নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/তৃতীয় খণ্ড/অষ্টম পরিচ্ছেদ

অষ্টম পরিচ্ছেদ।

সব শেষ।

কোনও কোনও ব্যবহার হৃদয়ে চিহ্ন রাখিয়া যায়। কোনও কোনও কথা যেন বহুক্ষণ কর্ণে ধ্বনিত হইতে থাকে। আজ শিশিরকুমারের ব্যবহার চপলার হৃদয়ে তেমনই চিহ্ন রাখিয়া গেল; আজ শিশিরকুমারের কথা চপলার কর্ণে তেমনই ধ্বনিত হইতে লাগিল। এক সময় শত কার্য্যে বা সহস্র কথায় যাহা হয় না, আর এক সময় সামান্য আচরণে,—বা দুই চারিটি কথায় তাহা হয়। আজ শিশিরকুমারের আচরণে, তাহার কথায় চপলার নিকট তাহার ভ্রান্তি সুস্পষ্ট ও সমুজ্জ্বল হইয়া উঠিল। হায়!― সে কি করিয়াছে! সুখে, দুঃখে,—বিপদে, সম্পদে—যাহার স্নেহ আশ্রয়রূপে অবলম্বন করিতে পারিত, যাহার স্নেহ অব্যাহত জানিয়া নির্ভরের সুখ লাভ করিতে পারিত, সে আজ তাহার ঘৃণামাত্র অর্জ্জন করিয়াছে। সে দুষ্ট আশার মোহে মুগ্ধ হইয়া যে ভ্রান্তপথে পদার্পণ করিয়াছিল —সে পথে আত্মগ্লানি ও অনুতাপ অনিবার্য্য। প্রেমভেষজ ব্যতীত সে জ্বালা জুড়াইবার নহে।

 কিন্তু—প্রেমলাভ! তখনই স্বামীর সেই রোগশীর্ণ,—পাণ্ডুর আননের কথা মনে পড়িল। সে ঘৃণায় সে প্রেম, পরিহার করিয়াছে; স্বেচ্ছাদত্ত প্রেম ত্যাগ করিয়াছে; স্বামীর সরল হৃদয়ে বেদনা দিয়াছে। সে স্বামীকে উপেক্ষা করিয়াছে। রোগযাতনাজীর্ণ স্বামীর যন্ত্রণার কারণ হইয়াছে। আজ যেন চপলার বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল। সে আপনার অবস্থা বুঝিল।

 কেহ একদিনে আপনার স্বভাব পরিবর্ত্তিত করিতে পারে না। তাই সদ্বংশসম্ভূতা রমণী যখন আপনার ভ্রম বুঝিতে পারেন, তখন তিনি প্রায়শ্চিত্ত করিতে আরম্ভ করেন। আর কাহাকেও তাহা বুঝাইতে হয় না। আর কেহ সে ভ্রান্তির কথা জানিতে না পারিলেও রমণী আপনি আপনার হৃদয়কে পীড়িত—দলিত করেন।

 বিজন কক্ষে বসিয়া চপলা ভাবিতে লাগিল। হৃদয় দগ্ধ হইয়া যাইতে লাগিল। তাহার পর চপলা বসিয়া কাঁদিতে লাগিল।

 চপলার জননী কিছুক্ষণ তাহাকে দেখিতে না পাইয়া তাহার সন্ধানে দাসী পাঠাইলেন। দাসী এ ঘর ও ঘর দেখিয়া যাইয়া সংবাদ দিল,—চপলা কাঁদিতেছে। শুনিয়া জননী দুহিতার নিকটে আসিলেন। তিনি মনে করিলেন, নলিনবিহারীর পীড়ার আশঙ্কাই দুহিতার ক্রন্দনের কারণ। তিনি কন্যাকে সান্ত্বনা দিতে আসিলেন; কিন্তু সান্ত্বনা দিতে পারিলেন না। বড় আদরের— সেই একমাত্র সন্তানকে যেন দারুণ বেদনায় ক্রন্দন করিতে দেখিয়া তিনি আপনি কাঁদিতে লাগিলেন। মাতাপুত্রী উভয়েরই নয়নে অবিরল অশ্রু বহিতে লাগিল।

