নাবিক-বধূ/একাদশ পরিচ্ছেদ

একাদশ পরিচ্ছেদ

কয়েক মিনিট পর্য্যন্ত কেহ কোন কথা বলিতে পারিলেন না।—যিনি যেখানে বসিয়াছিলেন, জড়ের ন্যায় সেই স্থানেই বসিয়া রহিলেন। বোটখানি সমুদ্রতরঙ্গে ভাসিতে-ভাসিতে কিছু দূরে চলিয়া গেল।হঠাৎ মিস্ এরস্‌কাইন উভয় হস্তে মুখ ঢাকিয়া “মাগো, মা। মা আমার।”—বলিয়া উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে রোদন করিয়া উঠিলেন।—যেন এতক্ষণ পরে তিনি তাঁহার বিপদের কথা বুঝিতে পারিলেন। পাচক ব্লেক বাহ্যজ্ঞানশূন্য, স্তম্ভিত।—সে জাহাজে আছে, কি বোটে আছে, সে-জ্ঞান পর্য্যন্ত বিলুপ্ত হইয়াছিল। কেবল ডড্‌লেই সম্পূর্ণ প্রকৃতিস্থ ছিলেন, তিনিই সর্ব্বপ্রথম কথা কহিলেন।

 ডড্‌লে বলিলেন, “ব্লেক, একবার উঠিয়া মাস্তুলটায় হাত দাও ত, উহা খাড়া করিয়া বসানো যাক। বোটে পাল তুলিয়া দিয়া আমরা যত শীঘ্র দূরে যাইতে পারি—তাহার চেষ্টা করিতে হইবে। জাহাজের লোকগুলা টের পাইলেই আমাদের ধরিবার জন্য ছুটিয়া আসিবে, তখন আত্মরক্ষা করা অত্যন্ত কঠিন হইয়া উঠিবে।”

 পাচক তৎক্ষণাৎ উঠিয়া মাস্তুলটা খাড়া করিল, উভয়ের চেষ্টায় মাস্তুলটি যথাস্থানে স্থাপিত হইলে তাহাতে পাল খাটাইয়া দেওয়া হইল। পালে বাতাস লাগিবামাত্র বোটখানি সমুদ্রতরঙ্গের উপর দিয়া নক্ষত্রবেগে ধাবিত হইল। ডড্‌লে হাল ধরিলেন। কিছুকাল পরে জাহাজখানি সুদূর সীমান্তে মসীচিহ্নের ন্যায় পরিলক্ষিত হইল। বোটখানি পশ্চিমদিগভিমুখে চলিতে লাগিল।

 এতক্ষণ পরে ডড্‌লে মিস্‌ এরস্‌কাইনকে বলিলেন,“মিস্ এরস্‌কাইন, আপনি মুক্তিলাভ করিয়াছেন, তাহা বুঝিয়াছেন কি?”

 মিস্‌ এরস্‌কাইন মৃদুস্বরে বলিলেন, “হাঁ, পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ। আমি মুক্তিলাভ করিয়াছি। আপনার অনুগ্রহেই আমি আসন্ন মৃত্যুর কবল হইতে উদ্ধার লাভ করিয়া জীবনের রাজ্যে ফিরিয়া যাইতেছি।—মিঃ ডড্‌লে, আমি কি বলিয়া আপনার নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিব?”

 সেই সময় শুভ্র চন্দ্রালোক খণ্ড-বিখণ্ড মেঘস্তরের ব্যবধান-পথে মিস্ এরস্‌কাইনের অশ্রুপ্লাবিত মুখের উপর পড়িয়াছিল। ডড্‌লে দেখিলেন, সে মুখ বড় সুন্দর। তাঁহার অশ্রুপূর্ণ চক্ষুদু’টিতে গভীর কৃতজ্ঞতা পরিব্যক্ত হইতেছিল। ডড্‌লে তাহা দেখিয়া মুগ্ধ হইলেন। তিনি সান্ত্বনা দানের অভিপ্রায়ে মিস্ এরস কাইনকে বলিলেন, “মিস্ এরস্‌কাইন, আপনি হতাশ হইবেন না, আপনার বিপদের মেঘ কাটিয়া গিয়াছে। আমরা যদিও এখন নিরাপদ নহি, কিন্তু জাহাজে আমাদের যে ভয় ছিল-সে ভয় এখানে নাই। আপনার মামা একটি নরপিশাচ, সে আপনাকে হত্যা করিয়া আপনার সমস্ত সম্পত্তি আত্মসাৎ করিবার জনা ষড়যন্ত্র করিয়াছিল, কিন্তু পাপিষ্ঠের সেই নিষ্ঠুর সঙ্কল্প আর সিদ্ধ হইবার সম্ভাবনা নাই, নারীহত্যা-পাতক হইতে সে নিষ্কৃতিলাভ করিয়াছে। আমার অনুমান, তীরভূমি এখান হইতে একশত মাইলের অধিক নহে। আমরা লামু-দ্বীপ লক্ষ্য করিয়া চলিয়াছি। সেখানে উঠিতে পারিলে আর আমাদের ভয় নাই। সেখান হইতে আমরা মেলবোটে জাঞ্জিবারে উপস্থিত হইতে পারিব, তাহার পর কেপ্ টাউনে গমন করা কঠিন হইবে না।—আপনি উৎকণ্ঠিত হইবেন না।”

