নাবিক-বধূ/দশম পরিচ্ছেদ
দশম পরিচ্ছেদ
চন্দ্রালোকিত রাত্রি। জাহাজের খালাসীরা তখনও স্ব-স্ব কর্ম্মে ব্যস্ত ছিল। মিঃ ডড্লে জাহাজের মাথার কাছে দাঁড়াইয়া উৎকণ্ঠিত চিত্তে একবার সমুদ্রের দিকে—একবার কার্য্যনিরত খালাসীদের দিকে চাহিতেছিলেন। তাঁহার মনে হইতেছিল—জাহাজের সকল লোকই তাঁহার শত্রু, সকলেই বেন তাঁহাকে সন্দেহের চক্ষে দেখিতেছে।—জাহাজধানি ফেনঃপুঞ্জ-মুকুটিত তরঙ্গাশি বিদীর্ণ করিয়া তাহার গন্তব্য পথে ছুটিয়া চলিয়াছে। একজন কর্ম্মচারী ‘ব্রিজের’ উপর পাহারায় নিযুক্ত আছে। সে একবার পাদচারণ করিতেছে, একবার দাঁড়াইতেছে, কখনও-বা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারিদিকে দেখিতেছে। —ইঞ্জিনের অশ্রান্ত ঘস্-ঘস্ শব্দ ভিন্ন কোন দিকে অন্য কোন শব্দ নাই।
ক্রমে রাত্রি এগারটা বাজিল।—মিঃ ডড্লে মনে করিলেন, আর বিলম্ব করা সঙ্গত নহে। এতক্ষণ তিনি ডেক পরিত্যাগ করিতে সাহস করেন নাই, কিন্তু আর ত নিশ্চেষ্ট ভাবে বসিয়া থাকা চলে না। এখনও সকল কাজই বাকি। তিনি ধীরে-ধীরে পাচকের কেবিনের দিকে চলিলেন। কেবিনের দ্বার খোলা ছিল, তিনি মস্তক প্রসারিত করিয়া দেখিলেন, পাচক তাহার শয্যায় বসিয়া কি পাঠ করিতেছে।—ডড্লে তৎক্ষণাৎ কক্ষ-মধ্যে প্রবেশ করিয়া সাবধানে দ্বার রুদ্ধ করিলেন।
পাচক পুস্তক বন্ধ করিয়া শয্যা হইতে নামিল, এবং একটি বাক্স খুলিয়া এক সুট্ পোষাক বাহির করিল। সে তাহা ডড্লেকে দেখিতে দিয়া তাঁহাকে বলিল, “আশা করি এই পোষাক আপনার অঙ্গে নিতান্ত বেখাপ্পা, দেখাইবে না। আমাদের দুই জনেরই শরীরের গঠন প্রায় এক রকম।”
ডড্লে বিনাবাক্যব্যয়ে পোষাকটি পরিধান করিলেন, তাহা তাঁহার গায়ে মন্দ মানাইল না। সেই পোষাকে তাঁহাকে আর আরবের মত দেখাইল না; তাঁহার চেহারা পর্য্যন্ত যেন বদলাইয়া গেল—তাহা দেখিয়া পাচক বলিল, “এখন আপনাকে ভদ্রলোকের মত দেখাইতেছে।”
ডড্লে বলিলেন, “পোষাক ত মিলিল, এখন কাপ্তেনের নামে যে চিঠিখানা লিখিতে হইবে, তাহার কি ব্যবস্থা করা যায়?”
