নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/দ্বিতীয় খণ্ড/অষ্টম পরিচ্ছেদ
অষ্টম পরিচ্ছেদ।
ছায়া গাঢ়তর ।
পর দিন প্রভাতেই প্রভাত আসিল। নবীনচন্দ্র তাহার সহিত যাইয়া যথারীতি ভ্রাতুষ্পৌত্ত্রকে দেখিলেন। শিশু তাহার ক্রোড়ে ক্রন্দন করিল না। কৃষ্ণনাথ রহস্য করিয়া বলিলেন, “আপনার লোক চিনিয়াছে। আমি লইতে যাইলেই কাঁদে।”
নবীনচন্দ্র বলিলেন, “আমি ভাই। আমার কাছে কাঁদিলে চলিবে কেন?”
শোভা আসিয়া প্রণাম করিল। নবীনচন্দ্র আশীর্ব্বাদ করিলেন; হাসিয়া বলিলেন, “মা, রোগা হইয়াছ । পরের বাড়ী বুঝি যত্ন হয় না? অনেক দিন পরের বাড়ী আছ। চল, ভাইকে লইয়া দেশে যাই; ঘর আলো হইবে।”
শোভা লজ্জায় মুখ নত করিয়া রহিল।
নবীনচন্দ্র আবার বলিলেন, “বাড়ীতে সকলেই ভাইটিকে দেখিবার জন্য ব্যাকুল। আমি কয় দিন থাকিয়া ভাইকে লইয়া যাইব বলিয়া আসিয়াছি।” অঙ্কস্থিত শিশুকে বলিলেন, “কি বল, ভাই? চল, বাড়ী যাইতে হইবে।”
কৃষ্ণনাথ বলিলেন, “অবশ্যই যাইবে। কিন্তু এখন পল্লীগ্রামে স্বাস্থ্য ভাল থাকে না।”
নবীনচন্দ্র বলিলেন, “গ্রামের স্বাস্থ্য এখন খুব ভাল। কোনও পীড়া নাই ।”
“কিন্তু ডাক্তাররা যাইতে নিষেধ করিতেছেন।”
“ডাক্তারদের সব কথা শুনিবেন না। সুস্থ শরীর ব্যস্ত করিতে তাঁহাদের মত আর কেহ নাই। কেবল বৃথা আশঙ্কা।”
কৃষ্ণনাথ যেন কিছু ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, “এখন যাওয়া হয় না।”
শোভা কৃষ্ণনাথের একমাত্র কন্যা। কৃষ্ণনাথের স্নেহ স্বভাবতঃই অধিক। সেই জন্য তাঁহার জ্যেষ্ঠ ও মধ্যম পুত্রদ্বয় “মানুষ” হয় নাই। কন্যার প্রতি তাঁহার স্নেহ যেন অতিরিক্ত ও অপরিমিত। তাই তিনি ভ্রান্ত হইয়াছিলেন;—কন্যাকে চক্ষুর অন্তরাল করিতে চাহিতেন না। তিনি জামাতাকে তাহার পরিবার হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া আপনার করিতে প্রয়াসী হইয়াছিলেন; এবং জামাতার ব্যবহারে সে বিষয়ে সফলযত্ন হইবার আশাও হৃদয়ে পোষণ করিতেছিলেন। তাই কৃষ্ণনাথ সাহস করিয়া এমন কথা বলিতে পারিলেন।
নবীনচন্দ্র বিস্মিত হইলেন; কিন্তু কিছু বলিলেন না।
কৃষ্ণনাথের পত্নী যখন শুনিলেন যে, নবীনচন্দ্র শোভাকে লইতে আসিয়াছেন, তখন তিনি বলিলেন,—মেয়েকে পাঠাইতে হইবে। কৃষ্ণনাথ তাহাতে আপত্তি জানাইলে তিনি বলিলেন, “না। যখন বৈবাহিক স্বয়ং আসিয়াছেন—তখন পাঠান অবশ্যকর্তব্য। নহিলে তাঁহার অপমান করা হইবে। মেয়ের শ্বশুরবাড়ী সব রাগ করিলে তখন মেয়ের কি হইবে?”
