নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/দ্বিতীয় খণ্ড/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

ছায়া।

যেমন নিকটে অন্য তাড়িতপ্রবাহ থাকিলে বিদ্যুৎ আপনি তাহা জানিয়া প্রবল হয়, তেমনই স্নেহের আকর্ষণে হৃদয় সহজেই আকৃষ্ট হয় তাই প্রভাত ক্রমে শ্বশুর পরিবারের প্রতি আকৃষ্ট হইতেছিল। সঙ্গে সঙ্গে শোভার পক্ষেও ধূলগ্রামে ঘর করিতে যাইবার কল্পনা সুদূরপরাহত হইয়া পড়িতেছিল।

 পরীক্ষা দিয়া প্রভাত গৃহে গেল। শোভার যাওয়া ঘটিল না।

 বৈশাখের রৌদ্রতপ্ত দীর্ঘ দ্বিপ্রহর;— বাতাস যেন অনলশিখা, তাহার স্পর্শ ক্লেশকর। আকাশে চাহিতে চক্ষু ক্লিষ্ট হয়। আহার,—উপবেশন,—শয়ন,— কিছুতেই সুখ নাই—দেহে যেন দৌর্বল্যকাতরতা; দেহের সমস্ত শক্তি যেন অবিরলধারায় বাহির হইয়া যাইতেছে। যাহার নিতান্ত আবশ্যক, সে ভিন্ন আর কেহ রৌদ্রতপ্ত রাজপথে বাহির হইতেছে না। রাজপথ প্রায় শূন্য।

 কৃষ্ণনাথের অন্তঃপুরে যে কক্ষে বধূত্রয়ের সহিত শোভা বসিয়াছিল, সে কক্ষে সকলেই যেন শ্রান্তা। বড় বধূ চপলাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ছোট ঠাকুরপো আজ কেমন?”

 গ্রীষ্মাগমে নলিনবিহারীর শিরঃপীড়া অত্যন্ত বৃদ্ধি পাইয়াছে। চিকিৎসকগণ নানা ঔষধের ব্যবস্থা করিতেছেন। “এক বিষয়ে সকল চিকিৎসক একমত,—কিছুকাল মানসিক শ্রমমাত্র করা হইবে না। আপাততঃ স্থানপরিবর্ত্তনে কিছু উপকার হইতে পারে, কিন্তু মানসিক শ্রম থাকিলে নিস্তেজ স্নায়ু সতেজ হইবে না। কিন্তু সেই মানসিক শ্রমবিরতিই নলিনবিহারীর পক্ষে অসম্ভব! তাহার হৃদয়ে যদি কোনও সখ থাকে, তবে সে পুস্তকের—যদি কিছুতে তাহার সুখ থাকে, তবে সে পত্নীর প্রতি প্রেমে ও পুস্তকের সাহচর্য্যে। মানসিক শ্রমবিরতির কথা কল্পনা করিলে, তাহার বহুদিনের চেষ্টায় সংগৃহীত ও সঞ্চিত পুস্তকরাশির মধ্যে বসিয়া তাহার চক্ষু ছল ছল করিত। প্রত্যেক পুস্তকের সহিত কত স্মৃতি বিজড়িত! সুখে, দুঃখে, সাফল্যে, অসাফল্যে, সম্পদে, বিপদে, গৌরবে, অপমানে সে সেই সকল পুস্তক পাঠ করিয়াছে;— সুখে সুখ শতগুণ বাড়িয়াছে, দুঃখে সে সান্ত্বনা পাইয়াছে; তাহাদের সাহচর্য্য-ত্যাগ কি তাহার পক্ষে সম্ভব?

 বড়বধূর কথার উত্তরে চপলা বলিল, “দেখিয়া বোধ হইল, খুব যন্ত্রণা হইতেছে। বড়দিদি, গত কল্য বড় ডাক্তারগণ কি বলিয়া গিয়াছেন?”

 বড়বধূ অপ্রিয় সত্য বলিতে ইতস্ততঃ করিতেছিলেন। মধ্যমা বধূ বলিলেন, “তাঁহারা বলিয়াছেন, অতিরিক্ত পরিশ্রমে মাথার কি সব খারাপ হইয়াছে; ভাল রক্ত যায় না। আমি ত কিছুই বুঝিতে পারিলাম না।”

 চপলা ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কি হইবে?”