 মিস্ এরস্‌কাইন বলিলেন, “না, আমি উৎকণ্ঠিত হই নাই। আমি যে আপনার অনুগ্রহে মুক্তিলাভ করিয়াছি, এই চিন্তায় আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার হৃদয় পূর্ণ হইয়াছে, আমার অন্তরে অন্য চিন্তার স্থান নাই। আপনি আমাকে উদ্ধার করিতে না পারিলে এতদিন আমি মৃত্যুমুখে পতিত হইতাম, তাই বুঝিতে পারিয়াছি। আশা করি আমি শীঘ্রই প্রকৃতিস্থ হইতে পারিব।”

 ডড্‌লে পাচককে বলিলেন, “ব্লেক, তুমি জাহাজখানা আর দেখিতে, পাইতেছ কি?

 পাচক বলিল, “না মহাশয়, আর দেখা যাইতেছে না।—উহা যেন আর কখনও দেখিতে না হয়। জাহাজের লোকগুলা এতক্ষণে টের পাইয়াছে— আমরা পলাইতেছি। কাপ্তেনটা বোধ হয় রাগিয়া জাহাজ মাথায় করিয়াছে, আর আমাদের গালি দিতেছে। আর শয়তান ডাক্তারটা শিকার হাতছাড়া হইয়াছে দেখিয়া দুই হাতে দাডি ছিঁডিতেছে। কি মজা।

 ডড্‌লে হাসিয়া বলিলেন, “ডাক্তার ল্যাম্পিয়নের ত দাডি নাই।

 পাচক বলিল, “তাও ত বটে। কথাটা ভুলিয়া গিয়াছিলাম। তা দাডি না থাক, চুল ত আছে, দুই হাতে সে চুল ছিঁড়িতেছে।”

 ডড্‌লে দেখিলেন, মিস্ এরস্‌কাইন অত্যন্ত বিষণ্ন হইয়া বসিয়া আছেন, বোধ হইল, কি ভাবিতেছেন।—তাঁহার চিন্তাস্রোত বিক্ষিপ্ত করিবার জন্য ডড্‌লে ব্লেককে বলিলেন, “বাবুর্চ্চি, আমাদের খাবারের ঝোড়ায় ব্র্যাণ্ডি কি অন্য কোন রকম মদের বোতল আছে কি?”

 পাচক বলিল, “হাঁ, এক বোতল ব্র্যাণ্ডি দিয়াছি। মিস্‌কে আধ ছটাক-খানেক ব্র্যাণ্ডি দিলে এ সময় তাঁহার অত্যন্ত উপকার হইত। মনটাও একটু চাঙ্গা হইত।”

 ডড্‌লে বলিলেন, “তবে বোতল খোল, আর একটি গ্ল্যাস বাহির কর।”

 পাচক তৎক্ষণাৎ ব্র্যাণ্ডির বোতল খুলিয়া অল্পপরিমাণ ব্র্যাণ্ডি ঢালিয়া তাহাতে জল মিশ্রিত করিল। মিস্ এরস্‌কাইন তাহা পান করিতে অত্যন্ত অসম্মতি প্রকাশ করিলেন, কিন্তু ডড্‌লের আগ্রহাতিশয্যে তাহা তাঁহাকে পান করিতে হইল। কয়েক মিনিটের মধ্যে তিনি অপেক্ষাকৃত সুস্থ হইলেন, তাঁহার মানসিক অবসাদও দূর হইল। অনন্তর ডড্‌লে ব্লেককেও কিঞ্চিৎ পান করিতে অনুরোধ করিলে পাচক বলিল, “একটি মাত্র বোতল আনিয়াছি, ভবিষ্যতে আপনাদেরই আবশ্যক হইতে পারে,এখন উহা অকারণ নষ্ট করিব না।”

 ডড্‌লে বলিলেন, “তুমিও অত্যন্ত অবসন্ন হইয়াছ, একটু খাও, আবল্য কাটলে আমাকে সাহায্য করিতে পারিবে।—আমার বিশ্বাস, চৌদ্দ পনের ঘণ্টায় মধ্যেই তীরভূমি আমাদের দৃষ্টিগোচর হইবে।—এখন রাত্রি কত? তোমার সঙ্গে ঘড়ি আছে কি?”

 পাচকের মণিবন্ধে ঘড়ি বাঁধা ছিল, সে ঘড়ির দিকে চাহিল, পরিস্ফুট আলোকে সময় দেখিবার অসুবিধা হইল না। সে বলিল, “এখন রাত্রি একটা বিশ মিনিট।

 মিস্ এরস্‌কাইন বলিলেন, “তাহা হইলে কাল বেলা তিন চারিটার মধ্যেই আমরা তীরভূমি দেখিতে পাইব?”

 ডড্‌লে বলিলেন, “এই রকমই ত আশা করিতেছি।”

 পাচক বলিল, “আমরা এখন সমুদ্রের কোন্ স্থান দিয়া যাইতেছি, তাহা কিছু বুঝিতে পারিতেছেন?

