নাবিক-বধূ/ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

সায়ংকালে চন্দ্রোদয় না হওয়ায় সমগ্র প্রকৃতি অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল, ডড্‌লে যখন তমসাবৃত অরণ্য অতিক্রম করিয়া মুক্ত প্রান্তরে প্রবেশ করিলেন— তখন পূৰ্বাকাশে চন্দ্রোদয় হইল।—কিন্তু অন্ধকাবে অরণ্যমধ্যবর্তী পথে অগ্রসর ইতে তাহার কিরূপ কষ্ট হইয়াছিল—তাহা সহজেই অনুমান করিতে পারা যায়। চতুর্দিকে ঘন বন, তাহার ভিতর দিয়া অতি সঙ্কীর্ণ পথ, —এক হাত দূরের বস্তুও দেখিতে পাওয়া যায় না। প্রতিপদক্ষেপে তাহার পদস্খলন হইতে লাগিল, নানাজাতীয় আরণ্য-লতায় তাহার পদদ্বয় বাধিয়া যাইতে লাগিল, কতবার তিনি পড়িতে পড়িতে সামলাইয়া লইলেন তাহা বলা যায় না। কষ্টেও যদি তিনি কার্যোদ্ধার করিতে না পারেন—তাহাহইলে মিস এরস কাইনের অবস্থা কিরূপ শোচনীয় হইবে—ইহা চিন্তা করিয়া তাহার উৎকণ্ঠা শতগুণ বর্ধিত হইস। নিজের সঙ্কটের কথা একবারও তাহার মনে পডিল না। —সেই অরণ্যের মধ্যে ঘণ্টাখানেক ঘুরিয়াও তিনি দি্কভ্রান্ত হইলেন না, সমুদ্রতীর লক্ষ্য করিয়া চলিতে-চলিতে মুক্ত প্রান্তরে পদার্পণ করিলেন। তখন চন্দ্রোদয় হইয়াছে, সুতরাং অসুবিধা অনেকটা দূর হইল, তিনি অপেক্ষা- কত দ্রুতবেগে সমুদ্রের দিকে চলিলেন তিনি দেখিলেন, চতুর্দিক নিস্তব্ধ, যেন সমগ্র প্রকৃতি গাঢ় সুপ্তিঘোরে সমাচ্ছন্ন। সমুদ্র স্থির, গগনবিহারী নক্ষত্র- নিকল্পের শুভ্রজ্যোতি স্বচ্ছ মুকুরের ন্যায় নির্মূল সমুদ্রবক্ষে প্রতিবিম্বিত হইতেছিল। ডড্‌লে দূরে দাঁড়াইয়া সমুদ্রতীরবর্ত্তী জাহাজখানির দীপরশ্মি দেখিতে পাইলেন; কিন্তু জাহাজের কাপ্তেন ও দুর্ব্বত্ত ডাক্তার ল্যাম্পিয়ন তথন জাহাজে আছে কি না, তাহা তিনি বুঝিতে পারিলেন না। তবে তিনি অনুমান করিলেন, এই রাত্রে তাহারা জাহাজ ছাড়িয়া অপরিচিত দ্বীপ অজ্ঞাত পল্লীর সন্ধানে ঘুরিয়া বেড়াইবে—তাহার সম্ভাবনা অল্প। তিনি জাহাজের বোট চু্রী করিয়া আনিয়াছেন, তাহার এই অপরাধ সে ক্ষমা করিবে—তাহার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা ছিল না। তিনি কোন্ দিকে যাইবেন, সমুদ্রের অদূরে দাঁড়াইয়া তাহাই চিন্তা করিতে লাগিলেন। কয়েক মিনিট চিন্তার পর তিনি বাম দিকে ফিরিলেন, এবং পাহাড়ের পাশ দিয়া গ্রামের অনুসন্ধানে চলিলেন। প্রায় অর্ধমাইল পথ অতিক্রম করিয়া একটা বাঁক’ ছাড়াইতেই চন্দ্রালোকে কতকগুলি সাদা দেওয়াল তাহার দৃষ্টিগোচর হইল।—তিনি বুঝিলেন, ইহাই স্থানীয় অধিবাসী- গণের বাসপল্লী।

 এইবার ডড্‌লে অত্যন্ত সন্তর্পণে অগ্রসর হইলেন। গ্রামের নিকট উপস্থিত হইয়া বুঝিতে পারিলেন, গ্রামখানি নিতান্ত ক্ষুদ্র নহে। গ্রামে গৃহের সংখ্যা শতাধিক, কিন্তু তন্মধ্যে কোনটি গ্রামের প্রধান ব্যক্তির বাডী, তাহা তিনি অনুমান করিতে পারিলেন না। তিনি আরও কয়েক গজ অগ্রসর হইয়া সম্মুখে যে বাড়ীখানি দেখিলেন, সেইদিকেই যাইতে লাগিলেন। তাহার ইচ্ছ, কোনও লোকের সহিত দেখা হইলে গ্রামের প্রধান ব্যক্তির বাসগৃহের সন্ধান লইবেন। তিনি কয়েক পদ অগ্রসর হইয়া একটা খোলা বাড়ীতে কয়েকটি লোকের কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ একটি গুলের অন্তরালে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন, এবং অন্যের অদৃশ্য থাকিয়া কাহারা কি বিষয় লইয়া আলোচনা করিতেছে, তাহা শুনিবার জন্য উৎকর্ণ হইয়া স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া রহিলেন।

 ডড্‌লে শুনিতে পাইলেন,—একজন লোক ইংৰাজীতে বলিতেছে, “তুমি ইহাকে ভাল করিয়া বুঝাইয়া বল—উহারা যে এই দ্বীপে আসিয়াছে, ইহা আমরা জানিতে পারিয়াছি, সুতরাং তার আর একথা অস্বীকার করা চলিবে না। কাল বেলা দুপুরের মধ্যে সে যদি তাহাদিগকে ধরিয়া আমার নিকট হাজির না করে—তাহা হইলে তাহাকে সপরিবারে গুলি করিয়া মারিব, তাহার পর তাহার ঘরে আগুন লাগাইয়া দিব। ল্যাম্পিয়ন, সে যেন মনে না করে আমি তাহাকে মিথ্যা ভয় দেখাইতেছি। তুমি ইহাকে এ সকল কথা ভাল করিয়া বুঝাইতে না পারিলে তোমারও দুর্দশার সীমা থাকিবে না। আমি যে উহাদের ভাষা জানি না, উহাদের ভাষা আমার জানা থাকিলে আমাকে তোমার মত অপদার্থের সাহায্য গ্রহণ করিতে হইত না।”

 বক্তা যে জাহাজের কাপ্তেন, ইহা বুঝিতে ডড্‌লের বিলম্ব হইল না। —কাপ্তেন ল্যাম্পিয়নকেই লক্ষ্য করিয়া এই সকল কথা বলিতেছিল।

 ল্যাম্পিয়ন বলিল, “এত ব্যস্ত হইলে চলিবে না, এখন আমাদিগকে ধীরভাবে কার্য করিতে হইবে। লোকটাকে ভয় দেখাইয়া বিশেষ কোনও লাভ হইবে না, আমাদের উদ্ধত আচরণে সে যদি একবার বাকিয়া বসে, তাহা হইলে তার দ্বারা কার্যোদ্ধার করা সহজ হইবে না। বল অপেক্ষা কৌশলে অনেক সময় বেশী কায হয়। আমি আগে কৌশল খাটাইয়া দেখিব।”

