈলের সরা লইয়া চলিয়া গেল। শ্যামের মা ‘আঁইস’বঁটী ও ছাই লইয়া প্রাঙ্গনে মাছ কুটিতে বসিল।
নবীনচন্দ্র বহির্ব্বাটীতে আসিয়া চণ্ডীমণ্ডপে তক্তপোষের উপর বিছানায় বসিলেন। পার্শ্ববর্তী প্রকোষ্ঠের বিছানা ভ্রাতুষ্পুত্ত্রের জন্য। সে যখন গৃহে না থাকে, তখন নবীনচন্দ্র সে কক্ষের দ্বার রুদ্ধ করিয়া রাখেন; কেবল কোনও অতিথি আসিলে সে কক্ষ তাহার শয়নজন্য ব্যবহৃত হয়।
ক্রমে বেলা বাড়িতে লাগিল। বালকগণ প্রভাতের পাঠ শেষ করিয়া পিঞ্জরমুক্ত বিহগের মত কলরব করিতে করিতে ধূলিধূসর রাজপথের ধূলি উড়াইয়া গৃহে চলিল। নবীনচন্দ্র চঞ্চল হইয়া উঠিলেন; এক একবার চণ্ডীমণ্ডপের রোয়াকে আসিয়া পথের দিকে চাহিতে লাগিলেন।
যাহার জন্য দত্তগৃহে এত আয়োজন, এত ব্যস্তভাব, অল্পক্ষণ পরেই রাজপথে তাহার পরিচিত মূর্ত্তি দেখিয়া নবীনচন্দ্র প্রাঙ্গণ অতিক্রম করিয়া গৃহদ্বারে যাইয়া দাঁড়াইলেন। গৌরবর্ণ, সুদর্শন, বিংশবর্ষবয়স্ক যুবক আসিয়া খুল্লতাতকে প্রণাম করিল। নবীনচন্দ্র তাহাকে সাদরে তুলিয়া শিরশ্চুম্বন করিলেন। পিতৃব্য ও ভ্রাতুষ্পুত্ত্র একত্র গৃহে প্রবেশ করিলেন।
শিবচন্দ্র চণ্ডীমণ্ডপে ছিলেন। প্রভাত যাইয়া পিতাকে প্রণাম করিল। তাঁহার স্নেহার্দ্রনয়নে বিস্ময়ভাব প্রকাশ পাইল। গুটিপোকা যেমন ক্রমে প্রজাপতিতে পরিবর্ত্তিত হয়, তাঁহার পুত্ত্র পল্লীগ্রাম হইতে সহরে যাইয়া ক্রমে সেইরূপ পরিবর্ত্তিত হইতেছিল। সে পরিবর্ত্তন শিবচন্দ্রের ভাল লাগিত না; ইহার প্রধান কারণ, তিনি লক্ষ্য করিতেছিলেন, বেশভূষার পরিবর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাহার ব্যবহারেও পরিবর্ত্তন পরিস্ফুট হইতেছিল। তিনি এবারও তাহার বেশভূষার পরিবর্ত্তন লক্ষ্য করিলেন।
নবীনচন্দ্র প্রভাতকে লইয়া অন্তঃপুরে চলিলেন। অন্তঃপুরে পদার্পণ করিয়া প্রায় এক সময়েই নবীনচন্দ্র ডাকিলেন,—“দিদি!” প্রভাত ডাকিল,—“পিসীমা!”
পিসীমা রন্ধন করিতেছিলেন; হাতা বেড়ী ফেলিয়া বাহির হইয়া আসিলেন। পার্শ্বস্থ আমিষ-পাকশালা হইতে কমল ও প্রভাতের জননী আসিলেন।
প্রভাত পিসীমা’কে প্রণাম করিয়া তাঁহার পদধূলি গ্রহণ করিতে যাইতেছিল, তাহার জননী নিষেধ করিয়া বলিলেন, “ঠাকুরঝি রাঁধিতেছেন, যেন ছুঁইয়া দিস্ না!”
পিসীমা তাঁহার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “বড়বৌ, তোমার সব তাতেই বাড়াবাড়ি। ও ছুঁইলে কি হইত? না হয়— কাপড়খানা ছাড়িয়া ফেলিতাম।”
ইহার পর প্রভাত মাতাকে প্রণাম করিল, এবং কমলের প্রণাম গ্রহণ করিল।
শ্যামের মা একটা ‘প্লেতে’য় তরকারী ধৌত করিয়া আনিতেছিল। প্রভাতের পদে সঞ্চিত ধূলি দেখিয়া সে বলিল, “দাদাবাবু, পায়ে ধূলা কেন?”
পিসীমা স্নেহসিক্ত তিরস্কারের স্বরে বলিলেন, “হাঁটিয়া আসিয়াছিস্ বুঝি?”
প্রভাত বলিল, “বিলের কাছে গাড়ী ছাড়িয়া আসিয়াছি।”
“রৌদ্রে হাঁটিতে আছে? আহা মুখ শুকাইয়া গিয়াছে! যা’—স্নান করিয়া আয়।”
নবীনচন্দ্র ভ্রাতুষ্পুত্ত্রকে লইয়া বাহিরে আসিলেন; তাহাকে বলিলেন, “চল্,তোর ঘরে কাপড় ছাড়িবি।”
উভয়ে চণ্ডীমণ্ডপের পূর্ব্বদিকস্থ সেই প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিলেন। শিবচন্দ্র তখন ধূমপান করিতে করিতে কি ভাবিতেছিলেন।
দেখিতে দেখিতে গোযান সশব্দে গৃহপ্রাঙ্গণে প্রবেশ করিল। চালক পুষ্টাঙ্গ, শ্বেত, বঙ্কিমশৃঙ্গ বাহনদ্বয়ের স্কন্ধ হইতে গাড়ী নামাইয়া দিল; তাহারা প্রাঙ্গণের তৃণ আত্মসাৎ করিতে আরম্ভ করিল। চালক যানমধ্য হইতে প্রভাতের ‘স্টীল–ট্রাঙ্ক’ বাহির করিয়া প্রভাতের বসিবার ঘরে দিয়া গেল।
নবীনচন্দ্র ভ্রাতুষ্পুত্ত্রকে বলিলেন, “চল্, স্নান করিতে যাই।”
প্রভাত বাক্স খুলিয়া তোয়ালে বাহির করিল। সুগন্ধি তৈলের শিশি বাহির করিতে কেমন লজ্জা করিতে লাগিল; সে পিতৃব্যের সহিত সর্ষপ-তৈল মাখিয়া লইল। উভয়ে স্নান করিতে বাহির হইলেন।