নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/চতুর্থ খণ্ড/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
শেষ।
চপলা কি করিল? স্বর্ণ অগ্নিদগ্ধ হইলে নির্ম্মল হয়; আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হইলে নির্ম্মল হয়। চপলার ভ্রম ঘুচিল, যাতনা বহিল। সে যাতনার চিতানল নিভিবার নহে। চপলা দেখিল, নিরবলম্বন হৃদয়, উদ্দেশ্যহীন জীবন বড় জ্বালার কারণ, বড় আশঙ্কার বিষয়। সে শোভার জ্যেষ্ঠভ্রাতার সংসারে আসিয়া তাঁহার পুত্রকন্যাদিগের পালনের ভার লইতে ইচ্ছা করিল। বড় বধূ যে সত্য সত্যই তাহার শুভ কামনা করেন, তাহা সে বুঝিতে পারিয়াছিল। সে সময়ে তাঁহার সদুপদেশ মত কার্য্য করে নাই বলিয়া সে দুঃখিতা হইয়াছিল। তাঁহার জননী তাহাকে নিকটে রাখিতে চাহিলেন; যাইতে দিলেন না; সে যাইতে চাহিলে কাঁদিয়া অস্থির হইলেন। শেষে সে বড় বধূর একটি পুত্ত্রকে নিকটে রাখিয়া লালনপালন করিতে লাগিল; তাহার উপর আপনার সকল স্নেহ—সব মনোযোগ ঢালিয়া দিল। সে সর্ব্বদা বড় বধূর সহিত সাক্ষাৎ করিত; তাঁহার নিকট উপদেশ লইত। তিনি তাহাকে তেমনই স্নেহ করিতেন। সে সর্ব্বদা শোভার সংবাদ লইত। তদ্ভিন্ন শিশিরকুমার সর্ব্ব অবস্থায় সর্ব্বদা তাহাকে সদুপদেশ দিত; তাহাতে সে বিশেষ শান্তি ও সান্ত্বনা পাইত।
এই ভাবে কয় বৎসর কাটিয়া গেল।
বিনোদবিহারী সংসারিক কার্য্যে কোনও দিনই অভিজ্ঞ ছিল না। সে পিতার ও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার আওতায় বর্দ্ধিত হইয়াছিল। পল্বলকূলে বৃহৎ বনস্পতির ছায়ায় বর্দ্ধিত ওষধির মত আপনি পুষ্ট ও সরস হইয়াছিল বটে, কিন্তু আতপতাপ, ঝঞ্ঝাবাত, বা করকাপাত সহ্য করিতে শিখে নাই। বিশেষ পিতার সংসারে তাহার ব্যয়সাধ্য বিলাসের অভ্যাস প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল। এখন আয় কমিয়া গেল। যাহা রহিল, তাহাও নির্দ্দিষ্ট। কিন্তু অতর্কিত ব্যয় যথেষ্ট। ইহাতে সঞ্চিত ধন ক্রমেই ক্ষয়প্রাপ্ত হইতে লাগিল । তাহার নিবারণ চেষ্টা করিলে, অভ্যস্ত ব্যয় কোনরূপে কমাইয়া আনিলে— সামান্য সুবিধার অভাবেই মধ্যমা বধূর উষ্ণ মস্তিষ্ক উষ্ণতর হইয়া উঠিত। তিনি জানিতেন, স্বামী সম্পূর্ণরূপে তাঁহার করতলগত। তাঁহার ব্যবহার বিনোদবিহারীর পক্ষে উত্তরোত্তর কষ্টের কারণ হইয়া উঠিতে লাগিল। যে দাম্পত্যসুখের ভ্রান্ত আশায় সে সব ত্যাগ করিয়াছিল, তাহার ভাগ্যে তাহাই ঘটিল না। সে যে সুধার আশায় আর সব ত্যাগ করিয়াছিল — এখন দেখিল, তাহা বিকৃত।
