নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/চতুর্থ খণ্ড/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

গৃহাগত

ধীরে,— ধীরে,—চরণ আর যেন চলে না,—প্রভাত গৃহের পথে অগ্রসর হইতে লাগিল। তাহার কেবল মনে পড়িতে নাগিল, পূর্ব্বে প্রবাস হইতে এই পথে গৃহে ফিরিবার সময় সে কি আনন্দ অনুভব করিত! হায়—সে দিন! মাঘ মাস শেষ হইয়া আসিয়াছে। দুই চারিটি বৃক্ষে নবপল্লব উদ্গত হইতেছে;কোথাও বা পলাশের সুপ্তলাবণ্য গুচ্ছ গুচ্ছ কুসুমে বিকশিত হইয়া উঠিয়াছে; কোথাও বা মন্দারের মুকুল কেবল দেখা দিতেছে; কোথাও বা তরুণ চূতমুকুলের গন্ধে পথ আমোদিত,—সে স্থান অলিকুলগুঞ্জনমুখরিত। বসন্তের কেবল আরম্ভ;— কোকিলকূজন ও কেবল আরব্ধ —চারি দিকে সেই ক্রমোচ্চগ্রামস্পর্শী স্বরের ছড়াছড়ি নাই, কিন্তু দূরাগত বিরল বিরাব আরও মধুর। আর কোকিল ভিন্ন আরও কত বিহগের গান!—দয়েল প্রভাতী ধরিয়াছে; বৌ-কথা-কও কোনও অনির্দ্দিষ্টা প্রণয়িণীর বাক্যশ্রবণলোলুপ হইয়া সাগ্রহমিনতি জানাইতেছে; গৃহস্থেরখোকা-হ’ক অযাচিত ভাবে গৃহস্থের গৃহে শুভ ঘটনার জন্য ব্যাকুল হইয়াছে; আরও কত বিহগ উচ্ছ্বসিতস্বরভঙ্গীতে কূজন আরম্ভ করিয়াছে। হয় ত প্রাচীন সাহিত্যে তাহাদের স্থান নাই। কিন্তু সে কৌলীন্যগৌরবহীন হইয়াও তাহারা পল্লীবাসীর স্নেহে বঞ্চিত হয় নাই। তাহারা পল্লীজীবনের অবিচ্ছিন্ন অংশ। কত দিন হইতে তাহারা পল্লীবাসীর কর্ণে সুধাধারার বর্ষণ করিতেছে! অদূরে তটিনী তপনকরে কলধৌতপ্রবাহবৎ বহিয়া চলিয়াছে। ক্বচিৎ বা দেখা যাইতেছে,—গ্রাম্যবধূ পূর্ণকুম্ভকক্ষে ঘাট হইতে ফিরিতেছে।

 সঙ্গিহীন প্রভাত ভাবিতে ভাবিতে গৃহে চলিল। ক্রমে মাঠ ছাড়াইয়া, বিলের পার্শ্ব দিয়া, গ্রামে প্রবেশ করিল। সে নতদৃষ্টি হইয়া চলিতে লাগিল,—পাছে কাহারও সহিত সাক্ষাৎ হয়। কিন্তু পথে দুই তিন জন তাহার কুশল জিজ্ঞাসা করিলেন। প্রভাত সংক্ষেপে উত্তর দিয়া গেল। সে লক্ষ্য কবিল,— তাঁহাদের দৃষ্টিতে বিস্ময় বিকশিত।

 প্রভাত গৃহদ্বারে উপনীত হইল। গৃহপালিত পুষ্টকায় কুক্কুর নূতন লোক ভাবিয়া ডাকিতে ডাকিতে ছুটিয়া আসিল, প্রভাতের মুখের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া আনন্দে লাঙ্গূল সঞ্চালন করিতে লাগিল; পরিচিত গৃহে,—গৃহপালিত পশুও তাহাকে ভুলে নাই।

 চণ্ডীমণ্ডপে শিবচন্দ্র একাকী পুস্তক পাঠ করিতেছিলেন। তাঁহার চক্ষুতে চশমা। প্রভাত শেষবারও যখন তাঁহাকে দেখিয়াছে, তখনও তাঁহার চশমা ব্যবহার করিবার আবশ্যক হয় নাই। প্রভাত চণ্ডীমণ্ডপে উঠিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিল। শিবচন্দ্র মুখ তুলিয়া দেখিলেন,—পুত্ত্র। প্রভাত নতমস্তকে দাঁড়াইয়া রহিল।

