নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/দ্বিতীয় খণ্ড/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

পুত্র।

কমলকে লইয়া সকলে কলিকাতায় আসিলেন। প্রভাত বাড়ী ভাড়া করিয়া রাখিয়াছিল। সে ছাত্রাবাসে আপনার কক্ষটিও ঝাড়িয়া, গুছাইয়া রাখিয়াছিল। কিন্তু শিবচন্দ্রের জানিতে বিলম্ব হইল না যে, পুত্ত্রের ছাত্রাবাসে বাস নামমাত্র। তিনি বিরক্ত হইলেন। পূর্ব্বে নবীনচন্দ্র প্রভাতকে যাহা লিখিয়াছিলেন, এবার শিবচন্দ্র স্বয়ং পুত্ত্র কে তাহা বলিলেন। তিনি বলিলেন,— তাঁহার শরীর ক্রমে অপটু হইয়া পড়িতেছে, সে দেশে যাইলে ভাল হয়। প্রভাত স্পষ্ট “না” বলিতে পারিল না; তবে ভাবে শিবচন্দ্র বুঝিলেন, তাহার কর্ম্মত্যাগ করিবার ইচ্ছা নাই। তখন তিনি বলিলেন, “যদি এখানে থাকিতেই হয়, তুমি বাসা কর। ছাত্রাবাসে থাকা ভাল দেখায় না।” প্রভাত সম্মত হইল। শিবচন্দ্র বৈবাহিককেও এ কথা বলিলেন। কৃষ্ণনাথ বলিলেন,“এ দুইটা মাস যাউক। তাহার পর যাঁহা স্থির করেন হইবে। এখন একা এক বাসায় থাকা—” শিবচন্দ্র ইহাতে আর আপত্তি করিতে পারিলেন না।

 ধূলগ্রাম হইতে সকলে কলিকাতায় আসিবার পর দিনই কৃষ্ণনাথের পত্নী বৈবাহিকাদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিলেন। শোভা সঙ্গে আসিল। তাঁহারা যাইবেন শুনিয়া চপলা সঙ্গে যাইবার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিল। গৃহিণী তাহাতে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন, যাতায়াতেই কুটুম কুটুম্বিতা বাড়ে। তিনি বুঝিতে পারেন নাই যে, চপলা অদ্ভুত জীব দেখিবার আশায়—কৌতূহলবশে যাইতে চাহিয়াছিল। তিনি তাহাকে সঙ্গে লইলেন।

 বৈবাহিকার ব্যবহারে অল্পে তুষ্টা পিসীমা বিশেষ সন্তুষ্ট হইলেন। কিন্তু বধূকে পাখা করিবার জন্য যে এক জন দাসী পাখা লইয়া আসিয়াছিল, সেটা পিসীমা’র কাছেও ভাল লাগিল না। পিসীমা বধূকে কত আদর করিলেন; আপনি পাখা লইয়া তাহাকে ব্যজন করিলেন। কমল অজস্র যত্নে যেন তাহাকে প্লাবিত করিয়া দিল। কমলের শাশুড়ীর পক্ষেও আদরের ত্রুটী হইল না। কন্যার এইরূপ আদর দেখিয়া গৃহিণীর হৃদয় আনন্দে পূর্ণ হইয়া উঠিল।

 চপলা কিন্তু নবাগতাদিগের কথার উচ্চারণে ও ব্যবহারে নূতনত্ব লক্ষ্য করিতেছিল, এবং লক্ষ্য করিয়া অবগুণ্ঠনের মধ্য মৃ মৃদু হাসিতেছিল। শিবচন্দ্রের পত্নীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাহা লক্ষ্য করিয়াছিল। তাই তাঁহার মুখ গম্ভীর।

 গৃহে ফিরিয়া গৃহিণী কুটুম্বদিগের অশেষ প্রশংসা করিলেন; সকলকে কন্যার সৌভাগ্যের কথা বিশেষ করিয়া বলিলেন। এ দিকে চপলা তাহার লক্ষিত উচ্চারণের ও ব্যবহারের যে অভিনয় করিল, তাহা মধ্যমা বধূর মুখরোচক বোধ হইলেও, বড় বধূর ভাল বোধ হইল না। শোভা তাহাতে সন্তুষ্ট হইল না। নলিনবিহারী সে অভিনয়ের বিষয় অবগত হইয়া বিরক্তি প্রকাশ করিল; বলিল,—“এরূপ ব্যবহার শোভন নহে। মানুষমাত্রেরই বিশেষত্ব আছে। বিশেষত্ব তোমারও আছে, আমারও আছে। তাহা লইয়া কেহ বিদ্রূপ করিলে কি আমাদের ভাল লাগে? তাঁহারা পূজ্য। আর ওরূপ করিও না।” চপলা, ইহাতে আপনাকে অপমানিতা বিবেচনা করিল।

