নাবিক-বধূ/নবম পরিচ্ছেদ
নবম পরিচ্ছেদ
সেইদিন সায়ংকালে ডড্লে ডেকের রেলিংএর উপর ভর দিয়া সম্মুখে ঝুঁকিয়া পড়িয়া সমুদ্রের দিকে চাহিতেছিলেন। এমন সময় পূর্ব্বোক্ত পাচকটি তাঁহার পাশে আসিয়া দাঁড়াইল, এবং তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, “কি চমৎকার সন্ধ্য।”
ডড্লে বলিলেন, “হাঁ, অতি চমৎকার সন্ধ্যা। পশ্চিম-আকাশে মেঘের সোনালী রঙের সহিত পাটল বর্ণের কি সুন্দর সমাবেশ। কিন্তু কল্য আকাশের অবস্থা কিরূপ থাকিবে কে বলিতে পারে?”
হঠাৎ তাঁহার মনে হইল কথাটা বলিয়া ভাল করেন নাই।—বিশেষত কথাটা তিনি পরিষ্কার ইংরাজীতে বলিয়া ফেলিয়াছিলেন। কি মারাত্মক ভ্রম।—লোকটা তাঁহাকে সন্দেহ করিবে না ত?
তাঁহার কথা শুনিয়া পাচকটা বলিল, “বাঃ, তুমি ত খাসা ইংরাজী বলিতে পার হে। আরবের মুখে এরকম শুদ্ধ ইংরাজী আর কখনও শুনি নাই। তুমি আসল আরব না ছদ্মবেশী, ঠিক ঠাহর করিতে পারিতেছি না, কে তুমি?”
মিঃ ডড্লে বুঝিলেন, তিনি ধরা পড়িয়াছেন। পাচকের নিকট সত্য কথা গোপন করিয়া কোন লাভ নাই, বরং তাহাতে অনিষ্ট হওয়াই সম্ভব। লোকটি অসৎ লোক নহে, ইহা তিনি বুঝিয়াছিলেন, বিশেষতঃ, জাহাজের উপর তাঁহার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করিতে সে ভিন্ন আর কেহই ছিল না। এখন তাহার হস্তে আত্মসমর্পণ করা ভিন্ন তিনি অন্য কোনও উপায় দেখিলেন না, অগত্যা তিনি নিম্নস্বরে বলিলেন, “তুমি আমাকে চিনিয়া ফেলিয়াছ, সুতবং তোমার নিকট আত্মগোপন করিয়া কোন লাভ নাই, আমি তোমার হস্তে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করিলাম। তোমার ইচ্ছা হইলে জাহাজের কাপ্তেনের নিকট আমাকে ধরাইয়া দিয়া আমার সর্ব্বনাশ করিতে পার—আমার জীবন ও মৃত্যু এখন তোমারই হাতে।”
পাচক বলিল, “তুমি কি আমাকে এই রকম শয়তান মনে কর? আমি তোমার সর্ব্বনাশ করিব।—তোমাকে বিপদে ফেলিয়া আমার লাভ কি?”
ডড্লে বলিলেন, “এই জাহাজে যদি কেহ আমার বন্ধু থাকে—তবে সে তুমি।—আমি কিরূপ বিপন্ন, তাহা তোমার নিকট প্রকাশ করিলে আমার হিত ভিন্ন অহিত হইবে না তাহা জানি, কিন্তু সাহস করিয়া এতদিন সে কথা তোমাকে বলিতে পারি নাই। তোমার নিকট আমার কোনও কথা গোপন করিব না।”
পাচক বলিল, “বুঝিয়াছি, তুমি হঠাৎ ধরা পডিয়াছ বলিয়াই অগত্যা আমার কাছে তোমার গুপ্তকথা প্রকাশ করিতে উদ্যত হইয়াছ। তুমি আমাকে চেন না, আমিও তোমার পরিচয় জানি না, কিন্তু যেদিন আমি তোমাকে সেই জীর্ণ তরণী হইতে উদ্ধার করিয়াছি, সেইদিন হইতেই আমার সন্দেহ হইয়াছিল—তোমার জীবন কোন দুর্ভেদ্য রহস্যজালে সমাচ্ছন্ন। তবে আমার সন্দেহের কথা কাহাকেও বলি নাই। তোমার কোন অনিষ্ট হয়, ইহা আমার ইচ্ছা নহে। যদি তুমি আমাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিতে না পার, তাহা হইলে তোমার গুপ্তকথা প্রকাশ করিবার আবশ্যক নাই, তাহা শুনিবার জন্য আমারও আগ্রহ নাই। তুমি এ কথা মনে করিও না যে, আমি উইলিয়াম ব্লেক—গুপ্তকথা গোপন রাখিতে পারি না। তোমার গুপ্তকথা আমার নিকট প্রকাশ করিলে যদি তোমার বা আমার বিপদের আশঙ্কা থাকে, তাহা হইলে সে সকল কথা আমাকে না বলাই ভাল। দেশে আমার স্ত্রী ও তিনটি মেয়ে আছে, আমি ভিন্ন তাহাদেব প্রতিপালন করিবার কেহই নাই, সুতরাং আমি কোন রকম বিপদের সম্মুখীন হইতে ইচ্ছুক নহি। আমার সকল কথাই শুনিলে, এখন তুমি তোমার কর্ত্তব্য স্থির করিতে পার।”
ডড্লে অসঙ্কোচে বলিলেন, “আমি আমার কর্ত্তব্য স্থির করিয়াছি। আমি বুঝিয়াছি, তুমি আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাসের পাত্র। বিশেষতঃ, আমার যেরূপ সঙ্কটজনক অবস্থা, তাহাতে মনে হয় এ সময় আমার একজন বিশ্বাসী বন্ধুর বড় আবশ্যক। আমার যে কি বিপদ, তাহা তোমার অনুমান করিবারও শক্তি নাই। আমি আমার সকল কথাই তোমাকে বলিব, তুমি দয়া করিয়া শুনিলে বড়ই অনুগৃহীত হইব। তোমার সামর্থ্যে কুলাইলে, আশা করি তুমি আমাকে সাহায্য করিতে কুণ্ঠিত হইবে না। যাহা ভাল বুঝিবে—করিও।”
মিঃ ডড্লে পাচকের পাশে দাঁড়াইয়া সন্ধ্যার ধূসর ছায়া সমাচ্ছন্ন সমুদ্রের দিকে চাহিয়া, তাঁহার আত্মপরিচয় ও লোমাঞ্চকর অভিযান-কাহিনী পাচকের নিকট প্রকাশ করিলেন। মিস্ এরস্কাইনকে হত্যা করিবার জন্য তাহার মাতুল কাপ্তেনের সহিত কি ভয়ানক ষড়যন্ত্র করিয়াছে, তাহাও তাহার গোচর করিলেন।—তাঁহার কথা শুনিতে-শুনিতে পাচকের মুখ সন্ধ্যার আকাশের ন্যায় অন্ধকারাচ্ছন্ন হইয়া উঠিল। সকল কথা শুনিয়া সে বলিল, “তোমার কথা উপন্যাসের মত অদ্ভুত। এ সকল কথা সত্য হইলে এই জাহাজের কাপ্তেনের মত নরপ্রেত দুনিয়ায় আর আছে কি না সন্দেহ।—কিন্তু তোমার কথা যে সত্য, তাহার প্রমাণ কোথায়?
