নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/প্রথম খণ্ড/পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
শিবচন্দ্র কি ভাবিলেন?
হেমন্তের প্রভাতে রৌদ্র কেবল উপভোগযোগ্য মধুর হইয়া আসিতেছে। শিবচন্দ্র প্রাতঃস্নান শেষ করিয়া আসিয়াছেন; চণ্ডীমণ্ডপে বসিয়া ধূমপান করিতেছেন। গ্রামের ডাক-হরকরা গৃহে প্রবেশ করিল। তাহার গাত্রে একখানি অর্দ্ধছিন্ন মলিন বালাপোশ, পদে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত ধূলি। সে আসিয়া শিবচন্দ্রকে নমস্কার করিল। শিবচন্দ্র তাঁহার পুত্ত্র—কন্যাদিগের কুশল জিজ্ঞাসা করিলেন। সে উত্তর দিল; তাহার পর ব্যাগের মধ্য হইতে একখানি পত্র বাহির করিয়া শিবচন্দ্রের হস্তে দিয়া প্রস্থান করিল।
খামের হস্তাক্ষর সুপরিচিত নহে। শিবচন্দ্র খামখানা দুই চারিবার নাড়া চাড়া করিলেন, পরে খুলিয়া পড়িতে লাগিলেন। পড়িতে পড়িতে তাঁহার মুখে বিরক্তিভাব সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল।
পত্রখানি পাঠ করিয়া শিবচন্দ্র ডাকিলেন, “লক্ষণ!” উত্তর না পাইয়া তিনি পুনরায় ডাকিলেন।
“আজ্ঞা যাই।”—বলিয়া পরক্ষণেই ভৃত্য আসিয়া উপস্থিত হইল।
শিবচন্দ্র বলিলেন, “নবীনকে ডাকিয়া আন্।”
যে পাকশালায় আমরা পিসীমাকে অন্নপূর্ণারূপে বিরাজিতা দেখিয়াছি, সেই পাকশালার পশ্চাতে উচ্চপ্রাচীরবেষ্টিত প্রাঙ্গন। প্রাঙ্গনের মধ্য দিয়া উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত একটি পথ; পথ উত্তরে বাটীর খিড়কীর দ্বার পর্য্যন্ত গিয়াছে। এই দ্বিধাবিভক্ত প্রাঙ্গনের পূর্ব্বার্দ্ধে পথিপার্শ্বে বৃতি গঠিত করিয়া মধ্যে ভূমিখণ্ডে শবজীর বাগান করা হইয়াছে। পশ্চিমার্দ্ধে গোশালা। গোশালার সম্মুখে অনাবৃত ভূমিতে এক স্থানে মৃত্তিকা কিছু উচ্চ করিয়া তাহার মধ্যে কয়টি বৃহৎ মৃৎপাত্র প্রোথিত। কয়টি গাভী সেই সকল পাত্রে প্রদত্ত আহার্য্য আহার করিতেছে। অদূরে একটি গোবৎস এক গুচ্ছ বিচালি মুখে লইয়া কি দেখিতেছে। একটি গাভী সম্প্রতি প্রসূতা হইয়াছে; তাহার দুগ্ধ সেদিন প্রথম পান করা হইবে। নবীনচন্দ্র স্বয়ং দাঁড়াইয়া দোহন পর্য্যবেক্ষণ করিতেছেন। গাভী বৎসের গাত্র লেহন করিতেছে; স্নেহরসে তাহার আপীন পূর্ণ হইয়া উঠিতেছে। গোশালার ভৃত্য ইহার পার্শ্বে বসিয়াছে, দুই জানুর মধ্যে মার্জ্জিত, উজ্জ্বল পাত্র রক্ষা করিয়া দোহন করিতেছে। উষ্ণ দুগ্ধধারা সবেগে ভাণ্ডে পতিত হইয়া অমল শুভ্র ফেনহাস্যময় হইয়া উঠিতেছে।
লক্ষণ আসিয়া নবীনচন্দ্রকে সংবাদ দিল, বড়কর্ত্তা ডাকিতেছেন। নবীনচন্দ্র বলিলেন, “আমি এখনই যাইতেছি।” কিন্তু শিবচন্দ্রের আর বিলম্ব সহিল না; তিনি পত্র লইয়া স্বয়ং আসিয়া ডাকিলেন, “নবীন!”
