নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/তৃতীয় খণ্ড/সপ্তম পরিচ্ছেদ
সপ্তম পরিচ্ছেদ।
চক্ষু ফুটিল।
যে প্রবল মানসিক বলে নলিনবিহারী শারীরিক দৌর্ব্বল্য জয় করিয়াছিল, তাহার আপনার হৃদয় জয় করিতে তদপেক্ষা প্রবলতর মানসিক বলের প্রয়োজন হইয়াছিল। কল্পনাসলিলসেচনে সুপুষ্ট,— আশালোকে বিবিধ বর্ণের রমণীয় কুসুমে শোভিত, চিরপ্রিয় আকাঙ্ক্ষাকে সমূলে উৎপাটিত করিতে হইয়াছিল। তাহার শত মূল তখন তাহার হৃদয়কে বেষ্টিত করিয়া ধরিয়াছিল; তাই হৃদয় শতধা বিভক্ত হইয়া গিয়াছিল। স্বহস্তপ্রদীপ্ত আশালোক নির্ব্বাপিত করিয়া, প্রবল আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করিয়া, জীবনের সুখ ও সৌন্দর্য্য সব ত্যাগ করিয়া সে নূতন পথে অগ্রসর হইয়াছিল। শ্রান্ত চরণের বল পরীক্ষা না করিয়া সে ভ্রান্ত কর্ত্তব্যের পথে পথিক হইয়াছিল। চপলার সুখের আলেয়ার আলোক লাভ করিবার জন্য সে সব ত্যাগ করিয়া গিয়াছিল; ভাবিয়াছিল, চপলাকে সুখী করিতে পারিবে,—তাহাই সুখ। কিন্তু ভগ্ন শরীরে সহিল না। মানসিক অবসাদে দেহের অবসাদ বর্দ্ধিত হইল— ভগ্নস্বাস্থ্য একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িল।
শরীর যে ক্রমে একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িতেছিল,—ক্রমে কার্য্যপরিচালনও অসম্ভব হইয়া আসিতেছিল, নলিনবিহারী তাহা বুঝিতে পারিয়াছিল। সে আসন্ন বিপদের ছায়া দেখিয়াছিল;— কিন্তু বিরত হয় নাই। দৌর্ব্বল্য দিন দিন বাড়িতেছিল; সঙ্গে সঙ্গে মস্তকের যন্ত্রণাও অসহনীয় হইয়া উঠিতেছিল। তবু সে বিরত হইল না। ক্রমে রক্তহীন, শীর্ণ, আনন পাণ্ডুর হইয়া আসিল। শেষে এক দিন আফিসে কায করিতে করিতে মস্তকের যন্ত্রণা আরও বাড়িয়া উঠিল,— চক্ষুর সম্মুখে দিবসের আলোক নিবিয়া গেল,—নলিনবিহারী অজ্ঞান হইয়া পড়িল।
সেই দিন হইতে ঔষধপথ্যের সকল চেষ্টা সত্ত্বেও দৌর্ব্বল্য আর প্রশমিত হইল না। প্রথম কয় দিন নলিনবিহারী শয্যা ত্যাগ করিতে পারিল না। ফলে অবসর বাড়িল; সঙ্গে সঙ্গে চিন্তা বাড়িল,,—এ অসুখ কেন? কেন চপলা এরূপ ব্যবহার করে?
নলিনবিহারী যতই লক্ষ্য করিতে লাগিল, ততই ভাবিতে লাগিল। ততই ব্যথিত হইতে লাগিল। চপলার ব্যবহারে সে পদে পদে আহত হইতে লাগিল। চপলার হৃদয়ে যে তাহার প্রতি প্রেম নাই, তাহার ব্যবহারে সেই সন্দেহ নলিনবিহারীর মনে ক্রমে বদ্ধমূল হইতে লাগিল। হায়!— সে সন্দেহে কেবল যাতনা,—কেবল কষ্ট!