পাচক তাঁহাকে দোয়াত কলম ও কাগজ বাহির করিয়া দিল।—ডড্লে পাচকের বাক্সের উপর বসিয়া তাড়াতাড়ি একখানি পত্র লিখিয়া ফেলিলেন। সেই পত্রে তিনি নিজের পরিচয় জানাইয়া কাপ্তেনের অজ্ঞাতসারে বোটখানি গ্রহণ করিবার কারণ লিখিলেন। তিনি সেই পত্রে একথাও লিখিলেন যে, নিরাপদ স্থানে উপস্থিত হইয়া কাপ্তেনের ক্ষতিপূরণ করিবেন।
তিনি পত্রখানি শেষ করিয়া উঠিবেন, এমন সময় কি মনে হওয়ায় পাচককে বলিলেন, “আরও একটা কায বাকি আছে।—হাতে যখন কাগজ কলম আছে, তখন ল্যাম্পিয়নকে দু’ছত্র লিখিতেই-বা দোষ কি? সে যে কত বড় শয়তান—তাহা তাহাকে জানাইয়া দেওয়া মন্দ নহে। হতভাগাটা ভয়ে ও দুশ্চিন্তায় আহার নিদ্রা ত্যাগ করুক ইহাই আমার ইচ্ছ।”
তিনি ডাক্তার ল্যাম্পিনকেও একখানি পত্র লিখিলেন, পত্রখানি লেফাপায় বন্ধ করিয়া তাহার উপর ল্যাম্পিয়নের নাম লিখিলেন। ইতিমধ্যে পাচকটি সিন্দুকের তলা হইতে একটা পুঁটুলি বাহির করিয়া তাঁহাকে বলিল, “আপনি নিরাপদে তীরে উঠিলে আপনার কাযে লাগিতে পারে এ রকম কিছু সংগ্রহ করিয়াছি।—আপনি ইহা পাইয়া নিশ্চয়ই সুখী হইবেন।”
মিঃ ডড্লে পুঁটুলিটি খুলিয়া দেখিলেন, কল টের একটি উৎকৃষ্ট রিভলভার ও কতকগুলি টোটা।—তাহা দেখিয়া আনন্দে উৎসাহে তাঁহার চক্ষু উজ্জল হইয়া উঠিল।
পাচক বলিল, “এগুলি আপনার কাযে লাগিবে —অথচ ইহা রাখিয়া আমার কোন লাভ নাই, উল্টা ফ্যাসাদ ঘটতে পারে। এগুলি লইয়া যান।
ডড্লে বলিলে, “ধন্যবাদ, শত-সহস্র ধন্যবাদ। তুমি যে আমার কি উপকার করিলে, তা’বলিবার শক্তি নাই। এরূপ মহামূল্য সামগ্রী আমি এ সময় কোথায় পাইতাম? আমার সঙ্গে যে পিস্তল ছিল, আমেদ বেন্ তাহা কাড়িয়া লইয়াছে। তোমার নিকট চিরকৃতজ্ঞ রহিলাম। আমার ব্যাঙ্কারকে চিঠি লিখিয়া দিই, তোমার লণ্ডনের ঠিকানাটা আমাকে বল।”
পাচক মিঃ ডড্লেকে আর একখানি কাগজ দিল। ডড লে পত্র লিখিয়া তাঁহার লণ্ডনস্থ ব্যাঙ্কারকে জ্ঞাপন করিলেন, এই পত্রবাহককে তাঁহার গচ্ছিত অর্থ হইতে যেন হাজার পাউণ্ড প্রদান করা হয়। তিনি পত্রখানি লেফাপায় মুড়িয়া পাচকের হস্তে প্রদান করিলেন।
এই অল্পবেতনভোগী পাচক হাজার পাউণ্ড—পনের হাজার টাকা জীবনে কখন একত্র দেখে নাই, সমস্ত জীবন চাকরী করিয়া তাহার এত টাকা সঞ্চয় করিবার আশা ছিল না। পত্রখানি পাঠ করিয়া আনন্দে, উৎসাহে, কৃতজ্ঞতায় তাহার হৃদয় পূর্ণ হইল, সে বলিল, “ধন্যবাদ মহাশয়। আমি জীবনে কখন এতগুলি টাকা একত্র দেখি নাই। না, ইহার সিকি টাকাও নহে। পরমেশ্বয়ের নিকট প্রার্থনা করি আপনারা নির্বিঘ্নে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় লাভ করুন। আমার এই কার্ডখানি রাখুন, ইহাতেই আমার লণ্ডনের ঠিকানা লেখা আছে। আপনারা নিরাপদে আশ্রয় পাইয়াছেন কি না দয়া করিয়া আমাকে জানাইবেন। আপনার সংবাদ না পাইলে আমার দুশ্চিন্তা দূর হইবে না।”
ডড্লে বলিলেন, “সে খবর তুমি নিশ্চয়ই পাইবে। চল, এখন বোটখানির সন্ধানে যাই।—কেহ আমাদিগকে দেখিতে না পাইলেই বাঁচি।—রাত্রিও অনেক হইয়াছে। এখন সময় কত?”