কৃষ্ণনাথ বলিলেন, “সে ভার আমার, আমি বৈবাহিককে বুঝাইব।”
“তুমি যতই বুঝাও, এ কায ভাল হইবে না। তাহাদের বধূ, তাহারা লইবার জন্য ব্যগ্রতা প্রকাশ করিতেছে; এ সময় না পাঠাইলে পরে ভুগিতে হইবে।”
কৃষ্ণনাথ গৃহিণীর পরামর্শ শুনিলেন না।
এ দিকে নবীনচন্দ্র প্রভাতকে বলিলেন, “প্রভাত, আমি মা’কে লইতে আসিয়াছি। দেশে দাদা, দিদি, বড় বধূ, কমল, সকলেই খোকাকে দেখিবার জন্য উদ্গ্রীব।”
প্রভাত বলিল, “চিকিৎসকগণ এ সময় পল্লীগ্রামে যাইতে নিষেধ করিতেছেন।”
নবীনচন্দ্র বুঝিলেন, কৃষ্ণনাথের কথার প্রতিধ্বনি। তিনি বলিলেন, “তুই ত জানিস, গ্রামের স্বাস্থ্য এ সময় ভাল। যদি স্বাস্থ্য ভাল না থাকে, আমি রাখিয়া যাইব। এখন না যাইলে দাদা দুঃখিত হইবেন।”
প্রভাত কিছু বলিল না।
নবীনচন্দ্র বলিলেন, “তুইও বাড়ী চল্। মা’কে লইয়া চল্।”
প্রভাত ধীরে ধীরে বলিল, — “এখন— না যাইলে—হয় — না?”
নবীনচন্দ্র যেন বিশেষ চেষ্টা করিয়া বলিলেন, “আচ্ছা।” তাহার পর বলিলেন, “আফিসের বেলা হইল, তুই যা।”
প্রভাত চলিয়া গেল।
নবীনচন্দ্র হৃদয়ে অসহনীয় যাতনা ভোগ করিতে লাগিলেন। তিনি বড় আশা করিয়া আসিয়াছিলেন, তিনি আসিলে সব গোল মিটিবে; তিনি বধূকে লইয়া যাইবেন; ভ্রাতার ও ভ্রাতুষ্পুত্ত্রের মনোমালিন্য দূর হইবে। সে আশা পূরিল না। তিনি স্নেহবশে যে বিশ্বাসে প্রিয়তম ভ্রাতুষ্পুত্ত্রকে আবৃত করিয়া রাখিয়াছিলেন, সে বিশ্বাস মুহূর্ত্তে ছিন্ন ভিন্ন হইয়া গেল। ব্যর্থ বিশ্বাসের বিষম বেদনা তাঁহাকে ব্যথিত করিল;- হৃদয় কাতর হইয়া পড়িল। স্নেহে বিষম আঘাত লাগিল। তাঁহার বুক যেন ফাটিয়া যাইতে লাগিল।
সন্ধ্যাকালে প্রভাত ও কৃষ্ণনাথ আসিয়া দেখিলেন, নবীনচন্দ্রের মুখে বিষাদকালিমা। অল্প সময়ে তাঁহার এই পরিবর্ত্তন দেখিয়া প্রভাত বিস্মিত হইল।কৃষ্ণনাথের ও প্রভাতের কক্ষে প্রবেশের বিষয় নবীনচন্দ্র জানিতেও পারিলেন না। তিনি ভাবিতেছিলেন,– গৃহের চারি দিকে যদি অনল জ্বলিয়া উঠে, তবে কেমন করিয়া নিবাইব?
কৃষ্ণনাথের কণ্ঠস্বরে নবীনচন্দ্র চমকিয়া উঠিলেন। কৃষ্ণনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন, “অসুস্থ হইয়াছেন না কি?”