মানুষ যাহাকে রত্ন-জ্ঞানে বহু দিন যত্নে রক্ষা করিয়াছে, সহসা তাহাকে আবার কাচখণ্ডমাত্র বলিয়া সন্দেহ হইলে, সে তাহাকে শতবার ঘুরাইয়া ফিরাইয়া পরীক্ষা করে, — আপনাকে ভ্রান্ত প্রতিপন্ন করিতে সচেষ্ট হয়। নলিনবিহারীরও তাহাই হইল। আপনার প্রেমের প্রতিফলিত বর্ণে সে পূর্ব্বে চপলার ব্যবহার প্রেমরঞ্জিত বোধ করিয়াছে—সেই বিশ্বাসে সুখ পাইয়াছে। ক্রমে সে বিশ্বাস শিথিল হইয়া আসিয়াছিল। এখন যখন সে বিশ্বাসে সন্দেহ হইল, তখন সে শতবার শতরূপে চপলার ব্যবহার লক্ষ্য করিতে লাগিল। উদ্দেশ্য,—আপনাকে ভ্রান্ত সপ্রমাণ করিবে— সন্দেহ অঙ্কুরিত হইতে না হইতেই পদদলিত করিবে। কিন্তু পরীক্ষার ফলে সন্দেহ দূর হওয়া দূরে থাকুক, কেবল বাড়িতেই লাগিল। সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রণা বাড়িতে লাগিল।
মানসিক যন্ত্রণার ফলে শরীর একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িল। ক্রমে এক মাস কাটিয়া গেল। নলিনবিহারীর শরীর আরও অসুস্থ হইল। আরও এক মাস গেল,—আর কোনরূপ মানসিক শ্রম সহে না।
ডাক্তার মানসিক শ্রম বিষবৎ পরিত্যাগ করিতে উপদেশ দিলেন। হৃদয় দুর্ব্বল,—মস্তিষ্ক আরও— দুর্ব্বল,—শরীর নিস্তেজ। কিছুক্ষণ কোনও বিষয়ের আলোচনা করিলে শিরঃপীড়া বর্দ্ধিত হয়; কোনও বিষয়ে মনোযোগ দিলে শ্রান্তি বোধ হয়; সংবাদপত্রখানি পাঠ করিবার চেষ্টা করিলেও মাথা ঘুরিয়া যায়। নলিনবিহারীর আপনার মনে হইল, সে তিলে তিলে মরিতেছে; তাহার যশোহীন, সুখহীন, কর্ম্মহীন জীবনের অবসানকাল আসন্ন। তাহার ব্যর্থ জীবনে কোনও কায হইল না; জীবন বৃথায় গেল। এইরূপ চিন্তা তাহার পক্ষে বিষম ক্লেশকর। মানসিকশক্তিহীন হইয়া জীবনধারণ সে সর্ব্বযন্ত্রণার আকর বলিয়া বিবেচনা করিত। আজ সে স্বয়ং সেই যন্ত্রণা ভোগ করিতেছে। হায়! জীবন-দীপ কেন ফুৎকারে নিবিয়া যায় না? তাহা হইলে ত সব যন্ত্রণার অবসান হয়! হৃদয় দুর্ব্বল; কিন্তু কর্ত্তব্যবুদ্ধি অব্যাহত, তাই সে আপনি আপনার জীবন শেষ করিবার কল্পনা মনে উদিত হইলেই পরিহার করিত। ভাবিত, যদি মানবহৃদয়ে বিবেকবুদ্ধি না থাকিত; যদি হৃদয়ে পরলোকের ছায়াপাত না হইত; যদি ইহলোকেই সব শেষ হইত! কিন্তু তাহা হইবার নহে। তাই নলিনবিহারীর নিস্তেজ জীবনে যন্ত্রণার দাহন কেবল বাড়িতে লাগিল। যে সামান্য চেষ্টায় সে জ্বালার অবসান হইত—তাহা করিতে পারিল না— পারিবে না।
