নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/দ্বিতীয় খণ্ড/সপ্তম পরিচ্ছেদ
সপ্তম পরিচ্ছেদ।
সূচনা।
শ্রাবণের শেষে প্রভাতের একটি পুত্ত্র হইল। ধূলগ্রামে দত্তগৃহে আনন্দের আর সীমা রহিল না। প্রায় বিশ বৎসর পরে গৃহে সন্তানের আবির্ভাব। সকলেরই হৃদয় আনন্দে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। শিবচন্দ্রও পৌত্ত্রকে দেখিবার জন্য ব্যগ্র হইলেন; এক মাস না যাইতেই স্বয়ং নবীনচন্দ্রকে বলিলেন, “নবীন, বধূমাতাকে কবে আনা যায়?
প্রভাতের পুত্ত্র কে দেখিবার জন্য নবীনচন্দ্রের ব্যাকুলতা জ্যেষ্ঠের ব্যাকুলতাকে পরাভূত করিয়াছিল। তিনি বলিলেন, “ভাল দিন দেখুন দেখি।”
শিবচন্দ্র হাসিয়া বলিলেন, “আজই ব্যস্ত হইয়া দিন দেখিয়া কি হইবে? আশ্বিন মাসের পূর্ব্বে ত আসা হইবে না।”
“তার আর কয় দিন আছে? এখনই লিখিয়া দেওয়া যাউক।”
শিবচন্দ্র সেই প্রস্তাব করিয়া কৃষ্ণনাথকে পত্র লিখিলেন। নবীনচন্দ্র প্রভাতকে সে কথা লিখিলেন।
এই পত্রের কথায় কৃষ্ণনাথের পত্নী কিছু বিপন্না হইলেন। তিনি বিলক্ষণ বুঝিতেন, কন্যাকে শ্বশুরালয়ে প্রেরণ করাই কর্তব্য। শ্বশুরালয়ে তাহার আদর যত্ন দেখিয়া তিনি উল্লাসে উৎফুল্ল হইয়াছিলেন। কৃষ্ণনাথ যখন আগ্রহ করিয়া জামাতাকে তাঁহার গৃহে থাকিতে বলেন, গৃহিণী তখন তাহার প্রতিবাদ করিয়াছিলেন। তিনি জানিতেন, কন্যা কখনও নিকটে থাকে না; এখন হইতে তাহাকে শ্বশুরালয়ে প্রেরণ করাই কর্তব্য। কিন্তু এবার কন্যা ‘ঘর করিতে’ যাইবে; শ্বশুরালয়ে বাস করিতে যাইবে,—তাই মাতৃহৃদয়ে বিচ্ছেদের আশঙ্কা কর্তব্যবুদ্ধিকে নিষ্প্রভ করিতে লাগিল। বিশেষ প্রসবের অল্পদিন পরে কন্যা শ্বশুরালয়ে যাইবে,—এখনও তাহার শরীর দুর্ব্বল । তিনি ভুলিয়া যাইলেন, সে কেবল তাঁহারই কন্যা নহে, পরন্তু সেই দূর পল্লীভবনেও দুই জন রমণী তাঁহার সেই কন্যার জন্য হৃদয়ের সঞ্চিত স্নেহ লইয়া অপেক্ষা করিতেছেন,— তাহারা তাহাকেই সৌন্দর্য্য, নয়নের আনন্দ ও হৃদয়ের তৃপ্তি করিতে প্রয়াসী; ভুলিলেন, শিবচন্দ্র শিশু পৌত্ত্রের দর্শন জন্য ব্যগ্র; বুঝিলেন না, স্নেহশীল নবীনচন্দ্রের হৃদয়ে আর বিলম্ব সহিতেছে না।
