নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/চতুর্থ খণ্ড/পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
প্রত্যাবর্ত্তন।
একদিন আহার্য্য প্রস্তুত হইলে প্রভাতকে ডাকিতে যাইয়া নবীনচন্দ্র দেখিলেন, সে কাঁদিতেছে। শঙ্কিত ও ব্যস্ত হইয়া তিনি কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। প্রভাতের জ্যেষ্ঠ শ্যালক পত্র লিখিয়াছেন, তাহার দুর্ব্বল কনিষ্ঠপুত্ত্র পীড়িত। জলরাশি সঞ্চিত হইতে হইতে শেষে একদিন সব বাধা অতিক্রম করিয়া প্রবাহিত হয়— সে দিন তাহার গতি রোধ করা দুঃসাধ্য। তাই আজ প্রভাতের অশ্রুধারা আর নিবৃত্ত হয় না। নবীনচন্দ্র বহুক্ষণে তাহাকে শান্ত করিলেন। তিনি সব শুনিলেন; বলিলেন, “চল্, আমরা কলিকাতায় যাই। তাহাদের লইয়া আসিব।”
প্রভাত মুহূর্ত্ত চিন্তা করিয়া বলিল, “বাবা সম্মতি দিবেন কি?”
নবীনচন্দ্র ভ্রাতুষ্পুত্ত্রের অশ্রুসিক্ত নয়ন মুছাইয়া বলিলেন, “বাবা, তিনি অভিমান করিতে পারেন— করুন। আমি পারিব না। যে দিন ভগবান আমাকে ভিখারীর অধম করিয়া সংসারে সবহারা করিয়াছিলেন, সে দিন তোদের দুই জনের দিকে চাহিয়া আমি অশান্ত হৃদয় শান্ত করিয়াছিলাম। আজ তুই ছাড়া আমার আর কেহ নাই।” বলিতে বলিতে নবীনচন্দ্রের দুই চক্ষু দিয়া অশ্রুধারা ঝরিতে লাগিল।
প্রভাত পূর্ব্বে কখনও পিতৃব্যকে এমন ভাবে কাঁদিতে দেখে নাই। তাহার অশ্রুধারা দ্বিগুণ বহিতে লাগিল। সঙ্গে সঙ্গে সে হৃদয়ে অনির্ব্বচনীয় স্নিগ্ধ শান্তি লাভ করিল। -এ স্নেহে কাহার হৃদয় শান্ত না হয়?
শেষে প্রভাত বলিল, “আমি যাইব না। আপনি যাইয়া যথাকর্ত্তব্য করুন।”
সে যে কত ব্যস্ত হইয়া থাকিবে, নবীনচন্দ্র তাহা বিলক্ষণ বুঝিলেন; তাই তিনি তাহাকে সঙ্গে যাইবার জন্য বিশেষ কবিয়া বলিলেন। কিন্তু প্রবল ইচ্ছা সত্ত্বেও সে সঙ্কোচ বোধ করিল। শেষে নবীনচন্দ্রের যাওয়াই স্থির হইল।
নবীনচন্দ্র আসিয়া শিবচন্দ্রকে বলিলেন, “দাদা, আমি কলিকাতায় যাইব।”
শিবচন্দ্র জিজ্ঞাসা কবিলেন, “কেন?”
“মা’কে ও দাদাদের আনিতে।”
“আসিতে তাঁহাদের মত হইয়াছে কি? তাঁহারা না বলিলে আবার নিষ্ফল চেষ্টা করিতে আমার প্রবৃত্তি নাই।”
নবীনচন্দ্র আনিতে যাইয়া ফিরিয়া আসিয়াছিলেন; সে ব্যথা শিবচন্দ্রের হৃদয়ে বড় বাজিয়াছিল। সে কথা আজ তাঁহার মনে পড়িল;—তাই এ কথা। নবীনচন্দ্রের হৃদয়ে সে ব্যথা স্নেহস্রোতে ধৌত হইয়া গিয়াছিল।
নবীনচন্দ্র জ্যেষ্ঠের দিকে চাহিলেন; বলিলেন, “আপনি রাগ করিতে পারেন। আমার উহারা ব্যতীত আর কেহ নাই।”
শিবচন্দ্র দেখিলেন, নবীনচন্দ্রের চক্ষু ছল ছল করিতেছে। “উহারা ব্যতীত আর কেহ নাই।” উভয়েরই স্নেহের আর এক অবলম্বন ছিল। সে আর নাই। সেই বনরাজিনীলা সমুদ্রবেলায় চিতার স্মৃতি তাঁহার মনে জাগিয়া উঠিল। শিবচন্দ্রেরও চক্ষু জলপূর্ণ হইয়া আসিল। তিনি বলিলেন, “তুমি একা যাইবে?”