 বহুক্ষণ কাঁদিয়া চপলা যেন কিছু শান্ত হইল। হৃদয়ে চিন্তার স্থান ছিল না,—এখন হইল। তখন সন্ধ্যা হয় হয়। সেই রাত্রিতেই নলিনবিহারীর যাইবার কথা। চপলা ব্যস্ত হইয়া বলিল, “আমি এখনই ফিরিয়া যাইব।”

 মা আহারের জন্য জিদ করিলেন। চপলা শুনিল না। সে যাইবার জন্য বড় ব্যস্ত। শেষে তাহার জননীও তাহার সহিত যাইলেন।

 চপলার যান যখন কৃষ্ণনাথের গৃহদ্বারে উপনীত হইল,সেই সময় য়ুরোপীয় চিকিৎসকের যান বাহির হইয়া গেল । চপলার হৃদয় কাঁপিয়া উঠিল। নামিয়া সে ব্যস্ত হইয়া বড় বধূর কাছে গেল; জিজ্ঞাসা করিল, “বড় দিদি, সংবাদ কি?”

 বড়বধূ সংবাদ দিলেন, অপরাহ্নে নলিনবিহারী একবার মূর্চ্ছিত হইয়াছিল।

 অল্পক্ষণ পরেই চপলা জানিতে পারিল, সে দিন নলিনবিহারীর যাওয়া হইবে না। ডাক্তার নিষেধ করিয়াছেন;— শরীর ভাল নাই ।

 চপলা আসিবার বহু পূর্ব্বেই শিশিরকুমার আসিয়াছিল। চপলা যখন তাহার কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্তা হইয়াছিল তখন শিশিরকুমারের হৃদয়ে বিষম যন্ত্রণা—দারুণ দুশ্চিন্তা। অল্পক্ষণ চিন্তার ফলে ধীর শিশিরকুমারের চঞ্চল হৃদয় সংযত হইয়াছিল। কিন্তু হৃদয়ের বেদনা অপনীত হয় নাই। তাহার পর সে কৃষ্ণনাথের গৃহে আসিয়াছিল। জগতে কয় জনের আশা পূর্ণ হয়? কর্ত্তব্যপালনেই মনুষ্যত্ব। সন্ধ্যা অতীত হইলে শিশিরকুমার ফিরিয়া গেল; চপলার জননী তাহার সহিত গৃহে ফিরিলেন।

 নলিনবিহারীর স্থানান্তরগমনের প্রস্তাব হইলে সে বলিয়াছিল, পরিবারের কাহারও তাহার সহিত যাইয়া কায নাই; সে সকলকে নিরস্ত করিয়াছিল, কেবল, জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে পারে নাই। জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠকে বিশেষ স্নেহ করিতেন। কনিষ্ঠের সচ্চরিত্রতা,-জ্ঞানার্জ্জনস্পৃহা—এইরূপ নানাগুণের জন্য তিনি বিশেষ গর্ব্বিত ছিলেন; সে কথা লোককে বলিতেন। নলিনবিহারীও জ্যেষ্ঠকে বড় ভালবাসিত। জ্যেষ্ঠ যখন আসিয়া বলিলেন, “নলিন তুমি নাকি আমাকেও সঙ্গে যাইতে দিবে না?” তখন নলিনবিহারী আর আপত্তি করিতে পারিল না। জ্যেষ্ঠ আর কিছু বলিলেন না; ভাবিলেন, এখন আর পীড়াপীড়ি করিয়া কায নাই, সঙ্গে যাইয়া ক্রমে ভ্রাতার মত করাইয়া আর সকলকে লইয়া যাইবার ব্যবস্থা করিবেন। তাহাই স্থির হইয়াছিল।

 সেই রাত্রিতে যাতনাব্যথিতা চপলা স্বামীকে বলিল, “তুমি আমাকে সঙ্গে লইয়া চল।”

 এই কথা শুনিয়া নলিনবিহারীর আহত-প্রেম সঞ্জাত দারুণ অভিমান যেন সঞ্চিত শক্তিতে আত্ম-প্রকাশ করিল। সে বলিল, “না। আমি জীবনে অনেক কষ্ট পাইয়াছি। এখন এই অন্তিমকালে আমাকে শান্তিতে মরিতে দাও।”

