নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/চতুর্থ খণ্ড/তৃতীয় পরিচ্ছেদ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
দত্তগৃহে।
ধূলগ্রামের দত্তগৃহে বিবাদের যে অন্ধকার ব্যাপ্ত হইয়াছিল, তাহা আর অপসৃত হইল না। মৃত্যু যে দীপ নিবায়, তাহা আর জ্বলে না। অবশিষ্ট দীপ যে নিবাইয়াছিল, সে ভ্রান্তিবশে তাহা আর জ্বালিল না। সেই নির্ব্বাপিত দীপের ধূমরাশি দত্তগৃহে শোকের অন্ধকার নিবিড়তর করিয়া দিল। কাহারও মনে সুখ নাই। শিবচন্দ্র দুঃখিত; নবীনচন্দ্র দুঃখিত; বড় বধূ ব্যথিতা; পিসীমা ব্যথিতা।
পিসীমা’র জীবনের এক দিকে যে দারুণ বেদনা ছিল, তাহা পিতৃগৃহে স্নেহানন্দে তিনি সহ্য করিতে শিখিয়াছিলেন। নিষ্ফল জীবনের দারুণ শূন্য যেন আপনার সন্তানের অধিক ভ্রাতুষ্পুত্ত্রের ও ভ্রাতুষ্পুত্ত্রীর প্রতি স্নেহে পূর্ণ হইয়াছিল। এখন জীবনের নিষ্ফলতা পদে পদে তাঁহাকে আহত—ব্যথিত করিতে লাগিল; হৃদয়ের শূন্যভাব অসহনীয় হইয়া উঠিতে লাগিল। পিসীমা যেন আর সহ্য করিতে পারিতেছিলেন না।
এক দিন পিসীমা শিবচন্দ্রকে বলিলেন, “শিব, আমি আর সহিতে পারি না। আমাকে কাশী পাঠাইয়া দে।”
তিনি কত সহিয়াছেন, শিবচন্দ্র তাহা জানিতেন। তিনি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। তিনি কি বলিয়া দিদিকে বুঝাইবেন? তাঁহারও বক্ষে বিষম বেদনা।
শিবচন্দ্র কিছু বলিলেন না বটে, কিন্তু নবীনচন্দ্র বলিলেন, “দিদি, এই সময় কি আমাদের ছাড়িয়া যাইবে?” মুখে আর কথা ফুটিল না; কণ্ঠ যেন রুদ্ধ হইয়া আসিল। সে কথা শুনিয়া পিসীমা চক্ষুর জল ছাড়িয়া দিলেন। কয় দিন আর সে কথা উঠিল না।
কিন্তু শূন্যহৃদয়ে সেই শূন্যগৃহে বাস সত্য সত্যই পিসীমা’র আর সহ্য হইতেছিল না। নবীনচন্দ্রও আর কি বলিবেন? শেষে তিনি সতীশচন্দ্র ও সতীশচন্দ্রের জননীর সহিত পরামর্শ করিলেন। সতীশচন্দ্র পরদিন দত্তগৃহে আসিল; অমলকে সঙ্গে লইয়া আসিল। স্নেহশীলা পিসীমা’কে সতীশচন্দ্র বিশেষ জানিত। সতীশচন্দ্র ফিরিয়া যাইতে চাহিলে পিসীমা বলিলেন, “অমল আজ থাকুক।” সতীশ বলিল, “থাকুক।” তাহার পর সে পিসীমা’কে বলিল, “আপনি নাকি আমাদের সব মায়া কাটাইয়া যাইতেছেন?” পিসীমা কাঁদিয়া ফেলিলেন। হায়! মায়া কাটাইতে পারিলে আজ কি আর এত কষ্ট হইত? মায়াতেই ত যাতনা! সতীশচন্দ্র বলিল, “সবই ত প্রায় শেষ হইয়াছে। এখন আর যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তাহা শেষ করিয়া কি হইবে?” বলিতে বলিতে সতীশচন্দ্রের হৃদয়ে পূর্ব্বস্মৃতি সমুজ্জ্বল হইয়া উঠিল। তাহার চক্ষু জলে ছলছল করিতে লাগিল। পিসীমা’র দুই নয়নে ধারা বহিতে লাগিল।