নবীনচন্দ্র বলিলেন, “প্রভাতকেও যাইতে বলিয়াছিলাম; সে যাইবে না। বিনয়ের অসুখ। আমি আজই যাইব।”
শিবচন্দ্র ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি অসুখ?”
“জ্বর। সে স্বভাবতঃ দুর্ব্বল, সর্ব্বদাই অসুস্থ। তাই তাহার সামান্য অসুখেই ভয় হয়।”
নবীনচন্দ্র সেই দিনই কলিকাতা যাত্রা করিলেন।
স্নেহের আশঙ্কায় শিবচন্দ্রের হৃদয়ে আশঙ্কার অন্ধকার কাটিয়া গেল। পরদিন প্রভাতেই প্রভাতের ডাক পড়িল। শিবচন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “প্রভাত, কখন সংবাদ আসিবার সম্ভাবনা?”
প্রভাত বলিল, “মধ্যাহ্নের পর নহিলে টেলিগ্রাম আসিবার সম্ভাবনা নাই।”
“তুই পোষ্টমাষ্টারকে লিখিয়া দে, আমার বা তোর নামে কোনও টেলিগ্রাম আসিলে তখনই পাঠাইয়া দেন।”
বহুদিন পরে প্রভাত পিতার নিকট পূর্ব্বের মত স্নেহসম্ভাষণ,— সস্নেহ ব্যবহার পাইল।
এ দিকে নবীনচন্দ্র কলিকাতায় আসিয়া দেখিলেন, বিনয়ের জ্বর ছাড়িয়াছে। শোভা আসিয়া প্রণাম করিলে তিনি বলিলেন, “মা, আমি লইতে আসিয়াছি। মা আমার, একবার ছেলেকে ফিরাইয়া দিয়াছ। এবার আমি কোনও কথা শুনিব না। তোমাকে যাইতেই হইবে।”
স্নেহের অনুযোগে শোভার বুক যেন ফাটিয়া যাইতে লাগিল। সে কেমন করিয়া এই স্নেহে এতদিন অন্ধ হইয়া ছিল?
কৃষ্ণনাথের গৃহে সব বিশৃঙ্খল; প্রভাত চলিয়া যাইলে বড় বধূ স্বামীকে তাহার কারণ বলিয়াছিলেন। তিনি সে কথা বিনোদবিহারীকে বলিলে, মধ্যমা বধূ দুর্ব্বল স্বামীর দৌর্ব্বল্যের সুযোগ লইয়া যে ব্যবহার করিয়াছিলেন, তাহাতে দুই ভ্রাতার পক্ষে আর সপরিবারে একত্র বাস সম্ভব রহিল না। জ্যেষ্ঠের সম্পূর্ণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুই ভ্রাতার বন্দোবস্ত পৃথক হইয়া গিয়াছিল—বিনোদবিহারীই তাহার উদ্যোগী।
জ্যেষ্ঠ নবীনচন্দ্রকে সে সব দুঃখের কথা বলিলেন। শুনিয়া নবীনচন্দ্র বড় ব্যথা পাইলেন।
এই সকল কথা জীবন্মৃত কৃষ্ণনাথের কর্ণে উঠিয়াছিল। মৃত্যুকাল একান্ত নিকট হইয়া আসিয়াছিল। নবীনচন্দ্র আসিয়া দেখিলেন, কৃষ্ণনাথের দিন ফুরাইয়াছে,— জীবনীশক্তি শেষ হইয়া আসিয়াছে। চিকিৎসকগণ বলিলেন,—আর বিলম্ব নাই। দুই দিন কাটিয়া গেল,—মৃত্যুর পূর্ব্বলক্ষণ সকল প্রকাশ পাইতে লাগিল।
নবীনচন্দ্র দুই দিন বৈবাহিকের মৃত্যুশয্যাপার্শ্বে কাটাইলেন। কৃষ্ণনাথ বলিলেন, “বৈবাহিক, আমি না বুঝিয়া অনেক কুব্যবহার করিয়াছি, আমাকে ক্ষমা করুন। আপনাদের মহত্ত্ব আমি বুঝিতে পারি নাই।” বলিতে বলিতে তাহার কণ্ঠরোধ হইয়া আসিল। মৃত্যুশয্যায় কৃষ্ণনাথ বড় দুঃখে আপনার ভ্রম বুঝিলেন। তিনি দুর্ব্বল হইয়াছিলেন, তাই তাঁহার সুখের সংসারে দুঃখ।
নবীনচন্দ্র বলিলেন, “ আপনি কষ্ট করিবেন না।”
