নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/তৃতীয় খণ্ড/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
দুঃসংবাদ।
একটি দুর্ঘটনা ঘটিলে হৃদয়ে অন্য দুর্ঘটনার আশঙ্কা জাগিয়া উঠে। বর্ষার মেঘে একবার বর্ষণ আরব্ধ হইলে—তখন পুনরায় বর্ষণের সম্ভাবনা জন্মে। গাড়ীর দুর্ঘটনায় প্রভাতের হৃদয় চিন্তাকুল হইল। সে কয় দিন ওয়ালটেয়ারের সংবাদ পায় নাই,— দুইখানি পত্র লিখিয়াও উত্তর পায় নাই। সহসা যে পীড়া বাড়িয়া সব শেষ হইয়া যাইবে—এ সম্ভাবনার কথা তাহার মনে উদিত হয় নাই। আজ তাহার মনে হইল,—কয় দিন সংবাদ নাই কেন? রাত্রিকালে সে অনিদ্র হইয়া চিন্তা করিতে লাগিল। মন বড় অস্থির হইয়া উঠিল। ভগিনীর সেই রোগশীর্ণ মুখের ছবি সে যেন চক্ষুর সম্মুখে দেখিতে লাগিল। তাহার মনে পড়িল, সে যখন চলিয়া আইসে, তখনও কমল বলিয়াছিল, “না, দাদা, তুমি যাইতে পাইবে না।” সেই স্নেহের অধিকারে বিশ্বাস হেতু আবদারের স্বর যেন তাহার কর্ণে ধ্বনিত হইতে লাগিল।
প্রভাত উঠিয়া বসিল,—ভাবিতে লাগিল।
শেষ রাত্রিতে পুত্ত্রের ক্রন্দনে শোভার নিদ্রাভঙ্গ হইল। সে দেখিল, প্রভাত বসিয়া ভাবিতেছে। সে জিজ্ঞাসা করিল, “জাগিয়া বসিয়া আছ যে?”
প্রভাত বলিল, “কয় দিন ওয়ালটেয়ারের কোনও সংবাদ পাই নাই। তাই ভাবিতেছি।”
“পত্র লিখ নাই?”
“লিখিয়াছি, উত্তর পাই নাই।”
“সে কি? কোনও সংবাদ নাই?”
“কল্য প্রভাতে টেলিগ্রাফ করিব। আমি একবার যাইব। মন বড় ব্যস্ত হইয়াছে।”
“ঠাকুরঝি আমাকেও যাইতে বলিয়াছিলেন। তাঁহার আসিবার পূর্ব্বে আমি যাইব।”
প্রভাত বসিয়া ভাবিতে লাগিল। ভাবনায় ভাবনা কেবল বাড়িতে লাগিল; মন ক্রমে অধিক অস্থির হইতে লাগিল।
ক্রমে নিশাবসান হইল। প্রভাত চাহিয়া দেখিল, ঈষন্মুক্ত বাতায়নপথে দিবালোক প্রবেশ করিতেছে। শোভাকে জাগাইয়া দিয়া সে বাহিরে গেল। রাত্রিজাগরণে ও দুশ্চিন্তায় তাহার মস্তকে বিষম যন্ত্রণা অনুভূত হইতেছিল।
প্রভাত ওয়ালটেয়ারে সতীশচন্দ্রের নামে টেলিগ্রাফ করিল; তাহার পর যথাকালে আফিসে চলিয়া গেল। কাজের ভিড়ে ছুটীর সময়ও কয় জন কর্মচারীকে আফিস করিতে হইতেছিল। আফিসে যাইয়া প্রভাত দেখিল, কিছুই ভাল লাগে না; কাযে মন বসে না। একটা হিসাব করিতে যাইয়া সে দুইবার ভুল করিল; তাহার পর হিসাব রাখিয়া বসিল। কিছুক্ষণ পরে সে শরীর অসুস্থ বলিয়া বিভাগের প্রধান কর্ম্মচারীকে জানাইয়া বাড়ী ফিরিল।
গৃহে ফিরিয়া প্রভাত প্রথমেই সংবাদ লইল, টেলিগ্রাম আসিয়াছে কি না। টেলিগ্রাম আইসে নাই। তাহার মন আরও চঞ্চল হইল। বেশ পরিবর্ত্তন করিয়া সে সংবাদপত্র লইয়া বসিল; ভাল লাগিল না। শচীকে আনিতে ভৃত্যকে পাঠাইল,— সে ঘুমাইয়াছে। শেষে প্রভাত উঠিয়া বারান্দায় আসিল। এক পার্শ্বে একটা বিলম্বিত পরগাছায় ফুল ফুটিয়াছে; প্রভাত সেই দিকে গেল; ফুল দেখিতে লাগিল।
সম্মুখের ছাত্রাবাসে তখনও ধূলগ্রাম অঞ্চলের ছেলেরা থাকে। এক জন সেই দিন গ্রাম হইতে আসিয়াছে; শিবচন্দ্র প্রভৃতিকে দেখিয়া আসিয়াছে। সে প্রভাতকে দেখিয়া ভাবিল, — “যাই, শোকে সহানুভূতি প্রকাশ করিয়া আসি।”
সে আসিয়া উপস্থিত হইল। বারান্দায় কতকগুলি বেত্রনির্ম্মিত চেয়ার ছিল। প্রভাত তাহাকে একখানিতে বসিতে বলিল, আপনি আর একখানিতে বসিল; তাহার পর জিজ্ঞাসা করিল, “সংবাদ কি?”
