নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/চতুর্থ খণ্ড/প্রথম পরিচ্ছেদ
চতুর্থ খণ্ড
দুঃখের পর ।
প্রথম পরিচ্ছেদ।
বন্ধুগৃহে।
মাঘের শেষ। শীত যায় যায়। প্রভাতের কয় জন বন্ধু কিছুদিন হইতে কলিকাতার বাহিরে চড়িভাতি করিতে যাইবার কল্পনা করিতেছিল। কিন্তু নানা কারণে তাহা ঘটিয়া উঠে নাই। এমন সময় বন্ধু শারদানাথের পুত্ত্র লাভে ও ডেপুটী বন্ধু অমৃতেন্দ্রনাথের বিভাগীয় পরীক্ষায় সাফল্যলাভসংবাদে সঙ্কল্প কার্য্যে পরিণত হইল। খড়দহে রাজেন্দ্রনাথের একখানি বাগানবাড়ী অর্দ্ধ-সমাপ্ত অবস্থায় ছিল;—গৃহ সম্পূর্ণ হইয়াছিল, উদ্যানরচনা হয় নাই। সেই গৃহে চড়িভাতি করা স্থির হইল।
অতি প্রত্যুষে যাত্রা করিতে হইল। তখন অন্ধকার কেবল দূর হইতেছে; ষ্টেশনে আলোক নির্ব্বাপিত হয় নাই। গাড়ী ছাড়িয়া দিল। সতের জন দুইখানি কামরা দখল করিয়া বসিল। বহুদিন কলিকাতায় বাসের পর পল্লীর স্নিগ্ধশ্যাম শোভা কি মধুর! ধূলিধূমমুক্ত শীত পবনের স্পর্শ কি প্রীতিপদ!
দেখিতে দেখিতে সূর্য্যোদয় হইল।পূর্ব্ব মেঘে রক্তিমা— কিরণগোলক সিন্দুরলোহিত,—প্রদীপ্ত তেজোহীন। ক্রমে বর্ণ ঔজ্জ্বল্যে পরিণত হইতে লাগিল। প্রান্তরদৃশ্য নয়নসমক্ষে প্রতিভাত হইয়া উঠিল।
পথিপার্শ্বে নালায় জল শুকাইয়া গিয়াছে; তলদেশে ভূমি শতধা বিদীর্ণ হইয়া মাঘের শেষে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করিতেছে। সেই বিদীর্ণ ভূমির ফাটলে ভাদলা তৃণের নবোদ্গগত পত্র হরিদ্রা হইতে গাঢ় হরিতে পরিণত হইতেছে। বৃক্ষশাখায় দুই চারিটি বিহগ বসিয়া আছে; প্রান্তরে আর কতকগুলি শস্যকণার বা পতঙ্গের সন্ধান করিয়া ফিরিতেছে। সমীরান্দোলিত বৃক্ষপত্র হইতে নিশার সঞ্চিত শিশির বিন্দু বিন্দু ঝরিতেছে। তৃণদলে পর্য্যাপ্ত শিশির। দূরে প্রান্তরদৃশ্যে কেবল হরিৎ শোভা— স্নিগ্ধ, নয়নরঞ্জন, মনোমোহন। সেই প্রান্তর দৃশ্যে সামান্য স্বচ্ছ কুয়াসা যেন পল্লীলক্ষ্মীর আননে সূক্ষ্ম অবগুণ্ঠনের মত প্রতীয়মান হইতেছে।
অল্প সময় মধ্যেই ট্রেণ খড়দহে আসিল। ক্রমে সকলে বাগানবাড়ীতে উপনীত হইল। গৃহের সম্মুখে কলতানময়ী, উদার গঙ্গা—পূতসলিলা,— ভারতের সম্পদ্বিধায়িনী, চিরকল্যাণময়ী। গৃহের পার্শ্বে ই তান্ত্রিক সাধক প্রাণনাথ বিশ্বাসের সাধনাশ্রম পঞ্চবটীর প্রবীণ বৃক্ষরাজি। চারি দিকে অশ্বত্থ, বট, খর্জ্জুর, বাবলা, নারিকেল, কুল, নোনা, নিম্ব ও শিমুল তরু। বৃক্ষের তলদেশে কালকাসন্দা ও আসশ্যাওড়ার ঝোপ। দুই একটি বৃক্ষ লতায় আবৃত,—লতায় ঢোলকলমীর ফুলের মত এক প্রকার সুন্দর ফুল ফুটিয়া