 ডড্‌লে দেখিলেন, একজন বলবান হাবসী লাম্পিয়নের অদুরে দাড়াইয়া আছে। ল্যাম্পিয়ন সেই হাবসীটাকে লক্ষ্য করিয়া দেশীয় ভাষায় বলিল, “আমার দোস্ত বলিতেছেন, সেই তিনজন লোককে কাল সকালে যেরূপে হউক আমাদের নিকট হাজির করাই চাই। তোমাদের সর্দার তাহা পারিলে আশাতীত বকশিশ পাইরে। তাহারা এই দ্বীপে আসিয়াছে—ইহাতে কোন সন্দেহ নাই; কারণ, তোমাদের লোকেরা তাহাদের বোটখানা পাইয়াছে। কাল রাত্রে তারা জাহাজ হইতে বোট চুরী করিয়া তাহাতে পলাইয়া আসিয়াছে। বোধ হয় তাহারা আজ বৈকালে এখানে আসিয়া পৌছিয়াছে। তাহারা চোর, মানুষ মারিয়া এখানে পলাইয়া আসিয়াছে। এই সকল চোর ও খুনী আসামী যাহাতে শীঘ্র ধরা পড়ে, তাহার উপায় করা তোমাদেরও কর্তব্য বটে। তাহাদের সঙ্গে একটি স্ত্রীলোক আছে, সে আমারই ঘরের মেয়ে। চোরেরা তাহাকে চুরী কবি আনিয়াছে। তাহাকে বাড়ী ফিরাইয়া লইয়া যাইতে না পারিলে আমার মানসম্ভ্রম সমস্তই নষ্ট হইবে।”

 হাবসীটা বলিল, “সর্দারের যাহা সাধ্য তাহার ত্রুটি হইবে না, আপনাদের দুষমনেরা যদি এই দ্বীপে আসিয়া থাকে—তাহা হইলে তাহারা নিশ্চয়ই ধরা পড়িবে। ইহার অধিক আর কি বলিতে পারি?

 কাপ্তেন ল্যাম্পিয়নকে জিজ্ঞাসা করিল, “লোকটা কি বলিতেছে?”

 ল্যাম্পিয়ন বলিল, “ও বলিতেছে—যদি তাহারা এই দ্বীপে আসিয়া থাকে, তাহা হইলে সর্দার তাহাদিগকে নিশ্চয়ই ধরিয়া দিতে পারিবে।—আমি কিন্তু একটা মতলব ঠিক করিয়াছি।

 ল্যাম্পিয়ন অপেক্ষাকৃত মৃদুস্বরে কাপ্তেনকে কি বলিল। ডড্‌লে বুঝিলেন, সে তাহার মতলবের কথাই বলিল, কিন্তু তিনি অনেকটা দূরে ছিলেন ল্যাম্পিয়নের মতলবটি কি তাহা শুনিতে পাইলেন না। তবে ল্যাম্পিয়নের মতলবটি যে তাহাদের অনুকূল নহে, ইহা তিনি বুঝিতে পারিলেন।

 ডড্‌লে সেই গুলের অন্তরালে আরও কয়েক মিনিট দাড়াইয়া রহিলেন। অল্পক্ষণ পরে তাহারা সেই স্থান ত্যাগ করিলে তিনি গুল্মান্তরাল হইতে বাহিরে আসিয়া মনে মনে বলিলেন, “এভাবে যে উহাদের পরামর্শ শুনিতে পাইব—ই পূর্বে আশা করি নাই। পরমেশ্বরের অনুগ্রহেই ইহা সম্ভব হইয়াছে। আমি এই রাত্রেই হাবসী সর্দারটাকে খুঁজিয়া বাহির করিব। আমার হাতে বন্দুক আছে—সুতরাং ভয়ের তেমন কারণ নাই। যদি সে অসদিচ্ছা-প্রণোদিত হইয়া আমাদের সাহায্য করিতে অসম্মত হয়, তাহা হইলে আমাকেও কৌশল খাটাইতে হইবে, লোভ দেখাইয়া তাকে আমার পক্ষে আনিতে হইবে।—সে কাহার বশীভূত হয় শীঘ্রই তাহার পরীক্ষা হইবে।

 ল্যাম্পিয়ন ও কাপ্তেন পূর্বোক্ত হাবসীটার সঙ্গে যেদিকে চলিতেছিল, উড়লেও তাহাদের অলক্ষ্যে সেইদিকে চলিতে লাগিলেন। তিনি বুঝিলেন, এই হাবসী যুবক তাহাদের সর্দারের সহিত দেখা করিতে যাইতেছে, তাহার অনুসরণ করিলেই তাহার আশা পূর্ণ হইবে।

 ডড্‌লে দেখিলেন, সমুদ্রতীরে আসিয়া ডাক্তার ল্যাম্পিয়ন ও কাপ্তেন একখানি বোটে উঠিয়া জাহাজে ফিরিয়া গেল, কিন্তু হাবসী যুবকটা আর এক পথ ধরিয়া একটি বাড়ীর দিকে চলিল। ডড়লে অদূরবর্তী একটি বৃক্ষমূলে বসিয়া রহিলেন। হাবসীটা বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। কয়েক মিনিট পরে সে, একটি বিপুলকায় বৃদ্ধ হাবসীকে সঙ্গে লইয়া সেই বাড়ীর বাহিরে আসিল, সেখানে কিছুকাল নিয়ে উভয়ের কি কথাবার্তা হইল, তাহার পর পুর্বোক্ত হাবসী যুবক বৃদ্ধের নিকট বিদায় লইয়া অন্যপথে চলিয়া গেল। ডড্‌লে এইবার সেই বৃক্ষমূল হইতে উঠিয়া লঘু-পদবিক্ষেপে বৃদ্ধ হাবসী সর্দ্দারের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন, এবং তাহাকে সেলাম করিয়া গম্ভীর স্বরে বলিলেন, “আল্লা আপনার ও আপনার পরিবারবর্গের মঙ্গল করুন। আমি আপনার সহিত দেখা করিবার জন্য বহু দূর-দেশ হইতে এই দ্বীপে আসিয়াছি। আপনি দয়া করিয়া আমার দুটি কথা শুনুন।

 হাবসী সর্দ্দার সবিস্ময়ে ডড্‌লের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, “তুমি এখানে আমার সহিত আলাপ করিতে আসিয়াছ। কে তুমি? তোমার মতলব কি? তুমি জান আমি এই দ্বীপের মালিক, এখানকার প্রধান লোক?

 ডড়লে সবিনয়ে বলিলেন, “হাঁ, তাহা জানি, জানি বলিয়াই ত আপনার সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছি। কিন্তু আমি কে, তাহা আপনি জানেন কি?

 হাবসী সর্দ্দার বলিল, “তাহা কিরূপে জানিব? মেঘ হইতে বৃষ্টি পড়ে, সেই বৃষ্টিতে গর্ত পূর্ণ হয়, কিন্তু মেঘ কি জানে তাহার করুণা-ধারায় কোথায় কোন্ গর্ত্ত পূর্ণ হইতেছে, বা কোন্ নীরস তরু সরস হইতেছে। তবে অনুমানে বুঝিতেছি—জাহাজের লোকেরা যাহাদের ধরিবার জন্য আমার সাহায্য প্রার্থনা করিয়াছে—তুমি তাহাদেরই একজন। তোমাদিগকে ধরিয়া কাল সন্ধ্যার পূর্ব্বে উহাদের হাতে দিতে হইবে, এইরূপ কথা আছে। —কেমন আমার কথা সত্য কি না?”

