নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/প্রথম খণ্ড/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

নূতন পরিচয়।

রবিবার অপরাহ্নে ভবানীপুরে একটি অবৃহৎ, অপেক্ষাকৃত পুরাতন অট্টালিকার দ্বারে একখানি গাড়ী দাঁড়াইল। অশ্বদ্বয় বহুদূর হইতে আসিয়াছে; তাহাদের চিক্কণ কৃষ্ণ অঙ্গে স্থানে স্থানে শ্বেত ফেন সঞ্চিত হইয়া আছে। কৃষ্ণনাথ যান হইতে অবতরণ করিলেন; সঙ্গে তাঁহার বাল্যসখা, হাইকোর্টের উকীল শ্যামাপ্রসন্ন রায়। গৃহস্বামী রমানাথ বাবুও উকীল। তিনি গৃহে আছেন, সন্ধান লইয়া উভয়ে গৃহে প্রবেশ করিলেন। গৃহস্বামী প্রবেশপথের দক্ষিণের কক্ষে বসিয়াছিলেন। হর্ম্ম্যতল সিক্ত; কক্ষপ্রাচীর বহুদূর পর্যন্ত রসিয়া উঠিয়াছে। একটা আলনায় একটা চাপ্‌কান, একখানি চাদর, একটা পেল্টুলেন, একজোড়া মোজা ও একটি শামলা ঝুলিতেছে। এক পার্শ্বে দুইটা আলমারীতে আইনের পুস্তক সজ্জিত—কোনখানা সোজা, কোনখানা বা উল্টা। অপর পার্শ্বে দুইখানি অনুচ্চ তক্তপোষের উপর মলিন বিছানা— স্থানে স্থানে তৈলপাতচিহ্ন। সেই বিছানায় গোটা দুই তাকিয়া, জন দুই মক্কেল ও খানকতক পুস্তকে বেষ্টিত গৃহস্বামী গলদেশে পশমী কম্‌ফর্টার জড়াইয়া, মলিদায় দেহ আবৃত করিয়া মোকর্দ্দমার নথি পরীক্ষা করিতেছিলেন। আগন্তুকদিগকে দেখিয়া তিনি স্বাগতসম্ভাষণ করিলেন।

 শ্যামাপ্রসন্ন কৃষ্ণনাথের সহিত রমানাথের পরিচয় করাইয়া শেষোক্তকে বলিলেন, “তোমার কাছে একটু কাযে আসিয়াছি।”

 রমানাথ বলিলেন, “কি? বল।”

 “তোমার বাড়ীতে ফুলতলার হরিহর ঘোষ থাকেন?”

 “হাঁ।”

 “কৃষ্ণনাথ একটি ছেলের সহিত কন্যার বিবাহের প্রস্তাব করিতেছে। ছেলেটি সম্পর্কে হরিহর বাবুর ভাগিনেয়। অন্য কোনও নিকটসম্পর্কীয় লোকের অভাবে আমরা তাঁহাকেই ধরিতে আসিয়াছি। ছেলের বাপের মত করাইতে হইবে!”

 শুনিয়া রমানাথ একটু বিস্মিত হইলেন। হরিহর তাঁহার সামান্য বেতনের মুহুরী। তিনি শেষে ভাবিলেন, “হইবে। ব্রাহ্মণ কায়স্থের সম্পর্ক কোথায় বা না থাকে?” ভৃত্য কলিকায় ফুঁ দিতে দিতে কক্ষে প্রবেশ করিল। রমানাথ তাহাকে বলিলেন, “হরিহরকে ডাকিয়া আন।”

 অল্পক্ষণ পরেই হরিহর কক্ষে প্রবেশ করিল। শ্যামাপ্রসন্ন বলিলেন, “বসুন।”

 সে বসিতে ইতস্ততঃ করিতেছিল। রমানাথ ইঙ্গিত করিয়া বসিতে বলিলেন। সে বসিল।

 শ্যামাপ্রসন্ন জিজ্ঞাসা করিলেন, “ধূলগ্রামের শিবচন্দ্র দত্ত আপনার ভগিনীপতি?”

 হরিহর বলিল, “হাঁ।”

 “তাঁহার অবস্থা কেমন?”

 “তাঁহারা বনিয়াদি ঘর। মধ্যে অবস্থ। কিছু হেল্‌তি হইয়া আসিয়াছিল। এখন আবার অবস্থা ভালই হইয়াছে, বেশ সঙ্গতিপন্ন।”

 “তাঁহার পুত্ত্র প্রভাতচন্দ্র বি. এ. পড়িতেছে। আমার এই বন্ধু তাহার সহিত কন্যার বিবাহ দিতে ইচ্ছুক হইয়াছেন। এ সম্বন্ধ শিববাবুর পক্ষে সৌভাগ্য। যাহাতে এ সম্বন্ধে তাঁহার মত হয়,আপনাকে তাহা করিতে হইবে।”

