নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/দ্বিতীয় খণ্ড/নবম পরিচ্ছেদ
নবম পরিচ্ছেদ।
গৃহান্তরে।
নবীনচন্দ্র যাইবার কয় দিন পরে প্রভাত পিতার পূর্ব্বনির্দ্দেশমত কৃষ্ণনাথের নিকট স্বতন্ত্র বাসা করিবার প্রস্তাব করিল। কৃষ্ণনাথ রলিলেন, “এখানে তোমার কি অসুবিধা হইতেছে?”
অসুবিধার কথা কিছু বলিতে না পারিয়া প্রভাত বলিল, “বাবার ইচ্ছা আমি স্বতন্ত্র বাসা করি।”
কৃষ্ণনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন?”
“তাহা কিছু বলেন নাই। তবে তাঁহারা কেহ আসিলেও অসুবিধা হয়। আর— শ্বশুরালয়ে—”
“তাঁহারা সর্ব্বদা আসেন না। আসিলেও দুই এক দিনের অধিক থাকেন না। সে অবস্থায় বৃথা ব্যয় করিয়া বাসা করিবার প্রয়োজন কি? শ্বশুরালয়ে বাস!—কেন, তুমি ত আর ঘরবাড়ী ত্যাগ করিয়া শ্বশুরালয়ে বাস করিতেছ না। ও সব পল্লীগ্রামের কথা।—ইহাতে দোষ কি?”
প্রভাত আর কোনও কথা কহিল না।
কৃষ্ণনাথ পুনরায় বলিলেন, “ছাত্রাবাসে একটা ঘর রাখিয়া বৃথা ব্যয় বাড়ান অনাবশ্যক। ওটা ছাড়িয়া দাও।”
শেষে তাহাই হইল। প্রভাত স্বতন্ত্র বাসা করা দূরে থাকুক—ছাত্রাবাসের ঘরটিও ছাড়িয়া দিল; তবে তখনও সে মনে করিল, আর কিছু দিন পরে—একটা সুযোগ বুঝিয়া পুনরায় বাসা করিবার প্রস্তাব করিবে; এবং মনকে বুঝাইল, সে সুযোগ নিশ্চয়ই আসিবে। মনের মত কাপুরুষ আর নাই। যে অতি সহজেই ইচ্ছার মতে মত দেয়—অসম্ভবকেও সম্ভব বুঝে।
কিন্তু সুযোগ ঘটা দূরে থাকুক, বরং সে প্রস্তাব করিবার পক্ষে অন্তরায় উপস্থিত হইল। শীত শেষ হইতে না হইতে নলিনবিহারীর শিরঃপীড়া বাড়িয়া উঠিল।
জামাতা শ্বশুরগৃহে বাস করেন, কৃষ্ণনাথের পত্নীর সে ইচ্ছা ছিল না। কৃষ্ণনাথ ভবিষ্যৎ ভাবিয়া দেখেন নাই, তাই তিনি প্রভাতকে তাহার পরিবার হইতে দূরে ও আপনার নিকট আনিতে সচেষ্ট হইয়াছিলেন। গৃহিণী বুঝিয়াছিলেন, স্নেহের বন্ধন একবার বিচ্ছিন্ন হইলে আর সহজে যুক্ত হয় না; স্নেহের সম্বন্ধে আঘাত লাগিলেও তাহা আর সহজে পূর্ব্বাবস্থা প্রাপ্ত হয় না। তাই তিনি কন্যাকে তাহার শ্বশুরের সংসার হইতে দূরে রাখিবার সঙ্কল্প না, করিয়া বরং তাহাকে সেই সংসার-ভুক্তা দেখিতে ইচ্ছুক ছিলেন। কন্যার পিতৃগৃহে অবস্থান হয় ত পুত্ত্রদিগের অভিপ্রেত হইবে না, বধূরা তাহাতে অসন্তুষ্টা হইবে; তাহাতে কন্যাজামাতার আদর থাকিবে না। এই সকল কারণে তিনি প্রভাতের পিতৃগৃহের সহিত সম্বন্ধ শিথিল করা ভাল বিবেচনা করিলেন না। যদি একবার সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়, তবে বিপদ ঘটিবে। শোভাকে এক দিন শ্বশুরের ঘরে যাইতেই হইবে,—এখন সে অভ্যাস করা ভাল। বিশেষ তিনি শ্বশুরালয়ে শোভার যে আদর দেখিয়া আনন্দোৎফুল্লা হইয়াছিলেন, তাহাতে তাঁহার আশা ছিল, সে সহজেই সে গৃহের গৃহলক্ষ্মীর আসন অধিকার করিতে পারিবে। তাই নবীনচন্দ্র শোভাকে লইতে আসিলে তিনি কৃষ্ণনাথকে মেয়ে পাঠাইতে বলিয়াছিলেন। তাই প্রভাতকে শ্বশুরালয়বাসী হইতে দেখিয়া তিনি শঙ্কিতা হইয়াছিলেন।