মহান্ মনুষ্যত্বের ও কঠোর কর্ত্তব্যের অনুসরণে বিদেশে— স্বজনগণের নিকট হইতে দূরে শিশিরকুমারের দিন কাটিতে লাগিল। চপলার ও চপলার জননীর কল্যাণসাধন তাহার জীবনের ব্রত হইয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু নদী কোনও লক্ষ্যের অভিমুখে যাইতে যাইতে যেমন পথেও স্নিগ্ধতা, উর্ব্বরতা ও লাবণ্যশ্রী ছড়াইয়া যায়, তেমনই তাহার সেই কল্যাণব্রতে বহুলোকের উপকার সংসাধিত হইত। কার্য্যোপলক্ষে শিশিরকুমার যখন যে স্থানে যাইত, তখন সেই স্থানের জনগণের চিত্তাকর্ষণ করিত। বহু দীনদুঃখী তাহার নিকট দয়া ও সাহায্য লাভ করিত, বহু লোক তাহার দ্বারা উপকৃত হইত।
শিশুদিগের আগমনে দত্তগৃহে বিষাদের ছায়া অপসৃত হইল। সে গৃহ প্রভাতের পুত্ত্রকন্যাদিগের কাকলিমুখরিত হইতে লাগিল। শিবচন্দ্রের হৃদয়ের অভিমান আশঙ্কায় দূর হইয়া গিয়াছিল। বধূর ও পৌত্ত্র দিগের আগমনে বড় বধূর মনের অন্ধকার অবশেষে দূর হইয়া গেল। শিবচন্দ্র ও বড় বধূ—উভয়েরই বৃদ্ধবয়স শিশুদিগের সাহচর্য্যে সুখময় হইতে লাগিল।
পিসীমা’র আর কাশী যাওয়া হইল না। প্রভাতের পুত্ত্রকন্যাদিগকে রাখিয়া তাঁহার আর নড়িবার উপায় নাই। তিনি নহিলে ছেলেদের চলে না। আবার ছেলেরা না হইলে তাঁহার চলে না। এখন তাঁহার অঙ্কে প্রভাতের স্থান প্রভাতের পুত্ত্রকন্যারা অধিকার করিয়াছে। তাহাদিগকে ছাড়িয়া তিনি কেমন করিয়া যাইবেন?
প্রভাত, সতীশ, শোভা, অমল ও প্রভাতের পুত্ত্রকন্যা—ইহাদিগকে লইয়া স্নেহশীল নবীনচন্দ্র সর্ব্বদা ব্যস্ত। তাঁহার আর অবসর নাই। প্রভাত ও সতীশ কোনও কার্য্য করিতে হইলে তাঁহার পরামর্শ ব্যতীত করে না। শোভারও কোনও বিষয়ে পরামর্শ লইতে হইলে সে নবীনচন্দ্রের নিকট লয়!
বিপত্নীক সতীশচন্দ্র আর বিবাহ করিল না। অমলকে ও প্রভাতের পুত্ত্রকন্যাদিগকে শিক্ষা দিয়া, এবং নানা সদনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত করিয়া তাহার দিন কাটিতে লাগিল। তাহার চেষ্টায় সে অঞ্চলে শিল্প, কৃষিকার্য্য ও শিক্ষার প্রভূত উন্নতি পরিলক্ষিত হইতে লাগিল। এক জনের সুপ্রভাব বড় অল্প নহে । বিশেষ, এখন তাহার সকল সদনুষ্ঠানে সে এক জন উদ্যোগী, সহকর্ম্মী পাইয়াছে। প্রভাত তাহার সকল সৎকর্ম্মে সহকর্ম্মী। উভয়ে একযোগে কার্য করিয়া নানাপ্রকারে লোকের কল্যাণসাধন করিতেছে।
শোভা আসিয়া প্রথম কয় দিন নূতন সংসারে একটু বাধ-বাধ বোধ করিয়াছিল। কিন্তু পিসীমার প্রভাবে সে ভাব দুই দিনেই দূর হইয়াছিল। লৌহ কতক্ষণ অয়স্কান্তের প্রভাব অতিক্রম করিতে পারে? বিশেষতঃ, এবার শোভা আপনার সংসারে আসিতেছে জানিয়া ও বুঝিয়া আসিয়াছিল। সে সেই সংসারেরই হইয়া গেল। তাই— নিদাঘের পর বর্ষায় দীপ্তরবিকরতপ্ত তরু যেমন আপনার তপ্ত হৃদয়ে বর্ষাবারিপাতে নবপল্লবশ্রীসম্পন্না লতিকার স্নিগ্ধকোমল বন্ধন অনুভব করে—নাগপাশমুক্ত প্রভাত, তেমনই আপনাকে প্রেমপাশবদ্ধ অনুভব করিয়া অনির্বচনীয় সুখে সুখী হইল।
সম্পূর্ণ।