 হরিহরের ইচ্ছা হইল, সত্য কথা বলে,—শিবচন্দ্রের সহিত তাহার সেরূপ ঘনিষ্ঠতার অভাব। কিন্তু মানব-হৃদয়ে নিহিত সম্মানলাভলালসা তাহাকে বুঝাইয়া দিল,—যদি অনায়াসে কৃষ্ণনাথের মত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির সম্মানলাভ করা যায়, তাহা ত্যাগ করা সুবুদ্ধির কার্য্য নহে। সে বলিল, “আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করিব।”

 শ্যামাপ্রসন্ন বলিলেন, “তবে আপনি পত্র লিখুন।”

 রমানাথ ও কৃষ্ণনাথ এই প্রস্তাবের সমর্থন করিলেন। তখন হরিহর কালী, কলম ও কাগজ আনিল। শ্যামাপ্রসন্ন বলিয়া যাইলেন, সে পত্র লিখিল।

 পত্র লিখিত হইলে রমানাথ হরিহরকে বলিলেন, “পত্রখানা এখনই পাঠাইয়া দাও।” হরিহর উঠিয়া গেল।

 অল্পক্ষণ পরেই কৃষ্ণনাথ ও শ্যামাপ্রসন্ন বিদায় লইলেন।

 যান ভবানীপুর ছাড়াইয়া ময়দানে আসিয়া পড়িল। ময়দান যেন নিরানন্দ। শীতবাতে অনেক তরুর অধিকাংশ পত্রসম্পদ হরিৎ হইতে হরিদ্রায় পরিণত হইয়াছে, বা হইতেছে;—কতকগুলি পবনতাড়নে নীরস বৃন্ত হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া বাতাসে ভাসিতে ভাসিতে তরুমূলে আসিয়া পড়িতেছে। পত্ররাজি ও ভূমির তৃণাবরণ ধূলিধূসর, ম্লান। রাজপথের উপর বাতাসে ধূলি ভাসিতেছে।

 শ্যামাপ্রসন্ন জিজ্ঞাসা করিলেন, “সব ভাল করিয়া জানিয়াছ ত?”

 কৃষ্ণনাথ বলিলেন, “ছেলেটি বিনোদের সঙ্গে পড়িত। ছেলেটি ভাল। বাড়ীর মেয়েদের বড় ইচ্ছা।”

 “মেয়েদের বিবেচনা চিরকালই সমান। কলিকাতার বাহিরে; অনেক দূর। সে সব ভাবিয়া দেখিয়াছ?”

 “সে আর কি করিব, বল? বিশেষ, কলিকাতার ছেলের অপেক্ষা পল্লীগ্রামের ছেলে ভাল হয়, ধীর হয়, লেখাপড়া করে। মোটা ভাত, মোটা কাপড়ের কষ্ট নাই। বিশেষতঃ ছেলেটি কলিকাতাতেই থাকিবে, কাযেই পল্লীগ্রাম বলিয়া বিশেষ আপত্তির কারণ নাই।”

 “বাড়ীর অবস্থার সন্ধান ভাল করিয়া লইও।”

 “তা’ ত লইতেই হইবে।”

 কৃষ্ণনাথ কি ভাবিতে লাগিলেন। গাড়ী দ্রুতবেগে পথ অতিক্রম করিতে লাগিল।

 শ্যামাপ্রসন্নকে তাঁহার গৃহে পৌঁছাইয়া কৃষ্ণনাথ গৃহে আসিলেন। তখন সন্ধ্যা হয় হয়।

 এ দিকে প্রভাত আর কৃষ্ণনাথের গৃহে যায় না;—বড় লজ্জা করে। বিনোদবিহারী প্রায়ই আইসে, কিন্তু সে যায় না। বিনোদবিহারী বিদ্রূপ করিয়া বলে, “বিবাহের কথা বলিয়া তোমাকে যে একেবারে হারাইতে বসিলাম! এখন কোথায় কি তাহার স্থির নাই, কিন্তু তুমি আর আমাদের বাড়ী মাড়াও না। এ যে বিষম লজ্জা!” প্রভাত উত্তর করে না, মুখ নত করিয়া থাকে।

 আপনার কক্ষে বসিয়া ভাবিতে ভাবিতে প্রভাত যদি সম্মুখের অট্টালিকার দিকে চাহে, তবে তখনই দৃষ্টি ফিরাইয়া লয়। লজ্জা আপনার মনে। তবুও তাহার অজ্ঞাতে দৃষ্টি কেবল সেই দিকে যায়!