 ডড্‌লে বলিলেন, “হাঁ, একথা সত্য, কিন্তু উহাদের আশা পূর্ণ হইতে দেওয়া হইবে না। উহারা অত্যন্ত বদলোক, উহারা আমাদের শত্রু। আমার প্রণয়িণীকে উহারা হত্যা করিবার জন্য অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছে। হাঁ, তাহাকে হত্যা করিয়া অবশেষে উহার আমাকেও হত্যা করিবে। তাহাদের এই দুরভিন্ধি পূর্ণ করিবার জন্য আপনি কি তাহাদের সাহায্য করিবেন? আমরা বিদেশী লোক, বিপদে পড়িয়াছি, এই দ্বীপে আসিয়া আপনার অতিথি হইয়াছি। আপনার আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছি—আমাদিগকে আমাদের শক্ত হতে সমর্পণ করা কি আপনার উচিত? আপনি যদি আমাদিগকে রক্ষা করেন; তাহা হইলে আপনি বিস্তর থেলাৎ ও বকশিশ পাইবেন, এবং আমাদের দেশের রাণী আপনার কার্যে অত্যন্ত সুখী হইবেন, কারণ, আমি তাহারই চাকরী করি। আপনি আমাদিগকে লামুতে রাখিয়া আসিবার ব্যবস্থা করুন। আপনি আমার প্রস্তাবে সম্মত হইলে যাহা চাহিবেন তাহাই পাইবেন। আমি প্রতিজ্ঞা করিয়া বলিতেছি আমার কথার খেলাপ হইবে না।

 ডড্‌লে নীরব হইলেন, এবং হাবসী সর্দারের উত্তরের আশায় রুদ্ধনিশ্বাসে দাঁড়াইয়া রহিলেন। তিনি বুঝিলেন, তাহার উত্তরের উপর তাহাদের তিনজনেরই জীবন নির্ভর করিতেছে।

 হাবসী সর্দার ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া বলিল, “ওহে বিদেশী, তুমি বিপদে পডিয়া আমাকে যথেষ্ট লোভ দেখাইতেছ, কিন্তু আমি আসল কাযের কথা শুনিতে চাই। তুমি বলিতেছ তোমাকে সাহায্য করিলে আমাকে ভাল রকম বকশিশ দিবে, কত টাকা দিবে—তাহা ত বলিলে না? অঙ্গীকার করা অতি কিন্তু তা পূর্ণ করাই কঠিন। তোমাদের প্রাণরক্ষা করা আমার পক্ষ কঠিন নহে, কিন্তু বকশিশের পরিমাণ জানিতে না পারিলে, আমি তোমাকে কোনরকম আশা দিতে পারিতেছি না।”

 ডড্‌লে বলিলেন, “আপনি কত টাকা বকশিশ পাইলে সুখী হইবেন—তাহা আমার জানা আবশ্যক। আপনি যাহা চাহিবেন, তাহাই পাইবেন। প্রাণের তুলনায় অর্থ নিতান্ত তুচ্ছ সামগ্রী, প্রাণরক্ষার জন্য অর্থব্যয়ে আমরা কুণ্ঠিত নহি।—আমাদের স্বর্ণমুদ্রা সম্বন্ধে আপনার কোনও ধারণা আছে কি?”

  হাবসী সর্দ্দার দাড়ি নাড়িয়া দাঁত বাহির করিয়া বলিল, “তা আর নাই? আমি কতবার জাঞ্জিবারে গিয়াছি, তোমাদের দেশের সোণার টাকা লইয়া বাণিজ্য করিয়াছি। আমি সব জানি। আমি বুড়া মানুষ, আমার দাড়ি পাকিয়া সাদা হইয়া গিয়াছে। আমি মিথ্যা কথা বলিতে শিখি নাই। আমার সকল কথাই সত্য। বল, তুমি আমাকে কত টাকা বকশিশ দিতে রাজী আছ।”

 ডড্‌লে বলিলেন, “আপনি যদি আমাদিগকে অবিলম্বে লামুদ্বীপে লইয়া গিয়া নিরাপদে সেখানকার গবর্ণরের বাড়ী পৌছাইয়া দিতে পারেন, তাহা হইলে আমি আপনাকে পাঁচশত গিনি পুরস্কার দিব।—আপনি এই প্রস্তাবে রাজী আছেন?

 হাবসী সর্দ্দার তাহার পাগড়ী খুলিয়া একবার মাথাটা চুকাইয়া লইল, তাহার পর ডড্‌লেকে বলিল, “হ, ইহাতে চলিতে পারে বটে, কিন্তু বড়ই ঝুঁকির কায। তবে আমি তোমাদিগকে সেখানে পৌছাইয়া দিলে তুমি যে আমাকে পাঁচশত গিনি গণিয়া দিবে—তোমার এ কথা আমি কি করিয়া বিশ্বাস করি। সেখানে গিয়া গিনি না দিয়া যদি আমাকে ফাঁকি দাও?”

 ডড্‌লে বলিলেন, আপনি আমাদের প্রাণরক্ষা করিবেন, আর আমি আপনাকে প্রতিশ্রুত অর্থ না দিয়া ফাঁকি দিব?—না, আমি সেরূপ ‘বেইমান নহি। আপনি নিশ্চয়ই পাঁচশত গিনি পাইবেন, আমার শির জামিন। ইহার অধিক আর কি বলিব? এতগুলি টাকা একসঙ্গে পাইলে আপনি কিরূপ ধনবান হইবেন, আপনার ব্যবসায়-বাণিজ্যের কত সুবিধা হইবে, তাহাও ভাবিয়া দেখিবেন।”

 হাবসী সর্দ্দার বলিল, “যাহারা জাহাজ লইয়া তোমাদিগকে ধরিতে আসিয়াছে আমি তাহাদিগকে কি জবাব দিব?”

 ডড্‌লে বলিলেন, “আপনি বলিবেন, আমি তাহাদিগকে খুঁজিয়া পাইলাম, তাহারা এ দ্বীপে নাই।’—আপনার কথা তাহারা অবিশ্বাস করিতে পারিবে না।”

 হাবসী সর্দ্দার বলিল, “আচ্ছ, আমি কথাটা ভাবিয়া দেখিব। এখন তুমি আমার সঙ্গে আমার বাড়ী চল, তোমার মুখখানি ভাল করিয়া চিনিয়া রাখা দরকার।

 ডড্‌লে দৃষ্টিতে পকেটস্থিত পিস্তলটি ধরিয়া হাবসী সর্দ্দারের অনুসরণ করিলেন। তিনি হাবী সর্দারকে বলিলেন, “আমি আপনার সঙ্গে যাইতেছি বটে, কিন্তু আপনি যদি আমার সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করেন, তাহা হইলে আপনি ত প্রতিশ্রুত পুরষ্কার পাইবেনই না, অধিকন্তু আমাদের দেশের রাণীর যুদ্ধ-জাহাজ আসিয়া আপনাকে সবংশে ধ্বংশ করিয়া যাইবে”

 হাবসী সর্দ্দার বলিল, “না, আমি কোনরকম নিমকহারামী করিব না। আমাকে বিশ্বাস করিতে পারিতেছ না কেন?

 অল্পক্ষণ পরে ডড্‌লে পাহাডের ধারে হাবসী সর্দ্দারের গৃহদ্বারে উপস্থিত হইলেন। ডড্‌লে তাহার সহিত গৃমধ্যে প্রবেশ করিলে, সর্দ্দারের আদেশে একটি ক্রীতদাস প্রজ্বলিত ‘চেরাগ লইয়া আসিল। সেই দীপালোকে ডড্‌লে সর্দ্দারের চেহারাটি ভাল করিয়া দেখিয়া লইলেন। লোকটি মোটা, বেঁটে, তাহার মুখখানি গোল, মুখে বসন্তের দাগ, চক্ষুদু’টি বাঘের চোখের মত। তাহার দৃষ্টি অত্যন্ত ক্রুর, তাহাতে সরলতার চিহ্ন মাত্র নাই।

 সর্দ্দার তাহার ফরাসে বসিয়া ডড্‌লেকে তার পাশে বসিতে অনুরোধ করিল। তিনি পকেট হইতে হাতখানি বাহির করিলেন না, পিস্তলটি বরিয়াই রহিলেন। তিনি সর্দ্দারের পাশে উপবেশন করিলে সর্দ্দার তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার দলের লোকজন কোথায় আছে?

 ডড্‌লে প্রথমে মনে করিলে, তাহাদের আশ্রয়স্থানের সন্ধান দিবেন না, কিন্তু ইহাতে তাহার সন্দেহের উদ্রেক হইতে পারে, এবং তিনি তাহাকে অবিশ্বাস করিতেছেন—ইহা বুঝিতে পারিলে সে-ও বিশ্বাসঘাতকতা করিতে পারে ভাবিয়া, তিনি সত্য কথা বলাই সঙ্গত মনে করিলেন। যাহর অনুগ্রহে সম্পূর্ণ নির্ভর করিতে হইবে—তাহাকে অবিশ্বাস করিয়া লাভ কি?