 পিসীমা কালীঘাটে যাইবার উদ্যোগ করিলেন। কৃষ্ণনাথের পত্নী তাঁহার সহগামিনী হইলেন। তাঁহার ব্যবহারে পিসীমা ও প্রভাতের জননী বিশেষ তুষ্ট হইলেন। তিনি কয় দিন আসিবার পর তাঁহার পুনঃ পুনঃ অনুরোধে পিসীমা ও প্রভাতের জননী একদিন কমলকে লইয়া কৃষ্ণনাথের গৃহে গমন করিলেন।

 সে দিন শোভা সযত্নে তাঁহাদের সেবা করিল। বড় বধূর ব্যবহারে সকলেই প্রীত হইলেন। কিন্তু মধ্যমা বধূর ও চপলার ব্যবহারে বিরক্তি ও বিদ্রূপ যেন ফুটিয়া বাহির হইতে লাগিল। তাহা পিসীমা লক্ষ্য করিতে পারিলেন না সত্য, কিন্তু প্রভাতের জননী তাহা লক্ষ্য করিলেন। তিনি ইহাতে যেমন বিস্মিত, তেমনই বিরক্ত হইলেন। সহরের মেয়েরা কি কুটুম্বের সহিত এইরূপ ব্যবহার করে?

 স্বামীর হৃদয়ের সন্দেহের ছায়া পত্নীকেও স্পর্শ করিয়াছিল। তাই প্রভাতের জননীরও যন্ত্রণা। সেই পুত্ত্রেই তাঁহার সব আশা;- সেই পরিবারের সর্ব্বস্ব। তাহার সামান্য দুর্ব্যবহারে তাঁহার যাতনা। পুত্ত্র জননীর সকল আশার কেন্দ্র। সেই জন্যই পুত্ত্রের সামান্য দুর্ব্যবহারে জননীর হৃদয় ব্যথিত হয়। বিশেষ, সে বেদনা ফুটিবার নহে; তাহা তুষানলের মত অহরহঃ হৃদয় দগ্ধ করে।

 প্রধান প্রধান চিকিৎসক ডাকাইয়া কমলকে দেখান হইল। কেহ কোনও রোগ স্থির করিতে পারিলেন না। শরীর যথেষ্ট সবল নহে,— এই পর্যন্ত। কয় দিন পরীক্ষার পর স্থির হইল,ফুসফুসও যথেষ্ট সবল নহে। এখনও কোনরূপ বিকৃতি সূচিত হয় নাই; সাবধানে থাকিলে দৌর্ব্বল্য দূর হইতে পারে। তবে সাবধান থাকা আবশ্যক। কিন্তু এক্ষণে সহরের ধুলিধূমসমাচ্ছন্ন বায়ু স্বাস্থ্যের পক্ষে অনুকূল নহে; এবং পল্লীগ্রামের নির্ম্মল বায়ুতে উপকার হইবে। দুর্ভাবনার ঘনান্ধকার কাটিয়া আশার অরুণকিরণবিকাশসূচনা দেখা গেল। সকলেই সুখী হইলেন। গৃহে ফিরিবার উদ্যোগ হইতে লাগিল।

 পিসীমা’র ও নবীনচন্দ্রের প্রস্তাবে শোভা কয় দিন তাঁহাদের নিকটে ছিল। তাহার জননী জিদ কবিয়া তাহাকে পাঠাইয়াছিলেন। সেই কয় দিনের আদর যত্নে তাহার হৃদয় কোমল হইয়া আসিয়াছিল, এবং তাহার ব্যবহারে কেহ নিন্দনীয় কিছু লক্ষ্য করিতে পারেন নাই। এই সময় সকলের গৃহে ফিরিবার উদ্যোগ হইল।