 বিনোদবিহারী দেখিল, তাহার বিদ্রূপবাণ প্রভাতের লজ্জার বর্ম্ম ভেদ করিতে পারিল না! তখন সে একদিন সন্ধ্যায় তাহাকে আহারের নিমন্ত্রণ করিল। প্রভাত অসুস্থতার ওজর করিল। বিনোদবিহারী হাসিয়া বলিল, “আমি দেখিতেছি, তুমি বেশ সুস্থ আছ। তোমার রোগ কেবল লজ্জা।” তাহার গমনে বিলম্ব ঘটিলে বিনোদবিহারী স্বয়ং পুনরায় আসিল। প্রভাত বলিল, “আমাকে ক্ষমা করুন। শরীর ভাল নাই।” বিনোদবিহারী বলিল, “ও বাঁধা ওজর আমি শুনিব না। তুমি যদি না যাও, তবে আমি আর তোমার এখানে আসিব না।” ইহার উপর আর কথা চলে না। প্রভাত যাইবার উদ্যোগ করিল। কিন্তু যেরূপ সাধারণ বেশে সে এত দিন সম্মুখের বাড়ীতে যাইত, আজ আর সেরূপ হইল না; আজ আয়োজন অনেক।

 পথে যাইতে যাইতে বিনোদবিহারী বলিল, “তোমার লজ্জিত হইবার কোনও কারণ নাই। আমি এ কথা এখনও সকলকে বলি নাই।”

 বিনোদবিহারী বলিল বটে, সে কথা সে সকলকে বলে নাই, কিন্তু সে বাড়ীতে তাহার আদর অভ্যর্থনার অতিশয্যে প্রভাতের বুঝা উচিত ছিল, সে কথা প্রকাশ পাইয়াছে—গোপন নাই।

 সে বাড়ীতে সকলেই তাহাকে বিশেষ লক্ষ্য করিতে লাগিল। বিনোদবিহারীর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা তাহার সহিত নানা কথা কহিতে লাগিলেন। কৃষ্ণনাথও তাহার সহিত আলাপ করিলেন।

 ইহার পূর্ব্বে প্রভাত বহুবার এ বাড়ীতে আসিয়াছে; কিন্তু সে বিনোদবিহারীর বন্ধুরূপে। কাযেই তখন সে বিনোদবিহারীর বসিবার ঘরে যাইত, সেখানে তাহারই সহিত কথোপকথন হইত। এবার এই আদরে, আলাপে, যত্নে সে যেমন লজ্জিত হইতে লাগিল, তেমনই আনন্দ অনুভব করিল।

 আহারের ব্যবস্থা বহির্বাটী ও অন্তঃপুরের মধ্যপথে—মর্ম্মরমণ্ডিতহর্ম্ম্যতল কক্ষে হইয়াছিল। অন্তঃপুরের দিকে দ্বার ভেজান ছিল; ভোক্তাদিগকে সেই দিকে সম্মুখ করিয়া বসিতে হইল। সেই সকল দ্বারের পশ্চাতে মহিলাদিগের অলঙ্কারশিঞ্জিত ও অঞ্চলবদ্ধ কুঞ্চিকাগুচ্ছের সঞ্চালনধ্বনিও পুনঃপুনঃ শ্রুত হইতে লাগিল। প্রভাত বুঝিল, অন্তঃপুরচারিণীরা তাহাকে লক্ষ্য করিতেছেন। লজ্জায় সে আর মুখ তুলিতে পারিল না।

 সেই হইতে প্রভাতের সে বাড়ীতে গতায়াত কিছু ঘন ঘন হইতে লাগিল। বিনোদবিহারী প্রায়ই আসিত, এবং তাহাকে লইয়া যাইত। কিন্তু শোভা আর পূর্ব্বের মত তাহার সম্মুখে বাহির হইত না। কেবল একদিন বিনোদবিহারীর সহিত তাহার বসিবার ঘরে প্রবেশ করিয়া প্রভাত দেখিল, সুবেশসজ্জিতা শোভা টেবলের উপর একখানি বাঙ্গলা উপন্যাস রাখিতেছে। প্রভাতকে দেখিয়া লজ্জায় তাহার মুখ রক্তাভ হইয়া উঠিল; সে নতদৃষ্টি হইয়া দ্রুতপদে কক্ষত্যাগ করিল। বিনোদবিহারী হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করিল, “পুস্তকখানা কি তোর মেজ বৌদিদি পাঠাইয়াছে?” শোভা উত্তর করিল না; সে একেবারে অন্তঃপুরে যাইয়া মেজ বৌদিদির সহিত ঝগড়া করিতে লাগিল, “মেজ বৌদিদি, আমি আর কখনও তোমার কোনও কথা শুনিব না। এই জন্যই বুঝি আজ এত সাজান—চুল বাধা?” তিনি যত হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করেন, “ঠাকুরঝি, কি হইয়াছে?” সে ততই রাগ করে। শোভার সেই লজ্জারাগরক্ত আননের ছবি প্রভাতের হৃদয়ে মুদ্রিত হইয়া গেল।

 প্রভাত আকাশে কুসুমকানন রচনা করিতে লাগিল। সে কাননে কুসুমের পার্শ্বে কণ্টক নাই। সে উপবনে কেবল কুসুম, কেবল আনন্দ, কেবল সুখ। হায়, মুগ্ধ যুবকের কল্পনা!