নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/দ্বিতীয় খণ্ড/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

কন্যা!

আষাঢ়ের অপরাহ্ন। নিশাবসান হইতে আকাশ যেন ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। মধ্যাহ্ন পর্যন্ত বর্ষণের আর বিশ্রাম ছিল না। এখনও বর্ষণ শেষ হয় নাই - প্রশমিতবেগ হইয়াছে মাত্র। এখনও পথিপার্শ্বে পয়ঃপ্রণালীপথে আবিল জলধারা শুষ্কবংশপত্র ও তৃণাদি ভাসাইয়া লইয়া বহিয়া যাইতেছে । খাল, বিল, পল্বল— পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। আকাশে দিবালোক ম্লান, রবির কিরণগোলক দৃষ্টিগোচর হয় ন।! এখন আকাশ জুড়িয়া মেঘ; —কোথাও ধূসর, কোথাও নিতান্তনীলোৎপলপত্রকান্তি, কোথাও প্রভিন্ন অঞ্জন তুল্য, মেঘ মেঘের উপর দিয়া নিঃশব্দে ভাসিয়া যাইতেছে, বারি বর্ষণ করিতেছে, লঘু হইয়া পবনের সহিত ক্রীড়া করিতে করিতে যাইতেছে। চারি দিকে ভেকের আনন্দকোলাহল। সতীশচন্দ্রের গৃহের সম্মুখে, পথের অপর পারে বৃহৎ কদম্ববৃক্ষ কুসুমসম্পদে সম্পদশালী হইয়াছে; গৃহপ্রাঙ্গনে কুটজশিশুও কুসুমে পূর্ণ।

 কমল শাশুড়ীকে বলিল, “মা, বেলা পড়িয়া আসিল। আজ যে আর বৃষ্টি ধরে, এমন বোধ হয় না। চল, ঘাট হইতে আসি।”

 শাশুড়ী বলিলেন, “আজ তোমার ঘাটে যাইয়া কায নাই। তুমি অমলকে রাখ; আমি আসি।”

 “কেন, আমার কি হইয়াছে, মা?”

 “মা, তোমার শরীর যে পারিতেছে না। এখনও সারিয়া উঠিতে পার নাই। আবার কয় দিন হইতে একটু একটু কাশিও দেখিতেছি।”

 “আমার কোনও অসুখ নাই। তোমরা মিছামিছি ভয় পাও।”

 মা হাসিয়া বলিলেন, “অসুখ না থাকিলেই বাঁচি। মা লক্ষ্মী, তুমি এক দিন পড়িলে কি সংসার চলে? তুমিই সংসার রাখিয়াছ।” পৌত্ত্রে র দিকে ফিরিয়া তিনি বলিলেন, “কি বল, খোকাবাবু?”

 খোকাবাবু তখন একটি কাষ্ঠনির্ম্মিত অশ্বকে কাগজের তৃণ ভোজন করাইতে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি পিতামহীর কথায় কর্ণপাত করিলেন না। কিন্তু পিতামহী কক্ষত্যাগের উদ্যোগ করিবামাত্র তিনি তাহাতে ঘোর আপত্তি জ্ঞাপন করিলেন; এমন কি, অশ্ব তৃণ, সব ত্যাগ করিয়া পিতামহীর অঞ্চল ধারণ করিলেন। তখন পিতামহী তাহাকে অঙ্কে তুলিয়া লইলেন, তাঁহার মুখচুম্বন করিলেন, এবং সর্ব্বশেষে তাঁহাকে একটি পুতুল দিয়া জননীর নিকট থাকিতে সম্মত করিয়া গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত করিলেন।

 কমল পুত্রকে ভুলাইয়া রাখিল। কয় মাস পূর্ব্বে কমলের সন্তান-সম্ভাবনা হইয়াছিল। জ্যৈষ্ঠমাসের মধ্যভাগে দুর্ঘটনা ঘটিবার পর হইতে কমল শরীর আর পূর্ব্বের স্বাস্থ্য ফিরিয়া পায় নাই। স্নেহশীলা মা তাহাতে চিন্তিতা হইয়াছিলেন। সতীশচন্দ্র সে জন্য বিশেষ উৎকণ্ঠিত ছিল। মাতাপুত্ত্রে সর্ব্বদা কমলকে সাবধানে রাখিতে চেষ্টা করিতেন। সে অধিক কার্য করিতে যাইলে মা বাধা দিতেন।

 মা যাইবার অল্পক্ষণ পরেই সতীশচন্দ্র অন্তঃপুরে আসিয়া ডাকিল, “মা!”

 কমল বলিল, “মা ঘাটে গিয়াছেন। কি চাহি?”

 “তোমাকে যাইতে বারণ করিতে আসিয়াছি।”

 “সে আর মা’কে বলিয়া দিতে হইবে না।”

 সতীশ আদর করিয়া পত্নীর গণ্ডে অঙ্গুলিস্পর্শ করিল; বলিল, “গরম জামা পর নাই কেন?”