শিরঃপীড়ায় সহসা কোনও আশঙ্কার কারণ নাই— গৃহে সকলে এই আশ্বাসে আশ্বস্ত হইয়াছিলেন। গৃহে সকল কার্য্য পূর্ব্ববৎ চলিতেছিল। কেবল কৃষ্ণনাথের হৃদয়ে অসুখের ছায়া কণ্টকের ন্যায় বিদ্ধ হইয়াছিল। অসুস্থ পুত্ত্রের জন্য গৃহিণীর চিত্ত উদ্বিগ্ন ও চিন্তাকুল হইয়াছিল। এখন সে ভাব পরিবর্ত্তিত হইল। গৃহে আশঙ্কার ছায়া পড়িল। চিকিৎসকগণ মত প্রকাশ করিলেন, রোগ সারিবার নহে;—সে আশা নাই। এখন যথাসাধ্য যত্নে শরীর রাখিতে হইবে, জীর্ণদেহে জীবনীশক্তি-বর্দ্ধনের চেষ্টা করিতে হইবে। এই মাত্র। মধ্যে মধ্যে সামান্য উত্তেজনায়, বা অমনই মূর্চ্ছা হইতে লাগিল।
য়ুরোপীয় চিকিৎসকগণ প্রথমে সমুদ্রযাত্রার কথা বলিয়াছিলেন। তখন তাহা হইয়া উঠে নাই। এখন কৃষ্ণনাথ আর দ্বিধা করিলেন না। কিন্তু চিকিৎসকগণ পরীক্ষা করিয়া বলিলেন, সে ব্যবস্থা বর্ত্তমান অবস্থার জন্য নহে;— যদি সমুদ্রে বিবমিষা উপস্থিত হয়, তবে শরীরে সহিবে না। সুতরাং সে সঙ্কল্প ত্যাগ করিতে হইল। রোগীকে স্থানান্তরিত করা দুঃসাধ্য। কিন্তু শীতাগমে কলিকাতার ধূলিধূমময় পবনও ত্যজ্য। শেষে স্থির হইল, নিকটে—কোনও স্বাস্থ্যকর স্থানে লইয়া যাওয়া কর্ত্তব্য। নানা স্থানের বিষয় আলোচিত হইল। ডাক্তারগণ একমত হইতে পারিলেন না;—একই স্থানে সকল সুবিধা হয় না।
শিশিরকুমার যে স্থানে ছিল, শেষে সেই স্থানের কথা উঠিল। স্থানটি স্বাস্থ্যকর। অধিকাংশ চিকিৎসকের মতে সেই স্থানে যাওয়া স্থির হইল। বাড়ী ভাড়া করিবার জন্য শিশিরকুমারকে পত্র লিখা হইল।
পত্রপ্রাপ্তিমাত্র শিশিরকুমার উত্তর লিখিল,—“আমি বাড়ীর চেষ্টা করিতেছি। আমার নিজের অধিকৃত গৃহ সুবৃহৎ। আমার আপনার জন্য একটিমাত্র ঘর যথেষ্ট। যে কয় দিন বাসা না মিলে, আমার গৃহে থাকিলে আমি বিশেষ অনুগৃহীত হইব। সেইরূপ ব্যবস্থা করিবেন। আর বিলম্ব করিবেন না।”
শিশিরকুমার পত্র লিখিয়া স্থির থাকিতে পারিল না। বিশেষ চেষ্টা করিয়া এক সপ্তাহের ছুটী লইয়া কলিকাতায় আসিল।
মধ্যাহ্নের কিছু পূর্ব্বে ট্রেণ কলিকাতায় পৌঁছিল। শিশিরকুমার ষ্টেশন হইতে কৃষ্ণনাথের গৃহে গেল; তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্ত্রের সহিত সাক্ষাৎ করিল; জিজ্ঞাসা করিল, “আপনারা প্রস্তুত?”