“যাই, দাদা!” বলিয়া নবীনচন্দ্র দোহনকারীকে বলিলেন, “দেখিস্, যেন বৎসের জন্য পর্য্যাপ্ত দুগ্ধ থাকে।”
দুই ভ্রাতা বহির্বাটীর অভিমুখে চলিলেন।
সহসা শিবচন্দ্রকে গোশালায় যাইতে ও উভয় ভ্রাতাকে ফিরিয়া আসিতে দেখিয়া পিসীমা রন্ধনশালা হইতে বাহিরে রোয়াকে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিরে, শিব?”
শিবচন্দ্র বিরক্তভাবে বলিলেন, “আমার মাথা আর মুণ্ড।” “এই লও, পড়” বলিয়া তিনি নবীনচন্দ্রকে পত্রখানি দিলেন। নবীনচন্দ্র পড়িলেন,—
“যথাবিহিত সম্মান পুরঃসর নিবেদন,
কিছু দিন আপনাদের সংবাদ না পাইয়া চিন্তিত আছি। কুশল সংবাদ দানে সুখী করিবেন।
আপাততঃ নিবেদন, শ্রীযুক্ত কৃষ্ণনাথ বসু মহাশয় কলিকাতার এক জন অতি প্রসিদ্ধ ব্যক্তি মুখ্য কুলীন, বিশেষ ধনী। শ্রীমান প্রভাতচন্দ্রের সহিত তাঁহার কন্যার বিবাহ দিতে সম্মত হইয়াছেন। কলিকাতায় অনেক বড়লোক তাঁহার সহিত সম্বন্ধ শ্লাঘার বিষয় বলিয়া বিবেচনা করেন। এ সম্বন্ধ আমাদের পক্ষে বিশেষ সৌভাগ্যের কথা। যাহাতে এ বিবাহ হয়; আমি তাহার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিতেছি। আপনি সত্বর সম্মতি দান করিয়া বাধিত করিবেন।
আপনাদের আশীর্ব্বাদে আমার প্রাণগতিক কুশল।
আপনি আমার নমস্কার জানিবেন ও শ্রীযুক্তা দিদিঠাকুরাণীকে প্রণাম জানাইবেন; নিবেদন ইতি।
বশংবদ
শ্রীহরিহর ঘোষ।”
শুনিয়া পিসীমা বলিলেন, “সে কি? ও পাড়ার মিত্ররা আমাদের আশায় আর কোথাও মেয়ের সম্বন্ধ করিল না, সর্ব্বদা আমাদের সংবাদ লয়। এখন কি হইবে?”
শিবচন্দ্র বলিলেন, “আমি বরাবরই বলিয়া আসিতেছি, তুমি আর নবীন আদর দিয়া ছোঁড়াটার মাথা খাইলে; দেখ দেখি,এখন কি করা যায়? কে কৃষ্ণনাথ? তাহাকে চিনি না; কেমন বংশ, কেমন ঘর, কিছুই জানা নাই।”
পিসীমা আর উত্তর করিতে পারিলেন না।
পত্র পাঠ করিয়া নবীনচন্দ্রও অত্যন্ত বিস্মিত হইয়াছিলেন। কিন্তু তিনি দেখিলেন, শিবচন্দ্র পুত্রের প্রতি ক্রুদ্ধ হইয়াছেন; তিনি প্রভাতকে নির্দ্দোষ প্রমাণ করিবার উদ্দেশ্যে বলিলেন, লিখিয়াছে আর এক জন। ইহাতে প্রভাতের দোষ কি? সে ত কিছু লিখে নাই!”
