নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/দ্বিতীয় খণ্ড/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
যুবক।
ফাল্গুনের শেষ। সন্ধ্যা হইয়াছে। ছাত্রাবাসে প্রভাতের কক্ষদ্বার-সম্মুখে বারান্দায় একটা কেরোসিনের চুল্লীতে জল গরম হইতেছে; প্রভাত চা’র আয়োজন করিতেছে। পাত্রগুলি সুদৃশ্য। পার্শ্বের কক্ষে গিরিজানাথ কাগজ বিছাইয়া তৈল ও লবণ সংযোগে মুড়ী আহারোপযোগী করিতে ব্যস্ত ছিল; পার্শ্বে ই গোটা দুই কাঁচা লঙ্কা সংগৃহীত ছিল। পেয়ালা চামচের শব্দ পাইয়া গিরিজানাথ বলিল, “প্রভাত, চা করিতেছ?”
প্রভাত বলিল, “হাঁ; চাই?”
“এক পেয়ালা দিও, ভাই।”
প্রভাত দুই পেয়ালা চা প্রস্তুত করিল; এক পেয়ালা লইয়া গিরিজানাথের ঘরে প্রবেশ করিয়া ইতস্থতঃ চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “রাখি কোথায়?”
যে সব বাক্সে কেরোসিন-তৈল পূর্ণ ‘টিন’ আইসে, তাহারই একটার উপর গিরিজানাথ পুস্তক রাখিত। সেটার উপর আর স্থান ছিল না। তাহা দেখিয়া গিরিজানাথ বলিল, “বিছানার উপর রাখ।”
প্রভাত বলিল, “খানিকটা পড়ুক!” গিরিজানাথ হাসিয়া বলিল, “ও বিছানায় খানিকটা চা পড়িলে বিশেষ ক্ষতি হইবে না।”
“না। তাহাতে কায নাই।”- বলিয়া প্রভাত হম্ম্যতলে পিরিচ পেয়ালা রাখিয়া প্রস্থান করিল।
আপনার চা লইয়া প্রভাত নিজ কক্ষে প্রবেশ করিল; টেবলের উপর রাখিয়া চেয়ার টানিয়া লইয়া বসিল। সে কক্ষে এখন অনেক পরিবর্ত্তন হইয়াছে। আবরণহীন হর্ম্মতলে মাদুর ও গালিচা পড়িয়াছে; অলঙ্কারশূন্য কক্ষপ্রাচীর সুদৃশ্য চিত্রে শোভিত হইয়াছে; খেলো টেবল্ ও হাতাহীন চেয়ারের পরিবর্তে উৎকৃষ্ট সেক্রেটেরিয়েট টেবল্ ও চক্রযুক্তচরণ আফিস চেয়ার আসিয়াছে; মূল্যবান আলমারী ষ্টীল ট্রাঙ্কের দ্রব্যাদি আত্মসাৎ করিয়াছে। টেবলের উপর বাতিদানে বাতি জ্বলিতেছে; আলোক কাচগোলকের মধ্য দিয়া স্নিগ্ধ হইয়া আসিতেছে। টেবলের উপর উৎকৃষ্ট আধারবদ্ধ শোভার ফটোগ্রাফের উপর সে আলোক পড়িয়াছে।
এক চুমুক চা পান করিয়া প্রভাত পুস্তক খুলিল; পড়িল;—
“মধু দ্বিরেফঃ কুসুমৈকপাত্রে পপৌ প্রিয়াং স্বামনুবর্ত্তমানঃ
শৃঙ্গেণ চ স্পর্শনিমীলিতাক্ষীং মৃগীমকন্ডূয়ত কৃষ্ণসারঃ॥”