ডড্লে বলিলেন, “যাহা সত্য আমি তাহাই বলিয়াছি, কিন্তু তুমি ইহার অকাট্য প্রমাণ চাহিলে তা দেওয়া সহজ নহে।—তবে দাঁড়াও, হয় ত তোমাকে এখনই তাহার প্রমাণ দিতে পারি। আজ বৈকালে আমি ডেকের উপর কায করিতে-করিতে দেখিলাম, ল্যাম্পিয়ন তার ভাগিনেয়ীর জন্য এক পেয়ালা ব্রথ্ লইয়া আসিল। মিস্ এরস্কাইন তাহা পান না করায়-ল্যাম্পিয়ন ব্রথের পেয়ালাটা জানালায় রাখিয়াছিল। তাহা কি এখনও সেখানে আছে?”
পাচক বলিল, “ষ্টুয়ার্ড বোধ হয় এতক্ষণ তাহা লইয়া গিয়াছে, খাইয়া ফেলিয়াছে কি না কে জানে?—কিন্তু তোমার অভিযোেগ যে সত্য, ইহা এই ব্রথ্টুকু হইতে কিরূপে প্রতিপন্ন হইবে?”
ডড্লে বলিলেন, “সেই ব্রথ্টুকু সংগ্রহ করিয়া জাহাজের কোন বিড়ালকে খাইতে দিলেই তুমি বুঝীতে পারিবে আমার অভিযোগ সতা কি না। -তুমি সেটুকু লইয়া আসিতে পার?—হাতে-হাতে পরীক্ষা হইবে।”
পাচক কৌতুহলপূর্ণ চিত্তে সেই পেয়ালাটা আনিতে গেল, পনের মিনিটের মধ্যে আর সে ফিরিল না। সে শূন্য হস্তে ফিরিয়া আসিলে,ডড্লে দেখিলেন, তাহার মুখ বিবর্ণ হইয়াছে, তাহার চক্ষুতে উদ্বেগ ও আতঙ্কের চিহ্ন সুপরিস্ফুট।
পাচক ডড লের পাশে আসিয়া নিম্নম্বরে কহিল, “তোমার কথাই সত্য। উঃ, কি ভয়ঙ্কর শয়তানী! মিস্ এরস্কাইনের মত সুন্দরী সুশীল সরলা যুবতীকে যাহারা এইভাবে বিষ খাওয়াইয়া মারিবার চেষ্টা করে,—তাহারা মানুষ না পিশাচ?”
ডড্লে বলিলেন, “আমার কথা যে সত্য, ইহা তুমি কিরূপে জানিলে? তুমি ত সেই ব্রথের পেয়ালা আন নাই, ব্রথের গুণাগুণেরও পরীক্ষা হয় নাই।”
পাচক বলিল, “সে পরীক্ষা হইয়া গিয়াছে।—ভয়ঙ্কর ব্যাপার।”
ডড লে কৌতূহল দমন করতে না পারিয়া বলিলেন, “কি হইয়াছে শুনিতে পাই না?”
পাচক গম্ভীর মুখে বলিল, “খানিক আগে ষ্টুয়ার্ড জানালা হইতে সেই ব্রথের পেয়ালাটি তাহার কুঠুরীতে লইয়া যায়। লোকটা ভয়ঙ্কর পেটুক, কিছুতেই তাহার পেট ভরে না। এক পেয়ালা ব্রথ্ ফেলিয়া দিবে—এমন পাত্র সে নহে। সে কুঠুরীতে ঢুকিয়াই এক চুমুকে ব্রথ্টুকু নিঃশেষ করে। আধ ঘণ্টা যাইতে-না-যাইতে বেচারার পেটে জ্বালা আরম্ভ হইল। সে যন্ত্রণায় ছটফট, করিতে লাগিল, আমাকে দেখিবামাত্র কাঁদিয়া বলিল, “আর বুঝি বাঁচিলাম না। আমি যে ব্রথ্ খাইয়াছি তাহা বিষ-মিশান ছিল। হাঁ, নিশ্চয়ই তাহা বিষাক্ত, নতুবা আমার এত যন্ত্রণা হইবে কেন? আর দেশে যাইতে পারিলাম না। হায়, হায়, লোভে পডিয়া কি কুকর্ম্মই করিয়াছি।’—বেচারা প্রাণভয়ে অস্থির হইয়া ল্যাম্পিয়নের নিকট ছুটিয়া গেল, তাহাকে বলিল, ডাক্তার, আমি বুঝি মরিলাম। আমি ব্রথ্ খাইয়া বিষের জ্বালায় অস্থির হইয়াছি। দয়া করিয়া আমাকে একটা ঔষধ দাও, আমাকে বাঁচাও।”
ডড্লে ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “ডাক্তার ল্যাম্পিয়ন একথা শুনিয়া কি বলিল?”