গৃহিণীর এই ভাবই কৃষ্ণনাথের পক্ষে যথেষ্ট হইল। কন্যাকে শ্বশুরালয়ে না পাঠাইবার সম্বন্ধে তিনি কখনও গৃহিণীর সহানুভূতি প্রাপ্ত হয়েন নাই; সুতরাং তাঁহার এই অস্থিরতাই যথেষ্ট বিবেচনা করিয়া শিবচন্দ্রকে লিখিলেন, প্রসূতিকে এত অল্প দিনে স্থানান্তরিত করা কর্ত্তব্য নহে। বিশেষ শরৎকালে পল্লীগ্রাম স্বাস্থ্যকর নহে। এই দুই কারণে চিকিৎসকগণ এখন শোভাকে পাঠাইতে নিষেধ করিতেছেন। তিনি প্রভাতকেও তাহাই বুঝাইলেন। শোভার ও শিশুর শরীর অসুস্থ হইবার আশঙ্কায় প্রভাতও মনে করিল, এখন না যাইলেই বা ক্ষতি কি? না হয় কিছুদিন পরেই যাইবে। শিবচন্দ্রের বিশ্বাস সম্পূর্ণ সত্য। অব্যবস্থিতচিত্ত পুত্ত্র যখন যে প্রভাবে পড়ে, তখন সেই প্রভাবেই প্রভাবিত হয়। সেও নবীনচন্দ্রকে লিখিল, চিকিৎসকগণ এখন শোভাকে পল্লীগ্রামে পাঠাইতে মত দিতেছেন না। তাঁহারা বলেন, আরও কিছুদিন কলিকাতায় থাকাই শ্রেয়ঃ।
কৃষ্ণনাথের পত্র পাইয়া শিবচন্দ্র বিরক্ত হইলেন। এ পত্রে কৃষ্ণনাথের পূর্ব্বের সব পত্রের বিনয়েরও অভাব ছিল। শিবচন্দ্র ভ্রাতাকে সে পত্র দেখাইলে নবীনচন্দ্র আর তাঁহাকে প্রভাতের পত্রের কথা বলিলেন না। তিনি জ্যেষ্ঠকে বলিলেন, “আমি কলিকাতায় যাই।”
শিবচন্দ্র বলিলেন, “না। তোমার যাইয়া কায নাই। যথেষ্ট অপমান হইয়াছে। আর কেন? বহুবার বধূকে আনিবার চেষ্টা করিয়া অকৃতকার্য্য হইলাম; তাঁহারা পল্লীগ্রামে মেয়ে পাঠাইবেন না।”
“প্রভাতকে লিখিব? ”
“সেও আমাদের সহিত সম্বন্ধ ঘুচাইয়াছে। নহিলে বৈবাহিকের এ সাহস হইত না।”
শিবচন্দ্রের কণ্ঠস্বর সহসা গাঢ় হইয়া আসিল। তিনি যে কথা বলিলেন— সে কথা মনে করিতে হৃদয় যেন ক্ষত বিক্ষত হইতে লাগিল।
নবীনচন্দ্র ভ্রাতার মুখের দিকে চাহিলেন। সে আননে অতি দারুণ দুঃখের ছায়া। তিনি বলিলেন, “আপনি বৃথা আশঙ্ক করিতেছেন। সে তেমনই আছে।”
শিবচন্দ্র আর কোনও কথা বলিলেন না: দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন।
নবীনচন্দ্র সেই দিনই কলিকাতায় যাইবার উদ্যোগ করিলেন। শিবচন্দ্র সে কথা শুনিয়া পুনরায় বলিলেন, “যাইয়া কায নাই।
নবীনচন্দ্র আশা করিতেছিলেন, তিনি যাইলে আর কোনও গোল হইবে না। ভ্রাতার সেই কষ্টার্ত্ত কণ্ঠস্বর তখনও তাঁহার কর্ণে ধ্বনিত হইতেছিল; সেই বেদনাক্লিষ্ট মুখচ্ছবি তিনি তখনও দেখিতেছিলেন। তিনি তাহা সহ্য করিতে পারিলেন না। তাই তিনি সেই দিনই কলিকাতা যাত্রা করিলেন; জীবনে এই প্রথম জ্যেষ্ঠের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কার্য্য করিলেন।