দেবাদেশে যোগমগ্ন মহাদেবের ধ্যানভঙ্গ করিবার জন্য বসন্তসহায় রতিপতি হিমাচলে মহাদেবের আশ্রমে উপনীত। অচিরে মলয়সঞ্চারে ধরিত্রীর শ্যামল অঞ্চল বিচঞ্চল হইয়া উঠিল; অশোকতরু ফুলভারাবনত ও বনভূমি ভ্রমরঝঙ্কারঝঙ্কৃত হইল; বসন্তলক্ষ্মীর অভিনব শ্রী প্রতিভাত হইয়া উঠিল; জীবজগতে প্রেমচাঞ্চল্য প্রকাশিত হইল; এমন কি, বসন্তোত্থাপিত প্রেমরস উদ্ভিজ্জগণকেও আকুল করিল। পাঠ করিতে করিতে প্রভাত পরীক্ষা, পাঠ্য— ভুলিয়া গেল; উদ্ভ্রান্তহৃদয়ে কবিতারস আস্বাদন করিল।তাহার আপনার হৃদয়ে যৌবনসুলভ প্রেমচাঞ্চল্য প্রবল হইয়া উঠিল। যুবকের কল্পনা প্রেমকে বেষ্টন করিয়া ফিরে।
চিত্ত সংযত করিয়া প্রভাত টীকা পাঠ করিতে চেষ্টা করিল: পড়িল বটে, কিন্তু সে পাঠ হৃদয় স্পর্শ করিল না। কয়বার চেষ্টা করিয়া শেষে সে পুস্তক রাখিয়া শয্যায় শয়ন করিয়া ভাবিতে লাগিল।
অল্পক্ষণ পরেই দ্বার হইতে সতীর্থ রমণীমোহন জিজ্ঞাসা করিল; “প্রভাত, পড়িতেছ?”
প্রভাত উত্তর দিল, “না। ভিতরে আইস।”
রমণীমোহন একখানি মাসিকপত্র হস্তে লইয়া প্রবেশ করিল; প্রভাতকে সেখানি দেখাইয়া বলিল, “আমার একটি কবিতা প্রকাশিত হইয়াছে।”
“কি কবিতা?”
“বসন্ত।”
“আমি এখনই ‘কুমারসম্ভবে’ হিমাচলে অকাল-বসন্তোদয়ের বর্ণনা পাঠ করিতেছিলাম।”
“আমার কবিতায় সে বর্ণনার ছায়া পাইবে।”
“পড়, শুনি।”
রমণীমোহন পাঠ করিতে লাগিল:
“হিম–ঋতু-অবসানে জাগিছে ধরার প্রাণে
আকুল-পুলক-দীপ্ত নবীন যৌবন;
বুকে রুদ্ধ প্রেমধারা বহিতে পারে না ধরা,—
তাই ফুলে ফুলময় বন—উপবন;
আকুল বকুলবাসে কি মোহ পবনে ভাসে,
কি প্রেম-মদিরা পানে বিহগ বিহ্বল,
তাই বিহগীরে তা’র ডাকিছে সে বারবার
অধীর কূজনে তা’র ফুটে প্রেমকল;
মুকুলিত আম্রশাখে কোকিল কুহরি’ ডাকে;
অশোকের অগ্নিশিখা সুনীল গগনে;
মলয়ের সাড়া পেয়ে সুপ্তিশেষে দেখে চেয়ে
কিংশুক, করুণ ঢালে সুরভি পবনে;
বিলোল-তটিনীকূলে বিকশিত-তরুমূলে
শ্যাম শষ্পশয্যা’পরে লুটিছে মলয়;
অব্যর্থ কুসুম-শরে প্রেম জাগে চরাচরে—
প্রেমের স্বপন ছায় মানব-হৃদয়।
রসাবেশে কৃষ্ণসার স্পর্শে শৃঙ্গে আপনার
সুখ-নিমীলিত-আঁখি মৃগীরে আপন;
পদ্মগন্ধী জলধারা শুণ্ডে তুলি’ আত্মহারা
প্রেমে করী করিণীরে করিছে অর্পণ;
প্রিয়া সহ মধুব্রত এক পুষ্পে পান-রত,
অধীর গুঞ্জন তা’র প্রেম-অনুরাগে;
চক্রবাক প্রেমসুখে দিতেছে প্রিয়ার মুখে,—
অর্দ্ধভুক্ত, সুকোমল মৃণাল সোহাগে;
পল্লবিত শাখা-করে তরুরে হৃদয়ে ধরে’
লতাবধূ—অঙ্গে শোভে কুসুমভূষণ;
সে প্রেমপরশরাগে তরুর হৃদয়ে জাগে
সুষমাসৌরভভরা নবীন যৌবন;
নবস্ফুট হৃদি-কূলে সুপ্ত প্রেম আঁখি খুলে,
হৃদিকুঞ্জে বাজি উঠে প্রণয়-কূজন;
কুসুমকুন্তলা ধরা মিলন-মাধুরী-ভরা,
প্রেমের বাঁশরী-রবে বিকল ভুবন।
বসন্তে সরম টুটে’ মালতী, মাধবী ফুটে,
কেশরকুসুমে বসে ভ্রমরের দল,
লবঙ্গলতিকা ঘ্রাণে কি মোহ আবেশ আনে,
প্রেমপরিমলপানে পবন পাগল;
বিহগের অঙ্গে আর ধরে না লাবণ্যভার—
নবপক্ষ্মে শোভে কিবা বর্ণ সমুজ্জ্বল;
স্বচ্ছনীর সরোবরে শুভ্র হংস খেলা করে,
নীল জলে শোভে যেন শ্বেত শতদল;
সুনীল গগনতলে বলাকা ভাসিয়া চলে,
গগনে লম্বিত যেন তারকার হার;
কপোতদম্পতি আসি’ পান করে সুখে ভাসি’
গলিত-রজত-ধারা নির্ঝরের ধার,
মৃগযুগ ফুল্লপ্রাণে চাহে এ উহার পানে,
আয়তলোচনে ফুটে প্রেমের কিরণ;
চরাচরে নাহি আর বিষাদের অন্ধকার,
ললিতলাবণ্যে ভাসে প্রেমের স্বপন।
আজি মলয়ের রথে এসেছে নন্দন হ’তে
আকুলপুলকদীপ্ত প্রণয় চঞ্চল;
তাই আজ চরাচরে কি আলোক খেলা করে;
কি প্রেম পীযূষপানে জগৎ বিহ্বল!
প্রণয়ের রক্তরাগে হৃদয়ে বসন্ত জাগে,
সুখস্বপ্নসুখাবেশে মোহিত হৃদয়;
প্রেমের কিরণ লাগি’ কি মাধুরী উঠে জাগি;
চরাচরে কি আনন্দ দিব্য প্রেমময়!
নয়নে প্রেমের আলা, হৃদয়ে প্রেমের জ্বালা,
সরস প্রেমের কান্তি — নবীন যৌবন
অধরে প্রেমের ভাষা, বুকে ভরা ভালবাসা,
অন্তরে বাহিরে প্রেম বিশ্ববিমোহন।
তৃষিত হৃদয় টানে তৃষিত হৃদয় পানে;
তৃষিত নয়ন চাহে তৃষিত নয়নে;
তৃষিত অধর ’পরে তৃষিত চুম্বন ঝরে;
তৃষিত হৃদয় খুঁজে হৃদয় ভুবনে।
শুনিয়া প্রভাত বলিল, “বেশ হইয়াছে। কিন্তু ‘অশোকের অগ্নিশিখা’ কেন? বসন্তে অগ্নিসেবনের ব্যবস্থা! কেন ভ্রমণাদির মধ্যে তোমার নিকট কি অগ্নিসেবনই প্রশস্ত বোধ হইল?”
উভয়েই হাসিল।
প্রভাত বলিল, “এত সৌন্দর্য্যের মধ্যে ‘অগ্নিশিখা’ কাষ নাই।”
প্রভাত, সাগ্রহে বহু কাব্য পাঠ করিয়াছিল; তাই তাহার বন্ধু কবিতা সম্বন্ধে তাহার মত অবধানযোগ্য বিবেচনা করিত। সে জিজ্ঞাসা করিল, “কি করা যায়?”
প্রভাত বলিল, “‘রক্তকেতু’ করিতে পার। বসন্তে প্রেমের দণ্ডপতাকাদির কল্পনা নূতন নহে। জয়দেব বসন্তে প্রস্ফুটিত কেশর কুসুমকে মদনমহীপতির কনকদণ্ড বলিয়াছেন। মধুসূদন প্রমীলার সহচরীর পৃষ্ঠবিলম্বিত বেণীর কথায় বলিয়াছেন, ‘কামের পতাকা যথা উড়ে মধুমাসে’। ‘কেতু’ মন্দ হয় না।”
কিছুক্ষণ কথার পর বন্ধু চলিয়া গেল।
সেই রাত্রিতে শয্যায় শয়ন করিয়া প্রভাত ভাবিতে লাগিল। বসন্তসমাগমে কালিদাসের সেই প্রেমচাঞ্চল্যের বর্ণনা; তাহার পর বন্ধুর কবিতা,— “তৃষিত হৃদয় খুঁজে হৃদয় ভুবনে।” সুর মিলিয়াছিল। তখন বাসন্তী জ্যোৎস্নায় গগন প্লাবিত। প্রভাত কক্ষবাতায়ন মুক্ত করিয়া দিল—বাতায়নপথে জ্যোৎস্নালোক তাহার বিরহশয়নের উপর আসিয়া পড়িল।
জ্যোৎস্নালোকে মানব-হৃদয়ে অভাবনীয় পরিবর্ত্তন সূচিত হয়। জ্যোৎস্নালোকে শিল্পীর নয়নে ধরণী অদৃষ্টপূর্ব্ব নবীন লাবণ্যে সুন্দর হইয়া উঠে। জ্যোৎস্নালোকে কবির কল্পনা পৃথিবী ত্যাগ করিয়া স্বপ্নরাজ্যে বিচরণ করে। জ্যোৎস্নালোকে প্রেম প্রবল হইয়া উঠে। দিবালোকের সাধারণ প্রেম চন্দ্রালোকে অসাধারণ হইয়া উঠে। যে প্রেম দিবালোকে সংযত থাকে, জ্যোৎস্নালোকে তাহা কূলপ্লাবী হইয়া উঠে। মলয়বীজিত, জ্যোৎস্নাপুলকিত যামিনীতে প্রভাতের প্রেম চন্দ্রের আকর্ষণে সমুদ্রের মত উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। প্রভাত উঠিয়া বারান্দায় আসিল। সম্মুখে কৃষ্ণনাথের উপবন-বেষ্টিত গৃহ,—কোলাহলহীন - শান্ত যেন সুপ্ত। সিংহদ্বার রুদ্ধ। দক্ষিণ দিকে যে কক্ষে শোভার অধিকার, সে কক্ষের একটি বাতায়ন অর্দ্ধমুক্ত। সেই বাতায়নপথে কক্ষ হইতে আলোক বাহির হইতেছে। প্রভাত ভাবিতে লাগিল, সে যেমন নিদ্রাহীন নিশীথে পত্নীর কথা ভাবিতেছে, ঐ দীপালোকিত কক্ষে শোভাও কি তেমনই জাগিয়া তাহার কথা ভাবিতেছে না?
সেই জ্যোৎস্নাস্নাত সুপ্ত গৃহের বাতায়নে নিবদ্ধদৃষ্টি প্রভাতচন্দ্র কল্পনায় কত সুখস্বপ্নের রচনা করিতে লাগিল। শোভার কত কথা, কত ব্যবহার তাহার মনে পড়িতে লাগিল।সে সব স্মৃতি সুখের। প্রেম সুখস্মৃতি সযত্নে রক্ষা করে। প্রেমদীপ্ত স্মৃতি সুখের।