 কমল বলিল, “কেন, আমার কি হইয়াছে? তোমরাই ‘অসুখ’—‘অসুখ’ করিয়া আমাকে রোগী করিবে।”

 সতীশ পত্নীর মুখচুম্বন করিল, বলিল,—“না, তোমার কোনও অসুখ নাই। আমি বলিতেছি, তাই একটা গরম জামা পর।

 “আচ্ছা, পরিব।”

 “‘আচ্ছা, পরিব’—বলিলে আমি শুনি না। আমি অমলকে দেখিতেছি। তুমি যাও, গরম জামা পরিয়া আইস।”

 “কি ব্যস্ত মানুষ! কথা বলিলে আর বিলম্ব সহে না!”

 কমল স্বামীর আদেশপালন করিতে গেল। যে সত্য সত্যই ভালবাসে, সে যদি ভালবাসা-জাত ভিত্তিহীন আশঙ্কা বশতঃও কোনও অন্যায় আদেশ করে, তবুও হৃদয় সে আদেশ-পালনে সুখ পায়।

 কমল ফিরিয়া আসিয়া বসিল। সতীশচন্দ্র পুত্ত্রের সহিত খেলা করিতেছিল। সেও বসিল। কমল জিজ্ঞাসা করিল, “আসন পাতিয়া দিব?”

 সতীশ বলিল, “না।”

 তাহার পর স্বামী স্ত্রীতে কত কথা হইতে লাগিল। সে সব কথা সাংসারিক হিসাবে অনাবশ্যক; কিন্তু প্রেমের হিসাবে অত্যাবশক। তাহার মধ্যে কত বিদ্রূপ, কত রহস্য—তাহাতে কত আনন্দ,—কত সুখ!

 দেখিতে দেখিতে সময় কাটিয়া গেল। মা ঘাট হইতে ফিরিয়া আসিলেন। শাশুড়ীর পদধ্বনি শুনিয়াই কমল কক্ষান্তরে যাইতেছিল । মা বলিলেন, “বৌমা, সতীশকে খাবার দাও।”

 সতীশ জননীকে বলিল, “মা, এ বাদলায় না হয় ঘাটে না-ই যাইতে?”

 মা বলিলেন, “সতীশ, বৌমা কিন্তু যাইতে চাহিতেছিল। দুষ্ট মেয়ে কিছুতেই সাবধান থাকিতে চাহে না। শরীর ত সুস্থ হইতেছে না। আবার আজ কয় দিন হইতে কাশি হইয়াছে। তুই কল্যই একবার ডাক্তারকে আনা।”

 সতীশ বলিল, “আচ্ছা।”

 সতীশ আহার করিয়া যাইলে কমল শাশুড়ীর সহিত খুব ঝগড়া করিল,—“কেন, আমার কি হইয়াছে? ”

 মা বলিলেন, “মা, শরীর যে শোধরাইতেছে না।”

 কমল বলিল, “মা, তোমার বৃথা ভয়।”

 পরদিন গ্রামের ডাক্তার আসিলেন। তিনি নাড়ীতে জ্বর পাইলেন না; রোগের স্বরূপনির্ণয়ে অসমর্থ হইয়া অগত্যা বলকারক ঔষধের ব্যবস্থা করিলেন। রোগী দেখিলে ঔষধের ব্যবস্থা করা রীতি।

 ইহার কয় দিন পরেই কমলের স্পষ্ট জ্বর প্রকাশ পাইল। সতীশ ব্যস্ত হইয়া পড়িল। মা চিন্তিতা হইয়া শিবচন্দ্রকে ও নবীনচন্দ্রকে সংবাদ দিলেন; তাঁহাদিগকে বলিলেন, “গ্রামের ডাক্তারকে ত দেখান হইয়াছে। আমার ইচ্ছা, একবার কলিকাতায় লইয়া যাইয়া ভাল ডাক্তার দেখাইয়া আনা হয়। শরীর শোধরাইতেছে না।

 সকলেরই সেই মত হইল। স্থির হইল, চিকিৎসা সম্বন্ধে সুচিকিৎসকের পরামর্শ লইবার জন্য পক্ষকালের জন্য কমলকে কলিকাতায় লইয়া যাওয়া হইবে।”

 কমল আপত্তি করিয়া বলিল, “আমার কোনও অসুখ নাই। ”

 শিবচন্দ্র হাসিয়া বলিলেন, “মা, না হয় আমি, নবীন, অমল–তিন ছেলে বেড়াইতে যাইব। মা কি ছেলেদের ছাড়িয়া থাকিতে পারিবে?”

 নবীনচন্দ্র প্রভাতকে বাড়ী ভাড়া করিতে লিখিয়া দিলেন।

 শুনিয়া পিসীমা বলিলেন, তিনি ও বড়বধূ সঙ্গে যাইবেন,— গঙ্গাস্নান করিয়া আসিবেন। পিসীমা’র যাইতে চাহিবার প্রধান কারণ,—কয় মাস প্রভাতকে ও শোভাকে দেখেন নাই।

 শেষে তাহাই স্থির হইল;— সকলেই যাইবেন, এবং এক পক্ষ কাল সেথায় থাকিয়া কমলকে ডাক্তার দেখাইয়া ফিরিয়া আসিবেন।

 গ্রামের ডাক্তারের চিকিৎসায় ও বিশেষ সতর্কতায় কমলের জ্বর কয় দিনেই বন্ধ হইল।