সে রাত্রিতে পিসীমা’র নিদ্রা হইল না। দুইখানি পরিচিত মুখ যেন তাঁহার চক্ষুর সম্মুখে স্থির রহিল। তিনি যাহাই করেন,— সেই দুইখানি মুখ যেন তাঁহার সম্মুখে। তাহারাই তাঁহার দগ্ধজীবনে অজস্র সুখের প্রস্রবণ; —তাহারাই এই বার্দ্ধক্যে তাঁহার অজস্র দুঃখের কারণ। তাহাদিগকে লইয়াই তিনি সব ভুলিয়াছিলেন;—আজ তাহারাই তাঁহার সব দুঃখের কেন্দ্র। যে দিন জীবনপ্রভাতের সকল আশার শ্মশান শ্বশুরের শূন্য ভিটা হইতে শূন্যহৃদয়ে পিতৃগৃহে আসিয়াছিলেন, সে দিন কল্পনাও করিতে পাবেন নাই, —আবার নূতন আশা অবলম্বন করিতে হইবে, আবার নূতন সংসার আপনার করিয়া আপনি তাহাতে জড়িতা হইবেন। কিন্তু সে দিন যাহা কল্পনারও অতীত ছিল, ক্রমে তাহাই সত্যে পরিণত হইয়াছিল। ভ্রাতুষ্পুত্ত্র ও ভ্রাতুষ্পুত্ত্রীর প্রতি স্নেহ যেন তাঁহাকে নূতন জীবন দিয়াছিল। শিশুর প্রতি স্নেহে অঘটন সংঘটিত হয়। তাই—সেই কমল-নয়নের কোমল দৃষ্টিতে,—সেই প্রসারিত ক্ষুদ্র করের আহ্বানে, —সেই কুসুমোপম ওষ্ঠাধরের অস্ফুট কাকলীতে মানবের কঠোর কর্ত্তব্য, বিষম বৈরাগ্য, অটল অভিলাষ—সবই ভাসিয়া যায়,— পাষাণে প্রবাহিণী প্রবাহিত হয়,— নীরস সরস, ও শুষ্ক আর্দ্র হয়, অসম্ভব সম্ভব হয়,—নূতন জীবন বিকশিত হয়।
তাহার পর আবার যখন তাহাদের প্রতি স্নেহে দহনতপ্ত হৃদয় শীতল হইয়াছিল,—শূন্য হৃদয় পূর্ণ হইয়াছিল;—তিনি সব ভুলিয়াছিলেন—তখন কে জানিত,বার্দ্ধক্যে এই অসহ যন্ত্রণা সহ্য করিতে হইবে,— দহনজ্বালা দ্বিগুণ হইবে— শূন্যহৃদয় শূন্যতর হইবে?
সতীশচন্দ্রের মাতৃহীন সুপ্ত পুত্ত্রকে বক্ষে লইয়া পিসীমা কাঁদিতে লাগিলেন। সে রাত্রি তাহার কাঁদিয়া কাটিল।
এমনই দুঃখে দত্তগৃহে দিন কাটিতে লাগিল।
কমলের মৃত্যুশোক বড় বধূর হৃদয়ে বুঝি সন্তানমৃত্যুশোক অপেক্ষাও অধিক বাজিয়াছিল। তাহার উপর পুত্ত্রের এই ব্যবহার। তিনি স্বামীর বিষাদ-মলিন মুখ দেখিয়া ব্যথিত হইতেন, স্নেহশীল দেবরের মুখে দারুণ বেদনার চিহ্ন দেখিতেন, ননন্দার নয়নজল দেখিতেন, আর পদে পদে বুঝিতেন, তাঁহার পুত্ত্রই এ সব বেদনার কারণ। মাতৃহৃদয়ের স্নেহরাশি কেবল যাতনায় পরিণত হইল। তাঁহার সেই পুত্ত্রগতপ্রাণ দেবর ও ননন্দা যে তাঁহার পুত্ত্রকে পাইলে এত দুঃখেও কিছু শান্তিলাভ করিতে পারিতেন—তাহা তিনি জানিতেন; তাই পুত্ত্রের ব্যবহারে হৃদয়ে দ্বিগুণ যাতনা অনুভব করিতেন। মধু বিকৃত হইলে যেমন বিষ হইয়া দাঁড়ায় —স্নেহ আহত হইলে তেমনই যাতনা হইয়া উঠে। বড় বধূর তাহাই হইয়াছিল। তাই তাঁহার হৃদয়ে কেবল যাতনা অসীম,—দারুণ, —ভীষণ! তাহার সেই শিশুমুখ চাহিয়া তিনি যখন মাতৃহৃদয়ে কত আশা করিয়াছিলেন, তখন কি মুহর্ত্তের জন্য এই সম্ভাবনার কল্পনা করিতে পারিয়াছিলেন?
