নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/চতুর্থ খণ্ড/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

যাতনা।

প্রভুর প্রকৃতি ভৃত্যে প্রতিফলিত হয়। যে গৃহে প্রভু দাতা, সে গৃহে দাসদাসী ভিখারীকে মিষ্ট কথায় তুষ্ট করে— যত্ন করে; কারণ, তাহাতে তাহাদের লাভ ব্যতীত ক্ষতি নাই। আর কৃপণের গৃহে ভিখারী সিংহদ্বার অতিক্রমের উদ্যোগ করিলেই দাসদাসী কর্তৃক লাঞ্ছিত হয়। যে গৃহে প্রভু আশ্রিতবৎসল, সে গৃহে দাসদাসীরা আশ্রিতদিগকে সম্মান করে; যে গৃহে প্রভু আশ্রয়দানবিমুখ, সে গৃহে দাসদাসীদিগের নিকট তাহাদিগের সম্মান থাকে না, পরন্তু বিপরীত দেখা যায়। বরং কাচবিশেষে যেমন রবিকর প্রতিফলিত হইলে তাহার দাহিকাশক্তি প্রবল হইয়া আত্মপ্রকাশ করে, ভৃত্যে তেমনই প্রভুর দোষ প্রতিফলিত হইয়া প্রবল ভাব ধারণ করে। বিবাহিতা কন্যার পিত্রালয়বাস নিয়ম নহে,— নিয়মের ব্যতিক্রম। শোভার পিত্রালয়বাসের কারণ বড় বধূ জানিতেন। মধ্যমা বধূও জানিতেন; কিন্তু জানিয়াও জানিতে চাহিতেন না। পিত্রালয়ে বাসহেতু শোভা তাঁহার নিকট যথেষ্ট শ্রদ্ধা হইতে বঞ্চিতা হইয়াছিল। কিন্তু শাশুড়ী জীবিতা থাকিতে সে ভাব প্রকাশের সুযোগ ঘটে নাই,—তাহা গোপনে হৃদয়ে পুষ্ট হইয়াছিল। এখন সে ভয় আর নাই। সুতরাং এখন সময় সময় সে ভাব দৃষ্টিতে বা কথায় প্রকাশিত হইত। তাহা লক্ষ্য করিয়া বড় বধূ শঙ্কিতা হইতেন। মধ্যমাবধূর দাসীরা তাহা লক্ষ্য করিয়াছিল। তাই তাহারাও শোভার প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা দেখাইত না। শোভা তাহা বুঝিতে পারিত না। তাহাদিগের কার্য্যে ত্রুটী দেখিলে সে তাহাদিগকে তিরস্কার করিত। দাসীরা সে বিষয়ে মধ্যমা বধূর নিকট অনুযোগ করিলে তিনি যে তাহাদের পক্ষ লইয়া তাহার অধিকারের অভাবের কথা বলিতেন, তাহা সে জানিত না। ক্রমে মধ্যমা বধূর ব্যবহারে তাঁহার দাসীরা অত্যন্ত প্রশ্রয় পাইল। কৃষ্ণনাথের পত্নীর মৃত্যু হইতেই দাসীদিগের প্রভু-বিভাগ হইয়াছিল।

 প্রভাত যে দিন খড়দহে গেল, তাহার কয় দিন মাত্র পূর্ব্বে শোভা দুর্ব্বল পুত্ত্রকে লইয়া সূতিকাগৃহ হইতে বাহির হইয়াছে। তাহার শরীর দুর্ব্বল; মনও ভাল নহে, পুত্ত্র নিতান্ত দুর্ব্বল— তাহার শরীর প্রায়ই অসুস্থ হয়। সেই দিন মধ্যাহ্নে শোভা একটা দ্রব্য আনিবার জন্য মধ্যমা বধূর এক জন দাসীকে আদেশ করিল। দাসী সে দ্রব্য না আনিয়া অন্য কার্য্যে চলিল। শোভা পুনরায় তাহাকে সেই দ্রব্য আনিতে বলিল। সে শুনিল না। কিছুক্ষণ পরে পুনরায় তাহাকে দেখিয়া শোভা তিরস্কার করিয়া বলিল, “ঝি, তোমাকে একটা কায করিতে কয়বার বলিতে হইবে?” দাসী উত্তর করিল, “যাহার বেতন ভোগ করি, তাহার কার্য্য অগ্রে করিতে হয়।” বড় বধূ পার্শ্বের কক্ষে ছিলেন। এই কথা শুনিতে পাইয়া তিনি দ্রুত আসিয়া দাসীকে তিরস্কার করিলেন, “তোমার বড় স্পর্দ্ধা হইয়াছে, তাই মুখে মুখে উত্তর করিতে আরম্ভ করিয়াছ। কায, করিতে না পার, চলিয়া যাও। কাযের ভাগ করিবার জন্য কেহ তোমাকে ডাকে নাই।”

