নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/তৃতীয় খণ্ড/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
ব্যথিত হৃদয়।
হৃদয়ে আশা নাই,—জীবনে সুখ নাই,—জগতে আনন্দ নাই। কমল যাঁহাদের হৃদয়ের আশা, জীবনের সুখ, জগতের আনন্দ ছিল, তাঁহারা তাহার শবদেহ লইয়া সমুদ্রতীরে উপনীত হইলেন। সকল বাঙ্গালী কর্ম্মোপলক্ষে বা অন্য কারণে ওয়ালটেয়ারে ছিলেন, তাঁহারাও কেহ কেহ আসিলেন। বিদেশে বাঙ্গালী বাঙ্গালীকে যত সাহায্য করে—যত সহানুভূতি করে—স্বদেশে তত করে না। যে স্থানে অন্য সম্বন্ধ ও তাহার আনুসঙ্গিক স্বার্থবিদ্বেষাদি থাকে না, সে স্থানে মানুষে মানুষে সহজ ও স্বাভাবিক সম্বন্ধ আত্মপ্রকাশ করে।
শব সমুদ্রতীরে সংস্থাপিত হইল। চিতা রচিত হইতে লাগিল। নবোদিত রবির কিরণ সেই মরণাহতার প্রশান্ত কোমল মুখে পতিত হইল। শিবচন্দ্র শবের পার্শ্বে বসিয়া অধীরভাবে রোদন করিতে লাগিলেন, “মা, আমার বড় আশা ছিল, তোদের সুখী দেখিয়া সুখে মরিব। মা, তুই আমার সামান্য কষ্ট সহিতে পারিতিস্ না। আজ সব ভুলিয়াছিস্?”
নবীনচন্দ্র ও সতীশ উভয়ে নীরব। উভয়েই রুদ্ধমুখ আগ্নেয় গিরির মত অন্তরস্থিত বহ্নিজ্বালায় দগ্ধ—দারুণ শোক হৃদয় দগ্ধ করিয়া ফেলিতেছে।
শবদেহ সমুদ্রকূলে স্থাপিত হইয়াছিল। ঊর্ম্মিমালা অদূরে বেলায় লুটাইয়া ফিরিয়া যাইতেছিল। শিবচন্দ্র শবের পার্শ্বে। সহসা অন্য তরঙ্গের আঘাততাড়িত একটি তরঙ্গ আবর্ত্তিত হইয়া তীরে আসিয়া পড়িল। উচ্ছ্বসিত সলিলে কমলের শবদেহ ও শিবচন্দ্রের শরীর সিক্ত হইয়া গেল। শিবচন্দ্র চমকিয়া উঠিলেন কমল সমুদ্রে স্নান করিতে চাহিলে তিনি বলিয়াছিলেন, “আমরা মাতাপুত্ত্রে একদিন স্নান করিব।” তাঁহার অশ্রু দ্বিগুণ বহিতে লাগিল।
চিতাশয়ন প্রস্তুত হইল। মরণাহতা কমলের দেহ তাহার উপর সংস্থাপিত হইল। চিতাগ্নি জ্বলিয়া উঠিল। শিবচন্দ্রের অধীরতা দেখিয়া নবীনচন্দ্রের নির্দ্দেশমত তাঁহাকে গৃহে ফিরাইয়া লইয়া যাওয়া হইল। সেথায় তিনটি স্নেহশীলা রমণীর শোকদীর্ণ হৃদয় হইতে অতি গভীর আর্তনাদ উঠিতেছিল।
চিতানল নির্ব্বাপিত হইল। সতীশচন্দ্রের হৃদয়ের সকল সুখের আশা সেই চিতানলে ভস্মসাৎ হইয়া গেল। নবীনচন্দ্রের পক্ষে জগৎ শূন্য,—জীবন যাতনার ভার মাত্র। হায়! যে জীবনের সুখ হৃদয়ের সর্ব্বস্ব—তাহাকে ছাড়িয়াও বাঁচিয়া থাকিতে হয়; জীবন যখন যাতনামাত্র, তখনও জীবন ধারণ করিতে হয়। হৃদয় যখন ভস্মসাৎ হইয়া যায়, জীবন তখনও যায় না কেন?
নবীনচন্দ্র গৃহে ফিরিলেন। সতীশ সঙ্গে নাই। নবীনচন্দ্রের সে দিকে লক্ষ্য ছিল না। যে ভৃত্য ধূলগ্রাম হইতে সঙ্গে আসিয়াছিল, সে গৃহদ্বারে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “জামাই বাবু কোথায়?”
নবীনচন্দ্রের যেন চমক ভাঙ্গিল। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “সতীশ ফিরে নাই?”