শিবচন্দ্র বলিলেন, “সে না জানিলে এ প্রস্তাব হইল কিরূপে? তাহারা কেমন করিয়া জানিল যে, তাহার ঘর করণীয়, সে অকৃতদার? কত ছেলেই ত কলিকাতায় পড়ে, কে তাহাদের বিবাহের সম্বন্ধ করে?”
“সে সব কিছুই ত এখন জানা যাইতেছে না। সন্ধান লইতে হইবে। হয় ত হরিহরই সম্বন্ধ করিতেছে।”
কত ছেলে কলিকাতায় পড়ে, কেহ তাহাদের বিবাহের সম্বন্ধ করে না—এ কথাটা শিবচন্দ্র পুত্ত্রকে বিশেষরূপে অপরাধী প্রতিপন্ন করিবার জন্যই বলিয়াছিলেন। কিন্তু শত ছেলের যাহা হয় না, প্রভাতের তাহাই হইয়াছে,—ইহাতে পিসীমা শত ছেলের অপেক্ষা প্রভাতের শ্রেষ্ঠত্বই স্পষ্ট অনুভব করিলেন। তিনি বলিলেন, “সত্যই ত, এখনও ত কিছুই জানা যাইতেছে না!”
শিবচন্দ্র বলিলেন, “ইহার আবার জানাজানি কি? আমি লিখিয়া দিতেছি, আমি কলিকাতার বড়মানুষের সঙ্গে কুটুম্বিতা করিব না।”
নবীনচন্দ্র বলিলেন, “মুখ্য কুলীন, বিশেষ হরিহর কুটুম্ব, একটা প্রস্তাব করিয়াছে, অমন ভাবে উত্তর দেওয়া কি ভাল হইবে?”
“তবে কি করিবে? না জানিয়া শুনিয়া সেখানে কায করিবে?”
“আমি তাহা বলিতেছি না। যদি ঘর করণীয় হয়—সম্বন্ধ আমাদের বাঞ্ছনীয় হয়, তবেই কায করিব; নহিলে নহে। আমাদের ছেলে—মেয়ে নহে। সম্বন্ধ অনভিপ্রেত বোধ হয়, একটা কোনও কারণ বলিয়া জবাব দিলেই হইবে।”
“তবে চল; সেই পরামর্শ করি।”
“চলুন। আমি যাইতেছি।”
শিবচন্দ্র অগ্রসর হইলেন।
পিসীমা বলিলেন, “নবীন, কি বল দেখি?”
বড়বধূ ঠাকুরাণী আমিষ—পাকশালার দ্বারান্তরালে ছিলেন, এখন বাহির হইয়া ননন্দার নিকটে দাঁড়াইলেন।
নবীনচন্দ্র বলিলেন, “দাদা যাহা বলিয়াছেন, তাহা সত্য। তাহারা সন্ধান পাইল কেমন করিয়া?”
পিসীমা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি করিবি?”
“আমি কলিকাতায় যাই। দেখি, ব্যাপার কি। প্রভাতের মত জানি। যদি তাহার মতই হয়!”
“মিত্রবাড়ীর উহারা কি মনে করিবে?”
“মিত্রবাড়ী কায হয়, খুবই ভাল। একান্ত না হয়, কি করা যাইবে? তাঁহারা খুব চেষ্টা করিতেছেন, কিন্তু আমরা ত কোনও কথা দিই নাই। এখনকার ছেলে—বড় হইয়াছে, তাহার অমতে কায করা ভাল হইবে না।”
“ইহা তোমরাই করিলে। আমি কবে হইতে বলিতেছি, ছেলের বিবাহ দাও।”
বড়বধূ ঠাকুরাণী ননন্দাকে বলিলেন, “তোমরা যাহা বলিবে, তাহার উপর ছেলের আবার কথা কি?”
