নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/দ্বিতীয় খণ্ড/প্রথম পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় খণ্ড।

দুঃখ।

প্রথম পরিচ্ছেদ।

বর্ষান্তে।

 “ঠাকুরঝি, ঠাকুর-জামাই তোমাকে খুব ভালবাসেন?”

 প্রভাতের বিবাহের পর এক বৎসর গত হইয়াছে। মাঘ মাসের স্বল্পায়ু দিবসের অপরাহ্নে কৃষ্ণনাথের অন্তঃপুরস্থিত একটি কক্ষে বড় বধূ পশম মিলাইয়া ছেলের জন্য মোজা বুনিতেছেন। মধ্যমা পিত্রালয়ে পত্র লিখিতেছিলেন। তিনি পত্র লিখা শেষ করিয়া শোভাকে বলিলেন, “ঠাকুরঝি, ঠাকুর-জামাই তোমাকে খুব ভালবাসেন?”

 শোভা উপন্যাস পাঠ করিতেছিল, মুখ না তুলিয়াই বলিল, “কেন, মেজবৌদিদি, তোমার ঠাকুর-জামাই কি তোমার কাণে কাণে এ কথা বলিয়াছেন?”

 মধ্যমা বধূ বলিলেন, “তুমি যতই পান খাও, তোমার ঠোঁঁট রাঙ্গা হয় না।”

 বড় বধূ হাসিলেন।

 শোভা বলিল, “আচ্ছা, আমি বলিয়া দিব, মেজবৌদিদি বড় দুঃখ করিয়াছে; তুমি—”

 কথা সমাপ্ত না হইতেই চপলা কক্ষে প্রবেশ করিল।

 বড় বধূ চপলাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ছোটঠাকুরপো আজ কেমন আছেন?”

 চপলা বলিল, “কি জানি, বড় দিদি, জিজ্ঞাসা করিলে সেই একই উত্তর—সমানই আছি।”

 মধ্যমা বধূ বলিলেন, “যাহাই হউক, ভাল মন্দ কিছু ত বুঝা যায়?”

 চপলা বলিল, “ভাঙ্গিবেন, তবু মচকাইবেন না। যে দিন অসুখ বড় বাড়ে, সে দিনও কি সহজে সে কথা বলেন!”

 মধ্যমা বধূ বলিলেন, “কেন, মূর্খ মানুষ অসুখের কথা শুনিলে কিছু দোষ হয় নাকি?”

 চপলার নয়নে যেন বিদ্যুৎ ঝলকিয়া গেল।

 শোভা বলিল, “এবার পরীক্ষায় সফল হইতে না পারিয়া ছোটদাদার শরীর একেবারে ভাঙ্গিয়া গিয়াছে।”

 বড় বধূ বলিলেন, “বরাবর ভাল করিয়া ‘পাস’ করিয়া এই প্রথমবার চেষ্টা বৃথা হইল। বড় লাগিবারই কথা। তোমার বড় দাদা পুনঃ পুনঃ বলিয়াছিলেন, অসুস্থশরীরে পরীক্ষা দিয়া কায নাই। ঠাকুরপো শুনিলেন না। প্রাণান্ত করিয়া পড়াই বা কেন?”

 চপলা বলিল, “পাস’ করা কি এতই কঠিন কায?” সে শিশিরকুমারের অক্ষুণ্ণ সাফল্যের কথা ভাবিতেছিল।

 মধ্যমা বধূ বলিলেন, “আর ‘পাসে’ কায নাই । অমনই ঠাকুরপো মানুষকে মানুষ বলিয়া গ্রাহ্য করেন না।”

 শোভা বলিল, “কেন, মেজবৌদিদি, ও কথা বল কেন?”