 সর্দ্দার তাহাদের আশ্রয়স্থানের ঠিকানা জানিতে পারিয়া বলিল, “তোমরা বেশ ভাল যায়গাতেই আশ্রয় লইয়াছ, আপাততঃ ঐখানেই থাক। তোমার শত্রুরা সেখান হইতে তোমাদিগকে খুঁজিয়া বাহির করিতে পারিবে না। আমি তোমাদিগকে নির্বিয়ে লামুতে পৌঁছাইয়া দিলে আমাকে পাঁচশত গিনি ঠিক দিবে ত?—তোমার কথার নড়-চড় হইবে না ত?”

 ডড্‌লে বলিলেন, “আমরা লামুতে পৌছিয়াই আপনাকে চক্চকে পাঁচশত গিনি গণিয়া দিব।—কিন্তু আমাদের সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করিলে একটি কাণা—কড়িও পাইবেন না।”

 সর্দ্দার তাহার দীর্ঘ দাড়ির ভিতর কর-চালনা করিয়া বলিল, “মোয়াহিনীর পুত্র মঙ্গাহোবো নিমকহারামী করিবে? তোবা। আমার যে কথা—সেই কা। যাহা হউক, এখন তুমি তোমার আজ্ঞায় যাও, খোদা তোমাদের নিরাপদে রাখুন। কাল তোমাদিগকে লামুতে লইয়া যাইবার উপায় স্থির করিব। যতক্ষণ এই দ্বীপ ত্যাগ করিতে না পারিতেছ—ততক্ষণ সাবধানে লুকাইয়া থাকিবে।”

 ডড্‌লে হাবসী-সর্দ্দারের নিকট বিদায় লইয়া যথাসম্ভব দ্রুতগতি তাহার আজ্ঞা প্রত্যাগমন করিলেন, চন্দ্রালোকে পথ দেখিত এবার আর তেমন কষ্ট হইল না। তিনি চলিতে-চলিতে ভাবিলেন, “এই অপরিচিত লোভী হাবসীটাকে বিশ্বাস করিয়া কি ভাল করিলাম? কিন্তু বিশ্বাস না করিয়াই বা উপায় কি?—না, লোকটা বোধ হয় বিশ্বাসঘাতকতা করিবে না, অন্য কারণ না থাকিলেও সে এতগুলি টাকার লোভ ছাড়িতে পারিবে না।— কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করিলেই আমাদের সর্বনাশ।

 ডড্‌লে দীর্ঘ পথ অতিক্রম পূর্বক শ্রান্তদেহে আজ্ঞায় প্রত্যাগমন করিলেন, তিনি মিস্ এরসকাইনকে বলিলেন, “আমি এই দ্বীপের সর্দারের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছি। জাহাজের কাপ্তেন ও আপনার মামাকেও দেখিয়াছি। তারা আমার প্রায় পাশ দিয়াই চলিয়া গেল, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমাকে দেখিতে পায় নাই। আমি সর্দ্দারের সঙ্গে তার বাড়ী পর্যন্ত গিয়াছিলাম।”

 মিস্ এরসকাইন ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাহার সহিত আপনার কি কথা হইল?

 হাবসী সর্দ্দারের সহিত তাহার যে সকল কথা হইয়াছিল, তাহা তিনি সমস্তই মিস এরসকাইনের গোচর করিলেন। তাহা শুনিয়া মিস্ এরসকাইন বলিলেন “লোকটা আমাদেব সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করিবে না ত?

 ডড্‌লে বলিলেন, “তাহা কিরূপে বলিব? তবে সে যে এতগুলি টাকার লোত ত্যাগ করিতে পারিবে——এরূপ বোধ হয় না, কিন্তু আমি যে তাহাকে এত টাকা নিশ্চয়ই দিতে পারিব—তাহার মনে এ বিশ্বাস উৎপাদনের কোন উপায় দেখিতেছি না। লামুতে উপস্থিত হইয়া আমার অঙ্গীকার পূর্ণ করিতে পারিব কি না—এ সম্বন্ধে তাহার কিছু সন্দেহ আছে। আপনার মামা কাপ্তেনটাকে সঙ্গে লইয়া এই দ্বীপে আসিয়াছে। সে সর্দ্দারকে অনুরোধ করিয়াছে—যেরূপে হউক আমাদিগকে ধরিয়া দিতে হইবে; কিন্তু তাহারা সদারকে যে অধিক টাকার লোভ দেখাইয়াছে—এরূপ বোধ হয় না। যেরূপ ব্যবস্থা হয়—কাল কর যাইবে, আপনি এখন শয়ন করুন। আমরা গৃহদ্বাৱে বসিয়া সমস্ত রাত্রি আপনার পাহারা দিব।”

 মিস্ এরসকাইন কৃতজ্ঞ হৃদয়ে তাঁহার দক্ষিণ হস্ত ডড্‌লের সম্মুখে প্রসারিত করিলেন, তিনি তাহার হাতখানি চুম্বন করিলেন। তাহার ইচ্ছা হইল তাহাকে বক্ষে ধারণ করিয়া হৃদয় শীতল কিন্তু তিনি এই ইচ্ছা দমন করিলেন, মনে মনে বলিলেন, “আমি তোমাকে কত ভালবাসি তাহা তুমি জান না, তোমার প্রাণরক্ষার জন্য আমি হাসিতে-হাসিতে এ প্রাণ বিসর্জন করিতে পারি।—হয় ত একদিন তুমি ইহা বুঝিতে পারিবে।”

 মিস্ এরসকাইন অল্পক্ষণ পরেই নিদ্রিত হইলেন, ডড্‌লে কতক রাত্রি জাগিয়া কতক রাত্রি বা ঢুলিয়া কাটাইলেন। পাচক ব্লেকও ঘুমাইয়া-জাগিয়া পাহারা দিল। পরদিন প্রত্যুষে মিস এরসকাইন সেই মৃৎকুটীরের বাহিরে আসিলেন, সুনিদ্রায় তাহার শ্রান্তি দূর হইয়াছিল, এবং তাহাকে বেশ প্রফুল্ল দেখাইতেছিল। তাহার ভাব দেখিয়া ডড্‌লের মনে হইল, তাহার কিছু বলিবার আছে।

 উড়লের এই অনুমান মিথ্যা নহে।—মিস, এরসকাইন মুহূর্তকাল ইতস্ততঃ করিয়া বলিলেন, “মিঃ ডড্‌লে, আপনি কাল রাত্রে আমাকে বলিয়াছিলেন, হাবসী সর্দ্দার আমাদিগকে নিরাপদে লামু দ্বীপে পৌছাইয়া দিলে আপনি যে তাহাকে প্রতিশ্রুত অর্থ দিতে পারিবেন, এ কথা তাহাকে বিশ্বাস করাইতে পারেন নাই। কিন্তু কথাটা তাহাকে বিশ্বাস করাইতেই হইবে, কারণ, ইহার উপর আমাদের শুভাশুভ নির্ভর করিতেছে। আমাদের কাছে নগদ টাকা নাই বটে, কিন্তু আমরা যে দরিদ্র নহি, ইহা সর্দ্দারকে বুঝাইবার ব্যবস্থা করা উচিত। তাহাকে কিছু লোত দেখাইতে হইবে। আমি তাহাকে কি দিতে পারিব—তাহা জানিবার জন্য আপনার আগ্রহ হওয়াই সম্ভব। আমি স্ত্রীলোক,—আমরা জীবন অপেক্ষা অলঙ্কারকে মূল্যবান মনে করি—এ কথা মিথ্যা নহে। আমি যখন জাহাজ ছাড়িয়া আপনার সহিত পলাইয়া আসি— সেই সময় আমার সমস্ত অলঙ্কারই লইয়া আসিয়াছি। সেই সকল হীরকজহরতের মূল্য নিতান্ত আর নহে। আমার কাছে যে হীরকখচিত ব্রেসলেট আছে তাহা মূল্যবান অলঙ্কার—আপনি ইহা লইয়া গিয়া হাবসী সর্দ্দারকে দিয়া আসুন, তাহা হইলে লোকটা হাতছাড়া হইবে না।

 মিস্ এরসকাইন তাহার পকেট হইতে একছড়া দ্যুতিমান হীরকখচিত ব্রেসলেট বাহির করিয়া ডড্‌লের হস্তে প্রদান করিলেন।

 ডড্‌লে বলিলেন, “এ যে মহামূল্য অলঙ্কার! ইহা দেখিলে হাবসী সর্দ্দারের মুখে লাল পড়িবে, কিন্তু এরূপ মূল্যবান অলঙ্কার তাহাকে দিতে আপনার কষ্ট হইবে না ত?”

