নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/তৃতীয় খণ্ড/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

দুঃখ কেন?

চপলার মনের ভাব নলিনবিহারী বুঝিতে পারিল না বটে, কিন্তু তাহার ব্যবহারে পদে পদে ব্যথিত হইতে লাগিল। আপনার প্রেমের প্রতিদানে সে পত্নীর নিকট যে প্রেম প্রত্যাশা করিয়াছিল, —তাহা পাইল না। সে যে প্রেমসুখের আশা করিয়াছিল,— যে প্রেম জীবনে সুখ, যাতনায় সান্ত্বনা ও অস্থিরতায় শান্তি হইবে ভাবিয়াছিল,—সে প্রেম সে পাইল না। পরন্তু চপলার ব্যবহারে সে বিপরীত ভাব লক্ষ্য করিতে লাগিল; লক্ষ্য করিতে লাগিল,— আর পদে পদে বিষম বেদনা পাইতে লাগিল।

 কিন্তু প্রেম সহজে প্রেমাস্পদের দোষ দেখিতে পায় না। তাই নলিনবিহারী আপনাকে দোষী করিয়া চপলাকে নির্দ্দোষ দেখিতে প্রয়াসী হইল। সে প্রথমে মনে করিল, সে অতিরিক্ত অসম্ভবের আশা করিয়াছিল,—তাই হতাশ হইয়াছে; সে কল্পনায় মাত্র সম্ভব আদর্শে চপলাকে বিচার করিয়াছে— অন্যায় করিয়াছে। কিন্তু সে চিন্তা স্থায়ী হইল না। জলোপরি জলবিম্বের মত সে সান্ত্বনা যখন বিলীন হইয়া গেল, তখন সে চিন্তান্তর গ্রহণ করিল।

 তাহার পর সে মনে করিল, স্বামীর অবিচারিত প্রেমাতিশয্যে পত্নীর হৃদয়ে বিরক্তি উৎপন্ন হয়। হয় ত সে পত্নীর বালিকাহৃদয়ে প্রেমবিকাশ সূচিত হইবার পূর্ব্বেই তাহার নিকট প্রেমতৃষ্ণা জানাইয়া তাহাকে বিরক্ত করিয়াছে। তখনও তাহার বৃত্তি উপযুক্তরূপে বিকশিত হয় নাই; তখনও সে প্রেমের স্বাদ বুঝিতে শিখে নাই,— বুঝিতে পারিত না। অবিচলিত নির্ভর, অসাধারণ সহিষ্ণুতা যে প্রেমের ভিত্তি, তাহা সে তখনও বুঝে নাই । কি মূল্যে কি কিনিতে হয়, কি লাভের জন্য কি ত্যাগ করিতে হয়—তাহা সে তখনও জানিত না। তাই সে বিরক্ত হইয়াছে। তখন সে লজ্জাধিক্যে সে কথা তাহার নিকটেও প্রকাশ করে নাই। হৃদয়ে প্রেম স্ফুরিত হইবার পূর্ব্বেই বিরক্তি স্থায়ী হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। প্রেম বিকশিত হইবার সময় বিরক্তির ব্যাঘাতে ফুটিতে পাবে নাই। স্বামীর ব্যবহারে সময় সময় পত্নী বিরক্ত হইয়া উঠে। হাস্যপরিহাসপ্রিয় সুন্দরী প্রথম যৌবনে আপনার প্রকৃতিপ্রদত্ত সম্পদের উপর শাসন নিতান্ত ক্লেশকর বলিয়াই বিবেচনা করে। স্বামী গুরুর আসনে বসিয়া—সথার পরিবর্ত্তে শাসক হইয়া দাঁড়াইলে, সে তাহা পারিবে কেমন করিয়া? সহ্য করিতে পারে না।

 নলিনবিহারী এমনই করিয়া মনকে বুঝাইবার চেষ্টা করিল। সেই চেষ্টায় হৃদয়ে সান্ত্বনালাভের আশা করিল; আপনাকে দোষী করিয়া প্রেমাস্পদকে নির্দোষ দেখিয়া সুখী হইবার চেষ্টা করিল। আশা পূর্ণ হইল কি? চেষ্টা সফল হইল কি?