ভৃত্য বলিল, “না।”
নবীনচন্দ্র আর রোদনধ্বনিধ্বনিত গৃহে প্রবেশ করিলেন না; ফিরিলেন। তিনি ধীরে ধীরে সমুদ্রের দিকে চলিলেন। তখন হৃদয় বেদনার আতিশয্যে একান্ত কাতর; —নয়ন শুষ্ক।
ভৃত্য সঙ্গে আসিতেছিল। নবীনচন্দ্র নিবারণ করিলেন।
যে স্থানে চিতা রচিত হইয়াছিল, তাহার অনতিদূরে সৈকতোপরি শিলাখণ্ডের পশ্চাতে সতীশ বসিয়াছিল। শিলার উপর যুক্ত বাহুযুগল স্থাপিত করিয়া তাহার মধ্যে মুখ লুকাইয়া সতীশ দুর্দ্দম বেদনায় রোদন করিতেছিল। সম্মুখে সাগর বিলাপ করিয়া ফিরিতেছিল, পশ্চাতে পবনের আর্ত্তস্বর। নবীনচন্দ্র দেখিলেন। তিনি সতীশের পার্শ্বে বসিলেন। শোকের আতিশয্য হেতু এতক্ষণ নয়নে সান্ত্বনাসলিল দেখা দেয় নাই। এখন —সহানুভূতির সংস্পর্শে অশ্রু প্রবাহিত হইল। মেঘ আপনার হৃদয়ে বাষ্প ধারণ করিয়া রাখে; শীতলপবনস্পর্শে তাহা বৃষ্টিরূপে পতিত হয়।
উভয়ে কাঁদিতে লাগিলেন। কতক্ষণ কাঁদিলেন,—কেহ জানিতে পারিলেন না। তখন কাহারও সময়ের পরিমাণ বুঝিবার সামর্থ্য ছিল না। তখন উভয়েরই হৃদয়ে কেবল শোক;—অন্য চিন্তার স্থান নাই। উভয়েই বাহ্যজ্ঞানহত।
ভৃত্য যখন সঙ্গে আসিতেছিল, তখন নবীনচন্দ্র তাহাকে নিবারণ করিয়াছিলেন। কিন্তু পুরাতন ভৃত্য ভৃত্যমাত্র নহে। সে ক্রমে প্রভু-পরিবারের অঙ্গীভূত হয়; সেই পরিবারের সুখদুঃখ আপনার সুখদুঃখ জ্ঞান করিতে আরম্ভ করে। তাই নবীনচন্দ্র সতীশের সন্ধানে যাইলে যখন তাঁহার ফিরিতে বিলম্ব হইতে লাগিল, তখন ভৃত্য চিন্তিত হইল,—শঙ্কিত হইল। সকলকে ক্রন্দন করিতে দেখিয়া বিস্মিত হইয়া অমল বারান্দায় তাহার নিকট বসিয়া কাঁদিতেছিল। ভৃত্য তাহাকে বক্ষে লইয়া নবীনচন্দ্রের ও সতীশচন্দ্রের সন্ধানে চলিল।
ভৃত্য আসিয়া দেখিল, সতীশচন্দ্র ও নবীনচন্দ্র উভয়েই ক্রন্দন করিতেছেন। কেহই তাহার আগমনের বিষয় জানিতে পারিলেন না। অমল বহুক্ষণ পিতাকে ও মাতামহকে দেখে নাই;—দেখিয়া আনন্দিত হইল; ভৃত্যের বক্ষ হইতে নামিয়া তাঁহাদিগের নিকট ছুটিয়া চলিল। কিন্তু তাঁহাদিগকে বিহ্বলভাবে রোদন করিতে দেখিয়া শিশু অর্দ্ধপথে থমকিয়া দাঁড়াইল; একবার বিস্মিতনয়নে ভৃত্যের দিকে চাহিল। শিশু যেন মুহূর্ত্তের জন্য কি ভাবিল। তাহার মুখে হর্ষচিহ্ন বিলুপ্ত হইয়া গেল; মুখ গম্ভীর হইল। সে যাইয়া পিতাকে জড়াইয়া ধরিয়া ডাকিল, “বাবা!”
