নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/তৃতীয় খণ্ড/পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
অতর্কিত বিপদ।
খিদিরপুরে বন্ধুগৃহে প্রভাতের নিমন্ত্রণ ছিল। সে দিন নানা স্থানে পূজার নিমন্ত্রণ। স্বয়ং কৃষ্ণনাথ এক স্থানে, তাঁহার জ্যেষ্ঠ ও মধ্যম পুত্র আর কয় স্থানে যাইবেন। জ্যেষ্ঠ প্রভাতকে বলিলেন, “তুমি বগী গাড়ীতে নূতন ঘোড়া লইয়া যাইও। বাবা বড় যুড়ি লইয়া যাইবেন। আর সব ঘোড়া এক একবার খাটিয়াছে; অত দূর যাইতে পারিবে না।” সে অশ্বটি বহুমূল্যে অল্প দিন ক্রীত, তেজে ভরা, দ্রুতগতি, সুন্দর।
যথাকালে প্রভাত সহিসকে গাড়ী আনিতে বলিল। প্রভাত স্বয়ং অশ্বচালনে বিশেষ পটু ছিল না। সহিস জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি যাইবেন?”
প্রভাত বলিল, “হাঁ।”
“হুজুর ঘোড়া নূতন। কয় দিন খাটান হয় নাই। দুষ্টামী করিতে পারে।”
প্রভাত আদেশ করিল, “গাড়ী লইয়া আয়।”
সহিস গাড়ী আনিতে গেল; গাড়ী সাজাইয়া আনিয়া বলিল, “বাতি নাই। সরকারবাবু বাহির হইয়া গিয়াছেন।” প্রভাত বলিল, “হয় ত বেলা থাকিতেই ফিরিব। না হয়, পথে লইবে।”
প্রভাত গাড়ীতে উঠিল। তেজস্বী অশ্ব বেগে বাহির হইল।
প্রভাত আশা করিয়াছিল, সন্ধ্যার পূর্ব্বেই ফিরিতে পারিবে। গৃহে তাহার কায ছিল। কিন্তু তাহা হইয়া উঠিল না। তাহার বাহির হইতে সন্ধ্যা অতিক্রান্ত হইল।
প্রভাত গাড়ীতে উঠিলে সহিস পুনরায় বলিল, “হুজুর, বাতি নাই।”
প্রভাত বলিল, “আচ্ছা। মাঠ ছাড়াইয়া সহরে যাইয়া কিনিয়া লইবে। সহরে পড়িয়াই পাইবে ত?”
“হাঁ, হুজুর।”
সহিস অশ্বের মুখরজ্জু ত্যাগ করিল। চাবুকের আবশ্যক হইল না। অশ্ব দ্রুততরবেগে গৃহাভিমুখে ছুটিয়া চলিল।
ময়দানে লঘু সুখদ পবনের মধুর স্পর্শ। অশ্ব তীরবেগে ছুটিয়া চলিল। প্রভাত অশ্বের গতি সংযত করিল না। গাড়ী যে স্থানে উপস্থিত হইল, সে স্থান হইতে অদূরে আর একটি রাস্তা আসিয়া বড় রাস্তায় মিশিয়াছে। প্রভাত দেখিল, সেই পথ হইতে দুইটি উজ্জ্বল আলোক ঘুরিয়া আসিল —মুহূর্ত্তমধ্যে সেই আলোকদ্বয় তাহার সম্মুখে আসিয়া স্থির হইল। তাহার গাড়ী যেন দারুণ ভূকম্পনে কম্পিত হইল; তাহার ’পর