নবীনচন্দ্র উত্তর করিলেন, “না।”
কৃষ্ণনাথ মধ্যাহ্নে নবীনচন্দ্রকে আহারের নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন। নবীনচন্দ্র সে নিমন্ত্রণ কাটাইয়াছিলেন। তিনি স্বয়ং থাকিতে পারিবেন না বলিয়া কৃষ্ণনাথও বিশেষ জিদ করেন নাই। শেষে কৃষ্ণনাথ রাত্রিতে আহারের জন্য জিদ করিয়াছিলেন। নবীনচন্দ্র সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করিয়াছিলেন। কিন্তু কৃষ্ণনাথ তাঁহার কথা আমলেই আনেন নাই। তিনি এখন বলিলেন, “চলুন।” নবীনচন্দ্র যত বলেন, কৃষ্ণনাথ কিছুতেই শুনেন না। শেষে নবীনচন্দ্র করজোড়ে নিবেদন করিলেন, “ক্ষমা করুন। আজ আহার করিতে পারিব না।”
কৃষ্ণনাথ তাহার পর নানা কথা বলিতে লাগিলেন। নবীনচন্দ্রের কিছুই ভাল লাগিতেছিল না। ক্রমে কৃষ্ণনাথ শোভাকে লইয়া যাইবার কথা তুলিলেন; বলিলেন, “শোভা এখন এখানে থাকুক। ইহার পর লইয়া যাইবেন।”
নবীনচন্দ্র কি ভাবিতেছিলেন, তিনি বড় অন্যমনস্ক;– সে কথার উত্তর দিলেন না।
কৃষ্ণনাথ বিদায় লইয়া দ্বার পর্য্যন্ত অগ্রসর হইলেন। প্রভাত তখনও বসিয়া রহিল। নবীনচন্দ্র বলিলেন, “আমি আজই বাড়ী যাইব।”
কৃষ্ণনাথ ফিরিলেন; অনেক বলিলেন,—তাহা কিছুতেই হইবে না,—নবীনচন্দ্রের বৈবাহিকা বড় রাগ করিবেন,– অন্ততঃ এক দিন থাকিয়া যাইতেই হইবে —ইত্যাদি।
নবীনচন্দ্র বলিলেন, “একটু কাযে কলিকাতায় আসিয়াছিলাম। কায শেষ হইয়াছে,—আর বিলম্ব করিব না।”
কৃষ্ণনাথ তাহাতে অনেক আপত্তি করিলেন; তাহার পর বিদায় লইলেন। প্রভাত তখনও বসিয়া রহিল। পিতৃব্যের এমন ভাব সে পূর্ব্বে কখনও দেখে নাই। সে-ও কি ভাবিতেছিল।
প্রভাত বসিয়া রহিল। নবীনচন্দ্র মনে করিলেন, প্রভাতকে সকল কথা বুঝাইয়া বলিবেন; একবার— আর একবার চেষ্টা করিবেন। কিন্তু পারিলেন না। বেদনায়—যাতনায় বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল; মুখে কথা ফুটিল না।
প্রভাতও কয়বার কি জিজ্ঞাসা করিবার, কি বলিবার চেষ্টা করিল; কিন্তু কিছু বলিতে পারিল না।
কিছুক্ষণ কাটিয়া গেল। নবীনচন্দ্র প্রভাতকে বলিলেন, “রাত্রি অনেক হইল। তুমি আর বিলম্ব করিও না।”
নবীনচন্দ্র কখনও তাহাকে “তুই” ভিন্ন “তুমি” বলিতেন না। সে স্নেহসম্ভাষণে বঞ্চিত হইয়া প্রভাত যে ব্যথা অনুভব করিল না— এমন নহে। সে কোনও উত্তর দিল না; কিন্তু উঠিল না,— বসিয়া রহিল।
ক্রমে নবীনচন্দ্রের যাইবার সময় হইল। যান গৃহদ্বারে আসিল। নবীনচন্দ্র প্রভাতকে বলিলেন, “বাবা, তবে আমি যাই।” কণ্ঠ যেন রুদ্ধ হইয়া আসিতেছিল।
প্রভাত বলিল, “আমি ষ্টেশনে যাইব।”
“আমার সহিত দ্রব্যাদি বিশেষ কিছু নাই। কষ্ট করিয়া যাওয়া অনাবশ্যক।”
নবীনচন্দ্র যখনই কলিকাতায় আসিতেন, যাইবার সময় প্রভাত তাঁহাকে ট্রেণে তুলিয়া দিয়া আসিত;—প্রতিবারই বিদায়কালে তাহার চক্ষু ছল ছল করিত। সে কথা আজ প্রভাতের মনে পড়িল। সে যাইয়া গাড়ীতে উঠিয়া বসিল। কিন্তু গাড়ীতে উভয়ে কোনও কথা হইল না। উভয়েই চিন্তামগ্ন।
