নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/তৃতীয় খণ্ড/নবম পরিচ্ছেদ
নবম পরিচ্ছেদ।
শূন্য গৃহ।
হৃদয়ের সব সুখ সেই চিতানলে ভস্মীভূত করিয়া সতীশচন্দ্র দেশে ফিরিল। দেশে ফিরিয়া প্রথম কয় দিন সে শিবচন্দ্রের গৃহেই রহিল। সে গৃহও শূন্য;—সে গৃহেও সুখালোক ও আনন্দকিরণ নির্ব্বাপিত। এখনও পল্লীর পৌঢ়গণ দত্তগৃহে আসিয়া থাকেন। কিন্তু গৃহে আর সে ভাব নাই। আর ক্রীড়া নাই, হাস্যপরিহাস নাই,—আনন্দ নাই। তপন মেঘাবৃত হইলে সমস্ত প্রকৃতিতে বিষাদের ছাড়া পড়ে; যে গৃহে গৃহস্বামীর মনে সুখ নাই, সে গৃহে আনন্দ আসিবে কোথা হইতে? যে গৃহে মরণের ছায়া পড়ে, সে গৃহে চাপল্য থাকে না, বিষাদগাম্ভীর্য্য আপনি আইসে।
পূর্ব্বে গৃহকর্ম্ম শিবচন্দ্র দেখিতেন; তাঁহার সুব্যবস্থায় সংসারে কোনরূপ বিশৃঙ্খলা ঘটিতে পারিত না। কিন্তু তাঁহার আর সে সকল কার্য্যে মন নাই। তিনি কমলকে কত ভালবাসিতেন, তাহা তিনি আপনিও ইহার পূর্ব্বে বুঝিতে পারেন নাই; এখন অতি দারুণ,—মর্ম্মভেদী শোকে বুঝিলেন, সে কত প্রিয় ছিল,— জীবনে সে কি ছিল,— সে বিনা জীবন কি হইয়াছে। জ্বালার উপর জ্বালা, যে নিকটে থাকিলে, যাহাকে স্নেহবন্ধনে বাঁধিতে পারিলে এ দহন প্রশমিত হইতে পারিত, সে আজ কোথায়? সে কথা ভাবিলে হৃদয়ে যন্ত্রণা যেন দ্বিগুণ হইয়া উঠিত। অথচ সে ভাবনা আপনি আসিত, —সর্ব্বদা আসিত। শিবচন্দ্র যেন সর্ব্বদাই চিন্তিত। এত দিন তাঁহার স্বাস্থ্য অটুট ও শক্তি অব্যাহত ছিল; এখন শোকে ও চিন্তায় স্বাস্থ্য ভাঙ্গিয়া যাইতে লাগিল।—শরীরে ক্ষয়চিহ্ন প্রকাশ পাইতে লাগিল। শিবচন্দ্র একান্ত কাতর,— একান্ত বিষণ্ণ।
পিসীমা’র শোক যদি বা ব্যক্ত হইয়া কিছু প্রশমিত হইত,—যদি বা সহানুভূতিতে কিছু সান্ত্বনা লাভ করিত, বড়বধূর শোক হৃদয়েই বদ্ধ রহিয়া অপ্রশমিত জ্বালায় অহরহঃ হৃদয়কেই দগ্ধ করিত। কমল যে শৈশবে তাঁহারই অঙ্কে পালিত; তিনি যে প্রভাতকেও তেমন করিয়া নাড়াচাড়া করেন নাই।
নবীনচন্দ্রের শোক বর্ণনীয় নহে। আগ্নেয় গিরি যেমন অন্তরস্থিত বহ্ণিজ্বালায় জ্বলিতে থাকে, তিনি তেমনই জ্বলিতে লাগিলেন। তাঁহার অটল ধৈর্য্য বিচলিত হইল না; কিন্তু প্রফুল্ল মুখে বিষাদগাম্ভীর্য্য স্থায়ী হইয়া রহিল; ম্লান হাসিতে উচ্ছ্বসিত ভাব নাই, হৃদয়ে প্রফুল্লতার অভাব। নবীনচন্দ্রের হৃদয়ে আর এক দারুণ শোকের জ্বালা ছিল। সে জ্বালা নির্ব্বাপিত হয় নাই। যাহাদের লইয়া সে জ্বালা প্রশমিত হইয়াছিল—তাহারা আজ কোথায়? এক জন আপনি দূরে গিয়াছে। আর এক জন?— হায়! তাহার শোকে পূর্ব্বশোক যেন দ্বিগুণ হইয়া উঠিল। তাই হৃদয় যন্ত্রণাময় । প্রশমিততেজ বহ্ণি যখন আবার জ্বলিয়া উঠে, তখন তাহাতে কি যন্ত্রণা—কি বিষম যন্ত্রণা!