পাচক বলিল, “ষ্টুয়ার্ডের কথা শুনিয়া ডাক্তারের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হইল। তাহার মুখ চূণ হইয়া গেল কিন্তু কয়েক মিনিট পরে প্রকৃতিস্থ হইয়া সে ষ্টুয়ার্ডকে বলিল, ‘কোন ভয় নাই, আমি ঔষধ দিতেছি, তাহা খাইলেই তুমি সুস্থ হইবে। তোমাকে এত ভালবাসি যে, তোমার অসুখের কথা শুনিয়া আমার মন অস্থির হইয়াছে।—যাহা হউক, তুমি বাপু এ কথা আর কাহারও নিকট প্রকাশ করিও না। খাদ্যদ্রব্য কোন কারণে বিষাক্ত হইয়াছে শুনিলে জাহাজের সকল লোকের মনে অত্যন্ত আতঙ্ক হইবে, তাহা প্রার্থনীয় নহে।”
ডড্লে বলিলেন, “কিন্তু ব্রথ্টা কিরূপে বিষাক্ত হইল, সে সম্বন্ধে ডাক্তার কোন কথা বলিয়াছে?”
পাচক বলিল, “হাঁ বলিয়াছে, শয়তানটা আমারই ঘাড়ে দোষ চাপাইয়াছে। বলিয়াছে, বাবুর্চ্চির দোষেই এ বিভ্রাট ঘটিয়াছে, সে বিষাক্ত টিন খুলিয়া ব্রথ্ প্রস্তুত করাতেই তোমার এই দশা। যদি তোমার মৃত্যু হয়—তাহা হইলে সেজন্য বাবুর্চ্চিই দায়ী।’—আপনার কাছে সকল কথা না শুনিলে ত মনে করিতাম আমিই এজন্য দায়ী।
ডড্লে বলিলেন, “মিস, এরস কাইনকে হত্যা করিবার জন্য যে ষড়যন্ত্র হইয়াছে তাহা তুমি জানিতে পারিয়াছ, একথা ত প্রকাশ কর নাই?
পাচক বলিল, “আমি কি পাগল যে, সে কথা লইয়া আন্দোলন করিব? আমি ত সকলই বুঝিতে পারিতেছি।—যাহা হউক, ল্যাম্পিয়ন যতই বড় লোক হউক, তাহাকে সায়েস্তা না করিয়া ছাডিতেছি না, বিষ দিয়া সে মানুষ মারিবার চেষ্টা করিতেছে। এতবড় শয়তানী?”
ডড্লে বলিলেন, “দেখ ব্লেক, ডাক্তার ল্যাম্পিয়ন ও জাহাজের কাপ্তেন মিস, এরস কাইনকে হত্যা করিবাব জন্য কি ভীষণ ষড়যন্ত্র করিয়াছে, তাহার ত অকাট্য প্রমাণ পাইলে?—আমার কথায় কি এখনও তোমার অবিশ্বাস আছে?
পাচক বলিল, “না মহাশয়, আর কিছুমাত্র অবিশ্বাস নাই। আপনার সকল কথাই যে সত্য, তাহা বুঝিতে পারিয়াছি। আপনার কথা প্রথমে অবিশ্বাস করিয়াছিলাম, সেজন্য আপনি কিছু মনে করিবেন না।”
ডড্লে বলিলেন, “আমি তোমার নিকট নিজের পরিচয় দিয়াছি। আমি ত বলিয়াছি আমি ইংলণ্ডেশ্বরীর নৌ-বহরের একজন কর্ম্মচারী। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রধান সেনাপতি এড মিরাল রেড ফর্ণের আদেশানুসারে আমি এখানে আসিয়াছি। আমি নৌ-বিভাগে চাকরী করিলেও আমার আর্থিক অবস্থা বেশ সচ্ছল। মিস্ এরস্কাইন কোনও লক্ষপতির একমাত্র কন্যা, পিতার বিপুল সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী।—এই সম্পত্তি আত্মসাৎ করিবার দুরভিসন্ধিতেই ডাক্তার ল্যাম্পিয়ন তাহার তাগিনেয়ীকে কৌশলে হত্যা করিবার ষড়যন্ত্র করিয়াছে, এবং কাপ্তেনটা কিছু টাকার লোভে তাহার সহায়তা করিতে সম্মত হইয়াছে। আমি জানিতে পারিয়াছি, মিস্ এরস্কাইনের মৃত্যুর পর, কাপ্তেন ডাক্তার ল্যাম্পিয়নের নিকট পঞ্চাশহাজার টাকা পাইবে।—অতঃপর আমি কি কবিব, তাহাই এখন শোন।—আগামী কল্য রাত্রেই আমি মিস্ এরস্কাইনকে সঙ্গে লইয়া অন্যের অলক্ষ্যে এই জাহাজ হইতে পলায়ন করিব, নতুবা তাঁর প্রাণরক্ষার কোনও আশা নাই। আমরা যাহাতে নির্বিঘ্নে জাহাজ ত্যাগ করিতে পারি, এ বিষয়ে যদি তুমি আমাকে সাহায্য কর, তাহা হইলে আমি লণ্ডনে আমার ব্যাঙ্কারের নামে তোমার হাতে একখানি পত্র দিব, তুমি সেই পত্র ব্যাঙ্কে দিলেই হাজার পাউণ্ড পাইবে। ইহাই তোমার পুরস্কার। এতদ্ভিন্ন মিস্ এরস্কাইনও কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ তোমাকে আর একহাজার পাউণ্ড পুরস্কার দিবেন, এবিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। এখন বল, তুমি আমাদের সাহায্য করিতে সম্মত আছ কি না।
পাচক মুহূর্ত্তকাল নিস্তব্ধ থাকিয়া বলিল, “আপনি যে পুরস্কারের কথা বলিলেন, তাহা আমার পরিশ্রমের তুলনায় প্রচুর,—এমন কি, আশাতীত, ইহা আমাকে স্বীকার করিতেই হইবে। কিন্তু আমি যে উহা অপেক্ষা অধিক পুরস্কার লোভে আপনার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিব না—পুরস্কারের চিঠিখানি হস্তগত করিয়া অবশেষে আপনার কথা ল্যাম্পিয়নের নিকট প্রকাশ করিব না, ইহা আপনি কিরূপে বুঝিবেন? আমি ত ধর্ম্মজ্ঞানহীন সামান্য পাচক, আমার অপেক্ষা সহস্র গুণ অধিক সম্ভ্রান্ত লোকেও এ রকম বিশ্বাসঘাতকতা সর্ব্বদাই করিয়া থাকে।”
