নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/তৃতীয় খণ্ড/দশম পরিচ্ছেদ

দশম পরিচ্ছেদ।

আর দুই সংসার।

নলিনবিহারীর মৃত্যুর পর বিধবা চপলা কাঁদিতে কাঁদিতে জননীর সঙ্গে পিত্রালয়ে, ফিরিয়া গেল। আপনার ভ্রম বুঝিয়া সে প্রায়শ্চিত্ত করিতে কৃতসঙ্কল্পা হইয়াছিল। জীবনব্যাপী আত্মগ্লানি মাত্র রহিল; —শান্তির আশা রহিল না। আপনার ভ্রান্ত কার্য্যের সংশোধনের কথা যখন সে বুঝিল,— বুঝিয়া কার্য্যে প্রবৃত্তা হইল, তখনই সব শেষ হইয়া গেল। হায়,—কেন সে পূর্ব্বে ইহা বুঝিতে পারে নাই? হৃদয়ের যন্ত্রণা হৃদয়েই রহিল;— হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত। সে যে আপনার দারুণ ভ্রম বুঝিয়াছে, বুঝিয়া আপনাকে ধিক্কার দিয়াছে; সে যে সে জন্য দুঃখিতা,—আপনাকে সংশোধনে প্রবৃত্তা, এ কথা সে একবার বলিবারও অবসর পাইল না। চপলা বুঝিল, ইহা ত তাহার দারুণ ভ্রমের প্রায়শ্চিত্তের এক অংশ। সে নীরবে সব সহ্য করিল। তাই বলিয়াছি, সহজে কেহ আপনার স্বভাব পরিবর্ত্তিত করিতে পারে না। সদ্বংশসম্ভূতা, পবিত্রজীবনের আদর্শে পালিতা ও শিক্ষিতা রমণী যখন আপনার ভ্রম বুঝিতে পারেন, তখন তিনি স্বতঃপ্রবৃত্তা হইয়া প্রায়শ্চিত্ত করিতে আরম্ভ করেন। আর কাহাকেও তাহা বলিয়া দিতে হয় না। আর কেহ সে ভ্রান্তির কথা জানিতে না পারিলেও, রমণী আপনি হৃদয়কে পীড়িত—দলিত করেন। চপলা তাহাই করিল। তাহার পুণ্যসঙ্কল্প যেন তাহার হৃদয়ে নূতন শক্তির সঞ্চার করিল; চপলতা গাম্ভীর্য্যে পরিণত হইল; হাস্যপরিহাসপ্রিয়তা চিন্তাশীলতায় অদৃশ্য হইয়া গেল। জীবনে নূতন পথ মুক্ত হইল,—হৃদয়ে নূতন উদ্দেশ্য বিকশিত হইয়া উঠিল। হায়—যদি সে অল্প দিন পূর্ব্বেও আপনার এই অতি দারুণ ভ্রম বুঝিতে পারিত, যদি স্বামীর নিকট ত্রুটী স্বীকার করিবার সময় পাইত!—তবে হয় ত এই চিরদাবানলদগ্ধ হৃদয়ে এক বিন্দু শান্তিবারি সিঞ্চিত হইত। কিন্তু তাহা হয় নাই,—তাহা হইবার নহে।

 গৃহে শোকের প্রথম বেগ কিছু প্রশমিত হইলে শিশিরকুমার কর্ম্মস্থানে যাইতে উদ্যত হইল। চপলার জননী কাঁদিয়া বলিলেন, “বাবা, আমার সব আশাই ত শেষ হইল। তুমি পুত্ত্রস্থানীয়। কর্ত্তা বলিতেন, তুমিই আমার অবলম্বন। তুমিও পুত্ত্রের অধিক করিতেছ। কায ছাড়িয়া দাও; বিবাহ কর; আমার নিকটে থাক।”

 তাঁহাকে সুখী করিতে পারিলে শিশিরকুমার যত সুখী হইত, তত আর কিছুতেই নহে। তাই শিশিরকুমার আবার ভাবিল, কি করা কর্তব্য। বিবাহ করিলে তিনি সুখী হইবেন! বিবাহ করিলে হয় ত আর এক জনের হৃদয়ে এক দারুণ সম্ভাবনার কল্পনার উদয়পথ রুদ্ধ হইয়া যাইবে। কিন্তু হায়! —দীর্ণ হৃদয় আর যুক্ত হইবার নহে;—ম্লান কুসুম আর প্রফুল্ল হয় না। শিশিরকুমার বুঝিল, সে কার্য্য তাহার ক্ষমতার অতীত। সে ত আত্মবিসর্জ্জন করিয়াছে,— সে ত আত্মত্যাগ করিতে প্রস্তুত। তাহার আর এক জনকে আত্মবিসর্জ্জন করিতে বলিবার অধিকার কোথায়? সে তাহা চাহিতে পারে না।