 নবীনচন্দ্র অন্তঃপুরে ছিলেন। শ্যামের মা যাইয়া সংবাদ দিল, তাহার দাদাবাবু আসিয়াছে—শিবচন্দ্র কোন কথা কহেন নাই। প্রভাত আসিয়াছে! সহসা—সংবাদ না দিয়া, —এমন ভাবে সে আসিয়াছে! নবীনচন্দ্র যে অবস্থায় ছিলেন, ছুটিয়া বাহিরে আসিলেন। প্রভাত পিতৃব্যকে প্রণাম করিল। নবীনচন্দ্র পূর্ব্বেরই মত তাহাকে বক্ষে টানিয়া লইলেন। সে আদরে প্রভাত কাঁদিয়া ফেলিল। নবীনচন্দ্র তাহাকে পার্শ্বের কক্ষে লইয়া যাইলেন;—কক্ষদ্বার রুদ্ধ ছিল,—তিনি মুক্ত করিলেন। নবীনচন্দ্রের বিশেষ আশঙ্কা হইল। তিনি বারবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা কেমন? দাদারা?” তাহারা ভাল আছে জানিয়া তবে তিনি নিশ্চিন্ত হইলেন; প্রভাতকে শান্ত করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। কিন্তু তাহার অশ্রু তিনি যত মুছান, সে অশ্রু তত দ্বিগুণ বহে।

 প্রভাতকে কথঞ্চিৎ শান্ত করিয়া নবীনচন্দ্র অন্তঃপুরে উৎকণ্ঠিত পিসীমাকে ও বড় বধূকে সংবাদ দিতে যাইতেছিলেন। শিবচন্দ্র তাঁহাকে ডাকিলেন, “নবীন, সংবাদ কি?”

 নবীনচন্দ্র বলিলেন, “ভাল।”

 “তবে সহসা কি মনে করিয়া? জিজ্ঞাসা করিয়াছ?”

 “দাদা, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরিয়া আসিয়াছে, ইহাতে আর মনে করা-করি কি?”

 নবীনচন্দ্র অন্তঃপুরে গমন করিলেন।

 অন্তঃপুরে পিসীমা তেমনই অবারিত আদরে প্রভাতকে গ্রহণ করিলেন। কিন্তু বড় বধূর মুখে বিরক্তির ছায়া অপসৃত হইল না; তাঁহার ব্যবহারে পূর্ব্ব ভাবের কি একটু অভাব। নবীনচন্দ্র লক্ষ্য করিলেন, শিবচন্দ্রের ব্যবহারে বিরক্তির ভাব বর্ত্তমান, বড় বধূর ব্যবহারেও তাহার ছায়া - যেন সেই জন্যই তিনি অত্যধিক স্নেহাদরে সে অভাব পূর্ণ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। নবীনচন্দ্রের আর ভ্রাতার সহিত স্নান হয় না, প্রভাতকে সঙ্গে লইয়া যান; আর ভ্রাতার সহিত আহার হর না, প্রভাতকে পার্শ্বে বসাইয়া একত্র আহার করেন; আর একা সতীশচন্দ্রের গৃহে গমন হয় না, প্রভাত সঙ্গে যায়। প্রভাতকে নহিলে হয় না।

 প্রভাতের প্রত্যাবর্ত্তনে যে শিবচন্দ্র ও বড় বধূ উভয়েই সুখী হইয়াছিলেন—নবীনচন্দ্রের তাহা বুঝিতে বিলম্ব হয় নাই। তথাপি —তাঁহাদের মনের অন্ধকার কাটে নাই বলিয়া তিনি দুঃখিত। সহসা সে কেন কলিকাতা হইতে আসিয়াছিল, তাহা তিনি জানিতে পারেন নাই;—করেন নাই। তবে প্রভাতের জ্যেষ্ঠ শ্যালক তাহার আগমনের পর দিনই তাহার সংবাদের জন্য তাঁহার নিকট টেলিগ্রাফ করাতে তিনি বুঝিয়াছিলেন, একটা কিছু হইয়াছে; পাছে জিজ্ঞাসা করিলে সে ব্যথিত হৃদয়ে আবার ব্যথা পায়, এই জন্য তিনি জিজ্ঞাসা করেন নাই; ভাবিয়াছিলেন, সে শান্ত হইলে ক্রমে জানিতে পারিবেন।