 মধ্যমা বধূ বলিলেন, “তাঁহারা বলেন, লিখাপড়া একেবারে ছাড়িয়া দিলে শরীর ক্রমে সুস্থ হইতে পারে। রোগ একেবারে না সারুক, খুব কমিয়া যাইবে। সে কথা বলিয়া ত সকলে হার মানিয়াছে।”

 বড়বধূ বলিলেন, “পড়াশুনায় এমন মন প্রায় দেখা যায় না। চপলা, তুমি বিশেষ করিয়া ধর। শরীরের বড় ত আর কিছুই নহে!”

 শোভাও চপলাকে বলিল- “তুমি ভাল করিয়া বল। নহিলে হইবে না।

 চপলা কি বলিতে যাইতেছিল। মধ্যমা বধূ বলিলেন, “বলে, হাতী ঘোড়া গেল তল; ভেড়া বলে কত জল! চপলা বলিলে ত সব হইবে! পোড়া কপাল ভালবাসার; ছাই আর পাঁশ। আজ যদি চপলা মরে তবুও ঠাকুরপো বই লইয়া বেশ সুখে থাকিতে পারিবে। এমন আর দেখিও নাই, শুনিও নাই। লিখাপড়া ত অনেকেই করে। তাই বলিয়া কি স্ত্রীকে এমন তাচ্ছীল্য করে? ছিঃ! ছিঃ!”

 বড়বধূ ইঙ্গিত করিয়া নিষেধ করিলেন; কিন্তু সে নিষেধে কোনও ফল ফলিল না। মধ্যমা বধূ দ্রুত এত কথা বলিয়া যাইলেন। শুনিয়া বড়বধূ ও শোভা সবিস্ময়ে পরস্পরের দিকে চাহিলেন।

 অল্পক্ষণ পরেই কি একটা কাযের ছুতা করিয়া চপলা উঠিয়া গেল। সে চলিয়া যাইলে বড়বধূ মধ্যমাকে বলিলেন, “তুমি ভাল কায কর নাই। অমন কি বলিতে আছে?”

 তিনি বলিলেন, “কেন, আমি কি মিথ্যা কথা বলিয়াছি?”

 “সত্য হইলেও কি অমন করিয়া বলিতে হয়? আর, ভালবাসা সকলের কি একই রকমের হয়?”

 মধ্যমা বধূ বিদ্রূপের স্বরে বলিলেন, “নাঃ! রকম রকম হয়!”

 “ছোট ঠাকুরপো এখন পড়াশুনা লইয়া ব্যস্ত; যদি তাহাতে অধিক মন হয়, তবে সেই কি দোষের? অমন ধীর, নম্র, বিদ্বান ছেলে সচরাচর দেখা যায় না। এ কথা সকলেই বলে। কোন দিন মুখে একটি উচ্চ কথা নাই।”

 শোভা বলিল, “এমন কি ভৃত্যদিগকেও উচ্চ কথা কহেন না।”

 মধ্যমা বধূ আত্মপক্ষসমর্থনের চেষ্টা করিলেন।

 শোভা বলিল, “তুমি যাহাই বল, মেজ বৌদিদি, তোমার অমন করিয়া বলা ভাল হয় নাই।”

 বড়বধূ বুঝিতে পারেন নাই যে, নলিনবিহারীর যশই মধ্যমা বধূর বিচারে তাহার সকল দোষের মূল! জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সহিত নলিনবিহারীর বয়সের অনেক পার্থক্য, প্রায় দশ বৎসর। বিনোদবিহারীর সহিত কনিষ্ঠের বয়সে অল্প দিনের অনৈক্য। বিদ্যালয়ে কনিষ্ঠ বিনোদবিহারীকে পশ্চাতে ফেলিয়া গিয়াছিল; যশেও তাহাই হইয়াছে। তাহাই মধ্যমা বধুর অসহনীয়। তাই বলিয়াছি, বড়বধূ বুঝিতে পারেন নাই যে, নলিনবিহারীর যশই মধ্যমা বধুর বিচারে তাহার সকল দোষের মূল।

সে দিন আপনার ঘরে যাইয়া চপলা ভাবিতে বসিল। মধ্যমা বধূর কথাগুলি তাহার হৃদয়ে বিদ্ধ হইয়াছিল। বিষ শরীরে একবার প্রবেশ করিলে দেহের সকল শক্তি বিকৃত করিয়া ফেলে। চপলা ভাবিতে লাগিল,সত্যই কি সে এমন অভাগিনী যে, লোকে তাহাকে কৃপার পাত্র বিবেচনা করে? মেজদিদি বলিয়াছে, পোড়া কপাল ভালবাসার! সে মরিলেও তাহার স্বামীর দুঃখ হইবে না? ভাবিতে চপলার নয়নে জল আসিল। যে পথে তাহার পর্য্যবেক্ষণ চালিত হইল, সে পথে মধ্যমা বধূর স্বেচ্ছাকৃত সন্দেহের কুজ্ ঝটিকা ছিল তাই সবই কেমন বিকৃত দেখাইতে লাগিল। সত্যই ত নলিনবিহারী কোন দিন বাক্যের বা কার্য্যের আতিশয্যে আপনার প্রেম প্রকাশ করে নাই! তবে তাহা প্রেমহীনতার পরিচয়? নহিলে মেজদিদি অমন বলিবে কেন? বাত্যাবিক্ষুব্ধ হ্রদের জলরাশি যেমন মুহূর্ত্তে মুহূর্ত্তে বায়ুবেগে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হয়, চপলার বালিকাহৃদয় তেমনই একান্ত চঞ্চল হইয়া উঠিল।