নবীনচন্দ্র কলিকাতায় যাইয়া ছাত্রাবাসে উঠিলেন। প্রভাত সেথায় নাই। ছেলেরা বলিল, সে শ্বশুরালয়ে থাকে। শুনিয়া নবীনচন্দ্র বিস্মিত ও দুঃখিত হইলেন; কিন্তু এমন ভাব দেখাইলেন যে, ছেলেরা মনে করিল,—তিনি পূর্ব্ব হইতেই এ বিষয় অবগত ছিলেন।
সন্ধ্যার সময় আফিস হইতে ফিরিয়া প্রভাত সংবাদ পাইল, ছাত্রাবাস হইতে তাহাকে দুইবার ডাকিতে আসিয়াছিল। সে ব্যস্ত হইয়া ছাত্রাবাসে আসিল; দেখিল, নবীনচন্দ্র আসিয়াছেন। সে ঘর খুলিল। ঘর বহুদিন বন্ধ ছিল। দ্রব্যাদিতে ধূলি জমিয়াছে। ছাত্রাবাসের ছেলেদের সহায়তায় কোনরূপে ঘর পরিষ্কৃত হইল। তাহারা প্রায় সকলেই ধূল গ্রামের নিকটবর্ত্তী গ্রামসমূহের অধিবাসী; নবীনচন্দ্রকে জানিত, এবং তাঁহার স্বভাবগুণে তাঁহাকে ভালবাসিত ও ভক্তি করিত। বিশেষ পল্লীগ্রামে অন্য সম্বন্ধ না থাকিলেও পরিবারে পরিবারে গ্রাম্য সম্বন্ধ আছে। সে সম্বন্ধে জাতিবিচার নাই,— তাহা মনুষ্যসমাজের প্রশস্ত ভিত্তির উপর সংস্থাপিত। সে সম্বন্ধে নবীনচন্দ্র ছেলেদের কাহারও কাকা, কাহারও জেঠা মহাশয়, কাহারও মামা ইত্যাদি। যাহাদের সহিত সেরূপ কোনও সম্বন্ধ ছিল না, তাহারও অন্য ছেলেদের সঙ্গে মিশিয়া গেল। সংসারসংঘাতে মানুষ স্বার্থপর হইবার পূর্ব্বে, তাহার হৃদয়ের উদারতা সঙ্কীর্ণতায় সীমাবদ্ধ হইবার পূর্ব্বে, মানুষের আদর্শ অতি সমুন্নত থাকে; ক্রমে তাহার অবনতি ঘটে। তাই যুবকদিগের মধ্যে সহজে বন্ধুত্ব জন্মে; তাহারা সহজে স্বার্থত্যাগ করিতে পারে; মহৎ অনুষ্ঠানে তাহারাই সর্ব্বাগ্রে অগ্রসর হইতে সমর্থ; তাহাদিগকে ছাড়িয়া কোনও মহৎ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হইতে পারে না। আবার নবীনচন্দ্রের মত স্নেহশীল ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সহজে, যেন আপনা হইতেই হইয়া যায়। কাযেই ছেলেরা তাঁহাকে পাইয়া যেন স্বজনসমাগমের আনন্দলাভ করিল।
সে যে শ্বশুরালয়ে স্থায়ী হইয়াছে, নবীনচন্দ্র তাহা জানিতে পারিয়াছেন,—এই লজ্জায় প্রভাত তাঁহার নিকট মুখ তুলিতে পারিতেছিল না; এবং এখন কি করিবে, এই চিন্তায় বিব্রত হইতেছিল। কিন্তু নবীনচন্দ্রের ব্যবহারে অল্প সময়ের মধ্যেই তাহার সে অপ্রতিভভাব কতকটা দূর হইল। পাছে ছাত্রাবাসের ছেলেরা জানিতে পারে,— তিনি প্রভাতের শ্বশুরালয়ের সহিত ঘনিষ্ঠতার বিষয় অবগত ছিলেন না,— এই আশঙ্কায় নবীনচন্দ্র সে ভাবের আভাষমাত্র ব্যবহারে প্রকাশ হইতে দিলেন না।