পাচক ঘড়ি খুলিয়া বলিল, “বারটা বাজিতে বিলম্ব নাই।”
ডড্লে বলিলেন, “পাহারা বদল না-হওয়া পর্য্যন্ত আমাদিগকে অপেক্ষা করিতে হইবে।—সকলে ঘুমাইলে আমরা নিঃশব্দে কায আরম্ভ করিব।”
কথা শেষ হইতে-না-হইতে জাহাজের ঘণ্টায় ঢং ঢং করিয়া বারটা বাজিয়া গেল। প্রায় পাঁচ মিনিট পরে জাহাজের প্রধান কর্ম্মচারী ও মেট্ শয়ন করিতে চলিল। তাহারা স্ব-স্ব কামরায় প্রবেশ করিয়া দ্বার রুদ্ধ করিলে ডড্লে পাচকের সঙ্গে তাহার কেবিন হইতে বাহির হইলেন। একজনের হাতে পানীয় জলের কলসী, পিস্তল টোটার পুঁটুলি, অন্যের হস্তে খাদ্যসামগ্রীর ঝোড়া।—উভয়ে অত্যন্ত সতর্ক ভাবে এ বোটের নিকট আসিলে ডড লে বোটের ক্যাম্বিসনির্ম্মিত আববণ খুলিয়া লাগিলেন, তাহার পর বোটের ভিতর খাদ্য-সামগ্রীপূর্ণ ঝোড়াটা সংরক্ষিত হইল। মিঃ ডড্লে দেখিলেন, বোটের মাস্তুল, পাল, দাঁড় প্রভৃতি সমস্তই বোটের ভিতর আছে। তিনি বোটখানি সমুদ্রে নামাইবার পূর্ব্বে একবার দূর আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন। নৌ-পরিচালন বিদ্যায় তিনি অভিজ্ঞ ছিলেন, মেঘ বা বাতাসের কিরূপ পরিবর্ত্তনের কি ফল—তাহাও তিনি জানিতেন। আকাশের অবস্থা দেখিয়া তাহার ধারণা হইয়াছিল, বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই একখানি কালো মেঘ পূর্ণ প্রায় শশধবকে ঢাকিয়া ফেলিল, সঙ্গে-সঙ্গে পরিস্ফুট জ্যোৎস্নালোক অন্তর্হিত হইল। হঠাৎ মেঘান্ধকার দেখিয়া ডড লে আনন্দিত হইলেন। ইহা তিনি দৈবানুগ্রহ বলিয়াই মনে করিলেন বটে, কিন্তু আফ্রিকার পূর্ব্ব-উপকূলে শান্ত স্থির প্রকৃতি কত অল্প সময়ে সহসা মেঘাচ্ছন্ন হইয়া ঝটিকাবর্ত্তে সংক্ষুব্ধ হইয়া উঠে, তাহা তাঁহার অজ্ঞাত ছিল না। হঠাৎ ঝটিকা আরম্ভ হইলে অকূল সমুদ্রে ক্ষুদ্র বোটে জীবন রক্ষা করা কঠিন হইবে বুঝিয়া তাঁহার সে আনন্দ স্থায়ী হইল না, কিন্তু আত্মরক্ষার অন্য কোন উপায়ও যে নাই।—“আত্মরক্ষার চেষ্টায়,বিপন্না নারীর উদ্ধারের চেষ্টায় মরিতে হয় ত মরিব”—এই সঙ্কল্প করিয়া তিনি বোটখানি নামাইবার ব্যবস্থা করিলেন, তাহার পর মিস্ এরস কাইনের সন্ধানে চলিলেন।—তাঁহার পত্রখানি মিস্ এরস্কাইনের হস্তগত হহয়াছে কি না তাহা বুঝিবার উপায় ছিল না। যদি তাহা কোনরূপে ল্যাম্পিয়নের হস্তগত হইয়া থাকে তাহা হইলে আর কোন আশা নাই, কিন্তু পত্রখানি পাইলে ল্যাম্পিয়ন কি এতক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া থাকিত?—তাঁহার কায কি এতদূর অগ্রসর হইত?