স্থির হইয়া দাঁড়াইল। চক্ষুর নিমেষে এই ঘটনা ঘটিয়া গেল। অপর যানের আরোহী লম্ফ দিয়া ভূমিতে নামিল। সে গাড়ীর অশ্বদ্বয়ের মধ্যবর্তী ‘বোম’ প্রভাতের অশ্বের বক্ষে বিদ্ধ হইয়া গিয়াছিল। আরোহীর সঙ্গে সঙ্গে সহিস দুই জনও লাফাইয়া পড়িয়াছিল। তাহারা গাড়ী ঠেলিয়া পিছাইয়া দিল। মুক্ত ক্ষতমুখে প্রভাতের অশ্বের রক্তধারা ছুটিয়া বাহির হইল। তপ্ত ভূমিতে সেই রক্তধারার পতনের শব্দ শ্রুতিগোচর হইতে লাগিল,—তৃষিত ভূমিতে তরল ধারার শোষণশব্দ শুনা গেল।
প্রভাত যেন হতবুদ্ধি হইয়া বসিয়াছিল; এক্ষণে গাড়ী হইতে নামিল; নিষ্ফল চেষ্টার উন্মত্ত আবেগে অশ্বের ক্ষতমুখে করতল সংস্থাপিত করিয়া শোণিতপ্রবাহ নিবারণ করিতে প্রয়াস পাইল। বৃথা চেষ্টা! ফলে কেবল অশ্বের ধূসর অঙ্গ ও তাহার অমলশ্বেত বসন রক্তে রঞ্জিত হইয়া গেল। প্রভাত হস্ত সরাইয়া লইল। ক্ষতমুখে অশ্বের জীবনস্রোতঃ বাহির হইয়া যাইতে লাগিল।
অপর যানের আরোহী য়ুরোপীয়। সে বলিল, “বাবু—যাহা হইয়াছে, তাহার জন্য আমি বিশেষ দুঃখিত। কিন্তু দোষ আমার নহে। আপনার যানে আলোক ছিল না।”
প্রভাত কোনও উত্তর দিল না।
য়ুরোপীয় সহিসদিগের সাহায্যে অশ্বকে যান হইতে মুক্ত করিয়া দিল,— গাড়ী সরাইয়া লইল। অশ্ব স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার পর নিঃশেষ জীবনীশক্তি হইয়া ভূতলে পতিত হইল।
সহিস প্রভাতকে বলিল, “হুজুর বাড়ীতে সংবাদ দিতে যাইব?”
প্রভাত কি ভাবিতেছিল, উত্তর দিল না।
সহিস পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল।
প্রভাত বলিল, “যাও।”
য়ুরোপীয় বলিল, “বাড়ী কত দূর?”
সহিত উত্তর দিল, “বহু দূর।”
“তুমি গাড়ী হাঁকাইতে জান?”
“না।”
য়ুরোপীয় প্রভাতকে জিজ্ঞাসা করিল, “আমি কি আপনার কাছে থাকিব?”
প্রভাত বলিল,—“অনাবশ্যক।”
য়ুরোপীয় পকেট হইতে ‘কেস’ বাহির করিল; প্রভাতকে আপনার ‘কার্ড’ দিল; আপনার গাড়ী হইতে একটি লণ্ঠন খুলিয়া প্রভাতের গাড়ীতে বসাইয়া দিল; বলিল, “বাবু, এই লণ্ঠন থাকিল। আমি চলিলাম; কল্য প্রভাতে যাইয়া আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব। অনুগ্রহ করিয়া আপনার নাম ও ঠিকানা বলিবেন কি?”