 নলিনবিহারী কখনও পত্নীকে এমন তিরস্কার করে নাই। আজ সহসা যেন কি উত্তেজনায় সে এই কথা বলিল। বলিতে বলিতে তাহার প্রেম তাহার হৃদয়কে শান্ত করিয়া দিল। তাহার কণ্ঠস্বর আর্দ্র হইয়া আসিল। সে আর্দ্রনয়নে চপলার দিকে চাহিল; বলিল, “চপলা, আমি রূঢ় কথা বলিয়াছি। কিছু মনে করিও না। আমাকে—”

 নলিনবিহারী আর বলিতে পারিল না। তাহার মাথা ঘুরিতে লাগিল।

 প্রথমে চপলার মনে হইল,স্বামীর চরণে লুণ্ঠিতা হইয়া ক্ষমা ভিক্ষা করে—আপনার অপরাধ স্বীকার করিয়া হৃদয়ের ভার লাঘব করে। কিন্তু তখনই মনে হইল,— চিকিৎসক বিশেষ করিয়া বলিয়াছেন,—সাবধান সহসা যেন রোগীর চাঞ্চল্যের কোনও কারণ না ঘটে। সহসা উত্তেজনায় বা চাঞ্চল্যে বিশেষ অনিষ্ট ঘটিবার সম্ভাবনা।

 চপলা প্রথম বাসনা সংযত করিল বটে, কিন্তু হৃদয় শান্ত করিতে পারিল না। পার্ব্বত্য নদী যখন বিগলিত তুষারজলে বেগবতী হইয়া পর্ব্বতগৃহ হইতে বাহির হয়, তখন প্রবল বাধায় তাহার স্রোতের গতি পরিবর্ত্তিত হইতে পারে বটে, কিন্তু গতিরোধ হয় না। চপলা আত্মসংবরণ করিতে পারিল না; কক্ষ হইতে বারান্দায় আসিল।

 অলিন্দে অনাচ্ছাদিত হর্ম্ম্যতলে পড়িয়া চপলা কাঁদিল। তাহার হৃদয়ে বিষম যন্ত্রণা। যে কতক্ষণ কাঁদিল—তাহা সে বুঝিতে পারিল না। সহসা কক্ষমধ্যে কাচপাত্র ভাঙ্গিবার শব্দে সে চমকিয়া উঠিল; উন্মাদিনীর মত কক্ষে প্রবেশ করিল।

 চপলা বারান্দায় যাইবার কিছুক্ষণ পরে নলিনবিহাবী অপেক্ষাকৃত সুস্থ বোধ করিল,—তখনও মস্তকে অত্যন্ত যন্ত্রণা। নলিনবিহারী ভাবিতে লাগিল;— অতীতের শত চিত্র তাহার মানসনেত্রের সম্মুখে একে একে উদিত হইতে লাগিল। কত কথা মনে হইতে লাগিল। আবার মাথা ঘুরিতে লাগিল, আবার নিশ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসিতে লাগিল।

 তাহার পর নলিনবিহারী বিষম তৃষ্ণা অনুভব করিতে লাগিল; তৃষ্ণায় কণ্ঠতালু যেন শুকাইয়া যাইতে লাগিল। নলিনবিহারী চাহিয়া দেখিল, কক্ষে চপলা নাই। সে হয় অবজ্ঞাভরে, নয় তাহার ব্যবহারে মর্ম্মাহত হইয়া চলিয়া গিয়াছে। চপলা কক্ষে নাই! পূর্ব্বে আর কখনও এমন হয় নাই। রুগ্ন, দুর্ব্বল, পদে পদে অপরের সাহায্য— প্রার্থী তাহাকে ফেলিয়া— একাকী শূন্য কক্ষে রাখিয়া চপলা পূর্ব্বে কখনও যায় নাই। তবে আজ সব শেষ;—আজ আশার শেষ — আকাঙ্ক্ষার শেষ। লাঞ্ছিত প্রেমের চিতানল আজ জ্বলিয়াছে,— সব দগ্ধ হইবে — ভস্ম হইবে।

 তৃষ্ণা ক্রমেই প্রবল হইতে লাগিল। শেষে শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করিয়া নলিনবিহারী শয্যা হইতে উঠিল। অদূরে একটা মার্ব্বল-টেব্‌লে জল থাকিত। নলিনবিহারী সেই টেবলের দিকে যাইবে; প্রথমবার উঠিলে মাথা ঘুরিতে লাগিল। সে শয্যায় বসিল। কিন্তু তৃষ্ণা প্রবলতর হইয়া উঠিল,— আর সহ্য হয় না । তখন সে আবার উঠিল। চরণ কম্পিত হইতে লাগিল। টেব্‌ল যেন কত দূর! কোন রূপে — যেন আপনার দেহভার কোনরূপে টানিয়া সে টেব্‌লের নিকটে উপস্থিত হইল। সে কি যন্ত্রণা-অবসানের আশা!