দত্ত গৃহে শোকের যন্ত্রণা। সকলেরই হৃদয় বিষাদভারাবনত,— সকলেই শোকাতুর। সে গৃহে আনন্দ আসিবে কোথা হইতে?
দত্তগৃহ হইতে কয় দিন পরে সতীশচন্দ্র আপনার গৃহে গেল। সেখানেও কেবল জ্বালা।
গৃহে সেই সবই আছে,—কেবল এক জনের অভাবে গৃহ শূন্য,—হৃদয় আনন্দহীন,—জীবন যাতনা মাত্র।
গৃহে সর্ব্বত্র কমলের স্মৃতি।
পিঞ্জরে তাহার পালিত পক্ষী রহিয়াছে। ক্ষুদ্র বিহগ; সে পিঞ্জর মধ্যে দুর্ব্বল অঙ্গুলির সামান্য পেষণে তাহার প্রাণ যায়। ঘুরিতেছে—ফিরিতেছে— কূজন করিতেছে। কেবল কমল নাই!
গৃহপ্রাঙ্গনে তাহার স্বহস্তলালিত শেফালী তরু। এখনও তাহার দুই চারিটি কুসুম ফুটিয়া ঝরিতেছে,—বৃন্তচ্যুত হইয়া গৃহপ্রাঙ্গনে পড়িতেছে। কিন্তু কমল নাই!
পুস্তকাধারে তাহার পুস্তকগুলি তেমনই রহিয়াছে। পুস্তকে তাহার নাম লিখিত। এক এক খানির অঙ্গে স্নেহশীলার পুত্ত্রের স্পর্শচিহ্নও রহিয়াছে। কিন্তু কমল নাই!
পালঙ্কে তাহার শয্যা তেমনই রহিয়াছে। কিন্তু কমল নাই!
কার্য্যাবসানে শান্ত হইয়া অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলে সতীশচন্দ্রের মনে হইত, বুঝি কমল সেখানে রহিয়াছে; তাহার পদশব্দ শুনিয়া সে সেই প্রেমসমুজ্জ্বল নয়নে তাহার দিকে চাহিবে; সে দৃষ্টিতে তাহার অর্দ্ধেক শ্রম দূর হইবে। তখনই মনে হইত—হায়! কমল কোথায়!
আপনার কক্ষে বসিয়া সতীশচন্দ্রের মনে হইত, যেন কমলের পদশব্দ শুনিতে পাইতেছে। বুঝি কমল আসিতেছে! কিন্তু তখনই নিষ্ঠুর সত্য মনে পড়িত,—হৃদয় ব্যথিত হইত।
দূরে কাহারও কণ্ঠস্বর শুনিলে সতীশ চমকিয়া উঠিত; বুঝি কমলের কণ্ঠস্বর! কিন্তু তখনই মনে পড়িত, সেই অভিলষিতশ্রবণ কণ্ঠস্বর সে আর শুনিতে পাইবে না। সতীশচন্দ্রের চক্ষু ছল ছল করিত।
শয্যায় শয়ন করিতে যাইয়া সতীশচন্দ্রের মনে হইত, যেন সে শয্যা প্রিয়তমার স্পর্শতাপতপ্ত। কিন্তু কমল কোথায়! তখন— সেই দীর্ঘযামা যামিনীতে সঙ্গিহীন শয্যায় সতীশচন্দ্র কাঁদিয়া উপাধান সিক্ত করিত।
চারি দিকে কমলের স্মৃতি। গৃহে প্রত্যেক দ্রব্যের সহিত তাহার কোনও না কোনও স্মৃতি বিজড়িত। সর্ব্বত্র তাহার স্পর্শ। গৃহে সর্ব্বত্র তাহার স্মৃতি—গৃহ আজ শ্মশান। হৃদয়ে তাহার স্মৃতি —হৃদয় আজ শ্মশান। হায়! সুখের আশা;— অসার কল্পনা! জীবন কেবল যাতনাদহন,—কেবল বেদনা।
যখন গৃহে প্রত্যেক কার্য্যে —পদে পদে পরিচিত —প্রিয়—এক জনের অভাব অনুভূত হয়, যখন, প্রত্যেক কার্য্যে তাহার কথা মনে পড়ে— কিন্তু তাহার নিপুণ হস্তের সযত্নস্পর্শ থাকে না, তখন হৃদয়ে যে যন্ত্রণা অনুভূত হয়, তাহা যে অনুভব না করিয়াছে, সে বুঝিতে পারিবে না। সে যন্ত্রণা বর্ণনার নহে; —বর্ণনার অতীত।