প্রভাত আপনার নাম ও ঠিকানা বলিল। য়ুরোপীয় লণ্ঠনের আলোকে ‘পকেট বুকে’ লিখিয়া লইল; প্রভাতের সহিসকে বলিল, “আমার সঙ্গে চল মাঠ পার হইয়া তোমাকে ঠিকাগাড়ী করিয়া দিয়া ফিরিয়া যাইব। তুমি যাইয়া গৃহে সংবাদ দাও।”
সহিস য়ুরোপীয়ের গাড়ীতে উঠিল। য়ুরোপীয় গাড়ী ফিরাইয়া সহরের দিকে চলিল। ক্রমে সে গাড়ীর আলোক অদৃশ্য হইয়া গেল। দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া প্রভাত পথিপার্শ্বে বসিল।
তখন চন্দ্রোদয় হইতেছে। চারি দিকে বৃক্ষরাজি—কলিকাতার শোভার ও স্বাস্থ্যের কেন্দ্র ময়দানকে বেষ্টন করিয়া আছে। দূরে হর্ম্ম্যমালা দৃষ্টিগোচর হয় না;— কেবল বৃক্ষের হরিৎপ্রাচীর। আকাশ কিছু দূর ধূমমলিন;— তদুপরি নীলাম্বর নক্ষত্রখচিত। পথে দুই একখানি যান গমনাগমন করিতেছে। একখানি যানের অশ্ব পথোপরি শয়ান মৃত অশ্ব দেখিয়া ভীতি প্রকাশ করিল,—চঞ্চল হইল; তাহার পর চালকের কশাঘাতে বেগে চলিয়া গেল।
ক্রমে চন্দ্রোদয় হইল। অশ্বের রক্তে সিক্ত ভূমি কৃষ্ণবর্ণ বোধ হইতে লাগিল। চন্দ্রালোক অশ্বের তখনও তপ্ত দেহের উপর পতিত হইল। কত ক্ষুদ্র ছিদ্রমুখে অশ্বের জীবনস্রোতঃ বাহির হইয়া গিয়াছে! প্রভাত বসিয়া ভাবিতে লাগিল। ভাবনার অন্ত নাই।
এ দিকে সহিস গৃহে যাইয়া সংবাদ দিল। তখন ছেলেরা ফিরিয়াছে, কৃষ্ণনাথ কেবল ফিরিয়াছেন। গৃহিণী তখন মধ্যম পুত্ত্রের ঘরে ছিলেন। পুত্ত্র তাঁহার ভগিনীর পুত্ত্রের বিবাহে পাকা দেখার নিমন্ত্রণে গিয়াছিল। গৃহিণী সেই বিষয়ে সংবাদ লইতেছিলেন। এমন সময় সহিস নিম্নের প্রাঙ্গন হইতে ডাকিয়া দুঃসংবাদ দিল।
শুনিয়া পুত্ত্র প্রথমে সহিসকেই দোষী ভাবিলেন। সে সবিশেষ নিবেদন করিল,—বাতির কথা সে পুনঃপুনঃ জামাইবাবুকে বলিয়াছিল; যাইবার সময় বলিয়াছিল, ঘোড়া নূতন, কয় দিন খাটে নাই, চঞ্চল হইয়াছে,—ইত্যাদি। শুনিতে শুনিতে বিনোদবিহারীর মুখ অন্ধকার হইতে লাগিল। অল্প দিন পূর্ব্বে সে-ই সখ করিয়া বাছিয়া অশ্বটি কিনিয়াছিল। গৃহিণী পুত্ত্রের মুখভাব লক্ষ্য করিলেন,—শঙ্কিতা হইলেন। তিনি মুহূর্ত্তমাত্র চিন্তা করিলেন, তাহার পর পুত্ত্রের কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্তা হইলেন।
কৃষ্ণনাথ নিমন্ত্রণ রাখিয়া ফিরিয়াছেন; বেশ পরিবর্ত্তন করিয়া, —হস্তমুখপ্রক্ষালনান্তে আসিয়া বসিয়াছেন। ভৃত্য তামাকু দিয়া গিয়াছে। কৃষ্ণনাথ আলবোলার নল মুখে দিয়া কেবল টানিয়াছেন, তখনও ধূম বাহির হয় নাই। গৃহিণী ব্যস্তভাবে কক্ষে প্রবেশ করিলেন, কৃষ্ণনাথ কোনও কথা জিজ্ঞাসার সময় পাইবার পূর্ব্বেই গৃহিণী বলিলেন, “সর্ব্বনাশ হইয়াছে।”
কৃষ্ণনাথের হস্ত হইতে নল পড়িয়া গেল। তিনি সবিস্ময়ে ভীতিকম্পিতস্বরে বলিলেন, “কি?”
“জামাই খিদিরপুর হইতে ফিরিতে পথে এক ‘সাহেবের গাড়ীর সঙ্গে তাহার গাড়ীর ধাক্কা লাগিয়াছে।”
“প্রভাত আসিয়াছে?”
“না। সহিস ভাড়াগাড়ী করিয়া আসিয়াছে। ঘোড়া পড়িয়া গিয়াছে। বাছার কি হইয়াছে—কে জানে?”
“বল কি?”