মিঃ ডড্লে বলিলেন, “তা করে, কিন্তু দীন দরিদ্র অশিক্ষিত লোক এরূপ অনেক আছে, যাহারা সম্ভ্রান্তবংশীয় শয়তানের তুলনায় দেবতা। অশিক্ষিত দরিদ্র হইলেও তোমার হৃদয় মহত্বপূর্ণ, তুমি খাঁটি লোক। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি, তোমাদ্বারা আমি বিপন্ন হইব না, ইহা বুঝিয়াছি।”
পাচক বলিল, “আপনার কথা শুনিয়া সুখী হইলাম। আপনি আমার নিকট কিঞ্চিৎ উপকারের প্রত্যাশায় আমাকে বিপুল অর্থ পুরস্কার দিতে উদ্যত ইয়াছেন, কিন্তু আপনি স্থির জানিবেন, আপনি এই পুরস্কারের লোভ না দখাইলেও আমি সাধ্যানুসারে আপনার উপকার করিতাম। মিস্ এরস কাইন যে বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারিণী, সে সংবাদ পূর্ব্বেই পাইয়াছি। জাহাজের কাপ্তেন ও ডাক্তার ল্যাম্পিয়ন মিস্ এরস কাইনকে একেবারে নজরবন্দী করিয়া রাখিয়াছে, তাহাকে তাহাদের কবল হইতে উদ্ধার করা নিতান্ত সহজ হইবে না। যাহা হউক, আপনি তাহার উদ্ধারসাধনের কি উপায় স্থির করিয়াছেন বলুন, দেখি,কথাটা আমার মনে লাগে কি না।”
মিঃ ডড্লে বলিলেন, “কাল রাত্রে যেরূপেই হউক-আমাকে জাহাজের একখানি বোট সংগ্রহ করিতে হইবে। সেই বোটে যথেষ্ট খাদ্যদ্রব্য পানীয় প্রভৃতি লওয়া আবশ্যক, ইহা অপরিহার্য্য। আমরা সেই বোটে সমুদ্রকূলে যাইবার চেষ্টা করিব। এতদ্ভিন্ন, আমার এক সুট্ পোষাক সংগ্রহ করা ও আবশ্যক হইবে। কারণ, যদি আমি সৌভাগ্যক্রমে তীরে উঠিতে পারি, তাহা হইলে আমার এই বেশ দেখিয়া, আমার কথা সত্য বলিয়া কেহই বিশ্বাস করিবে না। তোমার শরীরের গঠন ও উচ্চতা আমারই মত, তুমি তোমার এক সুট্ পোষাক আমাকে দিতে পার না?”
পাচক বলিল, “এ আর কঠিন কথা কি? আপনি অনায়াসেই তাহা পাইতে পারেন। কিন্তু বোটখানা সংগ্রহ করাই কিছু কঠিন হইবে। বোট এই জাহাজের সম্পত্তি, তাহা জাহাজ হইতে নামাইয়া লইয়া যাওয়ার অর্থ, বোটখানি চুরী করা। কিন্তু আপনি যেরূপ বিপন্ন, যে অবস্থায় একখানি বোট সংগ্রহ করিতে বাধ্য হইতেছেন,—তাহাতে এ রকম চুরীর যে সমর্থন করা যায় না—ইহাও বলিতে পারি না। নারীহত্যায় বাধা দিতে হইলে বোট চুরী না করিয়া উপায় কি? কিন্তু এ কাযে আপনার সাহায্য করা আমার পক্ষে সঙ্গত হইবে না। আমি জাহাজের কর্ম্মচারী, জানিয়া-শুনিয়া জাহাজের জিনিস চুরীর সহায়তা করিতে পারিব না, টাকার লোভে বিশ্বাসঘাতকতা করিব না। —এ কাযটা আপনাকে নিজের চেষ্টায় করিতে হইবে।”
ডড্লে বলিলেন “কিন্তু কিছু খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় সংগ্রহের কি উপায় হইবে? যদি তুমি বোট-সংগ্রহে আমাকে সাহায্য না কব—তাহা হইলে খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহেই-বা কিরূপে সাহায্য কবিবে?”
পাচক বলিল, “তাহাতে কোন অসুবিধা হইবে না। মিস্ এরস্কাইন ত জাহাজে তাঁহার খোরাকীর টাকা জমা দিয়াছেন,—নিশ্চয়ই দিয়াছেন। সুতরাং তিনি গন্তব্য স্থানে যতদিন না পঁহুছিবেন, ততদিন জাহাজের খাদ্যসামগ্রীতে তাহার ন্যায়তঃ দাবী আছে। এ অবস্থায় তাঁহার থোক তাঁহার সঙ্গে দিতে আপত্তি কি?
ডড্লে বলিলেন, “তুমি সঙ্গত কথাই বলিয়াছ। তাহা হইলে খাদ্য-সামগ্রী ও পানীয় সম্বন্ধে আমি নিশ্চিন্ত থাকিতে পারি।—বোটখানি সম্বন্ধে কি করিব শোন। আমি আত্মপরিচয় দিয়া কাপ্তেনের নামে তোমাকে একথানি পত্র দিব, সেই পত্রখানি তুমি এমন কোন স্থানে রাখিয়া দিবে—যেন কাপ্তেন সহজে তাহা দেখিতে পায়। আমি সেই পত্রে লিখিব—আমি বিশেষ প্রয়োজনে বোটখানি ভাড়া লইলাম, ইংলণ্ডেশ্বরীর যুদ্ধ জাহাজ ‘করিওলেনসে’র লেফটেনাণ্ট ডড লের নিকট দাবী করিলেই ভাড়ার টাকা তাহার হস্তগত হইবে। ভাড়ার পরিমাণ যাহাই হউক, তাহাতে আপত্তি হইবে না।”
পাচক বলিল, “হাঁ, এ রকম করিলে চলিতে পারে।—এরূপ করিলে বোট চুরী করা হইবে না, আমিও আপনাকে সাহায্য করিতে পারি। সকল কথা ত স্থির হইল, আমাকে আর কি করিতে হইবে?