 এইরূপ চিন্তায় চিন্তিতচিত্ত নলিনবিহারী শান্তি পাইল না, বরং অধিক যাতনা ভোগ করিতে লাগিল। কারণ, এই সকল চিন্তা মনে উদিত হইলে চপলার ব্যবহারের প্রতি অধিক দৃষ্টি পড়িল; সন্দেহ দৃঢ়তর হইল; পদে পদে মনে হইতে লাগিল,— চপলা তাহাকে ভালবাসে না, তাহার সকল কার্য্যে, ব্যবহারে স্বামীর প্রতি বিরক্তি প্রকাশ পায়; সে সে বিরক্তি গোপন করিবারও চেষ্টা করে না। নলিনবিহারীর জীবন যাতনাকাতর হইয়া উঠিল।

 নলিনবিহারী কয় দিন মনে করিল, চপলাকে একবার জিজ্ঞাসা করিবে—কেন সে তাহার প্রতি বিরক্ত হইয়াছে? কিন্তু সে বলি বলি করিয়া বলিতে পারিল না, কথা মুখে আসিয়া বাধিয়া গেল— পাছে চপলা সে কথায় ব্যথা পায়। হায় প্রেম! কিন্তু নদীর জল জমিতে জমিতে শেষে একদিন আপনার বেগে সব ভাসাইয়া বাহির হইয়া পড়ে। একদিন নলিনবিহারী আর পারিল না; বলিল, “চপলা, তুমি বিরক্ত হইয়াছ?”

 চপলার নয়নের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তীক্ষ্ণতর হইয়া উঠিল। সে বলিল, “কেন, এতদিন পরে সহসা আমার বিরক্তির কথা কেন?” সে স্বরে কোমলতা নাই।

 “অসুস্থ শরীরে আমি হয় ত আমার কর্তব্য পালন করিতে পারি না। কিছু মনে করিও না।”

 “কে সে জন্য তোমাকে কিছু বলিয়াছে? কে কাঁদিয়া তোমার সোহাগ যাচিয়াছে?” স্বর তীব্র।

 নলিনবিহারীর কণ্ঠ যেন বদ্ধ হইয়া আসিতেছিল। সে ব্যথিত হইল; বলিল, “চপলা, আমি কি করিলে তুমি সুখী হও?”

 চপলার ওষ্ঠাধর উপহাসব্যঞ্জক হাস্যে কুঞ্চিত হইল। সে বলিল, “কেন,—আজ সহসা আমার সুখাসুখের জন্য তুমি এত ব্যস্ত হইয়া উঠিলে কেন? এমন ত কখনও দেখি নাই। কেন, আজ কি পড়িবার বই সব ফুরাইয়া গিয়াছে?”

 চপলার চক্ষুতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তীক্ষ্ণতর হইয়া উঠিল। সে নলিনবিহারীর দিকে তীব্র কটাক্ষপাত করিল। নলিনবিহারীর চক্ষু তখন অশ্রুপ্লাবিত হইয়া উঠিতেছিল; সে সে কটাক্ষ লক্ষ্য করিতে পারিল না। নহিলে সে কটাক্ষ তীক্ষ্ণধার ছুরিকার মত তাহার ব্যথিত কাতর হৃদয় বিদ্ধ করিত।

 চপলা কক্ষ হইতে বাহির হইয়া যাইতেছিল। নলিনবিহারীর বক্ষ হইতে বেদনার উচ্ছ্বাস উচ্ছ্বসিত হইয়া যেন তাহার কণ্ঠরোধ করিতেছিল। সে বহুকষ্টে ভগ্নকণ্ঠে বলিল, “চপলা, আমি কবে তোমার সুখে অবহেলা করিয়াছি। তোমার সুখের জন্য—”

 চপলা ফিরিল না; উপেক্ষাভরে চলিয়া গেল।

 নলিনবিহারীর নয়নে অশ্রু উথলিয়া উঠিল। তাহার মাথা ঘুরিতে লাগিল,—যেন সংজ্ঞালোপ হইয়া আসিতে লাগিল।

 কিছুক্ষণ পরে যেন নলিনবিহারীর সংজ্ঞা ফিরিয়া আসিল; সে প্রকৃতিস্থ হইল! তখন সব ঘটনা যেন স্বপ্নবৎ প্রতীয়মান হইতে লাগিল। নলিনবিহারী কাঁদিল। কাঁদিয়া যখন হৃদয়ের বিষম যন্ত্রণাচাঞ্চল্য কিছু শান্ত হইল, তখন সে ভাবিতে লাগিল,—হায়! যে দরিদ্র উদরান্নসংস্থানের জন্য সমস্ত দিন শ্রম করে, কিন্তু জানে, সে সন্ধ্যায় শ্রান্তদেহে গৃহে ফিরিবে বলিয়া দুইটি নয়ন তাহার পথ চাহিয়া আছে; জানে, তাহার সুখে আর এক জন সুখী,আর এক জন তাহার দুঃখের অংশ লয়—সেও তাহার অপেক্ষা সুখী। সে দরিদ্র পত্নীর প্রেমসৌন্দর্য্যসুন্দর হৃদয়ে আপনার অবিচলিত আবাস সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ,—তাই সে সুখী। আর ঐশ্বর্য্যে যত্নে লালিত সে—দুঃখী। তাহার সুখ কোথায়;—সুখের আশা কোথায়? তাহার হৃদয়ের উপহার প্রেম প্রতিহত হইয়া তাহাকেই আঘাত করিল,—সে আঘাতের বেদনায় হৃদয় ব্যথিত হইল ।