সতীশচন্দ্রের দুঃখে গ্রামের সকলেই দুঃখিত। কারণ— স্বভাবগুণে সতীশ সকলের ভালবাসা লাভ করিয়াছিল।
সতীশচন্দ্র বুঝিয়াছিল, এ শোক কালজয়ী; এ শোকের জ্বালা যাইবার নহে; কিন্তু শোকের প্রবাহে সব ভাসাইলে কর্ত্তব্য পালনে ক্রটী ঘটিবে। সুখে হউক—দুঃখে হউক—বিপদে হউক— সম্পদে হউক, মানুষকে কর্ত্তব্য করিতেই হইবে। তাই সতীশচন্দ্র আপনার আরব্ধ কার্য্য আবার আরম্ভ করিল,— কর্ত্তব্যের জন্য আত্মবিসর্জ্জন করিল। কিন্তু হায়! —কার্য্যের অবসরে কেবল কাহাকে মনে পড়ে? তাহার সকল কার্য্য আরম্ভ করিবার পূর্ব্বে যাহাকে না জানাইলে সে তৃপ্ত হইতে পারিত না; যে তাহার সকল কার্য্যে সহানুভূতি দেখাইত; যাহার মৌন দৃষ্টি ও ব্যবহার তাহাকে উৎসাহিত করিত; নবীন শক্তি দান করিত, সে আজ কোথায়? তাহার কোনও সদনুষ্ঠানের কল্পনার কথা জানিতে পারিলে যাহার নয়ন আনন্দে প্রদীপ্ত হইয়া উঠিত;—যাহার নয়নের সেই আনন্দকিরণে তাহার কল্পনা দৃঢ় সঙ্কল্পে পরিণত হইত; —যাহার সহানুভূতির উৎসাহ ব্যতীত তাহার পক্ষে কোনও সদনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত করা সম্ভব হইত না— তাহার সেই সুহৃদ, সেই ভক্ত, সেই সহায়, সেই সহচরী, সেই জীবনের সুখ ও হৃদয়ের শান্তি—প্রেমময়ী পত্নী আজ কোথায়?
যখন হৃদয়ে যাতনা অসহ্য হইয়া উঠিত, তখন সতীশচন্দ্র পুত্ত্রকে কাছে আনিত, যেন কিছু শান্তি পাইত।
আর এক জনের মৌন সান্ত্বনায় সতীশচন্দ্র কিছু শান্তিলাভ করিত। একমাত্র সন্তান সতীশচন্দ্রের অতি দারুণ শোকই তাহার জননীর কষ্টের একমাত্র কারণ নহে। তিনি পুত্ত্রবধূকে দুহিতার স্নেহ দিয়াছিলেন। —তাহার নিকট জননীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা পাইয়াছিলেন। শাশুড়ী ও পুত্ত্রবধূর মধ্যে সাধারণতঃ যে ব্যবধান থাকে, তাঁহাদের দুই জনের মধ্যে সে ব্যবধান ছিল না— জননী-দুহিতার অবারিত স্নেহ ভালবাসার সম্বন্ধ তাহার স্থান অধিকার করিয়াছিল। মাতৃহীনা কমল তাঁহাকে মাতার মত দেখিত—তাঁহার নিকট মাতার স্নেহ পাইয়াছিল; কন্যাহীনা শ্বশ্রূ তাহাকে কন্যার মত দেখিতেন—তাহার নিকট কন্যার ব্যবহার পাইয়াছিলেন। তাই উভয়ের মধ্যে স্নেহসম্বন্ধ অতি মধুর হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। তাই কমলের মৃত্যুতে সতীশচন্দ্রের জননী সন্তানের মৃত্যুশোক অনুভব করিলেন। তাঁহার ব্যবহারে সতীশচন্দ্র তাহা বুঝিতে পারিত। তাঁহার আন্তরিক সহানুভূতি,—তাঁহার মৌন সান্ত্বনা, - তাঁহার প্রকৃত শোক তাহাকে যেন কিছু শান্তি দান করিত।