 দিনের পর দিন যাইতে লাগিল। নলিনবিহারীর পীড়া ও বাড়িতে লাগিল; চপলার হৃদয়ে দুশ্চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে সন্দেহও বাড়িতে লাগিল। মধ্যমা বধূর কুটিল ইঙ্গিত তাহার সন্দেহানলে ইন্ধন যোগ করিতে লাগিল।

 এই সময় প্রভাতের পরীক্ষার ফল বাহির হইল,— প্রভাত এবারও অকৃতকার্য হইয়াছে। সংবাদ পাইয়া প্রভাত কলিকাতায় আসিল; আবার পড়িবে।

 কৃষ্ণনাথের আফিসে একটি ভাল কর্ম্ম খালি ছিল। তিনি প্রভাতের নিকট প্রস্তাব করিলেন, বাজার যেরূপ, তাহাতে ‘পাস’ করিয়াও যে সহসা বিশেষ কিছু হইবে, এমন সম্ভাবনা নাই। যদি সে ইচ্ছা করে, এই কার্য্যে ব্রতী হইতে পারে। তাঁহার আফিস;— তিনি কায শিখাইয়া লইবেন। বেতনও নিতান্ত অল্প নহে, আজকাল সহজে সেরূপ বেতনের কর্ম্ম জুটে না। কালে,—তিনি অবসর গ্রহণ করিলে—সে মুৎসুদ্দির কাযও পাইতে পারে। তাঁহার ইচ্ছা ছিল, ছেলেরা কেহ কার্য্যে প্রবেশ করে। কিন্তু সে ইচ্ছা পূর্ণ হইবার নহে। তাহারা কর্ম্মের অনুপযুক্ত।

 উপর্যুপরি দুইবার পরীক্ষায় বিফলমনোরথ হইয়া প্রভাত নিরাশ হইয়া পড়িতেছিল।—সে সম্মত হইল।

 প্রভাত কার্য্যে ব্রতী হইতে সম্মত হইয়া পিতাকে ও পিতৃব্যকে পত্র লিখিল। তাহার পত্র পাইয়া শিবচন্দ্র ভ্রাতাকে বলিলেন, “উন্নতি কবে হইবে, স্থির নাই। বর্ত্তমান বেতনে যে বাসাখরচ নির্ব্বাহ হওয়াই দুষ্কর! যদি আর পড়িতে না চাহে, বাড়ী ফিরিয়া আসিলেই ভাল হয়।”

 নবীনচন্দ্র প্রভাতকে লিখিলেন, “দাদার ও আমার শরীর ক্রমেই অপটু হইয়া পড়িতেছে। তোমার বাড়ী থাকা আবশ্যক হইতেছে। এখন হইতে সব বুঝিয়া লইলে ভাল হয়। আমরা অনেক দিন হইতে এ কথা মনে করিতেছি। পাছে তুমি মনে কর, তুমি পরীক্ষায় অকৃতকার্য্য হইয়াছ বলিয়া আমরা এ কথা বলিতেছি—এই জন্য এবারও তোমাকে বলি নাই। আমাদের মতে তুমি বাড়ী আসিলেই ভাল হয়।”

 যথাকালে প্রভাত এই পত্র পাইল। কিন্তু স্বাধীন ভাবে, জীবিকা-অর্জ্জনের কথা পড়িয়া ও ইংরাজী সমাজে তাহার গৌরবের বিবরণ দেখিয়া সে স্বাধীনভাবে জীবিকা–অর্জ্জনেই বদ্ধপরিকর হইয়াছিল; আগ্রহাতিশয়ে ভুলিয়া গিয়াছিল, গৃহে যাহা কিছু তাহারই, এবং তাহার রক্ষণ তাহার প্রথম ও প্রধান কর্ত্তব্য।