 ডড্‌লে বলিলেন,“সে কথা বলা বড় শক্ত। আমি সেদিন দুই এক মিনিটের জন্য সমুদ্রের যে মানচিত্র দেখিবার সুযোগ পাইয়াছিলাম—তাহা হইতে অনুমান করিতেছি—কিহু (kwyhu Island) ও ফর্ম্মোজা উপসাগরের ভিতর দিয়া যাইতেছি, কিন্তু ইহা আমার অনুমান মাত্র। তবে এ অনুমান অসত্য নহে। আশা করি আমরা নিরাপদে লামুদ্বীপে পৌঁছিতে পারিব, তবে ইতিমধ্যে কোনও চলতি জাহাজ আমাদিগকে বিপন্ন দেখিয়া তাহাতে তুলিয়া লইতেও পারে।”

 মিস্ এরস্‌কাইন বলিলেন, “তাহা হইলে ত বাঁচিয়া বাই। পরমেশ্বর কি এত দয়া করিবেন? সকালে যদি সম্মুখে কোন জাহাজ দেখিতে পাই, তাহা হইলে আমাদের কি আনন্দই হইবে।”

 ইতিমধ্যে পাচক ব্লেক টিনে-আঁটা মাংসের একটি টিন খুলিয়া খানিক মাংস বাহির করিল, এবং তাহা দুই ভাগ করিয়া এক ভাগ মিঃ ডড্‌লেকে ও অপর ভাগ মিস্ এরস্‌কাইনকে খাইতে দিল।—পাচক নিজের জন্য কিছুই রাখিল না দেখিয়া ডড লে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কৈ, তুমি ত কিছু লইলে না?”

 পাচক বলিল, “আমার জন্য আপনি ব্যস্ত হইবেন না। আপনাদের আহার শেষ হইলে আমি খাইব। আমার খাবার অন্য স্থান আছে।”

 ডড্‌লে বলিলেন, “এ কোন কাযের কথা নহে। তুমি তোমার খাবারও বাহির করিয়া লও, না হইলে আমরা কিছুই খাইব না।”

 অগত্যা পাচকও খানিক মাংস বাহির করিয়া লইয়া খাইতে বসিল। ডড্‌লে একহাতে বোটের হাল ধরিয়া অন্য হাতে আহার করিতে লাগিলেন। বোটের হাল ছাডিবার কোন উপায় ছিল না, কারণ তখন বায়ুবেগ অপেক্ষাকৃত প্রবল হওয়ায় বোটখানি তরঙ্গরাশির উপর দিয়া হেলিয়া-দুলিয়া অতি দ্রুতবেগে অগ্রসর হইতেছিল। মিস্ এরস্‌কাইন অধিক কিছু খাইতে পারিলেন না। যাহা হউক, আহার শেষ হইলে ডড লে মিস এরস্‌কাইনের শালখানির ভাঁজ খুলিয়া তদ্বারা তাঁহার সর্ব্বশরীর ঢাকিয়া দিলেন।

 ডড্‌লে মিস্ এরস্‌কাইনকে জিজ্ঞাসা করিলেন,”ঠাণ্ডা বাতাসে আপনার শীত লাগিতেছে কি?”

 মিস্ এরস্‌কাইন বলিলেন, “না, একটুও শীত লাগিতেছে না। আমার বেশ আরাম বোধ হইতেছে। আমার মনের ভার অনেকটা হাল্কা হইয়া গিয়াছে, বিশেষতঃ মামাকে যে নরহত্যা-পাতকে লিপ্ত হইতে হয় নাই, ইহাই আমার সর্ব্বাপেক্ষা অধিক সুখের কথা।”

 ডড্‌লে বলিলেন, “আপনার কথা শুনিয়া একটা কথা মনে পড়িল। আশা করি আপনি আমার কৌতুহল দূর করিবেন।—আপনি আপনার কেবিন হইতে ডেকে আসিবার পূর্ব্বে আপনার মামা কি আপনার কেবিনে গিয়াছিল?”