কিন্তু কৃষ্ণনাথ যখন তাঁহার কথা শুনিলেন না, প্রভাতও যখন প্রকৃত অবস্থা বুঝিল না,— তখন অনন্যোপায় হইয়া গৃহিণী সর্ব্বপ্রযত্নে কন্যাজামাতাকে আগুলিয়া রাখিতে লাগিলেন। তাঁহার আশঙ্কা,—পাছে পুত্ত্রদিগের বা বধূগণের ব্যবহারে বিরক্তি প্রকাশ পায়; পাছে স্বার্থহানিশঙ্কিতদিগের কোন কথায় উপেক্ষার আভাষ থাকে; পাছে কন্যাজামাতার এমন মনে করিবার অবকাশ ঘটে যে, তাহাদের সে গৃহে অবস্থান সকলের অভিপ্রেত নহে।
গৃহিণীর মনেও সুখ ছিল না।
কিন্তু প্রভাতও কৃষ্ণনাথের মত ভবিষ্যতের বিষয় বিবেচনা করিল না। যে পরিবারের সেই সর্ব্বস্ব, সেই পরিবারের সহিত তাহার সম্বন্ধ ক্রমেই ক্ষীণ হইয়া আসিতে লাগিল। সে কি ভাবিয়া কি করিল? সে আপনার কর্ম্মে আপনই বদ্ধ হইয়া পড়িতে লাগিল।
কন্যার পক্ষে পিত্রালয়ে বাস সুখের। বিশেষ, যাহার ঘরকে আপনার ঘর করিয়া লইতে হয়, যাহার প্রেমে রমণী নূতন জীবন লাভ করে, নূতনে অভ্যস্তা হইয়া শেষে পরিচিত পুরাতনকেই নূতন বলিয়া মনে করে, সেই স্বামীও নিকটে। তবুও শোভার কেমন ভাল বোধ হইতেছিল না। সকলে যাহা পায়, তাহা না পাইয়া সে আপনাকে অধিকারে বঞ্চিতা মনে করিতেছিল। চপলার ভ্রাতা ভগিনী নাই, পিত্রালয়ে সবই তাহার, তথাপি সে শ্বশুরালয়ে আইসে। সকলের যাহা হয়, তাহার কেন তাহা হইল না? এক এক বার তাহার এমনও মনে হইত, সেই পল্লীভবন, সেই পল্লীজীবন, তাহাতেও ত নূতনত্বের আকর্ষণ ছিল! সময় সময় সে ভাবিত, যখন সে শ্বশুরালয়ে গিয়াছিল, তখনও সে বালিকা; কিছু ভাল বুঝিতে পারিত না। এখন একবার যাইয়া দেখিলেও হয় সে পল্লীজীবন সুখের, কি দুঃখের। সেই পল্লী ভবনে তাহার অসীম যত্নের কথা, পিসীমা’র ও নবীনচন্দ্রের অপরিম্লান আদরের স্মৃতি তাহার মনে পড়িত। প্রভাত শ্বশুরের উপদেশে চাকরী করিতেছিল, তাহাও শোভার অভিপ্রেত ছিল না। শ্যামাপ্রসন্ন প্রভাতের সে কার্য্যের সমর্থন করেন নাই, সে কথা শোভা শুনিয়াছিল। সে কথা সে সহজে ভুলিতে পারিতেছিল না; শ্যামাপ্রসন্নের সে কথা যখন তখন তাহার মনে পড়িত। চপলা সে কথা শুনিয়া অবজ্ঞা প্রকাশ করিয়াছিল। সে কথাও শোভা ভুলে নাই। তাহার পর প্রভাতের শ্বশুরালয়ে অবস্থান। প্রভাত শ্বশুরের নিকট স্বতন্ত্র বাসা করিবার প্রস্তাব উত্থাপনের পূর্ব্বে শোভাকে সে কথা বলিয়াছিল। শোভা সাগ্রহে সম্মতি দিয়াছিল। সে একা এক গৃহের গৃহিণী! দায়িত্বের অভিজ্ঞতা জন্মিবার পূর্ব্বে তাহার গৌরব হৃদয়কে আকৃষ্ট করে। বালক প্রবীণপদবাচ্য হইতে কত আকাঙ্ক্ষা করে; বালিকা গৃহিণী সাজিতে ভালবাসে। গৃহিণীর সহস্র জ্বালা শোভা জানিত না; তাই তাহার গৌরবে আকৃষ্টা হইয়াছিল; সাগ্রহে প্রভাতের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়াছিল। পিতা সে প্রস্তাবে অসম্মতি জ্ঞাপন করিলে সে পিতার উপর রাগ করিয়াছিল। প্রভাতের শ্বশুরালয়ে অবস্থান তাহার ভাল বোধ হইত না।