দত্তগৃহে কাহারও মনে সুখ ছিল না। সকলেই দুঃখিত। শিবচন্দ্রের দুঃখ ফুটিত না, —তাই বুঝি অত্যন্ত প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল। যে আশার অবলম্বন,—যাহার নিকট সর্ব্বাপেক্ষা অধিক আশা করিয়াছিলেন, সেই পুত্ত্রই হৃদয়ে দারুণতম আঘাত করিয়াছে। তিনি কাহার নিকট সে কথা প্রকাশ করিয়া শান্তিলাভ করিবেন? একমাত্র পাত্র ভ্রাতা । সেও সমদুঃখকাতর। তাহারও হৃদয় শোকে—দুঃখে ক্ষতবিক্ষত। শিবচন্দ্র তাহা বুঝিতেন । উপায় কি? ভ্রাতার দীর্ণ—বিদীর্ণ হৃদয়ে আর কোন্ আশা অবশিষ্ট আছে,— কোন্ সুখের সম্ভাবনা থাকিতে পারে? তাহার পিতৃহৃদয় শোকে ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। সে যাহাকে পুত্ত্রাধিক জ্ঞান করিয়া পালন করিয়াছিল, — স্নেহ দিয়াছিল, সেই ত সকলের হৃদয়ে দারুণ বেদনা দিয়াছে।
এই শোকে—এই দুঃখে—এই যাতনায় দত্ত-গৃহে সকলেরই হৃদয়ে এক আকাঙ্ক্ষা জাগিতেছিল—যদি প্রভাত—সেই একমাত্র স্নেহের ধন — ফিরিয়া আসিত! যদি সে পুত্ত্র পরিবার লইয়া আসিত; —শোকসন্তপ্ত হৃদয়ে শান্তি দান করিত! কিন্তু সে সব ভুলিয়াছে। যাহাকে তাঁহারা মুহূর্ত্ত ভুলিতে অসমর্থ, সে তাঁহাদিগকে একেবারে ভুলিয়াছে। সে যে এমন হইতে পারিবে, কে ভাবিয়াছিল?
এই ভাবে দিন কাটিতে লাগিল।
মাঘের মধ্যভাগে পিসীমা শিবরাত্রিতে গঙ্গাস্নানে যাইবার প্রস্তাব করিলেন। বড় বধূও তাহাতে আগ্রহ প্রকাশ করিলেন। শিবচন্দ্র, নবীনচন্দ্র ও সতীশচন্দ্র পরামর্শ করিয়া সম্মতি দিলেন। পূর্ব্বে যে স্থানে গঙ্গাস্নানে যাওয়া হইত, রেলে গতায়াত প্রচলিত হইবার পর সে স্থানে যাওয়া এক প্রকার উঠিয়া গিয়াছিল। এখন কলিকাতাতেই গতায়াতের সুবিধা, থাকিবারও সুবিধা। সেই জন্য কলিকাতাতে যাওয়াই চলিত হইয়া উঠিয়াছিল। পিসীমা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় যাওয়া হইবে?” নবীনচন্দ্র বলিলেন, “কলিকাতায়।” শুনিয়া পিসীমা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিলেন; শেষে বলিলেন, “এখনও বিলম্ব আছে। বিবেচনা করিয়া দেখি।”
কলিকাতায় যাইবার কথায় পিসীমা’র হৃদয় ব্যথিত হইল। হায়!—পাষাণনগরী, তোমাকে আমরা কি দিয়া কি পাই? তোমার কঠোর করের নিষ্ঠুর স্পর্শে আমাদের স্বর্ণমুষ্টি ধূলিমুষ্টিতে পরিণত হয়; আমাদের সযত্নসঞ্চিত—বহুকষ্টে রক্ষিত সুধা গরলে পরিণত হয়; আমাদের সব সুখ নিমেষে বিলীন হইয়া যায়। আমরা হৃদয়ের রক্তে যাহাকে পুষ্ট করি, তুমি তাহাকে বিকৃত করিয়া আনন্দলাভ কর। তোমার স্পর্শ আমাদের পক্ষে কেবল দুঃখের—কেবল কষ্টের কারণ।