সে বলিল, “আমি আজ ধূলগ্রাম হইতে আসিতেছি।”
“বাড়ীর সব ভাল?”
যুবক ভাবিল, প্রভাত তাহার নিজপরিবারের সকলের কুশলবার্ত্তা জিজ্ঞাসা করিতেছে। প্রভাত যে দুর্ঘটনার সংবাদ পায় নাই, তাহা সে কেমন করিয়া জানিবে? সে বলিল, নির্ব্বিঘ্নে পৌঁছিয়াছেন।”
প্রভাত বলিল, “সব ভাল আছে?”
“হাঁ। কেন জ্যেঠামহাশর বাড়ী পৌঁছিয়া এ কয় দিন কি আপনাকে পত্র লিখেন নাই?” যুবক শিবচন্দ্রকে ‘জ্যেঠামহাশয়’ বলিত।
শুনিয়া প্রভাত চমকিয়া উঠিল। শিবচন্দ্র গৃহে ফিরিয়াছেন! সে ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “সতীশ?”
“তিনি এখনও আপনাদের গৃহে। জ্যেঠামহাশয়ই শোকে সর্ব্বাপেক্ষা অধিক অধীর হইয়াছেন। বোধ হয়, সেই জন্যই পত্র লিখিতে পারেন নাই। কাকা ও সতীশবাবু—”
প্রভাত আর সে কথা শুনিতেছিল না। সে দুই হস্তে মুখ আবৃত করিয়া বালকের মত রোদন করিতেছিল। তাহার বুক যেন ফাটিয়া যাইতেছিল।
সংবাদ পাইয়া প্রভাতের জ্যেষ্ঠ শ্যালক তাহার নিকটে আসিলেন, তাহাকে সান্ত্বনা দিবার চেষ্টা করিলেন। প্রভাত একান্ত অধীর হইয়া বহুক্ষণ কাঁদিল। কেহ তাহাকে শান্ত করিতে পারিলেন না। তাহার দুঃখ কেবল শোক নহে, তাহাতে শোক ও আত্মগ্লানি মিশ্রিত। হায়! তাহার সেই একমাত্র ভগিনী, অজস্র যত্নের, অসীম স্নেহের কমল আর নাই! সে গৃহে যাইলে আর “দাদা” বলিয়া কেহ ছুটিয়া আসিবে না! কমল আর সাগ্রহে তাহার আগমন প্রতীক্ষা করিয়া দ্বারে দাঁড়াইয়া থাকিবে না! কমল আর নাই! এখন সেই পরিচিত গৃহে আর সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর শ্রুত হইবে না! সে আর নাই!—কমল মৃতা!
মানবহৃদয়ে কতকগুলি তন্ত্রী আছে,—তাহারা অতর্কিত ঘটনার আঘাত ব্যতীত ধ্বনিত হয় না। তাহারা সাগ্রহে দত্ত আঘাতে নিঃশব্দ রহে, কিন্তু অতর্কিত ঘটনার স্পর্শমাত্রে করুণস্বরে সমস্ত হৃদয় পূর্ণ করে। আজ প্রভাতের তাহাই হইল। আজ সুপ্তি-, গহ্বর শূন্য করিয়া শত স্মৃতি তাঁহার হৃদয়ে দেখা দিল। সে স্মৃতিতে কেবল যাতনা।
আজ তাহার গৃহ শোকমগ্ন। কিন্তু সে তথায় নাই। প্রভাত আপনাকে ধিক্কার দিল। হায়! মৃত্যুকালেও সে যদি কমলের কাছে থাকিত! তবে হয় ত এ দুঃখেও কিছু শান্তি পাইত। কিন্তু দোষ কাহার? কমল তাহাকে আসিবার সময়ও বলিয়াছিল, “না, দাদা, তুমি যাইতে পাইবে না। সে কেন আসিয়াছিল? কেন সে কমলের কথা রাখে নাই?