 প্রভাতের মনে সুখ ছিল না, কেবল যাতনা।—সে পিতার ব্যবহারে বিরক্তির ক্ষীণ ছায়া লক্ষ্য করিত,—মাতার ব্যবহারে পূর্ব্ব ভাবের কিছু অভাব অনুভব করিত। যেখানে আশা অতি অধিক, অধিকার অনাহত বলিয়া বিশ্বাস, সেখানে সামান্য ত্রুটীতে বড় কষ্ট,—বড় যাতনা। প্রভাতের তাহাই হইত। প্রভাত দেখিত, গিতার আর সে স্বাস্থ্য নাই, পিতৃব্যের দেহে অকালজরার চিহ্ন বিকাশ পাইয়াছে। সে সকলের জন্য সে যে কত দায়ী, তাহা সে বুঝিত; বুঝিয়া যাতনা পাইত। সে আত্মগ্লানির বেদনা ভোগ করিত।

 গৃহে যে শোকের ছায়া পড়িয়াছে, তাহাও বড় যাতনার। এ জীবনে ভগিনীর সে স্নেহলাভ আর ঘটিবে না। সেই পরিচিত গৃহে সে শোক যেন নূতন করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। এই গৃহে তাহার শৈশব হইতে কত স্মৃতি! শৈশবে, বাল্যে সে পদে পদে তাহারই উপর নির্ভর করিত, তাহাকেই ক্ষুদ্র সুখ দুঃখের কথা শুনাইত, —কত ভালবাসিত! সে আজ কোথায়!

 প্রভাতের যাতনার আরও কারণ ছিল। আবেগের উত্তেজনায় সে যাহাদের ছাড়িয়া আসিয়াছে, হৃদয় তাহাদের জন্য ব্যথিত হইতেছিল। প্রণয়পাত্রী প্রেমের অযোগ্যা হইলেও প্রেম যায় না। সে দিন প্রভাত প্রথমে শোভাকে দোষী ভাবিয়াছিল; কিন্তু ক্রমে সে বুঝিল, দোষ শোভার নহে, বরং তাহারই। সেই অপমানে শোভা যে কষ্ট অনুভব করিয়াছে, তাহা মনে করিয়া সে আপনি কষ্ট পাইল। সে কষ্টের জন্য সে দায়ী। এই ভাবে চলিয়া আসিয়া সে শোভাকে কষ্ট দিয়াছে; হয় ত আরও অপমান সহিতে রাখিয়া আসিয়াছে। সে আপনি কর্ত্তব্যবিমুখ হইয়াছে। যাহাদিগের সে ব্যতীত অন্য অবলম্বন নাই, যাহাদের ভার তাহার—সে তাহাদিগকে ছাড়িয়া আসিয়াছে! কিন্তু এখন সে কি করিবে;— তাহার পক্ষে কোন্ পথ মুক্ত? এই সব চিন্তায় সে অত্যন্ত অশান্তি ভোগ করিত; কেবল যাতনা পাইত। সে কি করিবে?

 এ সকল ভিন্ন পুত্ত্রদ্বয়ের কথা মনে পড়িত। বিশেষ সেই কনিষ্ঠ পুত্ত্র— সে নিতান্ত দুর্ব্বল। তাহার জন্য সর্ব্বদা আশঙ্কা;— সে কেমন আছে? সর্ব্বদা তাহার জন্য আশঙ্কা; কিন্তু সে সর্ব্বদা তাহার সংবাদও পাইত না। সংবাদ পাইবার জন্য সে ব্যস্ত; কিন্তু সংবাদ পাইবার কি করিবে?

 নানা দুশ্চিন্তায় প্রভাতের হৃদয় পদে পদে ব্যথিত হইত। তাই তাহার ব্যথিত হৃদয়ে সুখ ছিল না। সে কেবল মনে করিত, তাহার কৃত-কর্ম্মের ফল ফলিতেছে; সে আপনি ভ্রান্তিবশে যে কায করিয়াছে, তাহার ফল তাহাকে ভোগ করিতেই হইবে;—গরল পান করিলে তাহার ফল মৃত্যু অনিবার্য্য। এ দুঃখ তাহার স্ব-কৃত। প্রভাত কেবল ভাবিত। কেবল পিসীমার স্নেহযত্নে, পিতৃব্যের স্নেহাদরে তাহার ব্যথিত—বিক্ষত—কাতর হৃদয় কিছু শান্তি পাইত।

 এইরূপে পক্ষাধিককাল কাটিল।