ডড্লে বলিলেন, “বোটখানি জলে নামাইবার সময় তোমার সাহায্য চাই। তাহার পর তোমাকে আর কিছু করিতে হইবে না।”
পাচক বলিল, “সে সাহায্য আমার নিকট পাইবেন, আশা করি আপনি মিস্ এরস্কাইনকে সঙ্গে লইয়া নিরাপদে কূলে উঠিতে পারিবেন। কাপ্তেন ও ডাক্তারটার শয়তানীর কথা মনে হইতেছে, আর রাগে আমার সর্ব্বাঙ্গ জ্বলিয়া যাইতেছে।”
কথাবার্ত্তা শেষ হইলে পাচক স্বস্থানে প্রস্থান করিল। মিঃ ডড লে মনে বলিলেন, “এই লোকটাকে সকল কথা বলিয়া ভালই করিলাম। সে ইচ্ছা করিলে আমাদের সর্ব্বনাশ করিতে পারিত, কিন্তু খাঁটি লোক, সে আমাদের কোন অনিষ্ট করিবে না। যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়া ত দেখি, রক্ষা পাওয়া না পাওয়া পরমেশ্বরের এক্তিয়ার।”
মিঃ ডড্লে রাত্রে শয়ন করিয়া তাঁহার সঙ্কল্পের কথা চিন্তা করিতে লাগিলেন। দুইটি কায কিছু কঠিন বলিয়া মনে হইল, প্রথম, বোটখানি অন্যের অলক্ষ্যে সমুদ্রে নামাইয়া দেওয়া, দ্বিতীয়, মিস্ এরস কাইনকে অন্যের অজ্ঞাতসার তাঁহার কেবিন হইতে বাহির করিয়া আনিয়া সেই বোটে স্থাপন করা। এতদ্ভিন্ন, তিনি কোন্ সময় জাহাজ ত্যাগ করিবেন, তাহাও মিস্ এরস্কাইনকে জানাইতে হইবে।—বিভিন্ন চিন্তায় তাঁহার ক্ষুব্ধ হৃদয় এরূপ আলোড়িত হইতে লাগিল যে, তাঁহার নিদ্রাকর্ষণ হইল না। তিনি মুদিত নেত্রে নিদ্রাদেবীর উপাসনা করিতেছেন, এমন সময় হঠাৎ তাঁহার পিঠে কাহার হাত ঠেকিল। তিনি সবিস্ময়ে চাহিয়া মৃদু আলোকে দেখিলেন, পাচক ব্লেক তাঁহার মাথার কাছে দাঁড়াইয়া আছে। প্রথমে তাঁহার মনে একটু ভয় হইল, লোকটা এত রাত্রে কি উদ্দেশ্যে তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছে? তিনি তৎক্ষণাৎ উঠিয়া বসিলেন, কিন্তু কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবার পূর্ব্বেই পাচক বলিল, “আপনি ইচ্ছা করিলে আমার কুঠুরীতে গিয়া শুইতে পারেন, আপনি খুব সকালে উঠিয়া আসিলে এ কথা কেহই জানিতে পারিবে না।”
মিঃ ডড্লে এ প্রস্তাবে সম্মত হইলেন না। তিনি তাহাকে জানাইলেন, ইহাতে কোন লাভ নাই, অথচ জাহাজের কোন লোক তাঁহাদের ঘনিষ্ঠতার পরিচয় পাইলে বিপদের যথেষ্ট সম্ভাবনা।
পাচক বলিল, “আপনি সঙ্গত কথাই বলিয়াছেন, আমি অতখানি ভাবিয়া দেখি নাই।”
ডড্লে বলিলেন, “তোমার সহৃদয়তার জন্য ধন্যবাদ।—আর এক কথা,ষ্টুয়ার্ডটা কেমন আছে?”
পাচক বলিল, “তাহার অবস্থা অনেকটা আশাপ্রদ। আমি কয়েক মিনিট পূর্ব্বে তাহাকে দেখিতে গিয়াছিলাম। শুনিলাম, ডাক্তার ল্যাম্পিয়ন তাহার পেট ধুইয়া দিয়াছে। একজনকে মারিতে গিয়া শয়তানটা আর একজনকে মারিয়া ফেলিয়াছিল আর কি।”
ডড্লে বলিলেন, “লোকটার পরমায়ুর জোর আছে-তাই বাঁচিয়া গেল বোধ হয়। তবে সেই মৃদু বিষে বেচারা মরিত কি না ঠিক বলা যায় না। মরিলে কিন্তু ভয়ানক হৈ-চৈ পড়িয়া যাইত, মধ্যে হইতে তুমিই হয় ত মারা পড়িতে। যাহা হউক, আমি তোমার নিকট যে কতদূর কৃতজ্ঞ, তাহা বলিতে পারি না।”
পাচক প্রস্থান করিলে তিনি আর একবার ঘুমাইবার চেষ্টা করিলেন, নানা দুশ্চিন্তায় সে রাত্রে তাঁহার নিদ্রাকর্ষণ হইল না। তিনি যতই চিন্তা করিতে লাগিলেন, ততই তাঁহার উদ্বেগ বর্দ্ধিত হইতে লাগিল। জাহাজের সকল লোকের অজ্ঞাতসারে পলায়ন করা কতদূর কঠিন, তাহা বুঝিয়া তাঁহার মানসিক উৎকণ্ঠা ও চাঞ্চল্যের সীমা রহিল না। যদি অন্ধকার রাত্রি হইত, তাহা হইলেও তেমন উৎকণ্ঠার কারণ ছিল না, কিন্তু সেদিন শুক্লপক্ষ, সমস্ত রাত্রেই পরিস্ফুট, জ্যোৎস্নালোক।—এ অবস্থায় নির্বিঘ্নে সঙ্কল্প সিদ্ধির সম্ভাবনা কতটুকু?
পরদিন প্রভাতে প্রাতর্ভোজনের সময় ডড্লে পাচকের নিকট উপস্থিত হইলে সে তাঁহার সহিত তেমন মাখামাখি করিল না, অন্যান্য দিনের মত হাস্য পরিহাসও করিল না। সে অত্যন্ত গম্ভীরভাবে তাঁহাকে বসিতে বলিল, তাহার পর চতুর্দ্দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া—নিকটে কেহ নাই দেখিয়া তাঁহাকে নিম্ন স্বরে বলিল, “কি করিয়া আপনার কার্য্যোদ্ধার করিব, এই কথা ভাবিতে-ভাবিতে কাল রাত্রে ঘুমাইতে পারি নাই। আপনাকে এখন কি খাবার দিব বুঝিতে পারিতেছি না। আপনার অনুমতি হইলে আপনার ভাতের মধ্যে লুকাইয়া কিছু ভাল খাবার জিনিস দিতে পারি, আপনি অন্যের অলক্ষ্যে তাহা বাহির করিয়া লইবেন।
ডড্লে বলিলেন, “না, তাহার আবশ্যক নাই। পূর্ব্বের মত যাহা আমাকে দিবে, তাহাই যথেষ্ট। ঈশ্বর করুন আজ রাত্রিই যেন আমার জাহাজবাসের শেষ রাত্রি হয়। যাহা হউক, আজ রাত্রে বোটের উপর খাদ্য-সামগ্রী রাখিবার কি ব্যবস্থা করিবে? তুমি তাহা প্রস্তুত রাখিবে কি?