নবীনচন্দ্র হাসিয়া বলিলেন, “এখন কি আর সে কাল আছে?”
নবীনচন্দ্র বহির্বাটীতে যাইতেছিলেন, পিসীমা তাঁহাকে ডাকিলেন, বলিলেন, “দেখ্, নবীন, যদি প্রভাতের মতই জানিতে হয়, তবে না হয় সতীশকে দিয়া একখানা পত্র লিখাইয়া দে। তোর কাছে যদি লজ্জায় না বলে?”
নবীনচন্দ্র ভাবিলেন, প্রভাত তাঁহার নিকট যাহা বলিবে না, কাহারও নিকট তাহা প্রকাশ করিবে না; তিনি বলিলেন, “না। এখন এ কথা কাহাকেও বলিয়া কায নাই।”
নবীনচন্দ্র বহির্বাটীতে আসিলেন। শিবচন্দ্র চণ্ডীমণ্ডপে ছিলেন। নবীনচন্দ্র ভ্রাতার নিকট বসিলেন।
শিবচন্দ্র বলিলেন, “এখন কর্ত্তব্য কি?”
নবীনচন্দ্র বলিলেন, “হরিহর কুটুম্ব; কখনও কোনও অনুরোধ করে নাই। সহসা রূঢ় উত্তর দিবেন?”
“তবে কি লিখি?”
“বরং লিখুন, নবীন কলিকাতায় যাইবে; তাহাকে সকল বিষয় অবগত করাইবে। তাহার নিকট সব শুনিয়া উত্তর দিব।
“তাহা হইলে তোমাকে যাইতে হয়।”
“কাযেই।”
“তবে তাহাই লিখি।”
তখন নবীনচন্দ্র লেখনী প্রভৃতি আনিলেন। শিবচন্দ্র মুক্তার মত অক্ষরে হরিহরকে পত্র লিখিলেন:—
“পরম পোষ্টৃবরেষু,
তোমার পত্র পাইয়া আহ্লাদিত হইলাম।
শ্রীমান প্রভাতচন্দ্র বাবাজীর বিবাহের প্রস্তাব করিয়াছ।সে সম্বন্ধে সকল বিষয় জানিবার জন্য শ্রীমান নবীনচন্দ্র ভায়া কলিকাতায় যাইতেছেন। তিনি তোমার সহিত পরামর্শ করিয়া কর্তব্য স্থির করিবেন। তিনি বাবাজীর বাসাতেই থাকিবেন।
এ বাটীর মঙ্গল। তোমার মঙ্গল-সংবাদ সর্ব্বদা পাইতে বাঞ্ছা করি। ইতি; সাকিন ধূলগ্রাম।
শুভাকাঙ্ক্ষী—
শ্রীশিবচন্দ্র দত্ত।”
পত্রখানি ডাকঘরে প্রেরিত হইল।
শিবচন্দ্র ভ্রাতাকে বলিলেন, “দূর দেশ; কেমন ঘর, কেমন বংশ, কেমন পরিবার, কিছুই জানিবার সুবিধা নাই। কেবল বাহির দেখিয়া কায করিতে আমার প্রবৃত্তি হয় না। চিরজীবনের জন্য যাহাকে আনিতে হইবে, তাহাকে ভাল করিয়া না জানিয়া আনা কর্ত্তব্য নহে।”
নবীনচন্দ্র বলিলেন, “তা’ ত বটেই। তবে, ছোট মেয়ে, যেমন শিখান যাইবে, অবশ্যই শিখিবে।”
“তাহাই কি সকল সময় হয়, ভাই? তুমি যাইতেছ; কোনও কৌশলে এ সম্বন্ধ ভাঙ্গিয়া দিও।”
নবীনচন্দ্র পরদিন কলিকাতা যাত্রা করিলেন। পিসীমা গৃহবিগ্রহের উদ্দেশে বলিলেন, “ঠাকুর, যেন কোনও অমঙ্গল না ঘটে।”