ষ্টেশনে আসিয়া প্রভাত বলিল, “আমি টিকিট কিনিয়া আনি।”
নবীনচন্দ্র টাকা দিলেন। প্রভাত টিকিট আনিল। তাহার পর নবীনচন্দ্র গাড়ীতে উঠিয়া বসিলেন। প্রভাত গাড়ীর পিত্তলহাতল ধরিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ক্রমে গাড়ী ছাড়িবার সময় হইল। প্রভাত পিতৃব্যকে প্রণাম করিল। নবীনচন্দ্র কোনও কথা কহিতে পারিলেন না,— আপনার উভয় করতল প্রভাতের মস্তকে সংস্থাপিত করিলেন; মনে মনে আশীর্ব্বাদ করিলেন,—চিরসুখী হও।
গাড়ী ছাড়িয়া দিল। নবীনচন্দ্র ভাবিলেন, যাহা বলিবেন মনে করিয়াছিলেন, তাহা বলিলে ভাল হইত। প্রভাত মনে করিল, যাহা বলিবে ভাবিয়াছিল, তাহা বলিলেই ভাল করিত। দারুণ যাতনায় নবীনচন্দ্রের বক্ষ বিদীর্ণ হইতেছিল। প্রভাত হৃদয়ে অত্যন্ত বেদনা অনুভব করিতেছিল। যে সুযোগ আবার আপনি আসিয়াছিল, সে সুযোগও বহিয়া গেল। ব্যবধান কমিল না বরং বাড়িল।
ভাবিতে ভাবিতে প্রভাত ফিরিল।
ট্রেণে বসিয়া দুশ্চিন্তাকাতর, নবীনচন্দ্রের কেবল আর এক দিনের কথা মনে হইতে লাগিল। সে দিন শোভার সহিত বিবাহে প্রভাতের ইচ্ছা জানিয়া তিনি সে বিবাহে ভ্রাতার মত করাইবার উপায় চিন্তা করিতে করিতে এই পথে গৃহে ফিরিয়াছিলেন। সে যেন সে দিন! নবীনচন্দ্র দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিলেন।
নবীনচন্দ্র গৃহের যত নিকটবর্ত্তী হইতে লাগিলেন, ততই কেবল ভাবিতে লাগিলেন, দাদা শুনিয়া কি মনে করিবেন—কত কষ্ট পাইবেন! তখন মনে পড়িল, তিনি লোকচরিত্রাভিজ্ঞ জ্যেষ্ঠের অমতে কলিকাতায় গিয়াছিলেন। তিনি নিজে বড় আশা করিয়া গিয়াছিলেন;— সব ব্যর্থ হইয়াছে! যে বিশ্বাসে তিনি দুঃখেও সুখ পাইতেন— সে বিশ্বাস চূর্ণ হইয়া গিয়াছে।
নবীনচন্দ্র গৃহে উপনীত হইলেন। ভ্রাতার মুখ দেখিয়া শিবচন্দ্র শঙ্কিত হইলেন; জিজ্ঞাসা করিলেন, “নবীন, সব ভাল ত?”
নবীনচন্দ্র মাথা নাড়িয়া জানাইলেন—ভাল।
শিবচন্দ্র বুঝিলেন, তাঁহার আশঙ্কাই সত্য হইয়াছে — নবীনচন্দ্র বিফলযত্ন হইয়া ফিরিয়া আসিয়াছেন। তিনি ভ্রাতাকে আর সে কথা জিজ্ঞাসা করিলেন না। সে কথা উভয়েরই পক্ষে কষ্টকর।
নবীনচন্দ্র অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন না । অল্পক্ষণ বিশ্রামের পর তিনি স্নানার্থ গমন করিলেন। স্নানের পর উভয় ভ্রাতা একত্র আহারের জন্য অন্তঃপুরে গমন করিলেন।
পিসীমা ও বড় বধূ ব্যস্ত হইয়া ছিলেন। পিসীমা জিজ্ঞাসা করিলেন, “নবীন, প্রভাত, বৌমা, খোকা—সব ভাল আছে ত?”
নবীনচন্দ্র মুখ তুলিতে পারিলেন না। নতদৃষ্টি রহিয়াই বলিলেন,
-“হাঁ।”
“বৌমা কবে আসিবে? ”
নবীনচন্দ্র ধীরে ধীরে বলিলেন, “এখন কেহ আসিবে না।—” যেন সব অপরাধ তাঁহার।
শিবচন্দ্রের হৃদয়ে যেন ছুরিকা বিদ্ধ হইল।
প্রিয়তম ভ্রাতার অপমান শিবচন্দ্রের হৃদয়ে শেলসম বাজিল । দত্তগৃহে বিষাদের গাঢ়তর ছায়া পড়িল।