 ইহার পর কর্ম্মত্যাগ করিয়া তাঁহার নিকটে থাকিবার কথা। কেন সে ভিন্ন স্থানে-ভিন্ন কার্য্যে আপনার জীর্ণ হৃদয়ের হতাশা বেদনা সহনীয় করিতে গিয়াছিল, কেন হৃদয়ের সমস্ত সঙ্কল্প পরিবর্ত্তিত করিয়াছিল,—কেন সব উচ্চাশা বিসর্জ্জন করিয়াছিল, সে কথা তাহার মনে পড়িল। হৃদয় যেন নূতন করিয়া ব্যথিত হইল। সে ভাবিয়া দেখিল, সে নিকটে থাকিলে সদুপদেশসহায়তায় হয় ত চপলার উপকার করিতেও পাবে। কিন্তু দুর্ব্বল মানবহৃদয়ের ক্ষীণ শক্তিতে কত দূর নির্ভর করা যুক্তিযুক্ত? তাহার আবেগ!—শিশিরকুমার চপলার কথা ভাবিল; সব দিক দেখিল— চপলার জননীর আদেশ পালন করিতে পারিল না। যাঁহাদের ইষ্টসাধন তাহার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, সে কর্ত্তব্য বুঝিয়া আপনাকে তাঁহাদিগের নিকট হইতে দূরে লইল—নির্ব্বাসিত করিল। সে জন্য সে সবই সহ্য করিতে প্রস্তুত রহিল,—সবই সহ্য করিল। কিন্তু ব্যর্থ জীবনের সে লক্ষ্য অপরিবর্ত্তিতই রহিল।

 কৃষ্ণনাথের পত্নী কিছু দিন হইতে হৃদরোগ ভোগ করিতেছিলেন। নলিনবিহারীর মৃত্যুর পর তাহা বাড়িয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু তিনি প্রকাশ করেন নাই। অগ্রহায়ণের মধ্যভাগে এক দিন তাঁহার সামান্য জ্বর হইল। তিনি গ্রাহ্য করিলেন না। পর দিন জ্বর একটু বাড়িল। ছেলেরা জিদ করিয়া ডাক্তার ডাকাইল। ডাক্তার মত প্রকাশ করিলেন, জ্বর সামান্য—কিন্তু হৃদ্‌যন্ত্রের অবস্থা ভাল নহে। পর দিন সহসা নিশ্বাসরোধ হইল —রোগ যন্ত্রণা ভোগ না করিয়া পুত্ত্রশোকাতুরা জননী সর্ব্বযন্ত্রণামুক্তা হইলেন। কৃষ্ণনাথের সুখের সংসারে দুঃখের প্রবাহ প্রবেশ করিয়াছিল।

 পরিণত বয়সে পত্নী—গৃহের গৃহিণী, রোগে শুশ্রূষাকারিণী, সর্ব্বকার্য্যে সাহায্যকারিণী হইয়া দাঁড়ান। যিনি যৌবন হইতে স্বামীর সকল সুবিধা অসুবিধা সযত্নে লক্ষ্য করেন, স্বামীর সুখাসুখ আপনার করিয়া লয়েন; সুস্থাবস্থায় ও রোগে উপযুক্ত শুশ্রূষাদান করেন; সযত্নে জরার আগমন বিলম্বিত করিতে চেষ্টা করেন,—যাহাতে দেহে ক্ষয়ের স্পর্শচিহ্ন অনুভূত না হয়, সে জন্য সচেষ্ট হয়েন— তাঁহার মৃত্যুতে কেবল শোকই প্রবল হয় না। দীর্ঘজীবনপথ যাঁহার করে করবদ্ধ করিয়া অতিক্রম করা যায়, যিনি আবশ্যককালে অবলম্বন ও অন্য সময় মধুরভাষী সহচর, সহসা তাঁহার অভাবে হৃদয় যে বেদনা অনুভব করে, তাহা অপনীত হইবার নহে। দীর্ঘ দিন যে হৃদয় পূর্ণ করিয়া থাকে, সহসা—সন্ধ্যার কনককিরণ নিবিতে না নিবিতে তাহাকে হারাইলে হৃদয়ের শূন্যভাব যেন একান্ত অসহনীয় হইয়া উঠে। যৌবনে পত্নীবিয়োগে হৃদয় ভাঙ্গিয়া যায়; পরিণত বয়সে পত্নীবিয়োগে সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যও ভাঙ্গিয়া যায়। গৃহিণীর মৃত্যুর পর হইতে কৃষ্ণনাথের স্বাস্থ্যভঙ্গ হইতে লাগিল,—বার্দ্ধক্যের ক্ষয়চিহ্ন বড় দ্রুত সুস্পষ্ট হইয়া উঠিতে লাগিল। কোনও পীড়া নাই; কিন্তু স্বাস্থ্য ভাল নহে। এই ভাবে কয় মাস কাটিয়া গেল। কৃষ্ণনাথ পূর্ব্ববৎ যথারীতি আফিসের কায করিতে লাগিলেন। বৈশাখের প্রথমে অতি দারুণ তাপ পড়িল। গরমে কয় রাত্রি কৃষ্ণনাথ ঘুমাইতে পারিলেন না—শরীর অবসন্ন বোধ হইতে লাগিল। তখন আফিসেও কাযের বড় ভিড়। এই অবস্থায় এক দিন কৃষ্ণনাথকে আফিসের পক্ষ হইতে একটা মোকর্দ্দমার উপদেশ দিবার জন্য মধ্যাহ্নে উকীলবাড়ী যাইতে হইল। প্রত্যাবর্ত্তনকালে গাড়ীতেই তিনি মূর্চ্ছিত হইলেন। সর্দ্দিগর্ম্মি কাটিল বটে; কিন্তু পক্ষাঘাত দাঁড়াইল। কৃষ্ণনাথ জীবিত রহিলেন বটে, কিন্তু হায়! জীবন্মৃত।