 বধূর সাধ দিয়া সকলে ধুলগ্রামে ফিরিলেন। যাইবার সময় পিসীমা শোভাকে আদর করিয়া পুনঃপুনঃ বলিয়া যাইলেন, “মা, আশ্বিন মাসে বাড়ী যাইতে হইবে। ঘর আঁধার হইয়া আছে। তুমি না যাইলে কি হয়?”, প্রভাতের জননীও বধূকে সেই কথা বলিলেন। কমল বলিল, “বৌদিদি, আশ্বিন মাসে যাইবে ত?” শোভা কোনও স্থির উত্তর দিতে পারিল না।

 এ কয় দিন প্রভাত যে পিতার নিকটে ছিল, তাহা বলাই বাহুল্য। তাহার ব্যবহারে নবীনচন্দ্রের হৃদয়ের প্রান্তস্থিত আশঙ্কার অতি সামান্য অন্ধকার দূর হইয়া গেল। কিন্তু লোকচরিত্রবিষয়ে বিশেষজ্ঞ শিবচন্দ্রের সন্দেহ দূর হইল না। তিনি জানিতেন, পুত্ত্র স্বভাবতঃ মন্দ নহে; তাহার একমাত্র দুর্ব্বলতা,— সে চঞ্চলচিত্ত,—অব্যবস্থিতচিত্ত। সে যখন যে প্রভাবে পড়ে, তখন সেইরূপ হয়। তিনি বুঝিয়াছিলেন, সে জন্মাবধি যে প্রভাবে গঠিত ও বর্দ্ধিত, সে প্রভাব তাহার হৃদয়ে পুনরায় সংস্থাপিত করা,—তাহাকে পুনরায় সেই পরিচিত—পুরাতন প্রভাত করিয়া তুলা অসম্ভব নহে। সে জন্য কেবল তাহাকে অন্য সকল প্রভাব হইতে মুক্ত করিয়া পুনরায় সেই পুরাতন পথে লইয়া যাওয়া আবশ্যক। কিন্তু যে গৃহের প্রভাব সহজে অতিক্রম করিতে পারিয়াছে, তাহার হৃদয়ে সহজে কোনও প্রভাবের স্থায়িত্বের আশা করা সুবুদ্ধির কার্য্য নহে। এ বারের এ প্রভাব অতি সামান্য; ―তাঁহারা যাইতে না যাইতে সূর্য্যোদয়ে তমোরাশির মত দূর হইয়া যাইবে।

 সেই কথা বুঝিয়াই শিবচন্দ্র পুত্ত্রকে নিকটে লইয়া যাইবার জন্য ইচ্ছুক হইয়াছিলেন। তিনি যদি সে কথা স্পষ্ট করিয়া নবীনচন্দ্রকে বলিতেন, তবে নবীনচন্দ্র তাঁহার ইচ্ছানুরূপ কার্য্য করাইতেন। তিনি যদি স্বয়ং দৃঢ়ভাবে চঞ্চলচিত্ত পুত্ত্র কে বলিতেন, “তোমার আর এখানে থাকা নিষ্প্রয়োজন। তুমি চল; দেশে থাকিতে হইবে।”—তাহা হইলে পুত্ত্র অসম্মতি জ্ঞাপনে সাহসী হইত না। কিন্তু যে দুর্জ্জয় অভিমানে তিনি পুত্ত্রকে লিখিয়াছিলেন,- “তুমি বড় হইয়াছ। তোমার হিতাহিত তুমি বুঝিতে পার। এখন আর তোমার কার্য্য বা কর্ত্তব্য সম্বন্ধে আমার অনুমতি বা উপদেশ অনাবশ্যক।” এবারও পুত্ত্র এক কথায় কর্ম্মত্যাগ করিয়া তাঁহার সহিত যাইতে চাহে নাই বলিয়া তাঁহার হৃদয়ে সেই অভিমান প্রবল হইয়া উঠিল। সেই জন্য তিনি আর জিদ করিয়া তাহাকে যাইতে বলিলেন না।

 মাহেন্দ্রক্ষণ কাটিয়া গেল;—যে সুযোগ আপনা হইতে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল, সে সুযোগ ব্যর্থ হইল।

 শিবচন্দ্র দেশে ফিরিলেন।—হৃদয়ের ভার অপনীত হইল না।

 প্রভাত কলিকাতায় রহিল।