তিনি বলিলেন, “হাঁ।”
“আমি অপরাহ্ণে আসিব”—বলিয়া শিশিরকুমার বিদায় লইল: জানিয়া গেল, সে দিনও নলিনবিহারী একবার মূর্চ্ছিত হইয়াছিল।
শিশিরকুমারকে পাইয়া চপলার জননী যেন দুশ্চিন্তায় কিছু শাস্তি পাইলেন; হৃদয়ের ভার নামাইবার পাত্র পাইলেন। তিনি বলিলেন “বাবা তুই, আসিয়াছিস,যাহা ভাল হয়, কর। আমি আর দুর্ভাবনা সহিতে পারি না।” বলিতে বলিতে তাঁহার নয়ন অশ্রুপূর্ণ হইয়া আসিল।
শিশিরকুমার আশ্বাস দিয়া বলিল, “মা, আপনি ভাবিবেন না। আমি আজই নলিনকে লইয়া যাইব। দেখিবেন, অল্প দিনেই সারিয়া উঠিবে।” কিন্তু তাহার আপনার হৃদয়ে তখনও দারুণ আশঙ্কা,—বিষম দুশ্চিন্তা।
চপলা শুনিল, শিশিরকুমার আসিয়াছে। সে গৃহে আসিয়াছিল, তথাপি তাহার সহিত সাক্ষাৎ করে নাই কেন? চপলার চঞ্চল হৃদয়ে চাঞ্চল্য প্রবল হইল। এতদিন বায়ুকোণে মেঘ সঞ্চিত হইতেছিল। আজ ঝড় উঠিল। ঝড় উঠিলে সাগরসলিল শান্ত রাখা অসম্ভব হয়; তখন বারিরাশি উচ্ছ্বসিত চাঞ্চল্যে তীরকে আক্রমণ করে; আপনি আপনার গতিরোধ করিতে পারে না। মধ্যাহ্নের পরই চপলা পিত্রালয়ে গেল।
চপলার পিতৃগৃহে শিশিরকুমারের দুইটি কক্ষ ছিল। সেগুলি ব্যবহার করিবার অন্য কেহ ছিল না; কাযেই সে না থাকিলে সে কক্ষ দুইটির দ্বার বদ্ধ থাকিত। গৃহিণী মধ্যে মধ্যে কক্ষগুলি ঝাড়াইয়া দ্রব্যগুলি গুছাইয়া রাখিতেন। শিশিরকুমার যখনই আসিত—দেখিত, কক্ষদ্বয় যেন তাহার আগমন প্রতীক্ষা করিতেছে। তাহার প্রতি চপলার জননীর স্নেহ স্মরণ করিয়া তাহার হৃদয় ভক্তিতে পূর্ণ হইত।
একটি কক্ষে শিশিরকুমার ‘হোয়াটনট’ হইতে একখানি পুস্তক লইয়া পাতা উল্টাইল। পুস্তকখানি সে সযত্নে পাঠ করিয়াছিল; পত্রে পত্রে সে অর্থ প্রভৃতি লিখিয়া রাখিয়াছে। পুস্তকখানি বদ্ধ করিবার সময় সে দেখিতে পাইল, পুস্তকের এক স্থান কীটদষ্ট। সে পত্র উল্টাইয়া ক্ষুদ্র—শ্বেত কীটটি দেখিতে পাইল; পুস্তকখানি বাতায়নে লইয়া গেল—উল্টাইয়া ঝাড়িয়া কীটটি ফেলিয়া দিল, তাহার পর ফিরিয়া আসিয়া পুস্তকখানি যথাস্থানে রাখিয়া দিল। ‘হোয়াটনটে’র সর্ব্বোচ্চ থাকে ফ্রেমে কয়খানি ফটো। বর্ণের গাঢ়তা ও ঔজ্জ্বল্য কমিয়া আসিতেছে। একপার্শ্বে চপলার পিতার চিত্র, ফ্রেমের রৌপ্যের বর্ণ মলিন হইয়াছে। অপরপার্শ্বে চপলার জননীর চিত্র। মধ্যে চপলার চিত্র। তখনও চপলার বিবাহ হয় নাই। আলুলায়িতকুন্তলা চপলা একটি ভূপতিত বৃক্ষকাণ্ডোপরি উপবিষ্টা; -হস্তে এক গুচ্ছ পুষ্প। যে দিন চপলার পিতা ও শিশিরকুমার চপলাকে ফটো তুলাইবার জন্য লইয়া গিয়াছিলেন, সে দিনের কথা শিশিরকুমারের মনে পড়িল। নানাপ্রকারে বসাইয়া শেষে সে এই ভঙ্গিটিই সুন্দর মনে করিয়া ছবি তুলাইয়াছিল।
পকেট হইতে রুমাল বাহির করিয়া শিশিরকুমার ছবিগুলি ঝাড়িল। চপলার- চিত্রখানি রাখিয়া সে মুখ তুলিল;— দেখিল, সম্মুখে দর্পণে চপলার প্রতিবিম্ব—মুখে উদ্বেগভাব, নয়ন দীপ্ত। বিস্মিত হইয়া সে ফিরিয়া দাঁড়াইল,—চপলা কক্ষে!