 কিন্তু তখন বিষবাণ শোভার হৃদয়ে বিদ্ধ হইয়াছে। বিশেষ, শোভা লক্ষ্য করিয়াছিল, দাসী যখন তাহার কথায় উত্তর দিতেছিল, মধ্যমা বধূ তখন দ্বারের পার্শ্বে ছিলেন; তিনি দাসীকে কোনও কথা কহেন নাই,—সে স্থান ত্যাগ করিয়াছিলেন,— যাইবার সময় তাঁহার ওষ্ঠাধরে হাসির রেখা ফুটিয়া উঠিয়াছিল।

 শোভার যেন শ্বাসরোধ হইয়া আসিতে লাগিল। তাহার চক্ষু ফাটিয়া জল পড়িল। হায়!- যে পিতৃগৃহে তাহার ইচ্ছাই আজ্ঞা ছিল, যে গৃহে তাহার সুখের জন্য সকলে সর্ব্বদা ব্যস্ত থাকিত— সেই পিতৃগৃহে সামান্যা দাসী তাহার অপমান করিতে সাহস করে! স্নেহময়ী মা, আজ তুমি কোথায়? তোমার সঙ্গে যে সে সবই গিয়াছে! তবু সে কেবল পিতার জন্য এ সংসারে আছে!—কেন সে আর সকলের মত শ্বশুরালয়ে যায় নাই?— সে যদি ভুল বুঝিয়া থাকে, প্রভাত কেন তাহাকে পুরুষের কঠোর আজ্ঞায় লইয়া যায় নাই? দুর্ব্বলের স্বভাব, আপনি অপরের নিকট লাঞ্ছিত হইলে স্বজনের দোষ ভাবিয়া তাহারই উপর রাগ করে। যাহার উপর রাগ করা যায়,—তাহারই উপর রাগ হয়।

 বড় বধূ শোভার নিকটে বসিয়া অন্য কথার উত্থাপন করিয়া তাহাকে অন্যমনস্কা করিবার চেষ্টা করিলেন; কিন্তু তাহাতে ফল হইল না। শোভা ভাবিল,—এ অপমানের পূর্ব্বে সে মরে নাই কেন?

 সন্ধ্যা হইতেই প্রভাত ফিরিয়া আসিল । তাহাকে দেখিয়া শোভার আহত অভিমান উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। সে প্রভাতকে সেই অপমানের কথা বলিল, এবং তাহাকেই সে জন্য দায়ী করিল। শোভার সেই রোদনস্ফীত নয়ন দেখিয়া, তাহার তীব্র উক্তি শুনিয়া, তাহার ও আপনার অপমানের কথা ভাবিয়া প্রভাতের মনে ধিক্কার জন্মিল। সে কি ভ্রমই করিয়াছে। তাহার দারুণ পাপের এই নিদারুণ প্রায়শ্চিত্ত।

 প্রভাত যেন আর সহ্য করিতে পারিল ন।; ভাবিতে ভাবিতে গৃহের বাহির হইয়া গেল। লক্ষ্যহীন ভাবে যাইতে যাইতে সে গৃহের অনতিদূরস্থ সেই উদ্যানে উপস্থিত হইল,—প্রবেশ করিয়া সরোবরের তৃণাচ্ছাদিত তটভূমিতে বসিল। তখনও উদ্যানে পবনস্পর্শলোলুপ যুবকগণ ভ্রমণ করিতেছে;—এক এক স্থানে দুই চারি জন বসিয়া গল্প করিতেছে । পাত্রে জল ঢালিতে ঢালিতে শেষে জল উছলাইয়া পড়ে— হৃদয়ে যখন দুঃখকষ্ট আর ধরে না, তখনও তেমনই হয়! প্রভাত যে স্থানে বসিল, তাহার অদূরে কয় জন যুবকের কথায় তাহার মনোযোগ আকৃষ্ট হইল। যুবকগণ ভারতচন্দ্রের কবিত্ব লইয়া তর্ক করিতেছিল। এক জন বলিল, “ললিতমধুর ভাষায় ভাবপ্রকাশক প্রবাদবাক্যরচনায় ভারতচন্দ্রের সমকক্ষ কোথায়? মুখরা,—বিনয়হীনা স্বার্থপরা পত্নীর কথা অনেক কবি লিখিয়াছেন; কিন্তু এত অল্প কথায় এমন ভাবপ্রকাশ আর কে করিতে পারিয়াছে?—

