নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/দ্বিতীয় খণ্ড/একাদশ পরিচ্ছেদ

একাদশ পরিচ্ছেদ।

নিষ্ঠুর সত্য।

কমল কলিকাতায় আসিল। প্রভাত রেলওয়ে-ষ্টেশনে ছিল। সে কমলকে দেখিয়া শঙ্কিতনেত্রে পিতৃব্যের দিকে চাহিল। যে কৃশতা দিনে দিনে তিলে তিলে বর্দ্ধিত হইয়াছিল, যাঁহারা কমলকে প্রত্যহ দেখিতেন, তাঁহাদের নিকট সে কৃশতার স্বরূপ স্বপ্রকাশ হয় নাই। প্রভাত প্রথম দর্শনে সে কৃশতা দেখিয়া শঙ্কিত হইল। সে সতীশচন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করিল, “কত দিন জ্বর হইয়াছে?” সতীশ সবিশেষ বলিল। প্রভাত সকলকে বাসায় লইয়া গেল।

 পরদিন প্রভাতেই ডাক্তার ডাকা হইল। ডাক্তার সমস্ত অবস্থার কথা শুনিলেন; বিশেষ পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন; কিন্তু কোনরূপ মত প্রকাশ করিলেন না। সতীশ ও প্রভাত উভয়েই জিজ্ঞাসা করিল, “কিরূপ দেখিলেন?”

 ডাক্তার বলিলেন, “আগামী কল্য আবার দেখিয়া বলিব।”

 সেই দিন মধ্যাহ্নে শোভা ননন্দাকে দেখিতে আসিল। শোভাকে পাইয়া কমলের যেন আর আনন্দ ধরে না। সে কেমন করিয়া তাহাকে যত্ন করিবে, স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছিল না। শোভা যত বলে, “ঠাকুরঝি, তুমি অসুস্থশরীরে ব্যস্ত হইও না। আমার জন্য ব্যস্ত কেন?” কমল ততই যেন ব্যস্ত হইয়া উঠে।

 শোভার বর্ষমাত্রবয়স্ক পুত্ত্র শচীকে কমল আদরে বিব্রত করিয়া তুলিল। এমন কি, সে সহজে নবীনচন্দ্রকেও শিশুকে লইতে দিতে সম্মত হইল না। শোভা বলিল, “ঠাকুরঝি, তোমার পরিশ্রম হইবে। তুমি উহাকে ক্রোড় হইতে নামাও।”

 কমল ভ্রাতুষ্পুত্ত্রে র মুখচুম্বন করিয়া বলিল, “শচীবাবুকে লইতে পরিশ্রম! শচীবাবু, আর মা’র কাছে যাইও না। চল, আমরা বাড়ী যাইব।”

 শোভা হাসিতে লাগিল।

 কমল বলিল, “বৌদিদি, কেবল হাসিলে হইবে না।, এবার আমি ছাড়িব না; তোমাকে আমাদের সঙ্গে বাড়ী যাইতে হইবে।”

 শোভা আবার হাসিল; বলিল, “এখন তুমি শীঘ্র শীঘ্র সারিয়া উঠ। সত্য, ঠাকুরঝি, তুমি বড় রোগা হইয়াছ।” সত্য সত্যই শোভার তখন শ্বশুরালয়ে যাইতে আপত্তি ছিল না; বরং একবার যাইতে —বহুদিনের জন্য হউক বা না হউক, কিছু দিনের জন্য যাইতে—তাহার একটু ইচ্ছা হইয়াছিল। কমল যদি রোগমুক্তা হইয়া ফিরিবার সময় তাহাকে জিদ করিয়া বলিত, তবে সে যাইত। কিন্তু তাহা হইবার নহে।

 প্রভাতের ও শোভার ব্যবহারে নবীনচন্দ্রের আনন্দ আর ধরে না! তাঁহার আশা হইল, এইবার মনোমালিন্যের সকল কারণ দূর হইয়া যাইবে; শিবচন্দ্র আসিয়া দেখিবেন, পুত্ত্র আবার স্নেহালিঙ্গনে ফিরিয়া আসিয়াছে; বধূ গৃহের লক্ষ্মী হইবে; পুত্ত্র, পুত্ত্রবধূ, পৌত্ত্র; গৃহ উজ্জ্বল করিবে। তিনি শোভাকে বলিলেন, “মা’! বুড়া ছেলেকে একবার কাঁদাইয়া ফিরাইয়াছ। এবার কিন্তু ছেলে আর শুনিবে না। মা’র ছেলে মা’কে লইয়া যাইবে;—সে আর মা’কে ছাড়িয়া যাইবে না।”