ডড্লে সেলুনের সন্নিকটে আসিয়া নিম্নস্বরে পাচককে বলিলেন, “তুমি সিঁড়ির পাশে দাঁড়াইয়া থাক, মিস্ এরস্কাইন আসিলে জিনিসপত্র সহ তাঁহাকে নামাইয়া লইবে।—তাহার পর উভয়ে ধরাধরি করিয়া তাঁহাকে বোটে তুলিয়া দিব।”
ডড্লে মিস্ এরস্কাইনের কেবিনের দিকে অগ্রসর হইয়া তাঁহার আগমনের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন, কিন্তু তিনি আসিলেন না। এই ভাবে পাঁচ সাত মিনিট চলিয়া গেল। তখন ডড্লে অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত ভাবে বলিলেন, “তাঁহার এত বিলম্ব হইতেছে কেন? ব্যাপার কি। তবে কি আমার সকল চেষ্টা বিফল হইল? আমাকে এখানে হঠাৎ কেহ দেখিতে পাইলেই ত সর্ব্বনাশ।”
ক্রমে তাঁহার উৎকণ্ঠা অসহ্য হইয়া উঠিল।—আরও কয়েক মিনিট পরে মিস্ এরস্কাইনের কেবিনের দ্বার খুলিয়া কে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে তাঁর দিকে অগ্রসর হইল।
ডড্লে তাঁহাকে দেখিয়া রুদ্ধশ্বাসে বলিয়া উঠিলেন, “পরমেশ্বর, ধন্য তুমি। ঐ বুঝি মিস্ এরস কাইন আসিতেছেন।”—ডড্লে তাড়াতাডি কয়েক পদ অগ্রসর হইয়া মিস্ এরস কাইনকে লইতে আসিলেন।
আগন্তুক দ্রুতপদে তাঁহার দিকে আসিতে আসিতে ঠিক সেই মুহূর্ত্তে অন্ধকারে হুম্ড়ি খাইয়া পডিল, ও অস্ফুট স্বরে আর্তনাদ করিয়া উঠিল।
ডড্লে সেই স্বর শুনিয়া ভীত ভাবে বলিয়া উঠিলেন, “কি সর্ব্বনাশ, এ যে দেখিতেছি ডাক্তার ল্যাম্পিয়ন। তবে ত হতভাগাটা সবই টের পাইয়াছে। -আর বুঝি রক্ষা নাই।”
ডড্লের ইচ্ছা হইল তখনই দৌড়াইয়া গিয়া ল্যাম্পিয়নকে আক্রমণ পূর্ব্বক তাহার কণ্ঠরোধ করেন, কিন্তু তিনি এই ইচ্ছা কার্য্যে পরিণত করিবার পূর্ব্বেই পাচক আসিয়া তাঁহাকে ধরিয়া ফেলিল, এবং স্থির ভাবে দাঁড়াইয়া থাকিতে ইঙ্গিত করিল। অগত্যা তিনি রুদ্ধ নিশ্বাসে পাচকের পাশে দাঁড়াইয়া রহিলেন, অল্পক্ষণ পরে দেখিলেন, ল্যাম্পিয়ন বহু কষ্টে উঠিয়া টলিতে-টলিতে ও পড়িতে-পডিতে তাহার কেবিনে প্রবেশ করিল।—সে-যে রাত্রি বারটা পর্য্যন্ত মিস্ এরস কাইনের শয়নকক্ষে বসিয়াছিল, ডড লে তাহা জানিতেন না। তিনি অস্ফুটস্বরে পাচককে বলিলেন, “লোকটা তয়ানক মাতাল হইয়াছে—এখন আমরা কি করি?পাচক বলিল, “আরও মিনিট কয়েক এইখানেই দাঁড়াইয়া থাকি, দেখি ব্যাপারটা কতদূর গড়ায়।— আমার বোধ হয় উহার ভয়েই মিস্ বাহিরে আসিতে বিলম্ব করিতেছিলেন।”