‘নারী যার স্বতন্তরা  সে জন জীয়ন্তে মরা
তাহারে উচিত বনবাস।’

দেখ দেখি কি সুন্দর!” তর্ক চলিতে লাগিল। কিন্তু সে দিকে প্রভাতের আর মন ছিল না। কথা কয়টি তাহার মর্ম্মে বিদ্ধ হইয়াছিল। সে তখনও শোভাকে এ দুর্দ্দশার জন্য দায়ী ভাবিতেছিল। সে ত তাহারই জন্য আপনার আর সব ছাড়িয়াছে। হায়!—সে কি না করিয়াছে?

 সেই তৃণমণ্ডিত ভূমিতে শয়ন করিয়া প্রভাত ভাবিতে লাগিল; বাল্যকাল হইতে আজ পর্যন্ত কত ঘটনা তাহার মনে পড়িতে লাগিল। তাহার জীবনের ভ্রম সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল। সে পদে পদে সুযোগ ত্যাগ করিয়াছে! সে দারুণ যন্ত্রণায় দগ্ধ হইতে লাগিল। এখন সে কি করিবে?—তাহার কর্ত্তব্য কি?

 প্রভাত কতক্ষণ এইরূপ অবস্থায় চিন্তা করিল, তাহা সে আপনি জানিতে পারিল না। অদূরে কোথায় ঘড়ীতে প্রহর বাজিল। সেই শব্দে প্রভাত চমকিয়া উঠিল; চাহিয়া দেখিল, —উদ্যান প্রায় জনশূন্য, অনেকেই চলিয়া গিয়াছে; তৃণদলে শিশির সঞ্চিত হইতেছে,—তাহার কেশ ও বেশও আর্দ্র হইতেছে;—আকাশে চন্দ্রোদয় হইয়াছে,—সরোবরের স্থির অচঞ্চল জলে চন্দ্রকর পড়িয়াছে। প্রভাতের শীত করিতে লাগিল। প্রভাত উঠিয়া বসিল; ঘড়ী দেখিল,—রাত্রি নয়টা।

 প্রভাত গৃহের কথা ভাবিতেছিল। নয়টা বাজিল। তাহার মনে পড়িল,—কিছুক্ষণ পরেই ধুলগ্রামে যাইবার ট্রেণ ছাড়িবে। এক সময় এই ট্রেণে যাইবার জন্য তাহার কত আগ্রহ ছিল, এই সময়ের জন্য এক এক দিন কত ব্যস্ত হইত! এখনও ত সে যাইতে পারে। বন্দী পলায়নচেষ্টায় আপনার কারাগৃহের প্রাচীর, হর্ম্ম্যতল—সব শতবার পরীক্ষা করিয়া শেষে যদি দেখে, বাতায়নের লৌহদণ্ড তাহার সামান্য আকর্ষণে খুলিয়া আসিল, তবে সে যেমন আনন্দে বিহ্বল হয়, প্রভাত তেমনই বিহ্বল হইল। প্রভাত পকেটে হাত দিল,—ব্যাগ লইয়া দেখিল,— টাকা আছে। সে উঠিয়া রাস্তায় আসিল,—গাড়ী লইল। অল্পক্ষণের মধ্যেই সে ষ্টেশনে উপস্থিত হইল।

 ট্রেণ ছাড়িবার অধিক বিলম্ব ছিল না। টিকিট লইয়া প্রভাত দ্রুত আসিয়া ট্রেণে উঠিল। একটি নিদ্রিতা বালিকাকে বক্ষে লইয়া এক জন ভিক্ষুক প্ল্যাটফরমে ভিক্ষা করিতেছিল,—“এই মেয়েটির মা নাই। আমি এই ষ্টেশনে মালগুদামে কায করিতাম। এখন আর কায করিতে পারি না। বড় ‘সাহেব’ দয়া করিয়া আমাকে ভিক্ষা করিতে অনুমতি দিয়াছেন।—ইত্যাদি।” প্রভাত ব্যাগ খুলিল; যাহা কিছু ছিল, তাহাকে দিল। অত অর্থ পাইয়া ভিক্ষুক বিস্মিত হইয়া চাহিল, অপর যাত্রীরাও বিস্ময় প্রকাশ করিল। ট্রেণ ছাড়িয়া দিল।