নাবিক-বধূ/দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

ডড্‌লে মিস্ এরস্‌কাইনের হাত ধরিয়া তাঁহাকে তীরে নামাইলেন, তাহার পর বলিলেন, “আমরা ত কূল পাইলাম, কিন্তু নিরাপদ হইলাম কি না, কে বলিবে? এখন আমাদের কর্ত্তব্য কি, তাহারই আলোচনা করা আবশ্যক। চারিদিকের অবস্থা দেখিয়া মনে হইতেছে, এখানে আশ্রয় লাভের তেমন সুবিধা নাই। তবে দ্বীপের ভিতর অগ্রসর হইলে হয় ত মাথা রাখিবার মত একটা স্থান পাইতেও পারি। প্রথমে কিছু খাইয়া লওয়া যাউক, পরে কখন কোথায় কি জুটিবে-না-জুটিবে, কে বলিতে পারে? আহারান্তে গ্রামের সন্ধানে যাত্র করিব।—এতবড় দ্বীপে যে লোকালয় নাই, এরূপ ত মনে হয় না।”

 মিঃ ডড্‌লের প্রস্তাবে কাহারও আপত্তির কারণ ছিল না।—মিঃ ডড লের ইঙ্গিতে ব্লেক বোটের উপর হইতে খাদ্যসামগ্রীগুলি নামাইয়া লইল, তখন তাঁহারা একটি তালগাছের নীচে বসিয়া ক্ষুন্নিবৃত্তি করিলেন। ডড্‌লে মনে মনে বলিলেন, “যদি কোন উপায়ে এই দ্বীপের নামটি জানিতে পারি—এবং এখান হইতে লামুর দূরত্ব কত—তাহা বুঝিতে পারি, তাহা, হইলেও আশ্বস্ত হওয়া যায়। কোথায় আসিয়াছি জানি না, কোথায় এই অরণ্যের শেষ, তাহাও বুঝিতে পারিতেছি না, কোন দিকে যাইলে যে একটু আশ্রয় মিলিবে, তাহা অনুমান করাও অসম্ভব। এ অবস্থায় কি করিয়া আশ্বস্ত হইব?

 আহারান্তে ডড্‌লে মিস্ এরস্‌কাইনকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “নৌকাখানি এখানে রাখিয়া আমরা তিন জনেই যাইব, না আমরা দু’জনে যাইব, ব্লেক নৌকার পাহারায় থাকিবে?

 মিস্ এরস্‌কাইন বলিলেন, “অজ্ঞাত স্থান, কোথাও আশ্রয় মিলিবে কি তাহার স্থিরতা নাই; আমরা সকলেই নৌকা ছাড়িয়া চলিয়া যাইলে এই দ্বীপের অধিবাসী যদি দৈবাৎ এখানে আসিয়া পড়ে ও নৌকাখানি চুরী করে—তবে বড়ই বিপদে পডিতে হইবে। আমার বিবেচনায় ব্লেক বোটের পাহারায় থাকিলেই ভাল হয়।”

 কিন্তু ব্লেক এ প্রস্তাবে আপত্তি করিল, সে বলিল, “যদি দ্বীপের লোকেরা বোট আক্রমণ করে, তাহা হইলে বোটখানি রক্ষা করা দূরের কথা-আমার পক্ষে আত্মরক্ষা করাই কঠিন হইবে। দূরে গিয়া আপনিও একাকী মিস্ এরস্‌কাইনকে লইয়া বিপন্ন হইতে পারেন, কিন্তু আমরা তিন জন একত্র থাকিলে আত্মরক্ষার অনেকটা সুবিধা হইবে।”

 ডড্‌লে এই প্রস্তাব সঙ্গত মনে করিয়া পাচক-প্রদত্ত বন্দুকটি কাঁধে ঝুলাইয়া নইলেন, এবং অবশিষ্ট খাদ্যদ্রব্যসহ অরণ্যে প্রবেশ করিলেন। মিস্ এরস কাইন তাঁহার অনুসরণ করিলেন, পাচক ব্লেক তাঁহাদের পশ্চাতে চলিল। মিস্ এরস্‌কাইন বলিলেন, “আশা করি আপনার বন্দুক ব্যবহার করিবার আবশ্যক হইবে না—আর বেলা নাই, অন্ধকার গাঢ় হইলে হয় ত জঙ্গলের মধ্যে আমরা হারাইয়া যাইব।—চলুন একটু দ্রুত যাই।”