 “তোমার ভাই, তুমি কি দোষ দেখিতে পাইবে? আজকালকার ছেলেরা দুই পাত ইংরাজী উল্টাইলেই গর্ব্বে আর মাটীতে পা দেয় না। বাপ মা’কেই বড় গ্রাহ্য করে! আর সব ত পরের কথা।”

 বড় বধূ বলিলেন, “তাহা নহে। ছোটঠাকুরপো বরাবরই ঐ রকম, গোলমাল ভালবাসে না, পড়া শুনা লইয়াই থাকিতে চাহে। এই যে এত অসুখ—ডাক্তার বলে, পুস্তক স্পর্শ করিও না, তবু কি পড়া ছাড়িয়াছে?”

 শোভা বলিল, “তাই ত অসুখ সারিতেছে না।”

 মধ্যমা তৎক্ষণাৎ বলিলেন, “ও কেবল বাহাদুরী। লোকে বলিবে, বড় ভাল ছেলে,—বিদ্বান। তাই ও সব।”

 বড় বধূ বলিলেন, “তাহা নহে। বিশেষ পুরুষমানুষ, বিদ্বান হইবে, সে ত ভাল আকাঙ্ক্ষা।”

 এমনই নানা আলোচনা হইতে লাগিল।

 কিছুক্ষণ পরে চপলাকে উঠিতে দেখিয়া শোভা জিজ্ঞাসা করিল, ‘ছোটবৌদিদি, যাইতেছ যে?”

 চপলা বলিল, “যাই, দাসীকে সব গুছাইয়া লইতে বলি। মা বলিয়া পাঠাইয়াছেন, সকাল সকাল গাড়ী আসিবে, হিম না লাগে।”

 “এবার কয় দিন সেখানে থাকিবে?”

 “তাহা এখন কেমন করিয়া বলিব? এবার কত দিন পরে যাইতেছি!”

 “কত দিন ত খুব,—এখনও এক মাস পূর্ণ হয় নাই। ”

 মধ্যমা বধূ বলিলেন, “ভাল;—চালন বলেন, সূচ ভাই, তুমি, কেন ছেঁদা?' ঠাকুরঝি, তুমিই বুঝি বড় এক মাস শ্বশুরবাড়ী থাকিয়া আসিয়াছ?”

 চপলা হাসিয়া বলিল, “সে সূর্য্যমামার দেশে এক বার যাইলে আর সহজে আসিতে হইবে না। সে দেশে কি পথ ঘাট আছে? কেবল বন। আচ্ছা, ঠাকুরঝি, বনে খুব বাঘ আছে? ডাকাত আছে?”

 মধ্যমা বধূ বলিলেন, “ঠাকুরঝি অনেক দিন ঘর করিয়া আসিয়াছে কি না,—তাই সব জানে!”

 বড় বধূ চপলাকে বলিলেন, “ছোট ঠাকুরপোর অসুখ দেখিয়া যাইতেছ, এবার শীঘ্র ফিরিও।”

 চপলা বলিল, “কি জানি। মা যেমন বলিবেন, তেমনই হইবে।” চপলা চলিয়া গেল।

 মধ্যমা বধূ শোভাকে বলিলেন, “ঠাকুরঝি, পূজার সময় না হয় একটা ছুতা করিয়া কাটাইয়াছিলে, এবার লইয়া যাইতে চাহিলে কি হইবে?”

 শোভা বলিল, “তখনকার ভাবনা তখন। এখন চল, কাপড় কাচিতে যাই।”

 দুই জনে উঠিলেন।

 শারদীয়াপূজার সময় পিসীমা র আগ্রহে শিবচন্দ্র বধূকে লইয়া যাইবার প্রস্তাব করিয়াছিলেন। শোভার জননী তাহাতে বিশেষ আপত্তি করেন নাই। কিন্তু সে কথা শুনিয়া শোভা এমন ক্রন্দন আরম্ভ করিয়াছিল যে, অতিরিক্ত স্নেহশীল কৃষ্ণনাথ তাহাতে একান্ত বিচলিত হইয়াছিলেন। সৌভাগ্যের বিষয়, ধূলগ্রামের দত্তগৃহে দুর্গোৎসব ছিল না; থাকিলে কৃষ্ণনাথ শোভাকে না পাঠাইয়া পারিতেন না। কৃষ্ণনাথ চতুর বন্ধু শ্যামাপ্রসন্নের শরণ লইলেন। শ্যামাপ্রসন্ন প্রথমে বলিলেন, “এক ঘরের এক বধূ; লইয়া যাইতে চাহিয়াছে, পাঠাইয়া দাও। না হয়, এবার অল্প দিন থাকিয়া আসিবে।”

 কৃষ্ণনাথ বলিলেন, “এখন পল্লীগ্রাম স্বাস্থ্যকর নহে।”

 “কলিকাতাই বা কি এমন স্বাস্থ্যকর? সেখানে ম্যালেরিয়া নাই ত?”