 শোভা লজ্জা পাইল।

 শচীকে কমল যখন ক্রোড় হইতে নামাইল, নবীনচন্দ্র তখনই তাহাকে অধিকার করিয়া লইলেন।

 সন্ধ্যার সময় শোভা বিদায় লইল। কমল বলিল, “বৌদিদি, আজ সমস্ত দিন তোমার নানা অসুবিধা হইয়াছে।”

 শোভা বলিল, “সে কি, ঠাকুরঝি? অমন কথা মনে করিও না।”

 “মনে করিয়া এক একবার আসিও।”

 “আসিব বৈ কি! সর্ব্বদাই আসিব।”

 কমল পুত্ত্রকে ডাকিয়া বলিল, “অমল, মামীমা’কে প্রণাম কর।” অমল শোভাকে প্রণাম করিল। শোভা তাহাকে আদর করিল; বলিল, “আমার সঙ্গে চল।”

 বালক সরিয়া আসিয়া জননীর অঞ্চল ধরিল।

 শোভা ননন্দাকে বিদ্রূপ করিয়া বলিল, “ঠাকুরঝি, ছেলে বুঝি বাপের দেখাদেখি তোমার আঁচল ছাড়িতে চাহে না?”

 কমলের একবার মনে হইল, বলে,— ছেলে যে দেশে আসিয়াছে, সেই দেশের আচার শিখিতেছে। কিন্তু তাহার মুখ ফুটিল না।

 “তবে—আসি,” বলিয়া শোভা বিদায় লইল।

নবীনচন্দ্র স্বয়ং ক্রোড়ে লইয়া শচীকে গাড়ীতে তুলিয়া দিয়া আসিলেন। সতীশ তাহার জন্য রাশীকৃত খেলিবার পুতুল দিয়া গেল।

 নবীনচন্দ্র প্রভাতকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুই যাইবি না?”

 প্রভাত বলিল, “না।”

 শোভা চলিয়া গেল। প্রভাত রহিল।

 প্রভাত সেই দিন পনর দিনের ছুটীর জন্য দরখাস্ত করিয়াছিল। কৃষ্ণনাথ মুৎসুদ্দি, সুতরাং ছুটীর জন্য চিন্তা ছিল না।

 ক্রমে যখন রাত্রি হইল, নবীনচন্দ্র তখন প্রভাতকে বলিলেন, “তবে তুই যা।”

 প্রভাত বলিল, “আমি থাকি।”

 নবীনচন্দ্র ভাবিলেন, একেবারে অধিক ভাল নহে। তিনি বলিলেন, “আজ আর থাকিয়া কি করিবি? কল্য প্রভাতে— ডাক্তার আসিবার পূর্ব্বে আসিস্।”

 সে দিন নবীনচন্দ্র হৃদয়ে অননুভূতপূর্ব্ব আনন্দ অনুভব করিলেন। তাঁহার দৃঢ় আশা হইল, এইবার সত্য সত্যই সকল, গোল মিটিয়া যাইবে। তিনি অন্ধকারে আলোকবিকাশের কল্পনা করিতে লাগিলেন। তিনি আপনি আপনাকে বুঝাইলেন, “আমরাই ভ্রান্ত। প্রভাত কি কখনও আমাদিগের বন্ধন ছিন্ন করিতে পারে? তাহা সম্ভব নহে।” হায়-সরল হৃদয়!

 পর দিন শোভা পুনরায় কমলকে দেখিতে যাইতে চাহিল। চপলা বিদ্রূপ করিয়া বলিল, “কি, ঠাকুরঝি, এবার যে দেখি, শ্বশুরবাড়ীর উপর বড় টান! কাল একবার গিয়াছিলে, আজ আবার ননন্দার জন্য প্রাণ পুড়িতেছে!”

 শোভা সে বিদ্রূপ বিদ্রূপ-রূপেই গ্রহণ করিল।

 মধ্যমা বধূ বলিলেন, “ঠাকুরঝি, তোমার শাশুড়ী আসিতেন, সে অন্য কথা হইত। এখন এ কুটুম্বের বাড়ী। প্রত্যহ যাইবে কেন? তাহা কি ভাল দেখাইবে?”