 সেই দুর্গম অরণ্য ভেদ করিয়া দ্রুত চলিবার উপায় ছিল না।—একে কোন দিকে পথ নাই, তাহার উপর কণ্টক-লতা ও কণ্টকময় গুল্মে অরণ্য আবৃত। প্রস্তরাকীর্ণ মৃত্তিকাও অত্যন্ত বন্ধুর। যেখানে তাল ও নারিকেল বৃক্ষ ভিন্ন অন্য বৃক্ষ ছিল না, সেই স্থান দিয়াই তাঁহারা অপেক্ষাকৃত দ্রুত চলিতে সমর্থ হইলেন। কোন দিকে পথ-চিহ্ন না থাকায় ডড্‌লের আশঙ্কা হইল, এই দ্বীপে হয় ত মনুষ্যের বসতি নাই।—যে দিকে দুই চোখ যায়, সেই দিকেই তিনি নিরুৎসাহ চিত্তে, লক্ষ্যহীনতাবে চলিতে লাগিলেন। চলিতে-চলিতে মিস্ এরস্‌কাইন অস্ফুট শব্দ করিয়া হঠাৎ থামিলেন—ডড্‌লের আশঙ্কা হইল মিস্ এরস কাইন হয় ত সাপের ঘাডে পা দিয়াছেন! তিনি ফিরিয়া চাহিতেই মিস্ এরস্‌কাইন পার্শ্বে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া তাঁহাকে কি দেখাইলেন। মিঃ ডড্‌লে তীক্ষদৃষ্টিতে দেখিলেন—একটা সরু পথ বটে।—সেই সঙ্কীর্ণ পথ অরণ্য ভেদ করিয়া আঁকিয়া-বাঁকিয়া কিছুদূরে গিয়া অদৃশ্য হইয়াছে।

 ডড্‌লে সেই পথটি দেখিয়া সোৎসাহে বলিলেন, “চলুন, ঐ পথ ধরিয়াই আমরা অগ্রসর হই, কিন্তু পথটি দেখিয়া মনে হইতেছে, অনেকদিন পর্য্যন্ত এ পথে লোক-যাতায়াত নাই, তথাপি এ পথ ছাডা হইবে না। যে জলে ডুবিতেছে, সে সামান্য তৃণগুচ্ছও উপেক্ষা করে না।

 ব্লেক বলিল, “এই পথে চলিয়া যদি আমরা কোন একটা সামান্য আশ্রয় পাই, তাহা হইলে রাত্রিটা কোনরকমে কাটাইতে পারি। বিশেষতঃ সন্ধ্যার অন্ধকার শীঘ্রই গাঢ় হইয়া আসিবে, আকাশে মেঘ ও ঘনাইয়া আসিতেছে, বৃষ্টি আসিলে বিপদের সীমা থাকিবে না। এ অবস্থায় যদি একখানি ভাঙ্গা কুটীরও দেখিতে পাই, তাহা হইলে সেখানে অন্ততঃ মাথাটাও বাঁচিবে।”

 তাঁহারা তিনজনে সেই সঙ্কীর্ণ পথ ধরিয়া চলিতে লাগিলেন, চলিতে চলিতে তাঁহারা একটি অনুচ্চ পাহাড়ের সানুদেশে উপস্থিত হইলেন। অল্পক্ষণ পরে সূর্য্যাস্ত হইল, অস্তমিত তপনের লোহিত রশ্মিজাল তাল নারিকেল বৃক্ষের পত্রে প্রতিফলিত হইয়া হরিদ্বর্ণ তৃণ-সমাচ্ছাদিত প্রান্তরভূমি চুম্বন করিতে লাগিল। সেই আলোকে পথ দেখিতে তাঁহাদের কোন অসুবিধা হইল না। চারিদিক নিস্তব্ধ, তাঁহাদের তিনজনের লঘু পদশব্দ ভিন্ন অন্য কোনও শব্দ তাঁহাদের কর্ণগোচর হইল না।

 ডড্‌লে চলিতে-চলিতে হঠাৎ থামিয়া একদিকে অঙ্গুলি প্রসারিত করিলেন, বলিলেন, “ঐ ওদিকে—জঙ্গলের ওপাশে সাদা মত কি দেখা যাইতেছে?”

 মিস্ এরস্‌কাইন বলিলেন, “একটা ঘরের সাদা দেওয়াল বলিয়া বোধ হইতেছে না?—হাঁ, ঘরের দেওয়ালই বটে।—এই পথ দিয়া ঐখানেই যাওয়া যাইবে।*

 তখন সকলেই সেই অরণ্যান্তরালবর্ত্তী শুভ্র প্রাচীর লক্ষ্য করিয়া চলিতে লাগিলেন। তাঁহারা সেইস্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, তাহা সেই দ্বীপবাসী, অসভ্য লোকের বাসগৃহ, মাটীর দেওয়ালের বহির্দেশ চূণকাম করা, উপরে খড়ের চাল ছিল, তাহা সংস্কারভাবে ভাঙ্গিয়া খসিয়া পড়িয়াছে, চারিদিকে দেওয়াল মাত্র দাঁড়াইয়া আছে। অরণ্যের অন্তরালবর্তী তালীকুঞ্জ-বেষ্টিত সেই ভগ্নগৃহ গোধূলির অস্ফুট আলোকে তাঁহাদের নয়ন সমক্ষে পিশাচের লীলাক্ষেত্রবৎ প্রতীয়মান হইতে লাগিল।