“তুমি আপনি যাও।” গৃহিণীর দুই চক্ষুতে জলধারা ঝরিতে লাগিল।
দুর্ব্বলচিত্ত কৃষ্ণনাথ এই কথায় বিচলিত হইলেন। তাঁহার জিজ্ঞাসা করিবার, সবিশেষ জানিবার কথা মনেই হইল না। তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইতেছিলেন; গৃহিণীর কথায় যেন কর্ত্তব্য বুঝিতে পারিলেন; বলিলেন, “আমি যাইতেছি।”
দক্ষিণপদের চটি বাম পদে ও বাম পদের চটি দক্ষিণ পদে দিয়া, —উত্তরীয় পর্য্যন্ত না লইয়া কৃষ্ণনাথ বাহির হইলেন। যে যানে সহিস আসিয়াছিল, সে যান দ্বারেই ছিল। কৃষ্ণনাথ তাহাতে উঠিয়া বলিলেন, “হাঁকাও।” চালক একটু ইতস্ততঃ করিতেছে দেখিয়া কৃষ্ণনাথ বলিলেন, “যাহা চাহ, পাইবে।”
চালক জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় যাইব?”
কৃষ্ণনাথ তাঁহার সহিসকে গাড়ীতে উঠিতে আদেশ দিয়া বলিলেন, “যেখানে ঘোড়া পড়িয়াছে, সেইখানে চল।”
যান চলিল।
যান গন্তব্য স্থানে আসিয়া স্থির হইল। প্রভাত তাহা জানিতে পারিল না; সে চিন্তামগ্ন। কৃষ্ণনাথ ব্যস্ত হইয়া স্বয়ং যানের দ্বার খুলিয়া অবতরণ করিলেন। তিনি প্রভাতের অতি নিকটে আসিলেও প্রভাত জানিতে পারিল না। তাঁহার আশঙ্কা হইল, প্রভাত আহত। তিনি ভগ্নকণ্ঠে ডাকিলেন, “প্রভাত!”
পরিচিত স্বরে প্রভাত চমকিয়া উঠিল,—উঠিয়া দাঁড়াইল। সে লজ্জায় মুখ তুলিতে পারিল না।
কৃষ্ণনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার আঘাত লাগে নাই ত?”
প্রভাত বলিল, “না।”
কৃষ্ণনাথের অশান্ত হৃদয় শান্ত হইল। তিনি বলিলেন, “তুমি বাড়ী যাও নাই; আমরা কত দুর্ভাবনা করিতেছিলাম! শীঘ্র গাড়ীতে উঠ। তোমার শাশুড়ী ঠাকুরাণী কাঁদিয়া অস্থির হইতেছেন।”
কৃষ্ণনাথ সহিসকে বলিলেন, “তুমি এখানে থাক। আমি থানায় সংবাদ দিয়া ব্যবস্থা করিয়া যাইতেছি। বাড়ী যাইয়া আর একটি ঘোড়া পাঠাইয়া দিব;—গাড়ী লইয়া যাইবে।”
তিনি প্রভাতকে লইয়া গাড়ীতে উঠিলেন।
সমস্ত পথ প্রভাত মুখ তুলিতে পারিল না,—কোনও কথা কহিল না। সে কেবল ভাবিতে লাগিল;— সে চিন্তা অন্তহীন।
প্রভাত অপরাধীর মত গৃহে প্রবেশ করিল। গৃহিণী ব্যগ্রভাবে আসিয়া সাগ্রহে তাহার কুশল প্রশ্ন করিলেন।
গৃহে মধ্যম শ্যালকের মুখভাব দেখিয়া প্রভাত বুঝিল, বারুদের স্তূপ সঞ্চিত হইয়া আছে,—অগ্নিকণার স্পর্শমাত্রে তাহা জ্বলিয়া উঠিবে। সে আরও বুঝিল, শাশুড়ীর সতর্কতায় কেবল সে অগ্নি আত্মপ্রকাশ করিতেছে না। তিনি ব্যস্ত হইয়াছিলেন,—তাই কৃষ্ণনাথ স্বয়ং গমন করিয়াছিলেন।
প্রভাত ভাবিতে লাগিল।