ক্রমে দশ মিনিট চলিয়া গেল। কোনও দিকে কোন শব্দ নাই, মিস্ এরস্সকাইনেরও দেখা নাই। ডড্লে ছটফট করিতে লাগিলেন। তিনি ক্ষিপ্ত প্রায় হইলেন। এমন সময় একটি রমণীমূর্ত্তিকে ধীরে-ধীরে সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হইতে দেখা গেল। দূরস্থ মৃদু আলোকে ডড্লে চিনিতে পারিলেন, তিনি মিস্ এরস্কাইন।
ডড্লে ব্যগ্রভাবে অগ্রসর হইয়া মিস এরস্কাইনকে বলিলেন, আপনি আসিয়াছেন? আঃ, বাঁচিলাম।”— তিনি মিসের গাত্র-বস্ত্রখানি চাহিয়া লইয়া নিজের কাঁধে ফেলিলেন।
মিস এরস্কাইন কোনও কথা না বলিয়া সিঁড়ি দিয়া তাঁহাদের সহিত উপরের ডেকে উঠিলেন।—তাহার পর ডড্লের ইঙ্গিতে ডেকের প্রান্তস্থিত ‘রেলিং’এর উপরে উঠিয়া রেলিংএর পার্শ্বে দোদুল্যমান বোটে আরোহন করিলেন।—তাঁহার রুগ্ন দেহে এত বল আছে, ডড্লে ইহা মনে করিতে পারেন নাই।
ডড্লে উৎফুল্ল চিত্তে বলিলেন, “এইবার আমরা বোটখানি জলে নামাইয়া দিব। আপনি ‘বাতা’ ধরিয়া বসিয়া থাকুন, ভয় পাইবেন না। বোট জলে নামিলেই আমি আপনার নিকট উপস্থিত হইব।”
অনন্তর ডড্লে পাচকের সাহায্য বোটখানি ধীরে-ধীরে সমুদ্রে নামাইয়া দিলেন, কাছির শর্-শর্ শব্দ শুনিয়া ডড্লে বড়ই ভীত হইলেন। তাঁহার আশঙ্কা হইল, এই শব্দে জাহাজের সমস্ত লোক জাগিয়া উঠিয়া তাঁহাদের কায দেখিয়া ফেলিবে। যাহা হউক, দুই মিনিটের মধ্যেই তাঁহারা বোটখানি জলে ভাসাইয়া দিয়া অপেক্ষাকৃত নিশ্চিন্ত হইলেন।
পাচক বলিল, “আর কোন ভয় নাই, এখন দুই মিনিটের মধ্যেই আপনি বোটে গিয়া দাখিল হইতে পারিবেন।”
ডড্লে ডেকে রেলিংএ উঠিয়া দড়ি ধরিয়া বুলিয়া পড়িবেন, ঠিক সেই মুহূর্ত্তে পাচক ব্লেক সভয়ে অস্ফুট আর্ত্তনাদ করিয়া উঠিল।—তাহা শুনিয়া ডড্লে ঘুরিয়া-দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ব্যাপার কি?—কি হইয়াছে?”