 মিস্ এরসকাইন বলিলেন, “জীবন অপেক্ষা অলঙ্কার মূল্যবান নহে। জীবনরক্ষার জন্য তাহাকে আমার যথাসব্বস্ব দিতেও কুণ্ঠিত হইব না। আপনি ইহা লইয়া যান, আবশ্যক হইলে বলিবেন—আমার সঙ্গে যাহা কিছু আছে সমস্তই দিব।”

 ডড্‌লে দিবাভাগে সর্দ্দারের গৃহে গমন করা নিরাপদ মনে করিলেন না, তিনি বুঝিয়াছিলেন, সর্দ্দারই তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিবে। তাহার এই অনুমান মিথ্যা হইল না। বেলা একটু অধিক হইলে হাবসী সর্দ্দার একজন অনুচরসহ সমুদ্রের দিক হইতে তাহাদের আড্ডায় উপস্থিত হইল।

 হাবসী সর্দ্দার ডড্‌লেকে বলিল, “তোমার মঙ্গল হউক। আমি অনেক পূর্বেই তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিতাম, কিন্তু তোমার শত্রুরা আমার সহিত দেখা করিতে আসায় আমার এখানে আসিতে বিলম্ব হইয়া গিয়াছে। তাহারা তোমাদের অনুসন্ধানে বাহির হইয়াছে। আমি তাহাদিগকে মিথ্যাকথায় না ভুলাইলে তাহারা এতক্ষণ এই দিকেই আসিয়া পড়িত এবং তো্মাদিগকে দেখিবামাত্র বন্দী করিত।”

 ডড্লে সর্দ্দারের কথা বিশ্বাস করিলেন কি না বলা যায় না, কিন্তু তিনি তাহার কথা শুনিয়া তাহাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিলেন, এবং বকশিশের কথাটা আর একবার শুনাইয়া দিলেন।

 হাবসী সর্দ্দার বলিল, “হাঁ, টাকাগুলি অল্প নহে স্বীকার করি, কিন্তু তোর যে তত টাকা দেওয়ার শক্তি আছে ইহা কিরূপে বুঝিব?—পাচশত গিনি ত আমাকে বকশিশ দিবে, কিন্তু লামু পর্য্যন্ত তোমাদের লইয়া যাইতেও অল্প টাকা খরচ হইবে না, সে টাকার কি ব্যবস্থা করিবে?”

 ডড্লে বলিলেন, “সে টাকাও আমি দিব।—আপনাকে এত টাকা দিবার শক্তি আমার আছে কি না তাহা আপনি জানিতে চান।—ইহার প্রমাণস্বরূপ আপনাকে একখানি বহুমূল্য অলঙ্কার দিতেছি।”

 ডড্লে পকেট হইতে মিস্ এরসকাইন-প্রদও হীরকখচিত ব্রেসলেট, বাহির করিয়া সর্দ্দারকে দেখাইলেন, তাহা দেখিয়া লোভে তাহার চক্ষ উজ্জল হইয়া উঠিল। ডড্লের হাত হইতে ছোঁ-মারিয়া লইয়া সে তাহা লুব্ধনেত্রে দেখিতে লাগিল। প্রভাতের সূর্যালোক হীরকখণ্ডগুলিতে প্রতিবিম্বিত হওয়ায় তাহা ঝকমক করিতেছিল।

 সর্দ্দার জিজ্ঞাসা করিল, “এটি কি জিনিস?”

 ডড্লে বলিলেন, “উহা হীরকালঙ্কার, উহার মূল্য একশত গিনির অধিক। ঐ অলঙ্কার আমি আপনাকে উপহার দিলাম—এই অলঙ্কার দেখিযাই আপনি বুঝিতে পারিতেছেন—আমরা দরিদ্র নহি, লামুতে উপস্থিত হইয়া আপনাকে অনায়াসেই পাঁচশত গিনি দিতে পারিব।


 সর্দার ব্রেসলেটখানি তাহার অঙ্গরাখার মধ্যে লুকাইয়া রাখিয়া দীর্ঘ দাড়ি নাড়িয়া বলিল, “হাঁ, এবার তোমার কথা বিশ্বাস হইয়াছে, তবে এ গহনাখানির এত অধিক মূল্য কি না সন্দেহ। যাহা হউক, আমি সুযোগ পাইলেই তোমাদিগকে লামুতে লইয়া যাইব। সেখানকার গবর্ণর আমার উপর যাহাতে খুসী থাকে—তার ব্যবস্থা করি, আর টাকাগুলি দিও। তোমাদের প্রাণরক্ষার জন্য আমাকে বিস্তর ঝঞ্ঝাট সহ্য করিতে হইবে।

 ডড্লে বলিলেন, “টাকা সম্বন্ধে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। —এখন বলুন, কখন আমাদের যাত্রা করিবার সুবিধা হইবে।

 সর্দ্দার বলিল, “সে কথা তোমাকে এখন ঠিক বলিতে পারিতেছি না। আগে ত তোমাদের শত্রুদের ভূলাইয়া এখান হইতে বিদায় করি কাযটা বড় সহজ হইবে না।”

 সর্দ্দার তাহাদিগকে লুকাইয়া থাকিতে বলিয়া ডড্লের নিকট বিদায় লইল। সর্দ্দার তাহার অনুচরসহ প্রস্থান করিলে ডড্লে, মিস্ এরসকাইন ও পাচক ব্লেকের সহিত পরামর্শ করিতে বসিলেন।—মিস্ এরাইন বলিলেন, “লোকটার ভাবভঙ্গি দেখিয়া সন্দেহ হয়। এই লোভী নেটিভটা বিশ্বাসঘাতকতা করিবে কি না কে বলিতে পারে? আমাদের কাছে যাহা কিছু আছে—সমস্ত কাড়িয়া লইয়া আমাদিগকে শক্তহস্তে সমর্পণ করাও উহার পক্ষে অসম্ভব নহে।”

 ডড্লে বলিলেন, “ইহা যে তাহার পক্ষে অসম্ভব একথা কি করিয়া বলি? —কিন্তু অন্য কোনও উপায়ও ত দেখিতেছি না।”

 ব্লেক বলিল, “আমার মাথায় একটা ফন্দি আসিয়াছে, কিন্তু তাহা কার্য্যে পরিণত করা কতদূর সম্ভব তাহা বুঝিতে পারিতেছি না।আমরা যদি কোন উপায়ে আমাদের বোটখানি হস্তগত করিতে পারি, তাহা হইলে উহাদের অজ্ঞাতসারেই এই দ্বীপ ত্যাগ করিয়া লামুর দিকে যাত্রা করিতে পারিব।”

 ডড্লে বলিলেন, “বোটখানি পাইলে তোমার প্রস্তাবানুসারে কায করা যাইতে পারে, কিন্তু তাহা পাইব বলিয়া বোধ হয়না। সম্ভবত কাপ্তেন তাহা জাহাজে লইয়া গিয়াছে। —স্থানীয় অধিবাসীদের কোনো একখানি নৌকা সংগ্রহ করিয়া তাহাতে উঠিয়া পলায়নের চেষ্টা করা যাইতে পারে —কিন্তু তাহাও যথেষ্ট বিপজ্জনক, দৈবাৎ ধরা পড়িলে আর নিস্তার নাই।—এ অবস্থায় হাবসী সর্দারের উপর নির্ভর করাই সঙ্গত, যদি বুঝিতে পারি সে বিশ্বাসঘাতকতা করিবে—তখন যথাকর্তব্য স্থির করা যাইবে।