 নবীনচন্দ্র জ্যেষ্ঠকে বুঝাইলেন,— প্রথম ঝোঁক কিছু প্রবলই হয় কিছু দিন পরেই চাকরীর নেশা ছুটিয়া যাইবে।

 নবীনচন্দ্র বুঝাইলেন বটে, কিন্তু বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন শিবচন্দ্র তাহাই বুঝিলেন কি না সন্দেহ।

 প্রভাতের এ কার্য্যগ্রহণ বিষয়ে তাহার ও কৃষ্ণনাথের সম্মতি ছিল; আর কাহারও তাহা অভিপ্রেত ছিল না।

 চপলা শুনিয়া বলিল, “শুধু শুধু চাকরী করাই বা কেন?” গৃহিণী শুনিয়া কর্ত্তাকে বলিলেন, “লোকে কি ভাল বলিবে?”

 শুনিয়া কৃষ্ণনাথ কিছু বিরক্ত হইলেন। সকলেই তাঁহার মতের বিরোধী! তিনি বলিলেন, “তোমরা সব ঐ রূপ বুঝ। শ্যামাপ্রসন্ন বলে, ‘এক শত, দেড় শত টাকা বেতন পায়, এমন ছেলে ত কলিকাতাতেও অনেক জুটিল: তাহার জন্য পল্লীগ্রামে যাইবার আবশ্যক ছিল না।’ এখনকার দিনে এক শত দেড় শত টাকা বেতন কি সহজ কথা? হাকিম বৎসরে কয়টা হয়? হইলেই বা কি বেতন? মরিবার সময় পাঁচ শত। উকীল এখন কুড়ি টাকায় চারি গণ্ডা। আমি বসাইয়া দিয়া যাইতে পারিলে তাহার অধিক উপার্জ্জন করিতে পারিবে। তোমার ছেলেদের একটারও ত সে ক্ষমতা হইল না! কেবল খরচ করিতে পারেন। প্রভাত ত ভাল ছেলে।” গৃহিণী নলিনবিহারীর অসুস্থতার ওজর করিলেন। কৃষ্ণনাথ বলিলেন, “আর দুই জন? আমি মুখে রক্ত তুলিয়া যাহা করিলাম, তাহা রাখিয়া খাইবার ক্ষমতা হইলেই বাঁচি।”

 গৃহিণী পুনরায় বলিলেন, “বাপকে জিজ্ঞাসা করিয়াছে ত? পরের ছেলে;—তাহারা কি বলে—” কৃষ্ণনাথ বাধা দিয়া বলিলেন, “বলাবলি আর কি? তাঁহাদের ক্ষমতা হয়, ভাল কায করিয়া দিবেন। কর্ম্ম কায পথে পড়িয়া আছে কি না; কুড়াইয়া লইলেই হইল! চাকরী তত সুলভ নহে।”

 কৃষ্ণনাথ কিছু উত্তেজিত হইয়াই কথাগুলা বলিয়াছিলেন। নহিলে সচরাচর তিনি এমন কথা বলেন না। উত্তেজনা-হেতু কণ্ঠস্বরও কিছু উচ্চ হইয়াছিল। শোভা পার্শ্বের কক্ষে ছিল। সে সব শুনিতে পাইল।

 পিতার সেই কথা শোভার কর্ণে ধ্বনিত হইতে লাগিল,— “শ্যামাপ্রসন্নও বলে, ‘এক শত, দেড় শত টাকা বেতন পায়, এমন ছেলে ত কলিকাতাতেও অনেক জুটিত; তাহার জন্য পল্লীগ্রামে যাইবার আবশ্যক ছিল না’।” চপলাও শুনিয়া বলিয়াছে,— “শুধু শুধু চাকরী করাই বা কেন?”

 কৃষ্ণনাথ প্রস্তাব করিলেন, প্রভাতের পক্ষে আর বৃথা ছাত্রবাসে থাকা অনাবশ্যক। কিন্তু জামাতা গৃহে থাকে, তাহা গৃহিণীর ইচ্ছা ছিল না। কারণ, তাহাতে জামাতার আদর থাকে না। শোভারও তাহাতে মত ছিল না। প্রভাতও এক কথায় সম্মত হইল না। কিন্তু ছাত্রাবাসেও আর তাহার সুবিধা হইত না। তাহার সময়ের ছাত্রাবাসবাসীরা প্রায়ই পাঠ শেষ করিয়া গিয়াছে; এখন নুতন দল আসিয়াছে। কিন্তু পিতা কি মনে করিবেন? শেষে সে ছাত্রাবাসে একটি ঘর রাখিল। অবস্থান প্রায় শ্বশুরালয়েই হইতে লাগিল।