 কিন্তু, হায়!—গ্লাস শূন্য!—একবিন্দু জল নাই! নলিনবিহারী চারি দিক অন্ধকার দেখিল। কম্পিত কর হইতে গ্লাস পড়িয়া চূর্ণ হইয়া গেল। সে কেমন করিয়া শয্যায় ফিরিয়া আসিয়া পড়িল, তাহা সে আপনি জানিতে পারিল না । কক্ষে প্রবেশ করিয়া চপলা দেখিল, —নলিনবিহারী শয্যায়; চরণের কতকাংশ শয্যার বাহিরে; মুখে বিষম যন্ত্রণার চিহ্ন। সেই চূর্ণ কাচপাত্র,— স্বামীর সেই অবস্থা!— চপলা মুহূর্ত্তে বুঝিল, কি চেষ্টায় এ দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে। এই দুর্ঘটনাই তাহার নিষ্ঠুরতার চরম পরিণতি। সে কেমন করিয়া স্বামীকে একাকী রাখিয়া গিয়াছিল? সে কি করিয়াছে? ইহার অপেক্ষা সে আপনি কেন মরে নাই? চপলার বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল।

 চপলার আর্তনাদে অচিরে গৃহের সকলে সেই কক্ষে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। নলিনবিহারীর চৈতন্য-সম্পাদনের চেষ্টা হইতে লাগিল।

 অল্পক্ষণ পরেই চিকিৎসক আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি রোগীকে পরীক্ষা করিলেন; তাহার পর ব্যস্ত হইয়া গাত্রাবরণ ফেলিয়া কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস- প্রবর্ত্তনের চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কোনও ফল ফলিল না।

 সব শেষ হইল ।

 সে রাত্রিতে শিশিরকুমারের নয়নে নিদ্রা আইসে নাই। সে অনিদ্র হইয়া চিন্তা করিতেছিল। তাহার হৃদয়ে বিষম দুশ্চিন্তা। চপলার কথা শুনিয়া তাহার মনে শান্তি ছিল না । চপলা কি দারুণ ভ্রান্তিবশে হৃদয়ে অতিদারুণ দুশ্চিন্তা পোষণ করিয়াছে? অতি প্রবল না হইলে সে ত রমণীর স্বাভাবিক সংযম-বন্ধন বিচ্ছিন্ন করিয়া আত্মপ্রকাশ করিতে পারে নাই! রমণীর লজ্জা যাহার গতি রোধ করিতে পারে নাই, সে কত বল সঞ্চয় করিয়াছে!

 দুঃসংবাদ লইয়া কৃষ্ণনাথের গৃহের সরকার যখন রুদ্ধদ্বারে উপস্থিত হইয়া দ্বারবানকে ডাকিল, তখন শিশিরকুমার চমকিয়া উঠিল,— অমঙ্গলের আশঙ্কায় বিচলিত হইল। দ্বারবান জাগিয়া দ্বার মুক্ত করিতে করিতে সে দ্বিতল হইতে নিম্নে আসিল । সে যে স্থানে দুঃসংবাদ শুনিল, সেই স্থানেই বসিয়া উভয় করে মুখ আচ্ছাদিত করিয়া অধীরভাবে ক্রন্দন করিতে লাগিল। উদারচিত্ত,—সরলহৃদয় পুরুষ যখন আপনার ক্ষুদ্র দুঃখে নহে— স্নেহভাজনের দুঃখে ব্যথিত হয়, তখন সে এমনই অধীরভাবে ক্রন্দন করে। তাহার ব্যথিত, বিদীর্ণ হৃদয় বিষম বেদনা পাইল।— হায় চপলা!—অভাগিনী চপলা!