সন্ধ্যার পরই নবীনচন্দ্র প্রভাতকে বলিলেন, “তুই যা, আর বিলম্ব করিয়া কাজ নাই। আমার জন্য ব্যস্ত হইতে হইবে না।”
প্রভাত সে কথায় কাণ দিল না।
প্রভাতের গমনে বিলম্ব ঘটিল; কৃষ্ণনাথের গৃহ হইতে ভৃত্য তাহাকে ডাকিতে আসিল। নবীনচন্দ্র প্রভাতকে পুনরায় বলিলেম, “তুই যা।” সে গেল না। ভৃত্য জানিয়া গেল, “জামাই বাবু”র কাকা আসিয়াছেন।
ভৃত্য যাইয়া সংবাদ দিলে কৃষ্ণনাথ স্বয়ং ছাত্রাবাসে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। নবীনচন্দ্র তখন আহারে বসিয়াছেন।
বৈবাহিককে দেখিয়া নবীনচন্দ্র হাসিয়া বলিলেন, “আপনি বড় অসময়ে আসিয়াছেন। আপনিও প্রিয়, পাতেও প্রিয়। আমি এখন কাহাকে ছাড়িয়া কাহাকে রাখি?”
কৃষ্ণনাথ বলিলেন, “সে জন্য ভাবিবেন না। আমি এখানেই বসিতেছি। আপনার ‘দু’ কূল বজায় রবে।’ সব ভাল ত?”
“আপনাদের আশীর্ব্বাদে সব মঙ্গল।”
কৃষ্ণনাথ হর্ম্ম্যতলেই বসিবার উদ্যোগ করিতেছিলেন। এক জন যুবক একখানি চেয়ার আনিয়া দিল। নবীনচন্দ্রের অনুরোধে কৃষ্ণনাথ তাহাতে উপবেশন করিলেন।
কৃষ্ণনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন, “সহসা কি মনে করিয়া?”
নবীনচন্দ্র বলিলেন, “একবার দেখিতে শুনিতে আসিলাম। মা’কেও অনেক দিন দেখি নাই। বিশেষ ভাইটির সঙ্গে পরিচয় করিতে হইবে।”
নবীনচন্দ্রের আহার শেষ হইলে কৃষ্ণনাথ বৈবাহিককে বলিলেন, “চলুন, আমার ওখানে পদধূলি দিতে হইবে।”
নবীনচন্দ্র বলিলেন, “পূর্ব্বেই যাইতাম। কিন্তু প্রভাতের আসিতে বিলম্ব হইল, সন্ধা হইয়া গেল,—সেই জন্য আজ আর যাই নাই। আগামী কল্য প্রভাতেই যাইয়া ভাইকে দেখিয়া আসিব।”
“এখানে অসুবিধা হইবে।”
নবীনচন্দ্র হাসিয়া বলিলেন, “এখানে আমার কোনও অসুবিধা নাই। বরং সুবিধার জ্বালায় বিব্রত হইয়া পড়িয়াছি। এই সব সোনার চাঁদ ছেলে,—ইহারা কেহ আমার পর নহে। দেখুন না,—সবগুলি সব কার্য ছাড়িয়া আমার কাছে রহিয়াছে। উহারা আমাকে ছাড়িবে না।”
ছেলেরাও বলিল, তাহারা নবীনচন্দ্রের কোনও অসুবিধা হইতে দিবে না।
অগত্যা কৃষ্ণনাথ বিদায় হইলেন।
নবীনচন্দ্র প্রভাতকে পুনরায় বলিলেন, “তুই যা। সকালে আবার দেখা হইবে।” তথাপি প্রভাত রহিল দেখিয়া তিনি কৃষ্ণনাথকে বলিলেন, “প্রভাতকে লইয়া যাউন। আমার কোনও অসুবিধা হইবে না।”
শেষে প্রভাত শ্বশুরের সঙ্গে গেল।
সে রাত্রিতে নবীনচন্দ্রের ভাল নিদ্রা হইল না। তিনি চিন্তা করিতে লাগিলেন।