 মধ্যাহ্নে আহারে বসিয়া ডড্লে দেখিলেন, খাদ্যসামগ্রী যাহা, আছে— তাহাতে সেই বেলা কোনরকমে চলিতে পারে। ডড্‌লে বলিলেন, “এ বেলাটা ত চলুক, পরে হাবসী সর্দারের সহিত দেখা করিয়া তাহার নিকট কিছু খাবার চাহিয়া লইব। সন্ধ্যার পর তাহার সহিত দেখা করিব।”

 সন্ধ্যার অন্ধকারে বনভূমি সমাচ্ছন্ন হইলে, ডড়লে হাবসী সর্দ্দারের সহিত সাক্ষাৎ করিতে চলিলেন, এবার পথ চিনিয়া যাইতে তাহার তত কষ্ট হইল না।—তিনি সর্দ্দারের গৃহের অদূরে উপস্থিত হইয়া, তাহার গৃহে প্রবেশ করিবেন কি না একটি বৃক্ষের আড়ালে দাড়াইয়া তাহাই ভাবিতে লাগিলেন।—কাপ্তেন ও ল্যাম্পিয়ন সর্দারের সহিত দেখা করিবার জন্য যদি সেখানে আসিয়া থাকেতাহা হইলেই ত সর্বনাশ।—তৎক্ষণাৎ তাহাকে ধরা পড়িতে হইবে।

 হঠাৎ একজন লোক ডড্‌লের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।—তাহাকে দেখিয়া তিনি অত্যন্ত ভীত হইলেন, এবং তৎক্ষণাৎ পিস্তলে হাত দিলেন। আগন্তুক নিম্নস্বরে বলিল, “গোল করিও না, চুপ করিয়া আমার কথা শোন।—আমি আজ অনেকবার তোমার সহিত দেখা করিবার চেষ্টা করিয়াছি, কিন্তু দেখা করিতে পারি নাই। পথে তোমাকে আসিতে দেখিয়া তোমার অনুসরণ করিয়াছিলাম। এখানে তোমার সহিত দেখা না হইলে তুমি নিশ্চয়ই আজ রাত্রে ধরা পড়িতে।”

 ডড্‌লে বলিলেন, “তুমি কে? তোমার মতলব কি?

 আগন্তুক বলিল, “আজ সকালে আমি আমাদের সর্দার মঙ্গহোবোর সঙ্গে তোমাদের আড্ডায় গিয়াছিলাম, আমাকে চিনিতে পারিতেছ না? মঙ্গহোবো তোমর সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করিবে, তোমাদের ধরাইয়া দিবে,—এ কথা জানি তোমাকে সতর্ক করিতে আসিয়াছি। —একটু গোপনীয় স্থানে চল, সকল কথা শুনিবে।

 উড়লে আগন্তুকের কথা শুনিয়া উৎকণ্ঠিত চিত্তে নিশব্দে তাহার সঙ্গে চলিলেন। তাঁহারা উভয়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থানে উপস্থিত হইলে আগন্তুক বলিল, “আমার নাম মেগবাণী, মঙ্গহোবো আমার চাচাত ভাই, আপনি তাহাকে বলিয়াছেন-সে আপনাদিগকে নির্বিঘ্নে লামুতে পৌছাইয়া দিলে পাঁচ শত গিনি বকশিশ দিবেন। —কিন্তু আজ রাত্রে আপনার শত্রুরা জাহাজ হইতে নামিয়া উহার সহিত দেখা করিতে গিয়াছিল। ভাই আপনাদিগকে তাহাদের হস্তে সমর্পণ না করায় তাহারা রাগিয়া আগুন হইয়াছে। আমার ভাইয়ের একটি ছেলে আছে, তাহারা তাহাকে জাহাজে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে, বলিয়া গিয়াছে— আপনাদের ধরিয়া দিতে না পারিলে তাহারা কাল তাহাকে গুলি করিয়া মারবে—এ কথা শুনিয়া মঙ্গহোবো অত্যন্ত ভীত হইয়াছে। টাকা বড় না ছেলে বড়?—টাকার লোভে সে তাহার ছেলেটির প্রাণের আশা ত্যাগ করিতে পারিবে না, এই জন্য সে স্থির করিয়াছে, কাল আপনাদিগকে আপনাদের শত্রুহতে সমর্পণ করিবে।—আমি তাহাদের পরামর্শ শুনিয়াছি। আপনাদিগকে লামুতে লইয়া যাইবার ছলে নৌকায় তুলিবে কিন্তু লামুর দিকে না গিয়া অদূরবর্তী আর একটা দ্বীপে উপস্থিত হইবে। আপনার শত্রুরা জাহাজ লইয়া সেখানে লুকাইয়া থাকিবে, আপনারা সেখানে যাইবামাত্র—বুঝিয়াছেন?”

 আগন্তুকের কথা শুনিয়া ডড্‌লের সর্বাঙ্গ ঘর্মাক্ত হইয়া উঠিল। তিনি যে কি বলিবেন, কি করিবেন তাহা স্থির করিতে পারিলেন না। তবে বুঝি লেন, কথাটা সতা হইতে পারে, পাঁচশত গিনি বকশিশের লোভেই এই লোকটা তাঁহাদের সাহায্যের প্রস্তাব করিতে আসিয়াছে। কিন্তু ইহার কথা কি সত্য? ইহাকে কি বিশ্বাস করা যায়?

 এই সকল কথা চিন্তা করিয়া ডড়লে বলিলেন, “তোমার সকল কথা শুনিলাম। তোমার কথাগুলি অসঙ্গত নহে, কিন্তু তুমি কি আমাদের সাহায্য করিতে পারিবে? আমাদিগকে লামুতে রাখিয়া আসিতে পারিবে? যদি পার—তাহা হইলে তোমার ভাইকে যে পাঁচশত গিনি দিতে চাহিয়াছি, তুমিই তাহা পাইবে। যে বিশ্বাসঘাতকতা করিবে—সে টাকা পাইবে না, অধিকন্তু আমাদের রাণীর জাহাজ আসিয়া তোপে তাহার ঘর-বাড়ী উড়াইয়া দিবে, আখা-বাচ্চা একগড করিবে।”

 আগন্তুক বলিল, “আমি নিমকহারাম নহি, সচ্চা লোক। তোমাদের অসহায় অবস্থা দেখিয়া আমার বড় দয়া হইয়াছে, আমার খুব দয়ার শরীর; আমি তোমাদিগকে নির্ব্বিঘ্নে লামুতে রাখিয়া আসিব, কিন্তু আজ সকালে তুমি আমার ভাইকে যে রকম চকচকে চিজ, দিয়াছিলে, ঐ রকম চিজ, আমিও চাই।’

  ডড্‌লে বলিলেন, “নৌকা আনিয়া আগে আমাদের সঙ্গে রওনা হও তাহার পর তুমি তাহা অপেক্ষা অনেক উৎকৃষ্ট ও মূল্যবান অলঙ্কার পাইবে।— তোমার ধাও’ কোথায়?

 আগন্তুক বলিল, “সমুদ্রের ধারে বাধা আছে। আমার ধাও খুব সরেস নৌকা, একেবারে নূতন। তোমাদের লইয়া পাখীর মত উড়িয়া যাইব আমি লামু যাইবার পথ জানি, আমার সঙ্গে আজ রাত্রেই চল, তোমাদিগকে গোপনে লইয়া যাইব।”

 ডড্‌লে বলিলেন, “তোমার প্রস্তাবে রাজী হইলাম, এখন আর এক কথাতুমি বাড়ী গিয়া আমাদেব জন্য কিছু খাবার লইয়া এস, আমাদের খাবার ফুরাইয়া গিয়াছে।—খাবার আনিয়া দিলে বকশিশ পাইবে, বুঝিয়াছ?—শীঘ্র যাও।”

 আগন্তুক বলিল, “তুমি এইখানে অপেক্ষ’ কর, আমি শীঘ্রই আসিব।”

 আগন্তুক প্রস্থান করিলে ডড্‌লে উৎকন্বিত চিত্তে একখানি কাঠের গুড়ির উপর বসিয়া রহিলেন।—তিনি স্থির করিলেন, যেরূপ হউক, রাত্রেই দ্বীপ ত্যাগ করিতে হইবে। বিশ্বাসঘাতক সর্দ্দার প্রভাতে তাহাদিগকে ধরাইয়া দিতে পারে।

 প্রায় পনের মিনিট পর হাবসীটা কতক গুলি খাবার লইয়া ডড্‌লের নিকট উপস্থিত হইল। তিনি সাগ্রহে তা গ্রহণ করিলেন। হাবসী বলিল, “আমি যে খাবার দিলাম, তাহা ছয় জন লোক খাইয়াও ফুরাইতে পারিবে না। আমার বকশিশ কোথায়?