 মিস্ এরস্‌কাইন বলিলেন, “হাঁ, মামা আমার কামরায় গিয়াছিল বলিয়াই ত আমার বাহিরে আসিতে বিলম্ব হইয়াছিল। তাহার সম্মুখ দিয়া কি করিয়া আসি? রাত্রি নয়টার সময় মামা আমার কুঠুরীতে গিয়া আমাকে বলে, রাত্রি বারটার সময় আবার আসিবে। মামার কথা শুনিয়াই ত আমার চক্ষু স্থির। আমি বুঝিলাম, অদূরে কোন গুপ্তস্থানে আপনি আমার প্রতীক্ষায় দাঁড়াইয়া আছেন, আমার বিলম্ব দেখিয়া আপনি ছট্‌ফট্ করিতেছেন, কিন্তু উপায় কি? সে সময় আমার মনের অবস্থা কিরূপ হইয়াছিল, তাহা আপনাকে বুঝাইতে পারিব না। সে কথা চিরজীবন আমার মনে থাকিবে। মামা আমার কামরায় ঢুকিয়া কি করিল—জানেন? সে আমার খাটের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া আমার মুখের দিকে কট্-মট্ করিয়া চাহিতে লাগিল। দেখিলাম—তাহার সর্ব্বশরীর: কাঁপিতেছে, চক্ষু দু’টি জবাফুলের মত লাল! তাহার ভাব-ভঙ্গি দেখিয়াই বুঝিলাম—সে মদে চুর হইয়াছে। আমার ভয় তখন শতগুণ বর্দ্ধিত হইল। সে একটা শিশি হইতে ঔষধ ঢালিয়া আমাকে খাইতে বলিল, আমি বলিলাম, ‘আমি ঔষধ খাইব না, যদি আমাকে জোর করিয়া খাওয়াইয়া দাও, তাহা হইলে আমি বাঁচিব না।’—মামা বলিল, ‘না, তোমাকে খাইতেই হইবে, খাইলে তোমার শরীর অনেক সুস্থ হইবে।’—আমি তাহার সে কথা গ্রাহ্য করিলাম না। তখন সে আমার ঘাড় ধরিয়া ঔষধটুকু আমার মুখে ঢালিয়া দেওয়ার চেষ্টা করিল, আমি মুখ বুজিয়া বসিয়া রহিলাম। মামাও ছাড়িবার পাত্র নহে, জোর করিয়া তাহা আমার মুখের ভিতর ঢালিয়া দিতে উদ্যত হইল। অগত্যা আমি তাহার হাতে এক ধাক্কা দিলাম, সেই ধাক্কায় ঔষধটুকু বিছানার উপর পড়িয়া গেল। তখন সে রাগ করিয়া বলিল, “কি, আমার অবাধ্য হইতেছিস? ঔষধটা সমস্তই ফেলিয়া দিলি। আচ্ছা থাক্ তুই, ঔষধ গিলিস্ কি না দেখিব। তুই সহজে না খাইলে জোর করিয়া খাওয়াইয়া দিব। ঔষধ না খাইলে ব্যারাম সারে? একগুঁয়ে অবাধ্য মেয়ে।”

 মিস্ এরস্‌কাইনের কথা শুনিয়া ডড্‌লে ক্রোধে গর্জ্জন করিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “লোকটা মানুষ, না জানোয়ার? সে সময় আমি যদি তাহার পশ্চাতে লুকাইয়া থাকিতাম—তাহা হইলে সেই ধাড়ি বদ্‌মায়েসটাকে রীতিমত সায়েস্তা করিতাম। যাহা হউক, কাল সকালে যখন সে ঔষধ লইয়া আপনার কামরায় প্রবেশ করিবে—তখন দেখিবে পাখী উড়িয়া গিয়াছে।”

 মিঃ ডড্‌লে পাচকের দিকে চাহিয়া বলিলেন,“ব্লেক, আমি তোমার কুঠুরীতে যে চিঠি রাখিয়া আসিয়াছিলাম, সে চিঠি কোথায়? তুমি সঙ্গে লইয়া আসিয়াছ কি?”

 পাচক বলিল, “না মহাশয়, আমার খাটিয়ার পার্শ্বে যে আলমারিটা আছে, তাহার উপরেই তাহা পড়িয়া আছে। আমি তাহাতে হাতও দিই নাই। যেখানে তাহা রাখিয়াছিলেন, সেইখানেই আছে। আমার কুঠুরীতে ঢুকিলেই তাহারা তাহা দেখিতে পাইবে।”

 পাচক হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। তাহার হাসি দেখিয়া ডড্‌লে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ব্যাপার কি ব্লেক? এমন কি মজা হইয়াছে যে, তুমি না হাসিয়া থাকিতে পারিলে না?”

 পাচক আরও খানিকটা হাসিয়া বলিল, “বেটারা আচ্ছা জব্দ হইবে। জাহাজখানা যতদিন পর্যন্ত এডেন বন্দরে না পৌঁছিবে—ততদিন ক্ষুধার জ্বালায় সকলকে ছট্‌ফট্ করিতে হইবে। সাধে কি হাসিয়াছি? মজাটা টের পাবেন বাছাধনেরা। জাহাজে আর বাবুর্চ্চি নাই, আমার একটা জোগারদার আছে বটে, কিন্তু সে রাঁধিতে জানে না। কাপ্তেন দায়ে পড়িয়া তাহাকেই রাঁধিতে বাধ্য করিবে। সে যাহা রাঁধিবে, তাহা কি কেহ খাইতে পারিবে? উপোষ মশায়, বিলকুল লোককে উপোষ করিয়া থাকিতে হইবে। শুকনো রুটি, বিস্‌কিট্ চিবাইয়া আর কয়দিন কাটাইতে পারা যায়?—হা হা, হো হো, হি হি।”

 পাচকের হাসি আর থামে না।—ডড লে গম্ভীর হইয়া বলিলেন, “তোমার ভারি যে হাসির ঘটা।—জাহাজে ত খাইবার জিনিসের অভাব নাই, একরকম করিয়া চালাইয়া লইবে।”

 পাচক বলিল, “হাঁ, চালাইয়া লইবে বই কি? কিন্তু কি ভাবে চালাইবে তা ভাবিয়াই ত আমার হাসির ফোয়ারা খুলিয়া গিয়াছে। আমি আমার সেই জোগাড়দারটাকে কতদিন বলিয়াছি, বাপু, একটু রাঁধিতে শেখ।—কিন্তু সে কথা তাহার গ্রাহ্যই হইত না, সে ক্রমাগত ফাঁকি দিত। এবার তাহার ফল পাইবে। এক জাহাজ লোক—খাই-খাই করিয়া তাহাকে জ্বালাতন করিয়া তুলিবে।”