 “কি জানি? প্রথমবার যাইবে,—এখন থাক। বিশেষ সে বড় কাঁদিতেছে। দিন কতক পরেই যাইবে।”

 শেষে শ্যামাপ্রসন্নের পরামর্শমতে কৃষ্ণনাথ বৈবাহিককে লিখিলেন, “আপনি শোভাকে লইয়া যাইবার ইচ্ছা করিয়াছেন। আপনার বধূকে আপনি লইয়া যাইবেন, তাহাতে আমার আর কথা কি? তবে আপাততঃ শোভার শরীর বড় ভাল নাই। অল্প দিন হইল, তাহার জ্বর হইয়া গিয়াছে। চিকিৎসকগণ এখন যাইতে পরামর্শ দেন না। এ বিষয়ে আপনি যাহা যুক্তিযুক্ত বিবেচনা করেন, আদেশ করিবেন।”

 শ্যামাপ্রসন্ন বলিলেন, “আর অধিক কিছু লিখিয়া কায নাই। তাহারা ভাল লোক। দেখিও, ইহাতেই হইবে।”

 সত্য সত্যই তাহাই হইল। এই পত্র পাইয়া শিবচন্দ্র আপাততঃ বন্ধুকে লইয়া যাইবার সঙ্কল্প ত্যাগ করিলেন। শোভা হাফ ছাড়িয়া বাঁচিল।

 প্রভাত পূজাবকাশ গৃহেই কাটাইয়াছিল; হৃদয়ে যে নিবিড় হৃদয়ে ছায়া লইয়া সে পূর্ব্ববার গৃহ হইতে গিয়াছিল, এবার সে ছায়া নিবিড়তর হইয়া উঠে নাই বটে, কিন্তু অপনীত হয় নাই। হৃদয়ে একবার দাগ পড়িলে সহজে দূর হয় না। নদীর অবাধ স্রোতের মুখে একবার যদি ক্ষুদ্র বাধা পড়ে, তবে সলিলবাহিত পলি সেই স্থানে সঞ্চিত হইয়া ক্রমে প্রবাহপথ রুদ্ধ করিতে প্রয়াস পায়। স্নেহের স্রোতে একবার যদি সন্দেহের বাধা পড়ে, তবে সে বাধা অচিরে দূর করিও—নহিলে বিপদ নিবারণ করা অসম্ভব হইবে।

 প্রভাতের পরিবর্ত্তন এবার নবীনচন্দ্রের স্নেহান্ধ নয়নেও প্রতিভাত হইয়াছিল। প্রভাত আপনি হয়ত এ পরিবর্ত্তন বুঝিতে পারে নাই । মানুষ যেমন আপনার শারীরিক বৃদ্ধি সহজে বুঝিতে পারে না, তেমনই তাহার আচার ব্যবহারের পরিবর্ত্তনও সহজে তাহার দৃষ্টিতে পড়ে না। জীবনে ও হৃদয়ে পরিবর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গে আচার ও ব্যবহার পরিবর্ত্তিত হয়, সুতরাং সহজে অনুভূত হয় না।

 কিন্তু প্রভাত যেন আর সে প্রভাত ছিল না। সে পূর্ব্ব হইতেই ধীরে ধীরে পরিবর্ত্তিত হইতেছিল। সে পরিবর্ত্তনের সূচনা তীক্ষ্ণদৃষ্টি শিবচন্দ্র পূর্ব্বেই লক্ষ্য করিয়া তাহার প্রতিরোধ করিতে ইচ্ছুক হইয়াছিলেন। তখন স্নেহশীলা পিসীমা ও স্নেহশীল নবীনচন্দ্র তাঁহার সে চেষ্টা ব্যর্থ করিয়া দিয়াছিলেন। সুবর্ষণে শস্যশীর্ষ যেমন স্বল্পকালমধ্যে পূর্ণ ও পুষ্ট হইয়া ফুলিয়া উঠে, এখন সুবিধা পাইয়া সেই পরিবর্ত্তন তেমনই পুষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল। সুবিধার প্রধান উপকরণ—অর্থ। তাহার জন্য প্রভাতকে ভাবিতে হইত না। শিবচন্দ্র যাহাই করুন, তাহার আবশ্যক বাড়িয়াছে বলিয়া নবীনচন্দ্র গোপনে প্রতিমাসে তাহাকে পূর্ব্বাপেক্ষা অধিক অর্থ পাঠাইতেন। তদ্ভিন্ন তাহার আপনারও অর্থ ছিল। কৃষ্ণনাথ বিবাহকালে জামাতাকে যে অর্থ দিয়াছিলেন, শিবচন্দ্র তাহা স্পর্শ করেন নাই। সে টাকা প্রভাতের নামে ব্যাঙ্কে জমা ছিল। শিবচন্দ্র সে টাকার কথা জিজ্ঞাসা করিতেন না। যৌবনে — অভিভাবকহীন অবস্থায় প্রচুর অর্থের মত কুসঙ্গী আর নাই। সংসারের ভাব বুঝিবার পূর্ব্বে মানুষ ব্যয় করিতেই ভালবাসে—তাহার আনন্দ ব্যয়ে, সঞ্চয়ে নহে।

 পূজার অবকাশ শেষ হইবার পূর্ব্বেই প্রভাত কলিকাতায় ফিরিয়া গেল; পরীক্ষা নিকটবর্ত্তী।

 প্রভাত চলিয়া যাইবার পর শিবচন্দ্র এক দিন নবীনচন্দ্রকে বলিলেন, “নবীন, আমার সন্দেহ হইতেছে, প্রভাত বড় অমিতব্যয়ী হইয়া উঠিয়াছে। তাহার আচরণ ও ব্যবহার লক্ষ্য করিয়া আমি শঙ্কিত হইয়াছি। এখন হইতে সাবধান করা প্রয়োজন।”

 নবীনচন্দ্র মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কি তাহাকে কিছু বলিয়াছেন?”

 “না। আমি কিছু বলি নাই। আমি সেবার তিরস্কার করিয়াছিলাম, তাহাতে তাহার মন ভারি হইয়াছে। তুমিও তাহাতে কিছু অসন্তুষ্ট হইয়াছ। তাই আমি কিছু বলি নাই। বিশেষ, এখন সে বড় হইয়াছে। আর শাসনের সময় নাই। যদি তাহাকে কলিকাতার প্রভাব হইতে দূরে আনিয়া আবার আমাদের কাছে রাখিতে পারিতাম, তাহা হইলে ভাল হইত।”

 “কিন্তু—পাঠের—”

 “তাহাই বলিতেছি। আর তাহা হইবে না। আমরাই তাহার আকাঙ্ক্ষা বাড়াইয়াছি; এখন তাহার বদ্ধমূল উচ্চাশা উন্মূলিত করা সঙ্গত হইবে না। তুমি তাহাকে সকল কথা বুঝাইয়া সদুপদেশ দাও।”

 নবীনচন্দ্র এ কথার যাথার্থ্য‌ বুঝিলেন; শেষে বলিলেন, “পরীক্ষার আর কয় মাস মাত্র আছে। এই কয়টা মাস কাটুক।”

 শিবচন্দ্র বলিলেন, “কিন্তু অভ্যাস প্রবল হইয়া দাঁড়াইলে সহজে ছাড়িতে পারিবে না।”

 শেষে স্থির হইল, এই কয়টা মাস আর কিছু বলা হইবে না। দত্ত-গৃহে চিন্তার ছায়া পড়িল।