পরিচিত আহ্বানে সতীশ মুখ তুলিল; পুত্ত্রকে বক্ষে লইয়া অধীরভাবে রোদন করিতে লাগিল। পুত্ত্রও কাঁদিতে লাগিল। শিশু ভালবাসার পাত্রকে কাঁদিতে দেখিলে কাঁদে,—কারণ সন্ধান করে না। পুত্ত্রের অধীরতা সতীশচন্দ্রের অধীরতা-নিবারণের কারণ হইল। পুত্ত্রের আকুল রোদনে পিতৃহৃদয় ব্যথিত হইল। সতীশ পুত্ত্রের অশ্রুধারা মুছাইতে লাগিল; কিন্তু তাহার আপনার অশ্রু বহিতে লাগিল।
সতীশ মুখ তুলিল। নবীনচন্দ্র কাঁদিতেছিলেন। পরস্পর পরস্পরের মুখে একই দারুণ শোকের চিহ্ন লক্ষ্য করিলেন। তখন অধীর ক্রন্দনে উভয়েরই শোকের প্রথম উচ্ছ্বাস শান্ত হইয়াছে। নবীনচন্দ্র বলিলেন, “চল, যাই।”
পুত্ত্রকে লইয়া সতীশ উঠিল। সতীশ পুত্ত্রকে বক্ষে লইয়া,নবীনচন্দ্র শূন্যবক্ষে, আবাসে ফিরিয়া আসিলেন। গৃহে সকলেই তখনও একান্ত অধীর; শিবচন্দ্র অশান্ত। কে তাঁহাকে সান্ত্বনা দান করিবে? নবীনচন্দ্র ও সতীশ তখন শান্ত। উভয়ে বুঝিয়াছেন, এ শোকের অংশ হয় না,—এ শোকের হ্রাস হইতে পারে না,—এ শোকবহ্ণি মৃত্যু পর্য্যন্ত হৃদয়ে ধারণ করিয়া দারুণ জ্বালায় জলিতে হইবে। সে দহন প্রশমিত হইবে না, সে অগ্নি নির্ব্বাপিত হইবার নহে।
সব ফুরাইল। শঙ্কাদুঃসহ দিবস,—নিদ্রাহীন নিশা,—অজস্র যত্ন,—অক্লান্ত শুশ্রূষা,— আকুল উদ্বেগ,—অনন্ত ভালবাসা সবই বিফল হইল। এখন আবার সুখহীন জীবনের ভার বহিয়া আনন্দহীন গৃহে ফিরিতে হইবে; আবার তেমনই জীবনের সহস্র ক্ষুদ্র সুখ দুঃখ ভোগ করিতে হইবে,—হৃদয়ে বিষম শেল ধারণ করিয়াও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পিপীলিকার দংশনযন্ত্রণা সহ্য করিতে হইবে। আবার ফিরিতে হইবে। যে গৃহে তাহার শত স্মৃতি—শত চিহ্ন, সেই গৃহে ফিরিতে হইবে।
সপ্তাহ পরে যাত্রার আয়োজন হইল।
সতীশ টেলিগ্রাফের ‘ফরম্’ লইয়া লিখিতেছিল। শিবচন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় সংবাদ পাঠাইতেছ?”
সতীশ বলিল, “প্রভাতকে।”
শিবচন্দ্রের মুখে যাতনার চিহ্ন সুস্পষ্ট হইল। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন?”
সতীশ বলিল, “বাড়ী ঠিক করিয়া রাখিবে।”
“কোথায়?”
“কলিকাতায় বাসা রহিয়াছে। ছাড়িয়া আসা হয় নাই।”
“তাহাতে প্রয়োজন কি?”
“যাইয়া বাসায় উঠিবেন; পরে বাড়ী যাইতে হইবে।”
“বাসায় উঠিব না; বরাবর বাড়ী যাইব।”
“ষ্টেশনে প্রায় ছয় ঘণ্টা অপেক্ষা করিতে হইবে। কষ্ট হইবে।”
শিবচন্দ্র দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিলেন; বলিলেন, “কষ্ট! ভগবান কষ্টের শিক্ষা যথেষ্ট দিয়াছেন;—সে কষ্টকে তুচ্ছ জ্ঞান করিতে শিখাইয়াছেন।”
তিনি সতীশচন্দ্রের লিখিত ‘ফরম্’ লইয়া ছিঁড়িয়া ফেলিলেন; তাহার পর কাঁদিতে কাঁদিতে বারান্দায় চলিয়া যাইলেন। সতীশেরও নয়ন হইতে দুই ফোঁটা জল টপ্ টপ্ করিয়া কাগজে পড়িল।
সতীশ নবীনচন্দ্রের দিকে চাহিল। নবীনচন্দ্র বলিলেন, “দাদা যাহা বলেন, তাহাই কর।” কমলের মৃত্যুদিন হইতে শিবচন্দ্র যেন কেমন হইয়া গিয়াছিলেন। নবীনচন্দ্র এ সময় তাঁহার মতের বিরুদ্ধে কার্য্য করিয়া তাঁহাকে কষ্ট দিতে পারিবেন না। সতীশও তাহা বুঝিল। প্রভাতকে আর কোনও সংবাদ দেওয়া হইল না।
ইহার পর দিবস সেই সমুদ্রসৈকতে সুখরাশি ভস্মীভূত করিয়া সকলে শূন্যহৃদয়ে শূন্য গৃহের অভিমুখে যাত্রা করিলেন।