 উড়াল পকেটে হাত পূরিয়া তাহার রিভলভারটি বাহির করিলেন, এবং হাবসীটাকে তা দেখাইয়া বলিলেন, “বকশিশ হবার পূ্র্ব্বে তোমাকে আর একটা কায করিতে হইবে। আমরা এই দ্বীপে আর এক মুহুর্ত নিরাপদ নহি, এজন্য আমি স্থির করিয়াছি অবিলম্বে এ স্থান ত্যাগ করিব। আমার হাতে তুমি যে হাতিয়ার দেখিতেছ, ইহার সাহায্যে আমি এখনই তোমাকে সাবাড় করিতে পারি।—যদি ভাল চাও, তবে আমাকে তোমার নৌকায় লইয়া চল। আমরা সেই নৌকায় অবিলম্বে লামুতে যাত্রা করিব। সেখানে উপস্থিত হইয়া তোমাকে বকশিশ দিব।”

 লোকটা এই প্রস্তাবে আপত্তি করিল, বলিল, “অনেকদূর যাইতে হইবে, যোগাড়যন্ত্র করিয়া লইতে কিছু সময় লাগবে। এই মুহূর্তেই কি করিয়া রওনা ডড্‌লে বলিলেন, “না, কোন যোগাড়যন্ত্রের আবশ্যক নাই, আমার সঙ্গে চল, সঙ্গীদের লইয়া আসিয়া তোমার নৌকায় উঠিব।—আমার প্রস্তাবে অসম্মত হইলে তোমাকে প্রাণের আশা ত্যাগ করিতে হইবে।”

 হাবসীটা মুহূর্তকাল চিন্তা করিয়া বুঝিতে পারিল, এই শ্বেতাঙ্গ বিদেশী কথার প্রতিবাদ করিয়া কোনও লাভ নাই, সুতরাং অগত্যা তাহাকে সম্মত হইতে হইল।—ডড্‌লে তাহাকে সঙ্গে হইয়া তাহাদের আড্ডায় উপস্থিত হইলেন, এবং মিস্ এরসকাইন ও পাচক ব্লেককে সক্ষেপে সকল কথা বলিলেন। —উভয়ে সেই মুহূর্তেই তাহার অনুসরণ করিলেন। চারিজনে নিঃশব্দে নৌকায় উঠিলে হাবসী নৌকার পাল খাটাইয়া নৌকা ছাডিয়া দিল। অন্ধকার রাত্রে নৌকাখানি অনুকূল বায়ুপ্রবাহে মুক্তপক্ষ বিহঙ্গের ন্যায় লামু অভিমুখে ধাবিত হইল।

 নৌকায় বসিয়া ডড্‌লে মিস্ এরসকাইনকে হাবসী সর্দ্দারের বিশ্বাসঘাতকতার কথা জ্ঞাপন করিলেন। অনন্তর তিনি মেগবাণীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই দ্বীপ হইতে লামু কতদূর?

 মেগবাণী নৌকার হাল ধরিয়া বসিয়াছিল, সে বলিল, “যদি বেশ জোর বাতাস পাই, তাহা হইলে কাল এক সময় আপনাদিগকে লামুতে নামাইয়া দিতে পারিব।”

 ক্রমে রাত্রির অবসান হইল, প্রভাতে তাঁহারা লামুর পথে বহুদূর অগ্রসর হইলেন। সমস্যদিন নৌ-পরিচালনের পর অপরাহ্নকালে ডড্‌লে দেখিলেন, তাহারা একটি সমৃদ্ধ নগরের সান্নিধ্যে উপনীত হইয়াছেন।—প্রকাণ্ড অট্টালিকাশ্রেণী দ্বীপের উপর মাথা তুলিয়া দাড়াইয়া আছে। ডড্‌লে বুঝিলেন, ইহাই লামু নগর। তিনি মিস এরসকাইনের হাত ধরিয়া সোৎসশে বলিয়া উঠিলেন, “আমাদের বিপদ কাটিয়া গিয়াছে, এতদিনে আমরা রক্ষা পাইলাম। পরমেশ্বর। তুমিই ধন্য, তোমার করুণায় শত্রুকবল হইতে মুক্তিলাভ করিলাম নিরাপদ স্থানে ফিরিয়া আসিলাম। কি আনন্দ। কি আনন্দ।’— ডড্‌লে হঠাৎ মিস এ্র্ররসকাইনের পদ প্রান্তে মুচ্ছিত হইয়া পড়িলেন। এতদিন ধরিয়া তিনি যে দুঃখ কষ্ট, দুশ্চিন্তা, অনিয়ম, ক্লান্তি নীরবে সহ্য করিয়া আসিয়াছিলেন, বিপদে অবসানে তাহা তাহার দেহ ও মনের উপর এরূপ প্রতিক্রিয়া আরম্ভ করিয়াছিল যে, তিনি আর কোন মতে আত্মসম্বরণ করিতে পারিলেন না।

 মিস এরসকাইন ক্রোড়ের উপর তাঁহার মস্তক তুলিয়া লইয়া সফরে তার পরিচর্যা করিতে লাগিলেন, পাচক ব্লেক ব্রাণ্ডির বোতল খুলিয়া তাহাকে কিঞ্চিৎ ব্র্যাণ্ডি পান করাইল।—তাহার পর মিস এরসকাইনকে অত্যন্ত ভীত দেখিয়া বলিল, “মিস, আপনি স্থির হউন, শীঘ্রই উহার মুর্চ্ছা ভাঙ্গিবে, ভয়ের কোন কারণ নাই।

 কয়েক মিনিট পরে ডড্‌লের মুর্চ্ছা ভঙ্গ হইল, তাকে সচেতন দেখিয়া মিস্ এসকাইন গদগদ কণ্ঠে বললেন, হঠাৎ আপনার মূচ্ছ হওয়ায় আমার বড় দুশ্চিন্তা হইয়াছিল, এখন আপনি কেমন আছেন?”

 ডড্‌লে তৎক্ষণাৎ গাত্রোথান করিয়া বলিলেন, “না, আমার জন্য আপনি উৎকণ্ঠিত হইবেন না, আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হইয়াছি। বিপদের শেষে এভাবে ভাঙ্গিয়া পড়া বড়ই লজ্জাস্কর হইয়াছে।”

 নৌকাখানি নগরের প্রান্তভাগে উপস্থিত হই। ডড্‌লে মিস এরসকাইনকে বলিলেন, “আমাদের সকল বিপদ কাটিয়া গিয়াছে, আপনি কি ইহা বিশ্বাস করিছেন না? সত্যই আমরা এখন নিরাপদ।”

 মিস এরসকাইন অশ্রুপূর্ণ নেত্রে বলিলেন, “এতদিনে আমরা নিরাপদ হইয়াছি তাহা বুঝিয়াছি। অতীত ঘটনাগুলি দুঃস্বপ্ন বলিয়া মনে হইতেছে, কিন্তু মিঃ ডড্‌লে, আপনার অনুগ্রহেই আমি পুনঃপুনঃ মৃত্যুকবল হইতে রক্ষা পাইয়াছি। আপনার এ ঋণ আমি কি করিয়া পরিশোধ করিব? কি করিয়া আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিব?”