 ডড্‌লে সেই বিধ্বস্ত প্রায় গৃহটি পরীক্ষা করিয়া বলিলেন, “দেখিতেছি, এস্থান মনুষ্যবাসের অযোগ্য, এখানে আশ্রয় গ্রহণ করিয়া কোন ফল নাই। কিন্তু ঐদিকে আরও কয়েকখানি ঘর দেখা যাইতেছে না?—চল, ঐ ঘরগুলি পরীক্ষা করিয়া দেখি, ওখানে রাত্রিবাস করা হয় ত অসম্ভব হইবে না।”

 কিছু দূরে আরও কয়েকখানি গৃহ ছিল, তাঁহারা তাহা পরীক্ষা করিতে চলিলেন। পাহাড় হইতে নামিয়া প্রায় অর্দ্ধমাইল দূরে আসিয়া তাঁহারা কয়েকখানি মৃৎকুটীর দেখিতে পাইলেন, এগুলির অবস্থা পূর্ব্ববর্ণিত গৃহ অপেক্ষা কিছু ভাল। এই ঘরগুলিতে খড়ের চাল ছিল।

 ডড্‌লে বলিলেন, “এই দ্বীপে ইহা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট আশ্রয় লাভের আশা নাই, বিশেষতঃ, সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিতেছে। মিস্ এরস্‌কাইন, আপনি কি এই কুটীরে রাত্রিবাস করিতে পারিবেন?”

 মিস্ এরস্‌কাইন বলিলেন, “আপনি সঙ্গে থাকিলে আমি যে কোন ভয়ানক স্থানে নির্ভয়ে বাস করিতে পারিব।”—কথাটি বলিয়াই তাঁহার বড় লজ্জা হইল, তিনি মুখখানি লাল করিয়া অন্য দিকে সরিয়া দাঁড়াইলেন। কিন্তু মিস এরস কাইনের কথা শুনিয়া ডড্‌লের হৃদয় আনন্দে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল, সকল কষ্ট, যন্ত্রণা, পরিশ্রম তিনি সফল মনে করিলেন। তিনি স্থান, কাল সমস্তই বিস্মৃত হইলেন। একথা যদি মিস্ এরস্‌কাইনের অন্তরের কথা হয়, তাহা হইলে পৃথিবীতে কোন্ ভাগাবান পুরুষ তাঁহার অপেক্ষা অধিক সুখী? তাঁহার মনে হইল, এই দ্বীপই তাঁহার নিকট স্বণ, ঐ জীর্ণ, অপরিচ্ছন্ন, শ্রীহীন পর্ণকুটীরগুলি সুখৈশ্বর্য্যপূর্ণ রাজপ্রাসাদ।

 কিন্তু তাঁহার এই সুখস্বপ্ন দীর্ঘস্থায়ী হইল না। পাচক ব্লেক বিভিন্ন কুটীরের অভ্যন্তরভাগ পরিদর্শন করিয়া আসিয়া তাঁহাকে বলিল, “এসকল ঘরে কি ভদ্রলোকে বাস করিতে পারে? কি জঞ্জাল। দুর্গন্ধে যে তিষ্ঠিবার যো নাই। কুটীরগুলি সাপ, ছুঁচো, বিছে প্রভৃতির আড্ডা। সন্ধ্যা না হইতেই ঝিঁঝিঁ পোকায় সা-রে-গা-মা সাধিতে আরম্ভ করিয়াছে। গৃহস্থেরা বোধ হয় এ সকল বাড়ী বাসের অযোগ্য মনে করিয়াই ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছে।”

 ডড্‌লে বলিলেন, “ইহা অপেক্ষা ভাল ঘর যখন পাইবার উপায় নাই, তখন এখানেই কোন রকমে রাত্রিবাস করিতে হইবে। ব্লেক, তুমি নৌকা হইতে পা’লখানা খুলিয়া আনিতে পারিবে?—তাহা মিস্ এরসাইনের শষ্যরূপে ব্যবহার করিতে হইবে, নতুবা উনি মাটীতে শুইবেন কিরূপে?

 পাচক বলিল, “এ আর শক্ত কি? আমি বোটের উপর হইতে পাল আনিতেছি। এখনও অন্ধকার তেমন গাঢ় হয় নাই, আমি অনায়াসে এখানে ফিরিয়া আসিতে পারিব।”

 পাচক ব্লেক পা’ল আনিতে সমুদ্রকূলে চলিল, এবং মূহুর্তমধ্যে অরণ্যের অন্তরালে অদৃশ্য হইল। ডড্‌লে গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, গৃহমধ্যে জঞ্জাল স্তুপীকৃত হইয়া আছে। একস্থানে কতকগুলি শুষ তালপত্র, এক কোণে মদের ভাঙ্গা বোতল, কোথাও ফর্সির একটা ভাঙ্গা নল এবং এক দিকে কতকগুলি শুধু জ্বালানী কাঠ।

 ডড্‌লে মিস্ এরসকাইনকে ঘর হইতে বাহির করিয়া দিয়া ঘর পরিষ্কার করিতে আরম্ভ করিলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই মেঝের জঞ্জাল অদৃশ্য হইল, তখন তিনি বাহিরে আসিয়া মিস্ এরসকাইনের পাশে দাড়াইলেন, তাহাকে বলিলেন, “এদিকে ত সকল যোগাড শেষ, কিন্তু ব্লেক এখনও আসিতেছে না কোন বিপদে পড়িল না কি?—না, পথ ভুলিয়া বনের মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে?—এখন দেখিতেছি তাহাকে যাইতে না দিলেই ভাল হইত।”

 মিস্ এরসকাইন বলিলেন, “আমার জন্যই সে বোধ হয় বিপন্ন হইয়াছে। আপনি কেন তাহাকে পাল আনিতে পাঠাইলেন? আমি মাটীতে অনায়াসেই শয়ন করিতে পারিতাম।

 ডড্‌লে বলিলেন, “না, আপনার কোন দোষ নাই, আমার মনে হইতেছে —যদি তাহাকে না পাঠাইয়া আমি নিজে যাইতাম, তাহা হইলে আক্ষেপের কোন কারণ থাকিত না

 আরও দশ মিনিট চলিয়া গেল, কে ফিরিল না, তাহার প্রত্যাগমনের কোন চিহ্নও দেখিতে পাইলেন না। ডড্‌লে অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিলেন। অনেকক্ষণ পরে কাহার পদশব্দে উড়লে আত্মসংবরণ করিয়া উৎকর্ণভাবে দাঁড়াইয়া রহিলেন।—ডড়লে মিস্ এরসকাইনকে বলিলেন, “এইবার বুঝি ব্লেক আসিতেছে।”

 মিস্ এরসকাইন বলিলেন, “সে-ই যে আসিতেছে, ইহা কিরূপে বুঝিলেন? ঐ পদশব্দ স্থানীয় কোন লোকেরও ত হইতে পারে।”

 ডড়লে বলিলেন, “নিশ্চয়ই নহে। জুতার শব্দেই বুঝিয়াছি ব্লেক ‘আসিতেছে। স্থানীয় অসভ্য লোকগুলা জুতা পাইবে কোথায়?—না, ব্লেকই আসিতেছে।”

 কথা শেষ হইতে-না-হইতে পাচক ব্লেক তাদের সম্মুখে আসিয়া দাঁডাইল। তাহাকে দেখিয়া ডড্‌লে উত্তেজিত স্বরে বলিলেন, “ব্লেক, তোমার এত বিলম্বের কারণ কি? তোমার বিলম্ব দেখিয়া আমার যে কত দুশ্চিন্তা হইয়াছিল—তাহা তোমাকে বলিয়া বুঝাইতে পারিব না।”

 পাচক বলিল, “আমি পথ হারাইয়া। অন্যদিকে গিয়া পড়িয়াছিলাম। আমার বিলম্ব দেথিয়া আপনি উৎকণ্ঠিত হইবেন, তাহা কি আর বুঝিতে পারি নাই?

 ডড়লে বলিলেন, “কত রকম আশঙ্কাই মনে হইতেছিল—তাহা আর তোমাকে কি বলিব?—যাহা হউক, যে কাযে গিয়াছিলে তাহার কি হইল? তুমি ত বোটের পাল লইয়া আস নাই।”

 পাচক বলিল, “না মহাশয়, আমি বোটখানি খুঁজিয়া পাই নাই। আপনি একবার এদিকে চলুন।

 ডড়লে বুঝিলেন, পাচক তাঁহাকে কোন গোপনীয় কথা বলিবে, মিস 'এরসকাইনের সাক্ষাতে সে তাহা বলিতে অনিচ্ছুক। তিনি মিস্ এরাইনকে বলিলেন, “মিস এরসকাইন, পাল ত পাওয়া যায় নাই, আজ রাত্রির মত একখানা কম্বল বিছাইয়াই মাটীর উপর আপনাকে শয়ন করিতে হইবে, অন্য, কোন উপায় দেখি না।

 মিস্ এরসকাইন বলিলেন, “ইহাতে আর আপত্তি কি? বিপদের সময় সকলই করিতে হয়। আপনি লোকটাকে না পাঠাইলেই ভাল হইত, বেচারা অনর্থক হয়রাণ হইয়া আসিল।”

 মিস্ এরসকাইন সেই কুটীরে প্রবেশ করিয়া মৃত্তিকায় তাহার কম্বল প্রসারিত করিলেন।—ডড়লে পাচককে একাকী পাইয়া নিম্নস্বরে বলিলেন, “ব্লেক, তোমার ভাব দেখিয়া বোধ হইতেছে, আমাকে তোমার কিছু বলিবার আছে। তোমার এত বিলম্ব হইবার কারণ কি? কি জন্যই-বা নৌকার পালখানি আনিলে না?—আমার বড় ভয় হইয়াছে, ব্যাপার কি বল।”

 ব্লেক বলিল, “আপনি ঐদিকে চলুন, মিস্ এরসকাইন কে সে সকল কথা জানিতে দেওয়া হইবে না। তিনি ভয় পাইবেন। ব্যাপার বড় গুরুতর। এতই গুরুতর যে, তাহা শুনিল আপনি হতবুদ্ধি হইয়া যাইবেন। আমার ত মহাশয়, বুদ্ধি লোপ পাইয়াছে।”

 ডড্‌লে পাচকের হাত ধরিয়া তাঁহাকে কয়েক গজ দূরে টানিয়া লইয়া গিয়া উদ্বেগকম্পিত স্বরে বললেন, এবার কি কে? শীঘ্র বল।”

 পাচক বলিল, “ব্যাপার অতি সাংঘাতিক।—ডাক্তার ল্যাম্পিয়ন ও জাহাজের কাপ্তেন আমাদের অনুসরণ করিয়াছিল, আমাদের ধরিতে তাহারা এখানে পর্যন্ত আসিয়া পড়িয়াছে।

 কথাটা শুনিয়া ডডলির হৃৎকম্প হইল; তিনি অস্ফুটস্বরে বলিলেন, “সকল কথা খুলিয়া বল। তাহারা এখানে আসিয়াছে—ইহা কিরূপে জানিলে?”

 পাচক বলিল, “আমি এই দ্বীপের অদূরে জাহাজখানা দেখিয়া আসিয়াছি। —জাহাজ যেখানে নোঙ্গর করিয়াছে, সে স্থান এখান হইতে পাঁচ মাইলের অধিক দূরে নহে। আমি বোটের সন্ধানে পাহাড়ের উপর-দিয়া; সমুদ্রকুলের দিকে যাইতেছিলাম, হঠাৎ দেখিলাম, একখান জাহাজ আসিয়া দ্বীপের নিকট ভিড়িল।’ আমি জাহাজখানি দেখিয়াই চিনিতে পারিলাম। সে যে কেন আসিয়াছে— তাহাও বুঝিতে পারিলাম। আমার আর অগ্রসর হইতে সাহস হইল না। অতঃপর কি হয়—তাহা দেখিবার জন্য আমি সেই স্থানে দাঁড়াইয়া রহিলাম।

কয়েক মিনিট পরে দেখিলাম, জাহাজখানি নোঙ্গর করিয়া একখানি বোট জলে নামাইয়া দিল। বুঝিলাম, ডাক্তার ল্যাম্পিয়ন ও কাপ্তেন সেই বোটে আমাদের খুজিতে আসিতেছে। —কিন্তু আমি হতাশ হই নাই, উহারা যদি এই দ্বীপের কোন অধিবাসীর সাক্ষাৎ পায়, তাহা হইলেও তাহার নিকট আমাদের কোন সন্ধান জানিতে পারিবে না। আমরা যে এখানে আছি তাহা ত কেহই জানে না। সুতরাং উহার নিশ্চয়ই জাহাজে ফিরিয়া গিয়া নোঙ্গর তুলিবে, এবং আমাদের সন্ধানে অন্যদিকে যাইবে, তাহা হইলে আর আমাদের ভয় কি?

 ডড্‌লে বলিলেন, “সে কথা সত্য কিন্তু জানে এখনও কি সেইখানে নোঙ্গর করিয়া আছে?

 পাচক বলিল, “আছে বৈ কি।—ব্যাপার যাহা ঘটিয়াছে তাহা আরও জাহাজের বোটখানি দ্বীপের কিনারায় আসিলে দেখিলাম—ডাক্তার ল্যাম্পিয়ন ও জাহাজের কাপ্তেন সেই বোট হইতে তীরে নামিল। অতঃপর কি কর্তব্য তাহাই ভাবিতেছি, এমন সময় এই দ্বীপের কয়েকজন লোককে জঙ্গলের ভিতর দিয়া সমুদ্রকূলের দিকে যাইতে দেখিলাম।——তাহাদের দুই তিন জনের মাথায় এক-একটা ঝোডা। তাহার। অন্যদিক দিয়া সমুদ্রের ধারে উপস্থিত হইল, সেই স্থানেই আমাদের বোটখানি বাধা ছিল। বোটখানি দেখিয়া তাহারা যেন কি বলাবলি করিল, তাহার পর আমাদের বোটে উঠিয়া বোটের মাস্তুল খাটাইয়া তাহাতে পাল তুলিয়া দিল এবং দাঁড় টানিতে-টানিতে তাহারা বোটখানি লইয়া চলিল। আমার ইচ্ছা হইল আমি দৌড়াইয়া সমুদ্রকূলে উপস্থিত হইয়া তাহাদিগকে বোটখানি চুরী করিয়া লইয়া যাইতে নিষেধ করি, —কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হইল, তাহাদিগকে দেখা দেওয়া ভাল হইবে না, তাহারা আমাকে দেখিলেই সেকথা কাপ্তেনের কাছে প্রকাশ করিবে। যাহা হউক, তাহাৱা বোটখানি লইয়া জাহাজের দিকে চলিল,—আমিও আপনার নিকট ফিরিয়া আসিলাম।”

 পাচকের কথা শুনিয়া ডড়লের মুখ অন্ধকারাচ্ছন্ন হইল। অতঃপর তিনি কি করিবেন, তা সহসা স্থির করিতে পারিলেন না। ল্যাম্পিয়ন মিস এরসকাইনকে হত্যা করিবার জন্য কাপ্তেনের সহিত যে ষড়যন্ত্র করিয়াছিল— তাহ ডড়লে জানিতে পারিয়াছেন, একথা ল্যাম্পিয়ন ও কাপ্তেন উভয়েই বুঝিতে পারিয়াছে, সুতরাং কথাটা গোপন রাখিবার উদ্দেশ্যে তাহার যে তাহাদিগকে ধরিবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিবে, এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। একবার যদি তাহারা তাহাদিগকে ধরিতে পারে, তাহা হইলে তাহাদের প্রাণরক্ষার আশা নাই। তারা দ্বীপে আসিয়া তাহাদের অন্বেষণ করিতেছে, রাত্রিকালে ধরা না পড়িলেও পরদিন তাহাদিগকে ধরা পড়িতেই হইবে। —এখন কর্তব্য কি?

 ডড়লে অস্ফুট স্বরে বলিলেন, “এখন আমি করি কি? নেটিভগুলা আমাদের বোটখানি লইয়া চলিয়া গিয়াছে। কাপ্তেনের সহিত তাহাদেব নিশ্চয়ই দেখা হইবে, এবং বোটের কথা তাহাকে জানাইলেই কাপ্তেন ও ল্যাম্পিয়ন বুঝিবে আমরা এই দ্বীপেই আশ্রয় লইয়াছি।—তখন আমাদিগকে খুঁজিয়া বাহির করা তাহাদের পক্ষে কঠিন হইবে না। এখানে ধরা পড়িলে আমাদের প্রাণরক্ষার কোন আশা নাই। বোটখানি থাকিলেও এই রাত্রে স্থানান্তরে পলায়নের চেষ্টা করিতাম,—কিন্তু নেটিভগুলা বোটখানি লইয়া গিয়াছে। এই ক্ষুদ্র দ্বীপে সম্পূর্ণ নিরাশ্রয়ভাবে কয় দিন লুকাইয়া থাকিব?”

 ডড্‌লের অভিপ্রায় জানিবার জন্য পাচক উদ্বেগপূর্ণ দৃষ্টিতে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।——ডড়লে তাহাকে বলিলেন, “তুমি যে মিস্ এরসকাইনের সাক্ষাতে আমাকে এ সকল কথা বল নাই, ইহা খুব বুদ্ধিমানের কায হইয়াছে। তিনি এ সকল কথা শুনিলে অত্যন্ত ভয় পাইতেন, অথচ ইহাতে তাহার কোন উপকার হইত না।”

 পাচক বলিল, “সেটুকু বুদ্ধি আমার আছে। মিস এরসকাইন একেই ত অত্যন্ত বিপন্ন, তাহার উপর এ সকল কথা শুনিলে কি তিনি ধৈর্য্যধারণ করিতে পারিতেন? না মহাশয়, প্রাণ গেলেও আমি এ সকল গোপনীয় কথা তাঁহার নিকট প্রকাশ করিব না।

 ডড্‌লে বলিলেন, “সে বিশ্বাস আমার আছে। তুমি আমাদের বিপদের বন্ধু। আমরা বিপন্ন হইয়াছি, বিপদের মেঘ আমাদের মাথার উপর ঘনাইয়া আসিয়াছে; যে-কোন মুহূর্তে আমাদের মস্তকে বজ্রাঘাত হইতে পারে বটে, কিন্তু আমি এখনও হতাশ হই নাই। আশা আছে পরমেশ্বরের আশীর্বাদে এই ভীষণ বিপদ হইতে আমরা উদ্ধার লাভ করিতে পারি। অতঃপর আমাদের কি করা কর্তব্য, তারই আলোচনা করা যাউক।—এই দ্বীপের কোন দিকে লোকালয় আছে—তাহার কোন সন্ধান পাইয়াছ কি?”

 পাচক বলিল, “আমার অনুমান দ্বীপের পশ্চিমাংশে গ্রাম আছে। জাহাজখানি সেই দিকে নোঙ্গর করিয়াছে বলিয়াই এরূপ অনুমান করিতেছি।

 ডড্‌লে বলিলেন, “তোমার অনুমান সত্য হওয়াই সম্ভব। এখন কথা এই যে, আমরা আপাতত এখানেই লুকাইয়া থাকিব, না—এই দ্বীপের প্রধান ব্যক্তির সহিত সাক্ষাৎ করিয়া অর্থদানে তাহাকে বশীভূত করিবার চেষ্টা করিব?—সে আমাদিগকে আশ্রয় দান করিলে কাপ্তেন বা ল্যাম্পিয়ন আমাদের কোন অনিষ্ট করিতে পারিবে না। স্বীকার করি ল্যাম্পিয়নও তাহাকে উৎকোচ, দানে হস্তগত করিবার চেষ্টা করিবে, কিন্তু সে যে অধিক টাকা দিতে পারিবে, এরূপ বোধ হয় না। আমরা প্রাণরক্ষার জন্য তাহাকে অনেক অধিক অর্থ প্রদানের লোত দেখাইলে সর্দার আমাদেরই পক্ষাবলম্বন করিবে। সে যদি আমাদিগকে মোম্বাসা বা জাঞ্জিবারে রাখিয়া আসিতে সম্মত হয়—তাহা হইলে আমি তাহাকে আশাতিরিক্ত পুরস্কার দিব।—আমার প্রস্তাবে কি সে সম্মত হইবে না? একটা অসভ্য নেটিভকে বশ করা কি এতই কঠিন? তুমি কি বল?”

 পাচক বলিল, “আপনার এই প্রস্তাবই যুক্তিসঙ্গত বোধ হইতেছে।কিন্তু আপনি কি সেই নেটিভটার সঙ্গে কথা কহিতে পারিবেন?—তাহার ভাষা বুঝিতে পারিবেন?

 ডড্‌লে বলিলেন, “চেষ্টা করিয়া দেখিব। পূর্ব্ব-আফ্রিকার বহু দেশেই ঘুরিয়াছি, সেই নেটিভ সর্দারটা আরবই হউক, আর হাবসীই হউক-তাহার কথা বুঝিতে পারি, —আমার মনের ভাবও তাহাকে বুঝাইতে পারিব।

গ্রামখানি কোন্ দিকে—তাহা ঠিক জানিতে পারিলে, আমি এই মুহূর্ত্তেই নেটিভ সর্দ্দারের সহিত দেখা করিতে যাইতাম।”

 পাচক বলিল, “কিন্তু আপনি ত সেখানে মিস্ এরসকাইনকে আপনার সঙ্গে লইয়া যাইতে পারিবেন না। আপনি কি উদ্দেশ্যে কোথায় যাইতেছেন—এ কথা জিজ্ঞাসা করিলে মিস্ এরসকাইনকে কি বলিয়া বুঝাইবেন? কথা তাহাকে খুলিয়া বলিলে ভয়ে তাহার মূচ্ছ। হইবে, আর না বলিয়াই বা উপায় কি?

 ডড্‌লে ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া বলিলেন, “ভাবিয়া দেখিলাম—তাহার নিকট এ সকল কথা প্রকাশ করাই কর্তব্য। ঘরে আগুন লাগিলে নিদ্রিত গৃহবাসীকে সতর্ক না করা মূঢ়ের কার্য।—তুমি এখন আমার সঙ্গে যাইও না, আমি একাকী গিয়া তাহাকে সকল কথা বুঝাইয়া দিতেছি।”

 মিস্ এরসকাইন গৃহমধ্যে কম্বল বিছাইয়া ডড্‌লের প্রতীক্ষায় দ্বারপ্রান্তে দাড়াইয়াছিলেন। ডড্‌লে তার সম্মুখে আসিয়া বলিলেন, “মিস এ্রসকাইন, আপনার সঙ্গে আমার গোটাকত কথা আছে। আপনি এখন তাহা শুনিতে প্রস্তুত আছেন কি? বড়ই জরুরী কথা।”

 মিস্ এরসকাইন তৎক্ষণাৎ বাহিরে আসিয়া ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “কি কথা, বলুন। আপনি কথা বলিবেন, এজন্য আমার অনুমতির অপেক্ষা করিতেছেন কেন? আপনার ভাব দেখিয়া বোধ হইতেছে আপনি কোন দুঃসংবাদ পাইয়াছেন! আপনার কণ্ঠস্বরে উদ্বেগ ও ব্যাকুলতা ফুটিয়া উঠিয়াছে। যতই দুঃসংবাদ হউক, বলুন, তাহা শুনিবার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছি, আমি ভয়ার্ত বালিকা নহি যে, তাহা শুনিলে আমার মুচ্ছা হইবে।”

 ডড্‌লে মুহূর্তকাল ইতস্ততঃ করিয়া বলিলেন, “এ কথা বলাই বাহুল্য, আমি আপনার সাহসের পরিচয় যথেষ্ট পাইয়াছি। কিন্তু সত্য কথা বলিতে কি, আমরা বড়ই বিপন্ন, ইহা অপেক্ষা অধিক বিপদ আর কিছুই হইতে পারে না। আমি ব্লেকের নিকট অতি ভয়ঙ্কর সংবাদ পাইয়াছি। —আপনার মামা ও জাহাজের কাপ্তেন আমাদের অনুসরণ করিয়া এই দ্বীপে উপস্থিত হইয়াছে।”

 মিস্ এরসকাইনের সাহস যতই অধিক হউক, তিনি রমণীমাত্র। মিঃ ডড়লের কথা শুনিয়া তাহার মুখ শুকাইল, মাথা ঘুরিয়া উঠিল। তিনি অতি কষ্টে আত্মসংবরণ করিয়া ভগ্নস্বরে বলিলেন, “ভয়ানক বিপদের কথা বটে। কিন্তু এ বিপদ অধীর হইলে চলিবে না। মৃত্যুকবল হইতে আপনি একবার আমাকে উদ্ধার করিয়াছেন, আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে—আপনার চেষ্টায় এ সঙ্কটেও আমার প্রাণরক্ষা হইবে —এখন আপনি কি কর্তব্য স্থির করিয়াছেন, বলুন।”