পাচক বলিল, “সে সকল আমি ঠিক করিয়াই রাখিয়াছি। আমার কুঠুরীতে খাটিয়ার নীচে একটা বাক্সের মধ্যে তাহা বন্ধ করিয়া রাখিয়াছি, যখন আবশ্যক হইবে, তখনই তাহা দিতে পারি। আপনি কোন্ বোটখানি লইবেন, তাহা স্থির করিয়াছেন কি?”
ডড্লে বলিলেন, “পোর্ট-কোয়ার্টারের বোট। অন্যান্য বোট অপেক্ষা সেইখানিই সহজে জলে নামাইতে পারিব। আমি কি ভাবে কায করিব, তা তুমি শুনিয়া রাখ। রাত্রি দ্বিপ্রহরের পূর্ব্বে আমি জাহাজ ত্যাগ করিব। আমি মিস্ এরস্কাইনকে সঙ্কেত করিলেই তিনি ডেকে আসিবেন। তাহার পর তাঁহাকে বোটের মধ্যে বসাইয়া বোটখানি জলে নামাইয়া দিব। ইহাতে তাঁহার একটু কষ্ট হইবে, কিন্তু উপায় কি? বোটখানি নামাইয়া দিয়াই আমি রজ্জুর সাহায্যে তাহাতে নামিয়া পড়িয়া বোট খুলিয়া দিব। জাহাজের কাপ্তেন যখন আমাদের পলায়নের সংবাদ পাইবে, তখন সে ক্রোধান্ধ হইয়া তোমাদের সকলকেই জিজ্ঞাসা করিবে—তোমরা কিছু জান কি না।”
পাচক বলিল, “আমাকে কথা জিজ্ঞাসা করিলে তাহাকে যাহা বলিতে হয় বলিব, সেজন্য আপনার কোন চিন্তা নাই।”
ডড্লে বলিলেন, “তোমার কথা শুনিয়া নিশ্চিন্ত হইলাম। এখন আর কোন কথার আবশ্যক নাই, দুই তিনটা খালাসী আমাদের দিকে চাহিয়া আছে, আমাদের কথাবার্ত্তা শুনিতে না পাইলেও, আমার পলায়নের পর তোমাকে সন্দেহ করিতে পারে। কাপ্তেনকে হয় ত বলিবে, বাবুর্চ্চির সহিত আরবটার পরামর্শ হইতেছিল—দেখিয়াছি।—আমি এখন চলিলাম।”
মিঃ ডড্লে এক বাটী ভাত লইয়া সেই স্থান ত্যাগ করিলেন, এবং তিনি যেখানে বসিয়া প্রত্যহ আহার করিতেন, সেই স্থানেই বসিয়া খাইতে লাগিলেন। জাহাজের একটা খালাসীকে তিনি অত্যন্ত ঘৃণা করিতেন, সে অদূরে বসিয়া তাঁহার আহার দেখিতে লাগিল। এই ইংরাজ খালাসীটা তাঁহাকে কিছু সন্দেহের চক্ষে দেখে—তাহা তিনি বুঝিয়াছিলেন, সে হয় ত তাঁহাকে ছদ্মবেশী বলিয়া বুঝিতে পারিয়াছে,—এই কথা ভাবিয়া তিনি উৎকণ্ঠিত হইলেন।—কিন্তু তিনি কোনরূপ বাহ্যিক চাঞ্চল্য প্রকাশ না করিয়া-যেন তাহাকে দেখিতেই পান নাই, এই ভাবে খাইতে লাগিলেন।
আহারের পর তিনি তাঁহার দৈনন্দিন কার্য্যে চলিলেন। তিনি জানিতেন, মিস্ এরস্কাইন সেদিন আর ডেকে বেড়াইতে আসিবেন না। তাঁহার স্বাস্থ্য সম্বন্ধে তাঁহার মামা কাপ্তেনের নিকট কি মন্তব্য প্রকাশ করে, তাহা জানিবার জন্য তাঁহার অত্যন্ত কৌতুহল হইল। তাহাদের কথা শুনিবার জন্য কি কৌশল অবলম্বন করা যায়,—ইহাই তিনি ভাবিতে লাগিলেন। তিনি মনে করিলেন, কাপ্তেনের কেবিনে ভিন্ন অন্য কোথাও তাহারা এ সম্বন্ধে আলোচনা করিবে না, সুতরাং তিনি কাপ্তেনের কেবিনের নিকট গিয়া কায করাই কর্ত্তব্য মনে করিলেন। তিনি সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া কায আরম্ভ করিলেন, কিন্তু ডাক্তার ল্যাম্পিয়ন সেদিকে আসিল না। আটটার পর ল্যাম্পিয়ন ‘হরিকেন ডেকে’র সিঁড়ি দিয়া মন্থর গতিতে সেই স্থানে উপস্থিত হইল। মিঃ ডড্লে তখন এঞ্জিন-ঘরের পিত্তলনির্ম্মিত কয়েকটি ‘ফ্রেম’ পরিষ্কার করিতেছিলেন, তিনি ল্যাম্পিয়নের গতিবিধি লক্ষ্য করিতে লাগিলেন। সে ধীরে ধীরে কাপ্তেনের কেবিনে প্রবেশ করিবামাত্র—ডড্লে তাহার অনুসরণ করিলেন, এবং সেই কক্ষের দ্বারপ্রান্তে দণ্ডায়মান হইয়া—ভিতরে কি কথা হয়, শুনিবার জন্য উদ্যত কর্ণে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। তিনি তাহাদের অস্ফুট কণ্ঠস্বরে উদ্বেগের আভাস পাইলেন।
কাপ্তেন বলিল, “আজ তোমার ভাগিনেয়ী কেমন আছে? অবস্থাটা আশাপ্রদ কি?