সতীশচন্দ্রকে মধ্যে মধ্যে ধূলগ্রামে যাইতে হইত। এখন নানা কার্য্যে শিবচন্দ্র ও নবীনচন্দ্র তাহার পরামর্শ লইতেন। মানুষের স্বভাব,—হৃদয়ের উৎসাহ ও উদ্যম যৌবনের পর যত ক্ষয় হয়, সে ততই আর এক জনের সাহায্যলাভে ব্যস্ত হয়। যৌবনে অপরকে কার্য্যের অংশ দিতে ইচ্ছা হয় না,— যৌবনের পর তাহার জন্য ব্যগ্রতা জন্মে। তাই যৌবনের পর স্বাভাবিক স্নেহ যেন ঘনীভূত —প্রবল হয়; তখন স্নেহাস্পদদিগকে সকল কার্য্যে অংশ দিতে ইচ্ছা করে; তাহাদিগকে নিকটে পাইতে ও নিকটে লইতে তখন হৃদয়ে ব্যগ্রতা জন্মে। প্রভাতের জন্য শিবচন্দ্রের যন্ত্রণার অন্ত ছিল না। যে হৃদয়ের সর্ব্বস্বধন, তাহার জন্য হৃদয়ের ব্যাকুলতা পর্য্যন্ত রোধ করিবার নিষ্ফল চেষ্টায় কেবল যন্ত্রণা। যত দিন যাইতেছিল, তত যন্ত্রণা বাড়িতেছিল;-প্রভাতের সম্বন্ধে শিবচন্দ্র তত হতাশ হইতেছিলেন। তিনি যাহাকে সব আশার অবলম্বন করিয়াছিলেন— সে-ই নিতান্ত হতাশ করিল! শিবচন্দ্র সতীশকে সংসারে আপনার কার্যের অংশ দিতে লাগিলেন। সেই জন্য সতীশচন্দ্রকে মধ্যে মধ্যে ধূলগ্রামে আসিতে হইত।
সতীশচন্দ্র বিদ্যালয়ের কার্য্য ত্যাগ করিল,— ভাল লাগে না। মনের এ অবস্থায় আর সেই বাঁধাবাঁধির মধো থাকা সম্ভব নহে। তাহাতে অবসর বাড়িল—সঙ্গে সঙ্গে চিন্তাও বাড়িল,—অধ্যয়নও বাড়িল,— অবসরের অভাবে যে সকল সদনুষ্ঠান কল্পনা কার্য্যে পরিণত হয় নাই, সে সকল কল্পনা এখন কার্য্যে পরিণত হইতে লাগিল। নিদাঘতাপে পর্ব্বতের তুষাররাশি যেমন বিগলিত হইয়া দেবতার আশীর্ব্বাদের মত ধরণীতে স্নিগ্ধতার সঞ্চার করে, শোকে সতীশচন্দ্রের মানসিক শক্তি তেমনই প্রবাহিত হইয়া সমস্ত গ্রামে স্নিগ্ধ সরসতার—নূতন জীবনের সঞ্চার করিতে লাগিল।
সতীশচন্দ্রের এই সকল কার্য্যে শিবচন্দ্র ও নবীনচন্দ্র যে কত সুখী হইতেন, তাহা আর বলা যায় না।
নবীনচন্দ্রের হৃদয় একান্ত শূন্য। তিনি সমান স্নেহে দুই জনকে বক্ষে রাখিয়াছিলেন। এক জন আজ সব স্নেহের অতীত। আর এক জন আপনি আপনাকে সে স্নেহবন্ধন হইতে বিমুক্ত করিতে চেষ্টা করিয়াছে। কিন্তু তিনি তাহাকে মুক্তি দিতে পারিয়াছেন কি? আপনার হৃদয় মুক্ত করিতে পারিয়াছেন কি? তাঁহার হৃদয় কি কেবল তাহারই দিকে আকৃষ্ট হয় না? হায়—শূন্য গৃহে যদি সে থাকিত,—যদি তাহার শিশুপুত্ত্রও থাকিত—তবেও একটা কার্য থাকিত,—কিছু থাকিত।
নবীনচন্দ্র মধ্যে মধ্যে সতীশচন্দ্রের গৃহে আসিতেন; সমস্ত দিন অমলকে লইয়া থাকিতেন, তাহার পর শান্ত—কাতর হৃদয়ের ভাব বহিয়া শূন্য মনে আপনার শূন্য গৃহে ফিরিয়া যাইতেন। জীবনে আর কোনও আকর্ষণ নাই,—শূন্য হৃদয় পূর্ণ হয় না,—শূন্য গৃহ যেন শ্মশান!
ধূলগ্রামে সেই শূন্য গৃহে দুইটি মহিলার জীবনে আশার ও আনন্দের অরুণকিরণ অকালজলদোদয়ে নির্ব্বাপিত হইয়া গিয়াছিল। উভয়েরই জীবন যেন কেবল যন্ত্রণার ভার; সংসারের কোনও কার্য্যে আর আকর্ষণ নাই, সে সব কেবল কর্ত্তব্যের ভার— কেবল যন্ত্রণা।