দুই দিন কাটিয়া গেল। নবীনচন্দ্র অক্লান্ত যত্নে বৈবাহিকের শুশ্রূষা করিতে লাগিলেন। তৃতীয় দিন কৃষ্ণনাথের মৃত্যু হইল।
কৃষ্ণনাথ যে উইল করিয়াছিলেন, শ্যামাপ্রসন্ন তাহা জানিতেন। কৃষ্ণনাথের মৃত্যুর পর দিবস তিনি সে উইল আনাইলেন। উইল কৃষ্ণনাথের পত্নীর মৃত্যুর পর লিখিত হয়। উইলে —গৃহে দুই পুত্ত্রের, কন্যার ও চপলার সমান অংশ; সম্পত্তির একচতুর্থাংশ প্রভাতের ও শোভার, অবশিষ্ট অংশে দুই পুত্ত্রের সমান ভাগ। চপলার অর্থ অনাবশ্যক,— তথাপি তিনি চপলাকে দশ সহস্র টাকা দিয়াছেন।
উইলের নির্দ্দেশে বিনোদবিহারী বিরক্ত হইল। শোভা যে এত অর্থ ও গৃহের অংশ পাইবে, ইহা সে মনে করে নাই। কিন্তু এখন আর উপায় কি? বিনোদবিহারী আপনার অংশ স্বতন্ত্র করিয়া লইতে প্রবৃত্ত হইল।
নবীনচন্দ্র শোভাকে বলিলেন, “মা, এ গৃহে তোমার আবশ্যক নাই। তোমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার পুত্ত্র কন্যা অনেকগুলি। তাঁহার স্থানাভাব হইবে। তুমি যদি এখানে থাক, তাই বৈবাহিক এরূপ ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। কিন্তু তোমাকে বাড়ী যাইয়া বুড়া ছেলেদের দেখিতে হইবে।” সে কথার যাথার্থ্য বুঝিয়া শোভা বলিল, “আপনি যাহা বলিবেন, আমি তাহাই করিব।” নবীনচন্দ্র একবার প্রভাতের মত জানিতে বলিলেন,—আপনিও প্রভাতকে লিখিলেন। প্রভাত তাঁহার মতে কায করিবার জন্য শোভাকে লিখিল; নবীনচন্দ্রকে লিখিল, “আপনি যাহা ইচ্ছা, করিবেন। আমার মত চাহিয়া আমাকে আর লজ্জিত করিবেন না,—পর করিয়া দিবেন না।” তখন নবীনচন্দ্র শোভাকে বলিলেন, “মা, পিতার সম্পত্তিতে তোমার আবশ্যক? উহা দুই ভ্রাতাকে সমান ভাবে ভাগ করিয়া দিতে হইবে। মধ্যমের মতিগতি যেরূপ, তিনি লইবেন কি না সন্দেহ। কিন্তু যাহার কর্ত্তব্য, তাহার কাছে। তুমি প্রস্তাব করিয়া দেখ।”
হইলও তাহাই। শোভা বিনোদবিহারীকে প্রাপ্ত সম্পত্তির অর্দ্ধাংশ দিতে চাহে শুনিয়া বধূ মুখ বাঁকাইলেন,—“পোড়া কপাল টাকার! না খাইয়া মরি, সেও ভাল। তবু ভিক্ষার ধন চাহি না।” মধ্যম ভ্রাতার আর সে সম্পত্তি লওয়া হইল না।
তখন নবীনচন্দ্রের পরামর্শমত শোভা পৈত্রিক গৃহে ও সম্পত্তিতে আপনার প্রাপ্ত অংশ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে দিল।
শোভা যাইবে শুনিয়া চপলা তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিল। সে অনেক কাঁদিল; শেষে শোভাকে বলিল, “ঠাকুরঝি, আমি তোমার দুষ্ট সরস্বতী ছিলাম। তুমি সুখী হও। আমি আপনার দোষে সব হারাইয়া এখন আমার ভ্রম বুঝিয়াছি। আমার সব দুঃখ আমার স্ব-কৃত কর্ম্মের ফল।”
চপলার দুঃখে শোভা কাঁদিল।
তাহার পর নবীনচন্দ্র কলিকাতা হইতে বিদায় লইয়া শোভাকে ও তাহার পুত্ত্রদ্বয়কে লইয়া ধূলগ্রামে আসিলেন।