কিন্তু পাচক কোন কথা বলিবার পূর্ব্বেই একটি মনুষ্যমুর্তি তীরবেগে, তাঁহার দিকে দৌড়াইয়া আসিল।—সে নিকটে আসিবামাত্র তিনি চিনিলেন, সে খালাসী টম্কিন্স।
টম্কিন্সকে দেখিয়া ডড্লে মুহূর্ত্তের জন্য কিংকর্তব্যবিমুঢ় হইলেন; তাঁহার মনে হইল, তিনি আর ইতস্ততঃ না করিয়া সেই মুহূর্ত্তেই বোটে নামিয়া বোটখানি সমুদ্রে ভাসাইয়া দিবেন। কিন্তু তাহাতে কোন লাভ নাই তাহাও তিনি বুঝিলেন, জাহাজের সকল লোক মুহূর্ত্তে তাঁহাদের পলায়নের কথা জানিতে পারিবে,তখন ধরা পড়িতে বিলম্ব হইবে না। ডড্লে তৎক্ষণাৎ ডেকে নামিয়া টম্কিন্সের সম্মুখীন হইলেন।
টম্কিন্স তাঁহাকে দেখিয়া দাঁত বাহির করিয়া শ্লেষভরে বলিল, “কি খবর? পলাইবার চেষ্টা হইতেছে! তুমি আরব হও আর যাহাই হও, আমার চোখে ধূলি দিয়া পলাইতে পারিবে না।”
টম্কিন্স চীৎকার করিয়া লোক ডাকিবার উপক্রম করিতেই ডড্লে তাহার কণ্ঠদেশ বামহস্তে দৃঢ়রূপে চাপিয়া ধরিয়া দক্ষিণ হস্তে তাহার মস্তকে এমন জোরে মুষ্ট্যাঘাত করিলেন যে, টম্কিন্সের মগজ পর্যন্ত নড়িয়া গেল।—সে আর চীৎকার করিবার অবকাশ পাইল না। সেই অবসরে তিনি তাহাকে ডেকের উপর চিৎ করিয়া ফেলিয়া পাচক ব্লেককে বলিলেন, “শীঘ্র একগাছি দড়ি দাও, উহার হাত পা বাঁধিয়া ফেলি, হঠাৎ উঠিতে না পারে। উহার চেতনা-সঞ্চার হইলেই চীৎকার করিবে,একখানা রুমাল দাও, উহার মুখে দিয়া চীৎকারের পথ বন্ধ করি।”
ব্লেক দড়ি ও রুমাল বাহির করিয়া দিল। ডড্লে টম্কিন্সেরে হাত-পা বাঁধিয়া ও তাহার মুখে রুমাল গুঁজিয়া তাহাকে ফেলিয়া রাখিয়া বলিলেন, “ব্লেক, আর দেখ কি? তুমিও আমাদের সঙ্গে চল। এই খালাসীটা চেতনালাভ করিলেই আমার সহিত তোমার ষড়যন্ত্রের কথা কাপ্তেনের নিকট প্রকাশ করিবে, তখন তোমার প্রাণরক্ষার বিন্দুমাত্র আশা থাকিবে না।—আমাদের সঙ্গে যাইবে?
পাচক ভগ্নস্বরে বলিল,“জাহাজে থাকিলে সত্যই আমার নিস্তার নাই, কোথায় যাইব?'
ডড্লে বলিলেন,“তুমি দুঃসময়ে আমাদের যথাসাধ্য সাহায্য করিয়াছ, তুমিই আমার জীবন রক্ষা করিয়াছ। আমি তোমার নিকট অঙ্গীকার করিতেছি, যদি তুমি আমার সহিত যাও, তাহা হইলে চিরজীবন তোমার ভরণপোষণের ভার গ্রহণ করিব। তোমাকে কখন কষ্ট পাইতে হইবে না।—কেমন যাইবে?
পাচক বলিল, “চলুন, আপনাদের সঙ্গেই যাই। এ জাহাজে আর আমার স্থান নাই, ইহা অপেক্ষা হাঙ্গর-কুম্ভীরপূর্ণ মহাসমুদ্র অনেক অধিক নিরাপদ।”
ডড্লে বলিলেন, “তবে নামিয়া পড়।”—পাচক ব্লেক তৎক্ষণাৎ দড়ি ধরিয়া জাহাজের পাশ দিয়া বোটে নামিয়া পড়িল, ডড্লে তাহার অনুসরণ করিলেন। উভয়ে বোটে নামিয়া বোটের বন্ধন মোচন করিলেন।—বন্ধনমুক্ত বোটখানি জাহাজের পাশে সমুদ্র-তরঙ্গে দুলিতে লাগিল।