 ঘনান্ধকারে বিদ্যুদ্বিকাশের মত সহসা নলিনবিহারীর মনে হইল, হয় ত অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতাই চপলার বিরক্তির কারণ। সে অনন্যকর্ম্মা হইয়া পাঠে ব্যস্ত,—সর্ব্বদাই গৃহে; তাই হয় ত অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতায় চপলার প্রেমপিপাসা উদ্রিক্ত হইবার পূর্ব্বেই পরিতৃপ্ত হইয়াছে। আবার সেই পিপাসার অভাবে,—অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতায় স্বামীর তুচ্ছ ত্রুটী সকল হয় ত চপলার দৃষ্টিতে পড়িয়াছে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়িল, চপলা বলিয়াছে, সে পুস্তক লইয়াই ব্যস্ত। নলিনবিহারী ভাবিতে লাগিল। সে ভাবনার অন্ত নাই ।

 পরদিন হইতে সকলে নলিনবিহারীর অভাবনীয় পরিবর্ত্তন লক্ষ্য করিল। তাহার কার্য্যে বা ব্যবহারে দারুণ পীড়ার নিবিড় ছায়া আর নাই—কেবল মুখে চিন্তার ছায়া নিবিড়তম।

 পিতার আফিসে কর্ম্মখালির সংবাদ পাইয়া নলিনবিহারী কর্ম্মপ্রার্থী হইল । কৃষ্ণনাথ যেন আকাশ হইতে পড়িলেন; বলিলেন, “সে কি কথা? তোর শরীর অসুস্থ; তোর চাকরী কি?” নলিনবিহারী জিদ করিতে লাগিল; কৃষ্ণনাথ সহজে সম্মত হয়েন না দেখিয়া বলিল, “আমি কায কর্ম্মের অনুপযুক্ত হই, ইহাই কি আপনার অভিপ্রেত? আপনি এ কর্ম্ম না দেন, আমি অন্যত্র কর্ম্মের যোগাড় করিব।”

 কৃষ্ণনাথ দুর্ব্বলচিত্ত; পুত্ত্রের এই কথা শুনিয়া ভাবিলেন, অন্যত্র কর্ম্ম করিলে গুরু শ্রম অনিবার্য্য, তাহার অপেক্ষা তাঁহার আফিসে থাকাই ভাল। এইরূপ বিবেচনা করিয়া তিনি নলিনবিহারীকে কর্ম্মে ব্রতী করিয়া দিলেন।

 অসাধারণ মানসিক বলে দারুণ দৈহিক দুর্ব্বলতা দলিত করিয়া নলিনবিহারী কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইল।

 সকলেই বিস্মিত হইলেন। মধ্যমা বধূ বলিলেন, “আমি তখনই জানি, অত বাড়াবাড়ি কিছুই নহে।”

 বড় বধূ জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে কি?”

 “পরীক্ষায় ভাল হয়, কি না হয়, তাই পূর্ব্ব হইতে একটা ছুতা করিয়া রাখা। দেখিতে ভালমানুষটির মত; যেন কেবল পড়াশুনা লইয়াই আছেন। ঠাকুরপো কি কম চালাক! আমি ও অনেক দিন হইতেই জানি।”

 বড় বধূ বলিলেন, “ছিঃ! অমন কথা বলিও না।”

 মধ্যমা বধূ বলিলেন, “দিদি, তোমাকে বুঝান মানুষের সাধ্য নহে। তুমি বুঝিয়াও বুঝিবে না।”

 চপলা মধ্যমা বধূর কথা শুনিতেছিল। তাহার বিস্ফারিত নয়নে অতি উজ্জ্বল দৃষ্টি, চঞ্চল হৃদয়ে দারুণ সন্দেহ ও বিষম চাঞ্চল্য।