 ডড্‌লে এ সম্বন্ধে আর কোন কথা না বলিয়া মিস্ এরস্‌কাইনকে বলিলেন, “আপনার বোধ করি ঘুম পাইতেছে। বোটের খোলের মধ্যে আপনার শয়নের ব্যবস্থা করিয়া দিব? ব্লেক, দেখ ত উঁহার শয়নের কি ব্যবস্থা করা যায়।”

 মিস্ এরস্‌কাইন বলিলেন, “না থাক, আমার ঘুম আসে নাই। আমার জন্য আপনাকে ব্যস্ত হইতে হইবে না।

 ডড্‌লে সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া পাচকের সাহায্যে বোটের খোলের মধ্যে কম্বল বিছাইয়া তাঁহার জন্য বিছানা করিয়া দিলেন।

 মিস্ এরস্‌কাইন বলিলেন, “আপনি আমার সুখ-স্বচ্ছন্দতার জন্য কত কষ্টই না করিতেছেন।—আমি আপনাদের কোনও রকম সাহায্য করিতে পারিলে কৃতার্থ হইব।”

 ডড লে মিস্ এরস্‌কাইনকে সেই শয্যায় শয়ন করাইয়া বলিলেন, “আপনাকে নানা প্রকার অসুবিধা সহ্য করিতে হইতেছে।—আপনি প্রফুল্ল চিত্তে এই সকল অসুবিধা সহ্য করিলেই আমরা আপনার নিকট যথেষ্ট সাহায্য পাইলাম মনে করিব।”

 অনন্তর ডড্‌লে পাচককে বলিলেন, “ব্লেক, তুমি আর বসিয়া থাকিয়া কষ্ট পাও কেন? অত্যন্ত পরিশ্রান্ত হইয়াছ গলুইয়ে মাথা রাখিয়া ঐখানেই শুইয়া পড়। সমুদ্রের দিকে দৃষ্টি রাখিও, যদি হঠাৎ কোন দিকে জাহাজ দেখিতে পাও, তৎক্ষণাৎ আমাকে সে কথা জানাইও। কেমন, পারিবে ত?”

 পাচক বলিল, “এ কায আমি খুব পারিব, কিন্তু আপনিও একটু বিশ্রাম করিয়া লইলে ভাল হয়। ততক্ষণ আমি আপনার হাল ধরিয়া থাকিতাম।”

 ডড্‌লে বলিলেন, “তুমি সে জন্য চিন্তিত হইও না, আমি ক্লান্ত হইলে তোমার হাতে হাল ছাড়িয়া দিয়া বিশ্রাম করিব।—ঘুম আসিলে একটু ঘুমাইয়া লইও। আজ তুমি আমাদের যে উপকার করিয়াছ—তাহা আমরাই জানি।”

 পাচক বলিল, “ও কথা কেন বলেন আমি আপনাদের সঙ্গে না আসিতে আমারই কি মঙ্গল হইত?”

 পাচক গলুয়ে মাথা রাখিয়া শয়ন করিল। সে সমুদ্রের দিকে চাহিয়া, কোন জাহাজ সে দিকে আসিতেছে কি না তাহাই দেখিতে লাগিল, শীঘ্রই নিদ্রাভিভূত হইল। মিস্ এরস্‌কাইনও বোটের খোলে পড়িয়া ঘুমাইতে লাগিলেন। কেবল মিঃ ডড্‌লে ধ্রুব-নক্ষত্রের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া সেই গভীর রাত্রে চন্দ্রালোক-প্লাবিত মহাসমুদ্রে নৌ-পরিচালিত করিতে লাগিলেন। মধ্যে মধ্যে খণ্ড-বিখণ্ড মেঘ স্তরে-স্তরে নীলাকাশে ভাসিয়া যাইতেছিল, এবং সেই মেঘের ছায়া চঞ্চল সমুদ্র-তরঙ্গে অভ্রকান্তি বিকাশ করিতেছিল। ক্রমে বায়ুবেগ প্রবল হইয়া উঠিল। ইহা ঝটিকার পূর্ব্বলক্ষণ মনে করিয়া ডড্‌লে অত্যন্ত ভীত হইলেন। তিনি বুঝিলেন, ঝটিকা আরম্ভ হইলে মুক্ত-সমুদ্রে ক্ষুদ্র বোটখানি রক্ষা করা কঠিন হইবে।

 ডড্‌লে আরও এক ঘণ্টা নৌ-পরিচালন করিলেন। তিনি সম্মুখে ঝুঁকিয়া পড়িয়া পদপ্রান্তবর্ত্তিনী মিস্ এরস্‌কাইনের মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন। তিনি তখনও গাঢ় নিদ্রায় অভিভূত। ডড লে বোটের ‘গলুই’এর দিকে চাহিয়া পাচকের মাথা দেখিতে পাইলেন না, সুতরাং তিনি বুঝিলেন, সে-ও ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। তিনি তাহার নিদ্রার ব্যাঘাত করিলেন না। রাত্রিশেষে পাচক একবার মাথা তুলিয়া নিদ্রালস নেত্রে ডড্‌লের মুখের দিকে চাহিল, এবং ডড্‌লে তখনও শয়ন করিতে পান নাই দেখিয়া লজ্জিত হইয়া বোটের হাল গ্রহণের জন্য উঠিতে উদ্যত হইল, কিন্তু ডড্‌লে ইঙ্গিতে তাহাকে নিষেধ করিলেন, পাচক পুনর্ব্বার শয়ন করিল। ডড লে পূর্ব্ববৎ বোট চালাইতে লাগিলেন।