এই দারুণ শোকে প্রভাত শোভার নিকট সহানুভূতি পাইল। কমলের স্নেহ শোভার হৃদয় জয় করিয়াছিল। তাহার মধুর স্বভাবে শোভা মুগ্ধা হইয়াছিল।
কাঁদিয়া একটু শান্ত হইবার পর প্রভাতের প্রথম ইচ্ছা হইল, শোকার্ত স্বজনগণের নিকটে যাইবে,—সমশোককাতরদিগের সহিত এক সঙ্গে কাঁদিবে। শোক তাহার হৃদয়ের মলিনতা ধৌত করিয়াছিল,—এখন স্বভাবদত্ত আকর্ষণকে প্রবল করিয়া তুলিল।
প্রভাত শোভাকে সে কথা বলিল। শোভা তাহার মতে মত দিল।
পর দিন শোভা স্বয়ং স্বামীর ব্যাগে আবশ্যক দ্রব্যাদি গুছাইয়া দিল; প্রভাত রাত্রির গাড়ীতে বাড়ী যাইবে।
অপরাহ্নে শোভা স্বামীর ব্যাগে কয়টা দ্রব্য দিতেছিল। প্রভাত নিকটে বসিয়াছিল। এমন সময় নিম্নে গোলমাল শুনা গেল। অল্পক্ষণ পরেই সোপানে পদধ্বনি শুনিয়া বোধ হইল, যেন কয় জনে কোনও দ্রব্য তুলিয়া আনিতেছে। তাহার পর গৃহিণীর বাষ্পবিজড়িত কণ্ঠস্বর শ্রুত হইতে না হইতে শোভার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার কথা শুনা গেল, “এ ঘরে ভিড় করিও না। পাখা কর।” শুনিয়া শোভা দ্রুতপদে কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্তা হইল।
প্রভাত বসিয়া রহিল। শোভা অল্পক্ষণে ফিরিল না। প্রভাত শুনিল, বিনোদবিহারী বলিল, “তিনি বাড়ী না থাকেন, যে ডাক্তারকে পাও, ডাকিয়া আন।” নলিনবিহারীর শয়নকক্ষ হইতে শব্দ আসিতেছিল। প্রভাত সেই দিকে গেল।
কক্ষ পূর্ণ। বধূরা কক্ষদ্বার রোধ করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। কক্ষে প্রবেশ করিয়া প্রভাত দেখিল, সংজ্ঞাহীন নলিনবিহারীর দেহ শয্যায় শায়িত। কৃষ্ণনাথ হতবুদ্ধি হইয়া বসিয়া আছেন। গৃহিণী নলিনীবিহারীর মস্তক জলসিক্ত করিতেছেন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ব্যজন করিতেছেন। বিনোদবিহারী জলে অ-ডি-কলোন মিশাইতেছে। ভৃত্যবর্গ অনাবশ্যক জনতা করিয়া দাঁড়াইয়া আছে।
কক্ষের দুইটি বাতায়ন রুদ্ধ ছিল। প্রভাত সে দুইটি মুক্ত করিয়া দিল; তাহার পর ভৃত্যদিগকে বাহিরে অপেক্ষা করিতে বলিল।
আফিসে কায করিতে করিতে নলিনবিহারী অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিল। কোনরূপে তাহার সংজ্ঞাসঞ্চার করাইয়া কৃষ্ণনাথ তাহাকে গৃহে আনিতেছিলেন। পথে, যানে— তাহার পুনরায় সংজ্ঞালোপ হইয়াছে।
অল্প সময়ের মধ্যেই চিকিৎসক আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তখন নলিনবিহারীর সংজ্ঞাসঞ্চার হইয়াছে; সে যেন দীর্ঘনিদ্রাবসানে নয়ন মেলিতেছে। ডাক্তার পরীক্ষা করিলেন, দেহের দৌর্ব্বল্য দেখিয়া প্রশ্ন করিলেন, “অসুস্থ কয় দিন হইয়াছে?”
কৃষ্ণনাথ উত্তর করিলেন, “আজ আফিসে কায করিতে করিতে অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছে।”
“কেবল আজ?”
“হাঁ।”
চিকিৎসক নিতান্ত বিস্মিত হইলেন। এ বিষম দৌর্ব্বলা সত্বেও যে রোগী আফিসে কায করিতে পারে, চিকিৎসক সহজে তাহা বিশ্বাস করিতে পারিতেছিলেন না। যাহা হউক, যথারীতি কিছু ঔষধের ব্যবস্থা করিয়া তিনি বিদায় লইলেন; বলিয়া যাইলেন,— রোগীর সম্পূর্ণ বিশ্রাম আবশ্যক।
সে দিন আর প্রভাতের যাওয়া ঘটিল না।
পর দিন চিন্তা আসিল। তখন শোকের প্রথম উচ্ছ্বাস অপগত। তাহার একমাত্র ভগিনীর মৃত্যুসংবাদ সে পায় নাই; সংবাদ পাইবারও যথোচিত চেষ্টা করে নাই। যখন গৃহে সকলে শোকে অভিভূত, —তখন সে দূরে। সে কেমন করিয়া গৃহে মুখ দেখাইবে? তাহার পর সংবাদ পাইয়াও ঘটনাচক্রে তাহার গমনে বিলম্ব ঘটিল। পিতা যে যাইবার সময় তাহাকে সংবাদও দেন নাই, সে কি কেবল তাহার নিকট হইতে দুঃসংবাদ গোপন রাখিবার জন্য? সে ছাড়া তাঁহাদের আর কি অবলম্বন আছে; কে আছে? সেই একমাত্র সন্তানের মৃত্যুশোকে কাতর, স্নেহশীল পিতৃব্য! তাঁহার কি যন্ত্রণা! সেই স্নেহশীলা পিসীমা,—জননী! সে কেমন করিয়া তাহাদের কাছে মুখ দেখাইবে?
শোভা জিজ্ঞাসা করিল,—“আজ যাইবে কি?”
প্রভাত বলিল, “না।”
শোভা বিস্মিতা হইল; জিজ্ঞাসা করিল, “কেন?”.
“তাই ভাবিতেছি।”
শোভা আরও বিস্মিতা হইল। প্রভাত ভাবিতে লাগিল।
পর দিন প্রভাত পিতার পত্র পাইল; “কলিকাতায় আমাদের জন্য যে বাড়ী ভাড়া করা হইয়াছিল, তাহার বর্ত্তমান মাসের ভাড়া দেওয়া আছে: সে বাড়ী আর আবশ্যক নাই। তাহা যেন ছাড়িয়া দেওয়া হয়।”
পত্রের মৌন তিরস্কার প্রভাতের হৃদয় বিদ্ধ করিল। তাহার বোধ হইল, পিতার সহস্র তিরস্কারেও এরূপ তীব্রতা থাকিতে পারিত না। পিতা যেন তাহাকে পিতৃস্নেহ হইতে বঞ্চিত করিয়া, — পিতৃহৃদয় হইতে নির্ব্বাসিত করিয়া, পর করিয়া দিয়াছেন। পত্রের প্রত্যেক শব্দ যেন পিতার সমস্তহৃদয়নিষ্পেষণ-লব্ধ অতি তীব্র তিরস্কাররসে লিখিত। সেই পরিচিত হস্তের প্রত্যেক অক্ষর যেন জ্বলন্ত অঙ্গারের মত তাহার হৃদয় দগ্ধ করিতে লাগিল।
সেই পত্র পাঠ করিয়া প্রভাত কাঁদিল। সে বুঝিল, তাহার সকল বেদনা তাহার আপনার কর্ম্মের ফল।
সে দিন প্রভাতের ভাব দেখিয়া শোভা জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার কি অসুখ করিয়াছে?”
প্রভাত বলিল, “না।”
নিশীথে জাগিয়া শোভা দেখিল, প্রভাত কাঁদিতেছে। সে জিজ্ঞাসা করিল, “আজ কি বাড়ীর পত্র পাইয়াছ?”
প্রভাত বলিল, “পাইয়াছি।”
শোভা ভাবিল, তাহাতেই প্রভাতের শোক উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিয়াছে। সে তাহাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করিল। কিন্তু তখন প্রভাতের নিকট তাহা ক্লেশদায়ক বোধ হইতে লাগিল।