গাছ অলো করিয়া আছে। দক্ষিণে গঙ্গা বাঁকিয়া গিয়াছে; —কূলে বহু দিনের প্রাচীন ঘাট ও বহু শিবমন্দির। বামে গঙ্গা অশ্বক্ষুরের মত হইয়া অদৃশ্য হইয়াছে। পর পারে কলের চিম্নি হইতে ধূম উদ্গিরিত হইতেছে। পরিচ্ছন্ন গৃহগুলি মেঘহীন নীলাম্বরতলে, হরিৎ তরুলতার মধ্যে চিত্রের মত দেখাইতেছে। সারি সারি ঝাউ যেন আকাশদৃশ্য বিভক্ত করিয়া দণ্ডায়মান।দুই পার্শ্বে নীলাম্বরের কোলে বৃক্ষলতায় যেন অবিচ্ছিন্ন সবুজ রেখা।
বন্ধুদিগের সহায়তায় অল্প সময়ে মধ্যেই কিছু আহার্য্য প্রস্তুত হইল। প্রাতরাশের পর শারদানাথ ছুরিকার সাহায্যে উদ্ভিদ্বিদ্যার আলোচনা করিতে লাগিল; বিজয়চন্দ্র ও রাজেন্দ্রনাথ পাকের তত্ত্বাবধান করিতে লাগিল; এক দল তাস খেলিতে প্রবৃত্ত হইল; সঙ্গীতপ্রিয়গণ সঙ্গীত চর্চ্চা করিতে লাগিল; সকলেই অবসরমত পরচর্চায় যোগ দিতে লাগিল। রাজনীতি, সমাজনীতি, সাহিত্য—সবই আলোচিত হইতে লাগিল। বিশেষ, বঙ্গ ভাষায় নব প্রকাশিত ঐতিহাসিক গ্রন্থ, উপন্যাস ও কবিতা— এ তিনের যথেষ্ট সমালোচনা চলিতে লাগিল।
এক জনের মনে পড়িল,শ্যামসুন্দরের ও মদনমোহনের মন্দির ও বিগ্রহ দেখিতে হইবে। চাঞ্চল্য ও আবেগ যৌবনের ধর্ম্ম। কথা হইতে না হইতে সঙ্কল্প স্থির হইল। তখন সকলে যাত্রা করিল। পথে রাজেন্দ্রনাথ পূর্ব্বপরিচিত “দেওয়ানজী” মহাশয়কে ডাকাইয়া লইল। “দেওয়ানজী” বৃদ্ধ,—মুণ্ডিতগুম্ফশ্মশ্রু,—দীর্ঘকায়,—কৃষ্ণবর্ণ। তিনি যাঁহাদের দেওয়ান ছিলেন, তাঁহাদের ঐশ্বর্য্য অতীতের প্রবাহে বিলীন হইয়া গিয়াছে। তবে তখন লোকের ঐশ্বর্য্য থাকিলে তাহার কিছু স্থায়ী চিহ্নও থাকিত; সেগুলি বিক্রীত হইবার নহে—তাই থাকিয়া যাইত। বঙ্গের সর্বত্র দেখিবে, বিস্তৃত দীর্ঘিকা, প্রশস্ত রাজপথ সুগঠিত দেবমন্দির, স্নানের ঘাট— অধুনা দরিদ্র বা বিলুপ্ত বংশের ঐশ্বর্য্যস্মৃতি লইয়া দণ্ডায়মান। “দেওয়ানজী” যে পরিবারের সেবা করিয়াছিলেন, দেবমন্দিরে ও স্নানের ঘাটে তাঁহাদের ঐশ্বর্য্যস্মৃতি এখনও বর্ত্তমান; হয় ত আরও কিছুদিন থাকিবে। তবে তাহারাও এই পুরাতন, প্রভুভক্ত কর্ম্মচারীর মত জীর্ণ,—কালের করচিহ্নে চিহ্নিত। সে বংশপতি নাই, সে সম্পদ নাই, কেবল “দেওয়ানজী”র পদের নামটুকুমাত্র গ্রামবাসীদিগের নিকট এই বৃদ্ধের সহিত অবিচ্ছিন্নভাবে বদ্ধ হইয়া আছে।
“দেওয়ানজী” খড়দহের অতীত গৌরবের কথা বলিতে লাগিলেন। সে কালের সেই সব কথা বলিতে বলিতে বৃদ্ধের ক্ষীণদৃষ্টি নয়নদ্বয় যেন প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল। যুবকগণ সেই সব শুনিতে শুনিতে মন্দিরে উপনীত হইল। এক জন ভক্তিভরে চরণামৃত গ্রহণ করিলে আর এক জন বিদ্রূপ করিয়া রলিল, “ভণ্ডামী কেন?” সে উত্তর করিল, “ভণ্ডামী নহে। বিশ্বাস না করিতে পারি; কিন্তু জাতীয় আচার ত্যাগ করিব কেন? কোন্ জাতি জাতীয় আচার ত্যাগ করে?” কথায় কথায় অন্য কথা আসিয়া পড়ায় সে আলোচনা ত্যক্ত হইল,—মতভেদের বিষম তর্ক আর উত্থাপিত হইল না। তাহার পর নানা বিষয়ের আলোচনা করিতে করিতে যুবকদল বাগানবাড়ীতে ফিরিয়া আসিল।
তখন বেলা হইয়াছে। জোয়ারের উচ্ছ্বসিত বারি বাঁধা ঘাটের সোপানের পর সোপান ডুবাইয়া দিতেছে। গঙ্গাবক্ষে কত তরণী ভাসিয়া যাইতেছে। বাষ্পীয় জলযানের গমনে জলরাশি আন্দোলিত হইতেছে,—বড় বড় ঢেউ আসিয়া কূলে প্রতিহত হইতেছে। কত ছোট ছোট নৌকা যাইতেছে; মাঝিরা গল্প করিতেছে, ধূমপান করিতেছে, ক্ষিপ্রহস্তে দাঁড় বাহিতেছে। সকলে স্নান করিতে গঙ্গায় নামিল। যাহারা সন্তরণপটু, তাহারা সন্তরণরত হইল; হস্তের আন্দোলনে জল ছিটাইতে লাগিল। কেহ কেহ ইচ্ছা করিয়া সঙ্গীদিগের মুখে জল দিতে লাগিল। ক্রমে জল ছিটানটা সংক্রামক রোগের মত ব্যাপ্ত হইয়া পড়িল। কলিকাতায় সচরাচর অবগাহন-স্নান ঘটে না; আজ সকলে তাহার অনির্ব্বচনীয় আনন্দ উপভোগ করিতে লাগিল।
অপরাহ্নে—তিনটার পর- আহার্য্য প্রস্তুত হইল। আহারের আয়োজন যেমন বিপুল, ক্ষুধাও তেমনই প্রবল। কাযেই প্রচুর আহার্য্যের যথেষ্ট সদ্ব্যবহার হইয়া গেল।
প্রত্যাবর্ত্তনকালে ক্ষেত্রমোহনের দোষে পথ ভুলিয়া,—গোশকটচালক ও যাত্রীদিগের নিকট পথের সন্ধান জানিয়া সকলে পথে কলহাস্য ছড়াইতে ছড়াইতে ষ্টেশনে আসিল। ষ্টেশনে সকলেই সোডা, লেমনেড বা জিঞ্জারেড পান করিবে, কিন্তু বিক্রেতাকে এককালে দুইটি আনিতে বলিবে না! সে বিরক্ত হইতে লাগিল; যুবকদল তাহাতে যথেষ্ট আনন্দ উপভোগ করিতে লাগিল।
তাহার পর ট্রেণে আবার কলরব করিতে করিতে সকলে ফিরিয়া আসিল। তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয় হয়।
এই আনন্দের মধ্যে প্রভাত কেমন বিষণ্ণ বোধ করিতেছিল। এ আনন্দ যেন তাহার হৃদয় স্পর্শ করিতেছিল না। আজ বহু দিন পরে কলিকাতা হইতে পল্লীগ্রামে আসিয়া তাহার কেবল আপনার গ্রামের কথা মনে পড়িতেছিল, আজ গঙ্গা দেখিয়া তাহার গ্রামের সেই কলনাদিনী তটিনীর স্মৃতি মনে উদিত হইতেছিল,—আজ তাহার গৃহের কথা মনে হইতেছিল। আর— সঙ্গে সঙ্গে সেই পল্লীভবনবাসী শোকদুঃখকাতর স্বজনগণের কথা মনে পড়িতেছিল। আপনার ব্যবহারের কথা, স্বজনগণের ও তাহার মধ্যে ব্যবধানের কথা সব মনে পড়িতেছিল। তাই এই আনন্দের মধ্যে প্রভাত বিষাদের ছায়াপাত অনুভব করিতেছিল।