ল্যাম্পিয়ন জড়িত স্বরে বলিল, “শেষ হইতে আর যে বেশী বিলম্ব আছে—এমন ত বোধ হয় না।”—সে ঝুপ্ করিয়া একখানি চেয়ারে বসি পড়িল, সে শব্দও ডড লে শুনিতে পাইলেন।
কাপ্তেন বলিল, “ও কি। তুমি কঁপিতেছ কেন?—তোমার মুখ শুকাইয়া গিয়াছে। এত ভয় কিসের? তুমি এরকম কাপুরুষ তাহা ত জানিতাম না।”
কাপ্তেন সোডা খুলিয়া তাহা গেলাসে ঢালিল, ডড্লে অনুমান করিলেন, তাহাতে খানিক ব্রাণ্ডিও ঢালিয়া দেওয়া হইল। অনন্তর সে ল্যাম্পিয়নকে বলিল, “তুমি বড়ই দমিয়া গিয়াছ, এইটুকু খাইয়া মন চাঙ্গা কর।—কি বলিবার আছে বল।”
লাম্পিয়ন অস্ফুটস্বরে কি বলিল, তাহা ডড লের কর্ণগোচর হইল না। কিন্তু সে-কথা শুনিয়া কাপ্তেন সক্রোধে হুঙ্কার দিয়া বলিল, “আমার কাছে মাতলামি করা চলিবে না। মাতাল হইয়া কি তোমার বুদ্ধিভ্রংশ হইয়াছে?”
ল্যাম্পিয়ন ভগ্নস্বরে বলিল, “কে বলিল আমি মাতাল হইয়াছি? তুমি মিছামিছি আমার বদ্নাম করিতেছ। তোমার কথা মিথ্যা, তা তোমার মুখের উপর বলিতেছি। তুমি আমার অপমান করিও না। আমি তোমার কাছে অপমানিত হইতে আসি নাই। খবরদার। ফের যদি আমাকে মাতাল বলিবে ত ভাল হইবে না। আমাকে দেখিয়া কি মাতাল বোধ হয়? আমার কথা গুলি কি মাতালের মত? আর মাতাল হইলেই বা দোষ কি? তোমার চক্রান্তে পড়িয়া যে কায করিয়াছি, অতি বড় বেহেড, মাতালেও তাহা করে না।”
কাপ্তেন বুঝিল, ল্যাম্পিয়ন স্বকৃত কর্ম্মের জন্য অনুতপ্ত হইয়াছে, সে উত্তেজিত স্বরে বলিল, “তবে কি মেয়েটা মরিয়াছে—সে ত আনন্দেরই কথা।”
ল্যাম্পিয়ন বলিল, “না, মরে নাই, কিন্তু আর বেশী বিলম্ব নাই। উঃ-আমরা শয়তানের অধম। শয়তানও এরকম অপকর্ম্ম করিতে লজ্জিত হইত।”
কাপ্তেন বলিল, “বাহোবা।— তোমার এমন টন্টনে ধর্ম্মজ্ঞান এত দিন কোথায় ছিল?—হয় ত ইহার পর বলিবে আমারই কুপরামর্শে একায করিয়াছ। সম্পত্তিটা কি আমার দখলে আসিবে?”
ল্যাম্পিয়ন বলিল, “কিন্তু কাযটা যে অত্যন্ত গর্হিত হইয়াছে, ইহা হাজার বার—দু’হাজার বার বলিব।”
কাপ্তেন গর্জ্জন করিয়া বলিল, “পাঁচ হাজার বল, তাহাতে আমার ক্ষতিবৃদ্ধি নাই, কিন্তু আমার ঘাড়ে দোষ চাপাইলে আমি তোমার জিভ টানিয়া ছিঁড়িব। মাতলামী করিবার আর জায়গা পাও নাই? আমি তোমার প্রলাপ শুনিতে চাহি না। তুমি মুখ বন্ধ না করিলে কোন্ দিন আমাদের দুজনকেই ফাঁসিতে ঝুলিতে হইবে। মেয়েটা মরিলে আমাকে সংবাদ দিও, তাহার পর যাহা কর্ত্তব্য হইবে আমিই করিব। কিন্তু আমার বিনানুমতিতে তুমি এক ফোঁটা মদ খাইলেও আমি তোমাকে খাঁচায় পূরিব।”
ডড্লে যাহা শুনিলেন তাহাই যথেষ্ট, তিনি আর সেখানে না দাঁড়াইয়া তাড়াতাডি নীচের ডেকে আসিলেন। তাহার পর ল্যাম্পিয়ন কাপ্তেনের কেবিন হইতে বাহির হইল। ডড্লের বিশ্বাস ছিল, মিস্ এরস কাইন তাঁহার পরামর্শানুসারে কোন ঔষধ বা খাদ্যদ্রব্য স্পর্শ করেন নাই, তথাপি ল্যাম্পিয়নের কথা শুনিয়া তিনি অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হইলেন। ডাক্তার ল্যাম্পিয়ন কি মিস এরস্কাইনের চাতুর্য্যে প্রতারিত হইয়াছে। ইহা কি সম্ভব?—সে মিস এরস্কাইনের শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা না কবিয়াই কি এই মারাত্মক সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছে?