 শোভা ইতস্ততঃ করিল, —বিচলিত হইল। এক দিকে নবীনচন্দ্রের অপরিমেয় স্নেহ ও কমলের অসীম যত্ন মনে পড়িল। তখন যাইতে ইচ্ছা হইল। যাহারা অত অল্পে তুষ্ট হয়, তাহাদিগকে কি তুষ্ট না করিয়া থাকা যায়? অপর দিকে — মধ্যমা বধূর কথাও সত্য। কুটুম্বের বাড়ী প্রত্যহ যাওয়া কি ভাল? মধ্যমা বধূ ত তাহা ভাল বলেন নাই! শোভা ভাবিল; শেষে চপলার সহিত পরামর্শ করিল। চপলা বলিল, “মেজদিদির কথা ত সত্য; কুটুম্ববাড়ী প্রত্যহ না-ই যাইলে। গত কল্য ত গিয়াছিলে। আবার না হয় দুই চারি দিন পরে যাইও।”

 শোভা আবার ভাবিল। হৃদয়ে অনিশ্চয়তা দূর হইল না। কি করে? শেষে সে যাওয়া স্থগিত করিল; দাসীকে আদেশ দিল, “এখন যাইব না। শচীর পোষাক খুলিয়া দাও।”

 পোষাক পরিতেও যেমন, খুলিতেও শচীর তেমনই আপত্তি ছিল। সেই জন্য সে শৈশবে কষ্ট বা আপত্তি জানাইবার অস্ত্র ব্যবহার করিল,— কাঁদিতে লাগিল। শোভার মন একেই অনিশ্চয়তাহেতু ভাল ছিল না। সে পুত্ত্রে র ক্রন্দনে বিরক্ত হইয়া বলিল, “এমন বিষম জিদি ছেলে দেখি নাই।” সে পুত্ত্রকে তিরস্কার করিল,— ফলে পুত্ত্র দ্বিগুণ উৎসাহে ক্রন্দন করিতে লাগিল।

 সেই ক্রন্দনে শোভার জননী আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি দাসীকে শচীর পোষাক খুলিয়া দিতে দেখিয়া শোভাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “পোষাক খুলা হইতেছে কেন? এখন যাইবি না?”

 শোভা বলিল, “না।”

 “কেন? যাইতে ইচ্ছা হইয়াছে; গাড়ী তৈরী হইয়াছে। ঘুরিয়া আয়।”

 “না। আজ আর যাইব না।”

 শোভার জননী শচীকে কোলে লইয়া শান্ত করিতে লাগিলেন।

* * * *

 এ দিকে ডাক্তার আবার কমলকে দেখিলেন, দেখিয়া চিন্তিত হইলেন; পর দিন এক জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সহিত পরামর্শ করিবার ব্যবস্থা করিলেন।

 পর দিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও আসিলেন; বিশেষ করিয়া পরীক্ষা করিলেন, শেষে মত ব্যক্ত করিলেন—দ্রুত যক্ষ্মা।

 নবীনচন্দ্রের ও সতীশচন্দ্রের মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। শুনিয়া প্রভাতেরও চক্ষুতে জল আসিল।

 ডাক্তার উপদেশ দিলেন, চিকিৎসার ব্যবস্থা ত হইবেই, অধিকন্তু রোগিণীকে স্থানান্তরিত করিতে হইবে। নীলগিরি পর্ব্বতের বা সমুদ্রতীরবর্ত্তী ওয়ালটেয়ার সহরের জলবায়ু যক্ষ্মায় বিশেষ উপকারী। শীতকাল আসিতেছে, এখন ওয়ালটেয়ারে যাওয়াই ভাল;— বিশেষ যাইবারও সুবিধা, সুতরাং সেখানে যাওয়াই শ্রেয়ঃ।

 তাহাই স্থির হইল।

 যাইবার আয়োজন হইতে লাগিল।

 সংবাদ পাইয়া তিন দিনের মধ্যে গৃহে সব ব্যবস্থা করিয়া রাখিয়া উৎকণ্ঠিতা পিসীমা’কে ও বড় বধূকে লইয়া শিবচন্দ্র আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আর কি বিলম্ব সহে? সকলেই উৎকণ্ঠায় অধীর।

 ওয়ালটেয়ারে বাড়ী ভাড়া করিবার জন্য সতীশচন্দ্র চলিয়া গেল। চারি দিন পরে তাহার টেলিগ্রাম আসিল,—বাসা ভাড়া করা হইয়াছে।