 মিঃ ডড্‌লে উপস্থিত কর্তব্য সম্বন্ধে পাচককে যে সকল কথা বলিয়াছিলেন, মিস্ এরসকাইনকেও তাহাই বলিলেন। তাহা শুনিয়া মিস, এরসকাইন বলিলেন, “আপনার এই প্রস্তাবই সঙ্গত মনে হইতেছে। টাকার জন্য আপনি চিন্তা করিবেন না। আমি জানি আপনি নিঃসম্বল, কিন্তু আমি ত নিঃসম্বল নহি, আমার নিকট যাহা কিছু আছে—সমস্তই আপনার হস্তে প্রদান করিতেছি। আপনি নেটিভ সর্দারের সহিত সাক্ষাত করিয়া—সে যাহা চায়, তাহাই তাহাকে দান করিতে প্রতিশ্রুত হউন, তাহাকে বলুন—সে যদি আমাদিগকে মোম্বাসায় বা জাঞ্জিবারে নিরাপদে পৌছাইয়া দেয়, তাহা হইলে তাহাকে প্রতিশ্রুত অর্থ প্রদান করা হইবে। তাহাকে আগাম কিছু দিলেও ক্ষতি নাই, কিন্তু সে যে বিশ্বাসঘাতকতা করিবে না—এ সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হওয়া আবশ্যক।—আপনি কথ তাহার সহিত দেখা করিতে যাইবেন?

 ডড্‌লে বলিলেন, “আজ রাত্রেই যাইব মনে করিয়াছি, কিন্তু সে কোথায় বাস করে অগ্রে তাহা জানা আবশ্যক, নতুবা এই রাত্রিকালে জঙ্গলে-ঙ্গলে তাহাকে কোথায় খুঁজিয়া বেড়াইব? এই দ্বীপে যখন লোক আছে-তখন নিশ্চয়ই তাহাদের বাসস্থান আছে, এবং তাহাদের একজন প্রধানও আছে। আপনি এখানেই থাকুন, কে আপনার পাহারায় থাকিবে। আমি কায শেষ করিয়া যত শীঘ্র পারি এখানে ফিরিয়া আসিব।”

 মিস এরসকাইন বলিলেন, “তবে আর আপনি বিলম্ব করিবেন না, পরমেশ্বর আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করুন। তিনি অসহায়ের সহায়, বিপন্নের আশ্রয়। আমার জন্য আপনি কোন চিন্তা করিবেন না। আপনি যতক্ষণ না ফিরিবেন, ততক্ষণ আমার মন স্থির হইবে না।”

 অনন্তর ডড্‌লে ব্লেককে ডাকিয়া আহারের আয়োজন করিতে বলিলেন। নিঃশব্দে আহার শেষ হইল। আহার শেষ করিয়া উড়তে উঠিলেন, তিনি মিস, এসকাইনকে বলিলেন, “আমি নেটিভ সর্দ্দারের সন্ধানে চলিলাম। আমি ফিরিয়া না আসা পর্যন্ত আপনি এখানেই থাকিবেন।”

 মিস এরসকাইন বলিলেন, “আপনিই আমার একমাত্র অবলম্বন, আপনাকে ছাডিয়া কোথায় যাইব? আপনার প্রতাগমনের প্রতীক্ষায় এখানেই বসিয়া থাকিব, কিন্তু আপনি যেন অধিক বিলম্ব করিবেন না। আপনি ফিরিয়া না আসিলে আমার দুশ্চিন্তা দূর হইবে না।”

 ডড্‌লে বলিলেন, “যত শীঘ্র পারি-অমি ফিরিয়া আসিব। আপনাকে এখানে ফেলিয়া রাখিয়া আমি কি অকারণ বিলম্ব করিতে পারি?—আপনি ধৈর্য্যাবলম্বন করুন, হতাশ হইবেন না।”

 মিস, এরসকাইন বলিলেন, “আপনি সতর্ক থাকিবেন, সেই ‘রাস্কেল’ দুটো যেন আমাদের সন্ধান না পায়। পরমেশ্বর আপনার মঙ্গল করুন। আপনি একটি নিরাশ্রয়া অভাগিনী রমণীর উদ্ধারের জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করিয়াছেন, একথা স্মরণ করিয়া আপনি মনে বল পাইবেন।”

 ডড্‌লে বলিলেন, “এ কথা কি আমি ভুলিতে পারি?—ব্লেক, আমি যতক্ষণ ফিরিয়া না আসি, ততক্ষণ তুমি ইহার পাহারায় থাকিবে, ঘুমাইয়া পড়িও না। নিজের প্রাণ দিয়াও উহার প্রাণরক্ষা করিবে। —কায শেষ হইলেই আমি চলিয়া আসিব।”

 ডড্‌লে সেই সান্ধ্য অন্ধকারে নির্জন অরণ্যপথে অদৃশ্য হইলেন। মিস এরসকাইন উভয় হস্তে মুখ ঢাকিয়া নিঃশব্দে রোদন করিতে লাগিলেন।