ডড্লে ডেকের এক পাশে দাঁড়াইয়া এই সকল কথা চিন্তা করিতেছেন, এমন সময় একজন লোক হঠাৎ তাঁহার উপর সজোরে হুম্ড়ি খাইয়া পডিল। ডড্লের মনে হইল, ইহা ইচ্ছাকৃত ঘটনা, আকস্মিক নহে। তিনি তৎক্ষণাৎ আত্মসংবরণ করিয়া আরবি ভাষায় বিস্ময়সূচক শব্দ উচ্চারণ করিলেন।—ভাগ্যে তাঁহার মুখ হইতে ইংরাজী কথা বাহির হইয়া পড়ে নাই।
যে লোকটা এইভাবে তাঁহার উপর হুম্ড়ি খাইয়া পড়িয়াছিল, সে পূর্ব্বকথিত খালাসী-যুবক; সে গর্জ্জন করিয়া বলিল, “তবে রে হতভাগা! তুই আমার পথ বন্ধ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিস্? দাঁড়া, তোকে ভাল-রকম শিক্ষা দিতেছি।—খালাশীটা হঠাৎ তাঁহার মুখে এক ঘুসি মারিল। ডড্লে সেই ঘুসি খাইয়া ঘুরিয়া পড়িলেন।—তিনি কোন রকমে সামলাইয়া লইয়া তাঁহার আততায়ীকে আক্রমণ করিতে উদ্যত হইয়াছেন, এমন সময় ডড্লের পাচকবন্ধু ব্লেক তাহার কেবিন হইতে বাহির হইয়া উভয়ের মধ্যে আসিয়া পডিল, এবং সেই খালাসীটাকে বলিল, “টম্কিন্স, তোমার এ কি-রকম ব্যবহার? তুমি যদি পুনর্ব্বার এরূপ অন্যায় কায কর, তাহা হইলে রীতিমত প্রতিফল পাইবে। লড়াই করিতে ইচ্ছা হয়, কোন গোরা আদ মীর কাছে যাও, জুতাইয়া লম্বা করিয়া দিবে। এই গরীব অসহায় আরব বেচারীর উপর বীরত্ব প্রকাশ করিতে তোমার লজ্জা হয় না? পুনর্ব্বার এরকম বেয়াদবী করিলে তোমাকে এমন শাস্তি দিব যে, সাত দিনের মধ্যে আর উঠিতে পারিবে না।”
টম্কিন্স আর কোন উচ্চবাচ্য করিয়া তাহাদের উভয়কে বিড়-বিড় করিয়া গালি দিতে-দিতে সরিয়া পড়িল। সে প্রস্থান করিলে পাচক ডড্লেকে বলিল, “আপনি ক্রোধ সংবরণ করিতে না পারিয়া উহাকে প্রহার করিলে বড়ই বিভ্রাট ঘটিত। ঐ হতভাগা নিশ্চয়ই কাপ্তেনের কাছে গিয়া আপনার নামে নালিশ করিত। সে যে প্রথমে আপনাকে মারিয়াছে, সে কথা উড়িয়া যাইত, উহার অভিযোগই বলবৎ হইত। কাপ্তেন আপনাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া কয়েদ করিত। অবস্থানুসারে কিল খাইয়া কিল চুরী না করিলে চলে না। আপনারও এখন সেই অবস্থা। অন্তত মিস্ এরস কাইনের প্রাণরক্ষার জন্যও এ সময় আপনার ক্ষমাশীল হওয়া কর্ত্তব্য। বিশেষতঃ, ঐ খালাসীটা কাপ্তেনের বড় প্রিয়পাত্র, সে বোধ হয় কাপ্তেনকে খুশী করিবার জন্যই আপনার উপর গোয়েন্দাগিরি করিতেছে। ভাগ্যে সে আপনার ছদ্মবেশ বুঝিতে পারে নাই।”
ডড্লে বলিলেন, “তোমার কোন ভয় নাই, আমি আর তাহার কাছে ঘেঁসিব না। কিন্তু যদি কখন তাহাকে ডাঙ্গায় পাই, তাহা হইলে আমার ঘুসির বহরটা তাহাকে দেখাইয়া দিব। আর কয়েক ঘণ্টা না কাটিলে আমি স্থির হইতে পারিতেছি না। আমাকে একটা পেন্সিল, এক টুকরা কাগজ আর একটু লম্বা দড়ি দিতে পার?—একখানি চিঠি লিখিয়া মিস্ এরস্কাইনের কেবিনে ফেলিয়া দিতে হইবে।”
পাচক পেন্সিল কাগজ ও রজ্জু আনিয়া দিলে, মিঃ ডড্লে তাহা তাঁহার ‘জিব্বা’র নিচে লুকাইয়া রাখিলেন। অনন্তর তিনি অবসরকালে সেই কাগজে তাঁহার সকল ব্যবস্থার কথা লিখিয়া, তাহা মিস্ এরস কাইনের কক্ষে নিক্ষেপের কৌশল চিন্তা করিতে লাগিলেন। তিনি এক টুকরা কাঠ পূর্ব্বেই সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিলেন। সেই কাঠে তিনি চিঠিখানি জড়াইয়া তাহা দৃঢ়রূপে রজ্জুবদ্ধ করিলেন। অনন্তর তিনি সেই রজ্জুর অপর প্রান্ত ধরিয়া, তাহা গবাক্ষপথে মিস্ এরক সাইনের কেবিনে নিক্ষেপ করিবার জন্য নিঃশব্দ পদসঞ্চারে কেবিনের কিনারার দিকে চলিলেন। মিঃ ডড্লে লক্ষ্য স্থির করিবার ও সেই বজ্র ধরিয়া আন্দোলিত করিতেছেন, এমন সময় সেই রজ্জু ফস্ করিয়া তাঁহার হাত হইতে বাহির হইয়া কেবিনের দ্বারে গিয়া পড়িল। এই আকস্মিক ঘটনায় মিঃ ডড্লে একেবারে মুহ্যমান হইয়া পড়িলেন, তাঁহার মাথা ঘুরিয়া উঠিল তিনি কিংকর্ত্তব্য স্থির করিতে পারিলেন না। তাঁহার মনে হইল, যদি ডাক্তার ল্যাম্পিয়ন হঠাৎ সেই স্থানে আসিয়া পত্রাচ্ছাদিত সেই কাষ্ঠখও রজ্জুবদ্ধ অবস্থায় পতিত দেখিতে পায়, তাহা হইলেই ত সর্ব্বনাশ। সে নিশ্চয়ই তাহা কুড়াইয়া লইয়া পত্রখানি খুলিয়া পাঠ করিবে। তাহার পর যাহা ঘটিবে—সে কথা চিন্তা করিতেও ডড্লের হৃৎকম্প হইল। তিনি অবসন্ন ভাবে বসিয়া পড়িলেন। কিন্তু তখন আর হা হুতাশ করিবার সময় ছিল না। তিনি বিপুল চেষ্টায় মানসিক চাঞ্চল্য দমন করিয়া নিঃশব্দ পদসঞ্চারে মিস্ এরস্কাইনের কেবিনের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হইলেন, এবং রজ্জুর প্রান্তভাগ ধরিয়া আকর্ষণ করিলেন,—দেখিলেন, রজ্জুর অপর প্রান্তে পত্রখানি বাঁধা নাই, তাহা অন্তর্হিত হইয়াছে।—নিশ্চয়ই কেহ তাহা খুলিয়া লইয়াছে।—পত্রখানি কাহার হস্তগত হইল, তাহা বুঝিতে না পারিয়া তাঁহার মানসিক উৎকণ্ঠা কিরূপ দুঃসহ হইল, ভাষায় তাহা প্রকাশ করা অসম্ভব।