চপলা দেখিয়াছিল, শিশিরকুমার তাহার ছবি ঝাড়িতেছে। আশা কি সামান্য ভিত্তির উপর প্রাসাদ রচনা করে!
শিশিরকুমার জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কখন আসিলে?”
চপলা বলিল, “এইমাত্র।”
“এখন আসিলে কেন?”
“তুমি আসিয়াছ শুনিয়া আসিলাম।”
“আমি ত তোমাদের বাড়ীতে গিয়াছিলাম। আবার এখনই যাইতেছি। নলিনের শরীর আজ ভাল নাই। তুমি আসিলে কেন?”
চপলা বলিল, “আমি আর পারি না।”
চপলার এই কথা শিশিরকুমারের হৃদয়ে অতি কোমল তন্ত্রীতে আঘাত করিল। তাহার হৃদয় সহানুভূতিতে সিক্ত হইয়া উঠিল। সে বলিল, “কি করিবে, চপলা? যখন উপায় নাই, তখন সহ্য করিতেই হইবে।”
চপলা দৃষ্টি নত করিয়া হর্ম্ম্যতলে চাহিল,—বলিল, “জীবনে আমার কোন্ আশা পূর্ণ হইয়াছে?”
শিশিরকুমার দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিল, বলিল, “জগতে কয় জনের আশা পূর্ণ হয়? কর্ত্তব্যসাধনেই মনুষ্যত্ব। তুমি যাও।”
চপলা বলিল, “সেথায় আমি কি সুখ পাইয়াছি?”
চপলার কথা শুনিয়া শিশিরকুমার বিস্মিত হইল; বলিল, “জীবনে সুখলাভের আশা স্বপ্নমাত্র। তুমি ফিরিয়া যাও। এখন এখানে থাকা কর্ত্তব্য নহে।”
চপলা মুহূর্ত্তমাত্র কি ভাবিল; মুখ তুলিয়া দীপ্তদৃষ্টিতে শিশিরকুমারের দিকে চাহিল; বলিল,—“হায়—কর্ত্তব্য! বাতাস মেঘের গতি নিয়ন্ত্রিত করিয়া তাহাকে যেথায় ইচ্ছা লইয়া যাইতে পারে; কিন্তু স্বেচ্ছায় তাহাকে বারিবর্ষণ করাইতে পারে না। আমি যাইব না। তোমার হৃদয় কি পাষাণ?”
চপলার উজ্জ্বল দৃষ্টি দেখিয়া শিশিরকুমার মুহূর্তের জন্য হৃদয়ে বিদ্যুতের স্পর্শ অনুভব করিল।
চপলা নিকটে দাঁড়াইয়াছিল। শিশিরকুমার সরিয়া গেল,—যেন সে বিষধর দশন-দষ্ট। সে তীব্র তিরস্কারের স্বরে ডাকিল, “চপলা!”—বলিল, “তুমি কি এই শিক্ষা পাইয়াছ? এত উপদেশের এই ফল? তুমি কি মানুষ?”
শিশিরকুমার যেন সুরাপানে মত্তের মত কম্পিতপদে বাতায়নে গেল। তাহার চক্ষু জ্বলিতেছিল,—নিশ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসিতেছিল।
চপলা চলিয়া গেল।
শিশিরকুমার ভাবিতে লাগিল। তাহার বুক যেন ফাটিয়া যাইতেছিল। হায়! ভ্রান্ত আমরা যাহাকে দেবতা বলিয়া মনে করি, সেও আমাদেরই মত দুর্ব্বলচিত্ত মনুষ্যমাত্র; তাহারও পদে পদে ত্রুটী! দূরে যাহা দিব্য—নিকটে তাহা ধরার ধূলিমাত্র। আমরা কি ভ্রান্ত! ভ্রান্তিবশে কি বিশ্বাস বক্ষে লইয়া প্রতারিত হই! সে বিশ্বাস যখন ভাঙ্গিয়া যায়, তখন সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ও ভাঙ্গিয়া যায়।