যে বীজ ঊষর ভূমিতে উপ্ত হয়, তাহা সামান্য প্রতিকূল অবস্থায় বিনষ্ট হয়, —অঙ্কুরিত হয় না। চপলার প্রেমের তাহাই হইয়াছিল। সে শৈশব হইতে যখন যাহা চাহিয়াছে, সকলে তাহাকে তাহাই দিতে ব্যগ্র হইয়াছেন। সে ধনবান পিতার একমাত্র সন্তান,— জনকজননীর বড় আদরের। তাহার পর পিতার মৃত্যু হইতে সে-ই জননীর সর্ব্বস্ব। শ্বশুরালয়েও সে শ্বাশুড়ীর ব্যবহারে পদে পদে অপর বধূদিগের অপেক্ষা আপনার শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করিত। তাহার ধনগর্ব্ব তাহার রূপগর্ব্বকে স্ফীত করিয়াছিল। সে আপনার শ্রেষ্ঠত্বগর্ব্বে এমনই ভ্রান্ত হইয়াছিল যে, ভ্রান্তিবশে স্বামীর ব্যবহারেও আপনার শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয়প্রাপ্তির আশা করিত। কিন্তু নলিনবিহারীর প্রেমে স্বার্থসন্ধান ছিল না,— সে প্রেম ও স্বার্থ উভয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া ভালবাসে নাই। তাই সে পত্নীর ব্যবহারে নিন্দনীয় কিছু দেখিলে তাহার সংশোধনে চেষ্টা করিত: চপলার তাহা ভাল লাগিত না। বিশেষ নলিনবিহারীর প্রেমে যে গাম্ভীর্য্য ছিল, চঞ্চলা চপলা তাহার গরিমা বুঝিতে পারিত না। সে চাঞ্চল্য সহচর হৃদয়ে বিশালতার উপলব্ধি করিতে পারিত না। তাহাতে তাহার চটুলতায় অভ্যস্ত হৃদয় ছাপাইয়া যাইত। তাই সে নলিন বিহারীর প্রেমে তৃপ্তিলাভ করিতে পারিত না। সে প্রেমের বাহ্যিকবিকাশ ব্যতীত সন্তুষ্ট হইত না। তাহার সকল দুঃখ—সকল অসন্তোষ তাহার মনের দোষে উৎপন্ন হইত।
শীত শেষ হইতে না হইতে নলিনবিহারীর শিরঃপীড়া পুনরায় বাড়িয়া উঠিল। সেই সময় শিশিরকুমার বদলি হইল। নূতন কর্ম্মস্থানে যাইবার পথে শিশিরকুমাব কলিকাতায় আসিল;—দুই দিন মাত্র থাকিবে।
শিশিরকুমার আসিয়া নলিনবিহারীর পীড়ার কথা শুনিয়াই তাহাকে দেখিতে আসিল। শিশিরকুমার যে স্থানে বদলি হইয়াছিল, সে স্থান বিশেষ স্বাস্থ্যকর। শিশিরকুমার পুনঃপুনঃ নলিনবিহারীকে সেখানে যাইতে অনুরোধ করিল; বলিল, “এখানে শরীর সারিতেছে না; চলুন, বেড়াইয়া আসিবেন। দেখিবেন, সহরের বাহিরে যাইলেই স্বাস্থ্য লাভ করিতে পারিবেন। সহরের বাতাস শিরঃপীড়ার পক্ষে অপকারী। আমি মফঃস্বলে থাকি,—এখন সহরে আসিলেই কেমন দুর্গন্ধ বোধ হয়; বাতাস যেন আর লঘু বোধ হয় না।”
শুনিয়া নলিনবিহারী একটু হাসিল।
শিশিরকুমার পুনরায় বলিল, “সেখানে কোনও গোলমাল নাই। শরীর সহজেই সুস্থ হইবে। আমি যাইয়া পত্র লিখিব। আপনাকে যাইতেই হইবে।”