 ক্রমে পূর্ব্বাকাশ উষালাকে আরক্তিম হইল, প্রভাতকল্পা শর্ব্বরীর তরল অন্ধকার যেন কোন্ ঐন্দ্রজালিকের মায়াদণ্ড স্পর্শে ধীরে-ধীরে অপসারিত হইল। বাযুর বেগ ক্রমে মন্দীভূত হইলেও ডড লে আশ্বস্ত হইতে পারিলেন না। সমুদ্রের পর্ব্বত-প্রমাণ উচ্চ তরঙ্গের উপর সেই বোটখানি ক্ষুদ্র ঝিনুকের মত ভাসিতে লাগিল, তরঙ্গবেগে একবার তাহা বহু উর্দ্ধে উৎক্ষিপ্ত হয়, আবার বহু নিম্নে নিপতিত হয়,—যেন মুহূর্ত্তমধ্যে সেই ক্ষুদ্র তরীখানি তাহাদিগকে লইয়া রসাতল গর্ভে প্রবেশ করিবে।—ডড্‌লে বহুদর্শী সুদক্ষ নাবিক ছিলেন, তাই ক্ষুব্ধ-তরঙ্গসঙ্কুল ভয়াল সমুদ্রে অতি দক্ষতার সহিত তরণী পরিচালনে সমর্থ হইলেন। নৌচালনে অসামান্য দক্ষতা না থাকিলে বোটখানি রক্ষা পাইত না। কয়েকবার উচ্ছ্বসিত জলরাশি সেই বোটের উপর দিয়া চলিয়া গেল,জলের ঝাপ টায় ডড্‌লের পরিচ্ছদাদি সিক্ত হইল।

 প্রভাতে মিস্ এরস্‌কাইন ও পাচক ব্লেকের নিদ্রাভঙ্গ হইল। ছয়টার সময় তাঁহারা প্রাতর্ভোজন শেষ করিলেন। ডড্‌লে অনুমান করিলেন—এই এক রাত্রেই তাঁহারা অর্দ্ধপথ অতিক্রম করিয়াছেন। মিস্ এরস্‌কাইন দীর্ঘ নিদ্রার পর বেশ সুস্থ ও স্বচ্ছন্দ বোধ করিতে লাগিলেন, এই নিদারুণ কষ্ট ও অসুবিধায় তিনি বিন্দুমাত্র ক্ষোভ বা চাঞ্চল্য প্রকাশ করিলেন না। সকলের আহার শেষ হইলে, ডড্‌লে পাচককে তাঁহার নিকট আহ্বান করিলেন, এবং বলিলেন, “তুমি কিছুকাল হাল ধরিতে পারিবে কি? আমি ওদিকে গিয়া একটু বিশ্রাম করিব মনে করিতেছি। বোট যে ভাবে চলিতেছে—সেই ভাবেই চলিবে। ইহার গতি পরিবর্ত্তনের আবশ্যকতা নাই। তুমি বেশ সতর্কতার সহিত নৌকা চালাইবে, চারিদিকে দৃষ্টি রাখিবে।”

 মিস্ এরস্‌কাইন বলিলেন, “মিঃ ডড্‌লে, আপনি গলুইয়ের দিকে যাইবেন না, ওখানে শয়ন করিতে আপনার কষ্ট হইবে, আপনি বোটের খোলের ভিতর শয়ন করুন, আমি উঠিয়া বাহিরে যাইতেছি। আপনি আমার প্রস্তাবে আপত্তি করিবেন না, আমি কি আপনার ভারস্বরূপ হইয়াই থাকিব? কোনরূপে আপনার সাহায্য করিতে দিবেন না। এ বড় অন্যায়।”

 ডড্‌লে অগত্যা তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া বোটের খোলে মিস্ এরক্‌সাইনের শয্যায় শয়ন করিলেন, মিস্ এরক্‌সাইন বাহিরে আসিয়া বসিলেন। ডড্‌লে পাচককে বলিলেন, ‘আমি বোধ হয় শীঘ্রই ঘুমাইয়া পড়িব, ইতিমধ্যে যদি আকাশে মেঘ উঠে, কি বাযুর বেগ প্রবল হয়—অথবা দূরে কোনও জাহাজ দেখিতে পাও, তাহা হইলে আমাকে জাগাইবে।”