  ডড্‌লে তাহার হাতখানি নিজের গতের মধ্যে টানিয়া লইয়া, তাঁহার অশ্রু প্লাবিত মুখের উপর গভীর প্রেমপূর্ণ দৃষ্টি স্থাপন করিয়া বলিলেন, “মেরী, আমি যেদিন তোমাকে প্রথম দেখিয়াছি, সেই দিনই মন প্রাণ দিয়া তোমাকে ভাল বাসিয়াছি। তোমার অদৃষ্টের সহিত আমার অদৃষ্ট যেন একসূত্রে গ্রথিত। আমি যে তোমাকে কত ভালবাসি-পরমেশ্বরের অনুগ্রহে তুমি তাহার কিছু কিছু পরিচয় পাইয়াছি। যদি আমার প্রতি তোমার বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ও অবকাশ থাকে—তাহা হইলে তুমি আমাকে বিবাহ করিয়া আমার ঋণ পরিশোধ করিতে পার। আমি বোধ হয় তোমার প্রেমের নিতান্ত অযোগ্য নহি। কিন্তু আগে বল, তুমি কি সত্যই আমাকে ভালবাস?

 মিস্ এরসকাইন কম্পিত স্বরে বললেন, হ্যাঁ, আমি তোমাকে ভালবাসি, তুমি ভিন্ন আমার আপনার বলিতে এ সংসারে আর কেহই নাই। যদি তুমি আমাকে দয়া করিয়া গ্রহণ কর, তাহা হইলে আমি তোমাকে বিবাহ করিয়া চিরসুখী হব।”

 প্রণয়ীযুগল পরস্পরের হাত ধরিয়া মৌনভাবে নৌকার উপর দাঁড়াইয়া রহিলেন। নৌকাখানি ক্রমে তীরের নিকট উপস্থিত হইল। তখন ডড্‌লে পাচককে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “ব্লেক, আমরা তোমার নিকট কতদূব ঋণী, তাহা বলিতে পারি না। তোমায় সহায়তা ভিন্ন আমরা দুর্ব্বৃত্ত ল্যাম্পিয়নের কবল হইতে মুক্তিলাভ করিতে পারিতাম না। তোমার মত হিতৈষী বন্ধু জীবনে কখন পাইব না, তোমার উপকার জীবনে ভুলিব না। তোমার জীবিকানির্ব্বাহের যথাযোগ্য ব্যবস্থা করিয়া দিব।”

 ব্লেক কোন উত্তর দিল না, কিন্তু তাহার চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইল।—সে মুখ ফিরাইয়া চক্ষু মুছিল।—নৌকা দশ মিনিটের মধ্যে তীরে ভিড়িল।

 তারা তিনজনে লামুর গবর্ণরের গৃহে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন।—গবর্ণর এডমিরাল রেডকর্ণের নিকট পূর্ব্বেই ডড্‌লের অভিযান-বার্তা শ্রবণ করিয়াছিলেন। ডডলকে সুস্থদেহে প্রত্যাগমন করিতে দেখিয়া তাহার আনন্দের সীমা রহিল না। তিনি মেগবাণীকে যৎকিঞ্চিৎ পুরস্কার দিয়া বিদায় করিতে চাহিলেন, কিন্তু ডড্‌লে তাহাতে সম্মত হইলেন না। প্রতিশ্রুত পুরষ্কার দিয়াই বিদায় করা হইল। মিস এরসকাইন তাকে একখানি মূল্যবান অলঙ্কার দিলেন।

 সেইদিন সায়ংকালে উড়লের বন্ধু লেফটেনাণ্ট ব্রাডফোর্ড করিওলেনস’ জাহাজে লামু দ্বীপে উপস্থিত হইলেন। সেখানে গবর্ণরের গৃহে মিঃ ডডলকে দেখিয়া তিনি যে কত আনন্দিত হইলেন তাহা বলিবার নহে। অনেকক্ষণ ধরিয়া উভয়ে সুখদুঃখের অনেক কথা হইল। এডমিরাল ডড্‌লেকে আমেবেন্ হাসোনর ন্যায় মহাপরাক্রান্ত দুর্বত্ত দস্যুকে ধরিবার জন্য পাঠাইয়া কিরূপ অনুতপ্ত হইয়াছিলেন, ডড্‌লে ব্রাডফার্ডের নিকট তাহাও শুনিতে পাইলেন।

 ব্রাডফোর্ড পরদিন মধ্যাহ্নকালে ডাক্তার ল্যাম্পিয়ন ও তাহার ভাড়াটে জাহাজের কাপ্তেনকে ধরিবার জন্য সমুদ্রযাত্রা করিলেন, কিন্তু তাহাদিগকে ধরিতে পারিলেন না।—ডড্‌লে মিস্ এরসকাইনকে লইয়া মেগবাণীর নৌকায় পলায়ন করিলে ল্যাম্পিয়ন বুঝয়াছিল, তাহারা লামুতে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন, সেখানে তাদের অনুসরণ করা নিরাপদ নহে। তাহার ষড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ হইল জেলে যাইবার সম্ভাবনা আছে বুঝিয়া ল্যাম্পিয়ন কাপ্তেনের সহিত পরামর্শ করিয়া এডেন অভিমুখে পলায়ন করিতে থাকে।—এডেনে আসিয়া ল্যাম্পিয়ন কোথায় নিরুদ্দেশ হয়—তাহা কেহই জানিতে পারে নাই। সেই জাহাজের কাপ্তেন সৈয়দবন্দরে উপস্থিত হইয়া জাহাজ ছাডিয়া পলায়ন করে, তাহারও কোন সন্ধান পাওয়া যায় নাই। মেগবাণী মিঃ ডড্‌লের নিকট প্রতিশ্রুত পুরষ্কার লাভ করিয়া মোম্বাসায় বাস করিতে আরম্ভ করিল। হাবসী সর্দারের ভয়ে তাহার স্বদেশে যাইতে সাহস করে নাই।—মোম্বাসায় ব্যবসায়-বাণিজ্য করিয়া সে ধনবান হইয়াছে।
 মিঃ ডড়লে মিস্, এরসকাইনকে লইয়া লামু দ্বীপে উপস্থিত কইবার একপক্ষ পরে জাঞ্জিবারের ভজনালয়ে মহাসমারোহে তাঁহাদের পরিণয়োস। সুসম্পন্ন হইল। এডমিরাল রেড ফর্ণ কন্যাকর্তা হইয়া মিস, এরসকাইনকে ডড্‌লের হস্তে সম্প্রদান করিলেন। ব্রাডফোর্ড বরকর্ত্তার কার্য্য করিলেন। বিবাহের পর ডড্‌লে চাকরী ছাড়িয়া সস্ত্রীক স্বদেশে প্রত্যাগমন করিলেন। তাঁহার পৈত্রিক সম্পত্তি নিতান্ত অল্প ছিল না, তাহার উপর তাহার স্ত্রীর বিপুল পৈত্রিক সম্পত্তি তাঁহার হস্তগত হওয়ায়, তাহার আর চাকরী করিবার আবশ্যকতা ছিল না। ডড্‌লে কিছু দিনের মধ্যেই লণ্ডনস্থ সম্ভ্রান্ত-সমাজে বিলক্ষণ প্রতিষ্ঠাপন্ন হইয়া উঠিলেন, কিন্তু তিনি তাহার বিশ্বস্ত পরিচারক ও বিপদের বন্ধু ব্লেককে ভুলিলেন না, কিছু টাকা দিয়া তাহাকে একখানি হোটেল খুলিয়া দিলেন। সেই ব্যবসায়ে সে যথেষ্ট লাভ করিতে লাগিল। ডড্‌লের গুণবতী পত্নী মেরী অবসর কালে তাহার বন্ধুগণকে তাঁহার লোমহর্ষণ বিপদের কাহিনী শুনাইয়া স্তম্ভিত করিতেন। তিনি সেই ভীষণ বিপদ ও অদ্ভুত উপায়ে তাহা হইতে মুক্তিলাভের কাহিনী স্মরণীয় করিয়া রাখিবার জন্য সকলেরই নিকট আপনাকে নাবিক-বধূ বলিয়া পরিচিত করিতে অত্যন্ত আনন্দ ও গর্ব অনুভব করিতেন।


সম্পূর্ণ।