 গৃহিণীর মৃত্যুর পর অন্তঃপুরের কার্য্যভার বড় বধূর হস্তে আসিয়াছিল। এখন বাহিরের কার্য্যভার কৃষ্ণনাথের জ্যেষ্ঠপুত্রের হস্তে আসিল। বাহিরের কার্য্য যেমন চলিতেছিল, তেমনই চলিতে লাগিল। বাহিরের কার্য্যে নিত্য নূতন পরিবর্ত্তন হয় না, —নিত্য নূতন ঘটনা ঘটে না;—কাযেই বাহিরের কার্য্যে কোনও গোল ঘটিল না। বিশেষ জ্যেষ্ঠ সর্ব্ববিষয়ে বিনোদবিহারীর সুবিধা দেখিতেন। কিন্তু যেমন সমস্ত দেহের শক্তি হৃদয়ে চালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়, তেমনই সংসারের প্রকৃত কার্য্য অন্তঃপুরেই সম্পাদিত হয়। সেখানে অতি তুচ্ছ কার্য্য হইতে অতি গুরু ফল ফলিয়া থাকে। মধ্যমা বধূ শাশুড়ীর যে কর্ত্তৃত্ব অস্বীকার করিতে পারিতেন না, বড় বধূকে সেই কর্ত্তৃত্বদানে তাঁহার আগ্রহ ছিল না। বড় বধূ সর্ব্ব বিষয়ে তাঁহার সুবিধা দেখিলেও তিনি সন্তুষ্ট হইতে পারিতেন না। কাযেই সংসার ক্রমে প্রধানহীন সাধারণতন্ত্রের অবস্থা প্রাপ্ত হইতে লাগিল। বড় বধূর সর্ব্বাপেক্ষা অধিক আশঙ্কা— পাছে মধ্যমা বধূ কোনরূপে শোভার সহিত অসদ্ভাব করেন। শাশুড়ীর সে আশঙ্কা তিনি বুঝিয়াছিলেন। তাই তিনি শঙ্কিতা থাকিতেন,—সাবধান থাকিতেন।

 মা নাই;—সে সংসার নাই। শোভা চিরদিন আদরে অভ্যস্তা। এখন আপনার কায আপনি দেখিতে হয়। বড়বধূর অনেকগুলি সন্তান। তিনি শোভাকে অত্যন্ত আদরে রাখিতে চেষ্টা করিতেন বটে, কিন্তু নানা কার্য্যে সর্ব্বদা তাহাকে দেখিতে পারিতেন না। শোভা অন্যত্র-স্বতন্ত্র সংসার পাতিবার কথা ভাবিল, প্রভাতকেও বলিল। কিন্তু উভয়েরই এক বিপদ,—কেমন করিয়া কৃষ্ণনাথকে এ অবস্থায় ছাড়িয়া যাইবে? সে কার্য্য অত্যন্ত অশোভন দেখাইবে। কাযেই তাহা হইল না। ইহার পর পৌষ মাসের মধ্যভাগে নিয়মিত কালের পূর্ব্বে শোভা একটি দুর্ব্বল সন্তান প্রসব করিল।

 প্রভাত মধ্যে মধ্যে সতীশের পত্র পাইত। স্নেহশীল নবীনচন্দ্র কি তাহাকে ভুলিতে পারেন? তাই সতীশচন্দ্রকে মধ্যে মধ্যে প্রভাতের সংবাদ লইতে হইত, নহিলে নবীনচন্দ্র থাকিতে পারিতেন না। সতীশ প্রায়ই প্রভাতকে গৃহে আসিতে লিখিত। সে গৃহে না যাওয়াতে গৃহে সকলেই দুঃখিত জানিয়া প্রভাত সত্য সত্যই দুঃখিত হইত। কিন্তু উপায় কি? কতবার সে কত সুযোগ ত্যাগ করিয়াছে—তাহা প্রভাতের মনে পড়িত। সে ভাবিত, এখন কেমন করিয়া কৃত কর্ম্মের প্রায়শ্চিত্ত করিতে পারি;—কেমন করিয়া আবার গৃহে মুখ দেখাইব? তাহার ব্যবহারে গৃহে সকলে কত কষ্ট পাইয়াছেন, এবং পাইতেছেন,তাহা মনে করিয়া প্রভাত কষ্ট পাইত।