 ডড্‌লে শয়নমাত্র গাঢ় নিদ্রায় অভিভূত হইলেন। সমস্তরাত্রি জাগিয়া তিনি অত্যন্ত ক্লান্ত হইয়াছিলেন, কিন্তু তাঁর ব্যবহারে বা কথায় ক্লান্তির লক্ষণ প্রকাশ পায় নাই। তিনি দীর্ঘকাল নিদ্রাসুখ ভোগ করিতে পারিলেন না। পাচক বোটখানি চালাইতে-চালাইতে হঠাৎ ঝুঁকিয়া পড়িয়া ডড্‌লের স্কন্ধদেশে হস্তাপণ পূর্ব্বক ঝাঁকি দিল, ডড্‌লে তৎক্ষণাৎ উঠিয়া বসিলেন, বসিলেন বটে, কিন্তু তাঁহার চক্ষু মেলিয়া চাহিতে কষ্ট হইল। যাহা হউক, তিনি চক্ষু উন্মীলিত করিয়া একবার চতুর্দ্দিকে চাহিলেন, কিন্তু প্রকৃতির কোন ভাবান্তর বুঝিতে পারিলেন না, বোটখানি যে ভাবে চলিতেছিল, তাহারও কোন ব্যতিক্রম দেখিলেন না, তখন তিনি পাচককে তাঁহার নিদ্রাভঙ্গের কারণ জিজ্ঞাসা করিলে সে কিছু দূরে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিল। ডড্‌লে সেই দিকে চাহিয়া একখানি প্রকাণ্ড জাহাজ দেখিতে পাইলেন। জাহাজখানি এরূপ বৃহৎ যে, তাহা তিন চারি হাজার টন মাল অনায়াসে বহন করিতে পারিত। ডড্‌লে অনুমান করিলেন, তাঁহাদের বোট হইতে জাহাজখানির দূরত্ব একশত গজের অধিক নহে এমন কি, জাহাজের নামটিও স্পষ্ট পাঠ করিতে পারিলেন। —জাহাজখানির নাম, “ইউনাইটেড ইটালী।”

 ডড্‌লে ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “জাহাজখানি এই দিকেই আসিতেছে। যেরূপ বেগে আসিতেছে, তাহা দেখিয়া মনে হইতেছে আমরা সাবধান না হইলে উহা আমাদের বোটের উপর চাপিয়া পড়িবে, উহার ঢেউ লাগিয়াও আমাদের বোটখানি ডুবিতে পারে।”—তিনি শয্যা ত্যাগ করিয়া এক লম্ফে নৌকার হা‘লের নিকট আসিলেন, এবং পাচককে সরাইয়া দিয়া ক্ষিপ্রহন্তে হা’ল গ্রহণ করিলেন।

 দেখিতে দেখিতে জাহাজখানি বোটের পাশ দিয়া চলিয়া গেল, কয়েক মুহূর্ত্ত মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ গজ তফাতে গিয়া পড়িল। বোটখানি তাহার তরঙ্গ-তাড়নে নাগরদোলাব মত দুলিতে লাগিল। নৌকা ডোবে আর কি।—ডড্‌লে কষ্টে ধাক্কা সামলাইয়া লইয়া জাহাজখানির দিকে চাহিলেন, এবং বলিলেন, “জাহাজের লোকেরা আমাদিগকে দেখিতে পাইয়াছে, এখনই জাহাজ থামাইয়া আমাদিগকে তুলিয়া লইবে।—পরমেশ্বর বুঝি আমাদের এত কষ্টের পর মুখ তুলিয়া চাহিয়াছেন।”

 কিন্তু তাঁহার আশা পূর্ণ হইল না, দেখিতে-দেখিতে জাহাজখানি আরও দূরে চলিয়া গেল। জাহাজের লোকেরা হয় তাঁহাদের বোটখানি দেখিতে পায় নাই, না হয় তাঁহাদের জীবনরক্ষা করা আবশ্যক মনে করে নাই। মিনিটের মধ্যেই জাহাজ অদৃশ্য হইল। তাঁহাদের হৃদয়ে যে ক্ষীণ আশা-দীপ প্রজ্জ্বলিত হইয়াছিল, সঙ্গে-সঙ্গে তাহা নির্ব্বাপিত হইল। ডড্‌লে ক্ষুব্ধভাবে বলিলেন, “জাহাজের লোকগুলা আমাদের বিপদ বুঝিতে পারে নাই। কিন্তু আমাদের নিরাশ হইলে চলিবে না। পরমেশ্বর আমাদিগকে ত্যাগ করেন নাই, এ বিশ্বাস রাখিতেই হইবে। ভয় কি?—দুশ্চিন্তারও কোন কারণ নাই, আমার বোধ হয় তীরভূমি এখান হইতে ত্রিশ মাইলের অধিক নহে।”

 একথা শুনিয়া মিস্ এরস্‌কাইন বা ব্লেকের মুখ হইতে কোনও কথা বাহির হইল না। সুশীতল জলপূর্ণ গ্লাসটি মুখের কাছে আনিবামাত্র তাহা হাত হইতে খসিয়া-পড়িয়া শতধা বিদীর্ণ হইলে তৃষ্ণার্ত্ত পথিকের মনের ভাব যেরূপ হয়, তাঁহাদের মনের অবস্থাও তথন সেইরূপ শোচনীয়।—বোটখানি উঠিয়া পড়িয়া হেলিয়া-দুলিয়া গন্তব্য পথে অগ্রসর হইল। পশ্চিক দিকই কর্ণধার ডড্‌লের লক্ষ্য, তিনি সেই দিক লক্ষ্য করিয়াই বোট পরিচালিত করিতে লাগিলেন।