শিশিরকুমার কৃষ্ণনাথের নিকটেও এই প্রস্তাব করিল। কৃষ্ণনাথ বলিলেন, “আমি ত পুনঃপুনঃ বলিতেছি, কোথাও যাইয়া দিন কতক থাকিয়া আইস। সেবার দার্জ্জিলিং যাইয়া কিছু সুস্থ হইয়াছিল। কিন্তু কিছুতেই কোথাও যাইতে চাহে না; যাইলেও থাকিতে পারে না। আরও দোষ, পড়াও ছাড়িবে না। সকলেই বলিলাম, ‘পরীক্ষা দিও না।’ কিছুতেই শুনিল না। তাহার পর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইতে না পারিয়া শরীর আরও ভাঙ্গিয়া পড়িল। এখনও ঝোঁক—পরীক্ষা দিবে।”
“আর শ্রম করিতে দিবেন না।”
“আমি ত বলি, পরীক্ষা দিয়া কি হইবে? কিছুতেই সে কথা শুনে না। পড়া বন্ধ করে না।”
“আমি যাইয়া পত্র লিখিব। আপনি উঁহাকে পাঠাইয়া দিবেন।”
“সে ত ভাল কথা।”
শিশিরকুমার গৃহে ফিরিল।
চপলার জননী সেবারও শিশিরকুমারকে বিবাহের জন্য বিশেষ জিদ করিতে লাগিলেন; বলিলেন, “আমি একা আর এ শূন্য পুরীতে বাস করিতে পারি না। তুমি বিবাহ কর। কখনও চপলা, কখনও বধূ আমার কাছে থাকিবে। এখানে যে আমার মুখে জল দিবার কেহ নাই!”
শুনিয়া শিশিরকুমারের চক্ষু ছল ছল করিতে লাগিল। সে বলিল, “মা, চপলার ছেলে মেয়ে হউক, তাহারা আপনার কাছে থাকিবে। যদি কখনও কোনও আবশ্যক হয়, আমাকে আদেশ করিলেই আমি আসিব!”
মা তথাপি জিদ করিতে লাগিলেন শেষে শিশিরকুমার বলিল, “মা, আর যে আদেশ হয়, করুন; আমাকে ও আদেশ করিবেন না।”
পরদিন চপলা পিত্রালয়ে গেল। সে দিন তাহার মাসীমা ভগিনীকে দেখিতে আসিয়াছিলেন। দুই ভগিনীতে কথা হইতেছিল। জ্যেষ্ঠা কনিষ্ঠাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “জামাই কেমন আছে?”
চপলার জননী বলিলেন, “কিছুতেই ত সারিতেছে না। শিশির বদলি হইয়াছে। গত কল্য এখানে আসিয়াই ছুটিয়া দেখিতে গিয়াছিল।
“সে কি বলিল?”
“দেখিয়া আসিয়া অবধি মুখ আঁধার করিয়া আছে; বলিতেছে, মা, আমি যে স্থানে যাইতেছি, সে স্থান খুব ভাল। নলিনকে লইয়া যাইতেই হইবে। আপনাকেও যাইতে হইবে।’ সে ছেলে সহজে বিচলিত হয় না। তাই তাহার এ ভাব দেখিয়া আমার বড় ভয় হইয়াছে।”
“শিশির বিবাহ করিল না?”
“না, দিদি। সে কথা বলিলে বলে, ‘মা, ও আদেশ করিবেন না।”
“শিশির জামাইকে যাইবার কথা বলিয়াছে?”
“সে ত বলিয়াছে। তাহার চেষ্টার ত্রুটি নাই। এখন যাওয়া হইলে বাঁচি।”
“তাই ত। শিশির কবে যাইবে?”
“সে আজই যাইবে। বলিতেছে, বাসা ঠিক করিয়াই পত্র লিখিবে। যদি আবশ্যক হয়, নিজেই আসিবে। সে কি স্থির হইয়া আছে? দেখিয়া আসিয়া অবধি কেবল ঐ কথা বলিতেছে। তাই ত আমার আরও ভয় হইয়াছে।”
“তুমি একবার যাও। বেহাইনকে ভাল করিয়া বুঝাইয়া বল।”
“যাইব। আমি ত আর, দিদি, ভাবিয়া উঠিতে পারি না। আমারই কপাল পোড়া; নহিলে এমন হইবে কেন?”
“আহা, তখন যদি শিশিরের সঙ্গে চপলার বিবাহ দিতে। সোনার চাঁদ ছেলে; অমন ছেলে হাজারে একটি মেলা ভার। জামাইবাবুর বিশেষ ইচ্ছা ছিল। তখন তুমিই অমত করিলে। শিশিরও আর বিবাহ—”
এই সময় চপলা কক্ষে প্রবেশ করিল।