 ক্রমে মধ্যাহ্নকাল উপস্থিত।—মধ্যাহ্নে বাযুর বেগ পুনর্ব্বার প্রবল হইল। ডড্‌লে আশা করিলেন, ঝটিকারম্ভের পূর্ব্বেই তাঁহারা লামু বা তৎসন্নিহিত কোন দ্বীপে উপস্থিত হইতে পারিবেন।একবার সেখানে পদার্পণ করিতে পারিলে ‘ডিউসি-অস্-আফ্রিকা লাইনের জাহাজে মোসাম্বায় এবং তথা হইতে জাঞ্জিবারে গমন করা বিশেষ কঠিন হইবে না। কোম্পানীর জাহাজ পাইতে বিলম্ব হইলেও আশ্রয় লাভের ব্যাঘাত হইবে না।

 মিঃ ডড্‌লে এই সকল কথার আলোচনা করিয়া অপেক্ষাকৃত আশ্বস্ত হইলেন, এবং পাচককে মধ্যহ্নভোজনের আয়োজন করিতে বলিলেন। অল্পক্ষণ পরেই সকলে ভোজনে বসিলেন। মিস্ এরস্‌কাইন পূর্ব্বাপেক্ষা অধিক আহার করিতে পারিলেন দেখিয়া ডড্‌লের বড়ই আনন্দ হইল। এই অল্প সময়ের মধ্যেই মিস এরস্‌কাইনের গণ্ডে স্বাস্থ্যের লক্ষণ দেখিতে পাওয়া গেল। বিষে তাঁহার দেহ জর্জ্জরিত হইতেছিল—তাহার প্রভাব অতিক্রম করিয়া তিনি যেন নূতন মানুষ হইলেন -আহারান্তে ডড্‌লে মিস্ এরস্‌কাইনকে পুনর্ব্বার শয়ন করিতে অনুরোধ করিলেন। মিস্ এরস্‌কাইন বলিলেন, “তাহাতে আমার আপত্তি নাই, কিন্তু তটরেখা দেখিবামাত্র আপনি আমাকে বলিবেন ত। ডাঙ্গা দেখিতে না পাইলে আমার মন স্থির হইবে না।—দিবারাত্রি চারিদিকে কেবল জল! এ আর সহ্য হয় না।”

 ডড্‌লে বলিলেন, “তীর দেখা যাইলেই আপনাকে জানাইব, তবে কতক্ষণে এ আশা পূর্ণ হইবে—বলিতে পারি না। বোট কিছু ধীরে চলিতেছে।”

 তখন বাতাসের বেগ মন্দীভূত হইয়াছিল, বেলা তিন ঘটিকার সময় বাতাস পড়িয়া গেল। পালে আর বাতাস পাইল না। অপরাহ্ন পাঁচ ঘটিকার সময় ডড্‌লের বোধ হইল, বহুদূরে পশ্চিম সীমান্তে মেঘাচ্ছন্ন গিরিশৃঙ্গের ন্যায় অস্পষ্ট তটরেখা দৃষ্টিগোচর হইতেছে। ইহা দৃষ্টিবিভ্রম কি সত্য, তাহা তিনি প্রথমে বুঝিতে পারিলেন না, কিন্তু পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তাঁহার সন্দেহ দূর হইল। তিনি বুঝিলেন, উহা তটভূমিই বটে।—তিনি তৎক্ষণাৎ মিস্ এরস্‌কাইনকে এই আনন্দের সংবাদ জ্ঞাপন করিলেন।

 মিস্ এরস্‌কাইন ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “ঐস্থান এখান হইতে কতদূর?”

 ডড্‌লে বলিলেন, “অনুমান পাঁচমাইল।—না, নিশ্চয়ই তাহার অধিক কিন্তু উহা কোন স্থান তাহা জানিতে না পারিলে ত ওখান বোট ভিড়াইতে সাহস হইবে না। তবে উহা লামু না হইলেও তাহার সন্নিকটবর্ত্তী কোন স্থান হওয়াই সম্ভব।”

 ক্রমে বোটখানি সমুদ্রতটের নিকটে উপস্থিত হইল। কিন্তু তটভূমি অত্যন্ত দূরারোহ, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাহাড়ে পরিপূর্ণ। সমুদ্রতরঙ্গ গিরি-পাদমূলে ক্রমাগত প্রতিহত হইতেছিল।—তথাপি ডড্‌লে অতি সাবধানে নৌকা চালাইয়া তীরের দিকে অগ্রসর হইলেন। অপরাহ্নের লোহিতালোকে তিনি ভূখণ্ডটি সুস্পষ্ট দেখিতে পাইলেন। তিনি বুঝিলেন, দ্বীপটির নাম যাহাই হউক, উহা নিতান্ত ক্ষুদ্র নহে, তাঁহার অনুমান হইল, তাহা পনের বিশ মাইল দীর্ঘ, কিন্তু তিনি নিকটে বা দূরে গ্রামের কোন চিহ্ন দেখিতে পাইলেন না। প্রস্তর-কঙ্করপূর্ণ তটভূমি অরণ্যাবৃত, অরণ্যে তিন্তিড়ী জাতীয় অসংখ্য বৃক্ষ, এবং দূরে দূরে রাশি রাশি নারিকেল তরু উন্নত মস্তকে দণ্ডায়মান। মিঃ ডড্‌লে নানাদিক দিয়া ঘুরিয়া বালুচর ও তরঙ্গের ঘূর্ণাবর্ত্ত অতিক্রম করিয়া তীরে বোট ভিড়াইলেন, এবং উভয়ে নতজানু হইয়া পরমেশ্বরকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিলেন।