নাবিক-বধূ/প্রথম পরিচ্ছেদ
আফ্রিকার কেপ্ টাউনের ‘গবর্মেণ্ট-হাউসে’ সেদিন বল-নাচের ধূম পড়িয়াছিল। এই নৃত্যোৎসবে কেপ্ কলোনির বহু সন্ত্রান্ত রাজকর্ম্মচারী যোগদান করিয়াছিলেন, মহিলাবর্গ প্রজাপতির ন্যায় বেশভূষায় মজলিসের শোভাবর্দ্ধন করিতেছিলেন। মজলিসে আনন্দের স্রোত বহিতেছিল। সেই সান্ধ্য মজলিসে যে সকল ইংরাজ-যুবক উপস্থিত ছিলেন, তাঁহদের মধ্যে ফিলিপ ডড্লে সর্ব্বাপেক্ষ অধিক সুপুরুষ, বিশেষতঃ রমণীর মনোরঞ্জনে তাঁহার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। এই যুবক নৌ-সেনাপতি এড্মিরাল রেড্ফর্ণের অধীনে লেফ্টেনাণ্টের পদে নিযুক্ত ছিলেন।
নিমন্ত্রিত নরনারীগণ লাট-প্রাসাদে সমাগত হইলে লাট সাহেব আগন্তুকগণের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া এড্মিরাল রেড্ফর্ণকে বলিলেন, “আজ যাহারা এখানে আমোদ-প্রমোদে যোগদান করিয়াছে, তাহাদের মধ্যে একটি ছোক্রার চেহারা আমার বড় ভাল লাগিতেছে, উহারই নাম বুঝি ফিলিপ ডড্লে? তোমার অধীনে ছোক্রা লেফ্টেনাণ্টগিরি করে না?”
এড্মিরাল রেড্ফর্ণ বলিলেন, “হাঁ মহাশয়, উহারই নাম ফিলিপ ডড্লে। ছেলেটির যেমন রূপ, সেইরূপ গুণ। কালে ও একজন ভাল যোদ্ধা হইবে; উন্নতিও করিবে। আপনি বুঝি উহার পরিচয় জানেন না? কাপ্তেন জ্যাক ডড্লেকে আপনার মনে পড়ে?—তাঁহার সহিত আপনার ত বেশ আলাপ ছিল।
লাট সাহেব বলিলেন, “ভারতে সে কাপ্তেনী করিত? ’৭১ অব্দে সেকন্দরাবাদ নগর হইতে সে লর্ড বেলামীর মেয়েটিকে ফুসলাইয়া বাহির করিয়া লইয়া গিয়াছিল না? আহা, বেচারা তেল্-এল্-কেবিরের যুদ্ধে মারা পডিয়ছিল— একথা বেশ মনে আছে।”
এড্মিরাল রেড্ফর্ণ সোৎসাহে বলিলেন, “হাঁ, ঠিক বটে, এ তাঁহারই পুত্র।”
লাট সাহেব বলিলেন, “বটে। বল কি? হাঁ, উভয়ের চেহারায় যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে বটে। উহার পিতা তাহার সমসাময়িক যোদ্ধৃগণের মধ্যে অত্যন্ত সাহসী বীরপুরুষ ছিল। বেচারার দুর্ভাগ্যের কথা মনে হইলে দুঃখ হয়। ডড্লের কথা আমার বেশ মনে আছে। রেড্ফর্ণ, ছেলেটিকে দেখিয়া আমার বড় মমতা হইয়াছে, উহার সহিত একটু আলাপ করিতে ইচ্ছা হইতেছে।”
এড্মিরাল রেড্ফর্ণ বলিলেন, “তবে ত তাহার বেশ সুযোগ উপস্থিত। বিলম্ব করিলে উহার সহিত সাক্ষাতের সম্ভাবনা অল্প, কারণ উহাকে অতি অল্প দিনের মধ্যেই সমুদ্রযাত্রা করিতে হইবে।”
লাট সাহেব বলিলেন, “তাহা হইলে আজই উহাকে আমার সহিত দেখা করিতে বলিব, উহার পিতার খাতিরে আমি উহার সহিত আলাপ করিয়া উহাকে সম্মানিত করিব।”
অনন্তর লাট সাহেব তাঁহার একজন এডিকংকে ডাকিয়া নিম্নস্বরে তাহাকে কি আদেশ করিলেন। তখন এক দফা নাচ শেষ হইয়াছিল। যে সকল যুবক-যুবতী দীর্ঘকাল নৃত্য করিয়া পরিশ্রান্ত হইয়াছিলেন, তাঁহারা গল্পগুজব ও বিশ্রাম করিবার জন্য বারান্দার দিকে যাইতেছিলেন।—তাঁহাদের বিশ্রামের জন্য সেখানে আসনশ্রেণী নির্দ্দিষ্ট ছিল।
কয়েক মিনিট পরে পূর্ব্বোক্ত এডিকং ডড্লেকে সঙ্গে লইয়া লাট সাহেবের নিকট উপস্থিত হইল।
লাট সাহেব ডড্লেকে দেখিয়া তাহার করমর্দ্দন করিয়া সদয়ভাবে বলিলেন, “কি হে ছোক্রা। তুমি আছ কেমন? আমি এইমাত্র এড্মিরালের নিকট শুনিলাম তুমি আমার প্রিয় বন্ধু জ্যাক ডড্লের ছেলে। তোমার চেহারা অনেকটা তোমার পিতার চেহারার মতই, তথাপি যে আমি তোমাকে পূর্ব্বে চিনিতে পারি নাই, ইহাই আশ্চর্য্য। নৌ বিভাগের কার্য্যে তোমার উন্নতি দেখিলে আমি বড়ই সুখী হইব, তুমি আমাকে তোমার মুরুব্বি বলিয়া মনে করিও। সে কথা যাক—তোমার মা ভাল আছেন ত?”
ডড্লে সবিষাদে বলিলেন, “না মহাশয়, আমার মাতার মৃত্যু হইয়াছে গত বৎসর শীতকালে কয়েক দিনের অসুখে তিনি মারা গিয়াছেন।”
লাট সাহেব সহানুভূতিভরে বলিলেন, “কি দুঃখের কথা। আমি না জানিয়া তোমার মনে কষ্ট দিয়াছি, এজন্য কিছু মনে করিও না। অল্প বয়সে তুমি পিতামাতা উভয়কেই হারাইয়াছ। তোমার পিতা তোমার মাতার বড় গৌরব করিতেন। যে নাচের মজলিসে তোমার মাতার সহিত তোমার পিতার প্রথম পরিচয়, আমি সেই মজলিসে উপস্থিত ছিলাম। তোমার মা বড়ই সুন্দরী ছিলেন, নৃত্যেও তাঁহার অসাধারণ পারদর্শিতা ছিল। ডড্লের ন্যায় প্রেমিক পুরুষ যে তাঁহার প্রেমে পড়িয়াছিলেন, ইহাতে বিস্ময়ের কোন কারণ ছিল না। যাহা হউক, আমি আর দীর্ঘকাল তোমাকে আট্কাইয়া রাখিব না, তুমি সময় পাইলেই মধ্যে মধ্যে আসিয়া আমার সহিত দেখা করিবে। দু’জনে গল্প করিব। আবার নাচ আরম্ভের সময় হইয়াছে, এখন তুমি তোমার সঙ্গিনীর নিকট যাও, কিন্তু যাহার সহিত নাচ করিবে, তাহাকে হয়রাণ করিয়া মারিও না, স্মরণ রাখিও যুবতীদের হৃদয় তোমাদের যুদ্ধ জাহাজের মত দুর্ভেদ্য নয়, আর যদি তাহা একবার ভাঙ্গিয়া যায়, তাহা হইলে তাহা মেরামতের জন্য ডকেও পাঠান যায় না।”
লাট সাহেবের এই রসিকতায় যুবক ডড্লে কৌতুক বোধ করিলেন, কিন্তু শিষ্টাচারের অনুরোধে তাঁহাকে হাস্য সংবরণ করিয়া লাট সাহেবের নিকট বিদায় লইতে হইল। তিনি লাট সাহেবকে অভিবাদন করিয়া প্রস্থান করিবেন, এমন সময় তাঁহার উপরওয়ালা এড্মিরাল তাঁহার স্কন্ধে হস্তস্থাপন করিয়া বলিলেন, “ডড্লে, আমি তোমার আমোদ-প্রমোদে বাধা দিতে চাহি না, কিন্তু নাচের পর যদি তুমি সময় পাও,—তাহা হইলে একবার আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবে। তোমাকে এমন একটি খবর দিব—যাহা শুনিয়া তোমার আনন্দের সীমা থাকিবে না।”
ডড্লে বলিলেন, “আপনার আদেশ শিরোধার্য্য। আপনি যখন বলিবেন— সেই মুহূর্ত্তেই সাক্ষাৎ করিব।”
এড্মিরাল বলিলেন, “না, না, তোমার অত ব্যস্ত হইবার আবশ্যক নাই। সে কথা এখনই বলিতে হইবে—এরূপ মনে করিও না, বিলম্বে বলিলেও কোন ক্ষতি নাই। এখন তুমি যাইতে পার, তোমার সুবিধা অনুসারে এক সময় আমার সহিত দেখা করিলেই চলিবে।”
ডড্লে প্রস্থান করিলেন, কিন্তু এড্মিরাল কি সুসংবাদ দিবেন, তাহা বুঝিতে না পারিয়া তাঁহার মন কিঞ্চিৎ চঞ্চল হইল। যাহা হউক, তিনি মানসিক চাঞ্চল্য গোপন করিয়া বারান্দায় আসিলেন, এবং যে যুবতীর সহিত তাঁহার নাচিবার কথা, তাঁহাকে খুঁজিতে লাগিলেন। হঠাৎ কে একজন পশ্চাৎ দিক হইতে আসিয়া তাঁহার স্কন্ধে হস্তস্থাপন করিলেন।
ডড্লে সবিস্ময়ে মুখ ফিরাইয়া দেখিলেন, আগন্তুক তাঁহারই একটি বন্ধু,— একজন টর্পেডো লেফ্টেনাণ্ট। আগন্তুক ডড্লেকে সহাস্যে বলিলেন, “ব্যাপার কি হে ছোক্রা!–অল্পক্ষণ পূর্ব্বে তুমি দেবতাদের দলে মিশিয়া তাহাদের সহিত সমকক্ষের মত গল্পগুজব করিতেছিলে, দেখিয়া প্রথমটা ত আমার চক্ষুকে বিশ্বাস করিতেই পারি নাই। যাহারা আমাদিগকে কীটপতঙ্গের মত দেখে, তাহাদের সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠতা, আলাপ আপ্যাত তোমার সৌভাগ্য ত কম নয়, দেখিয়া আমাদের মত আদার ব্যাপারীর হিংসা হয়। কিন্তু ভাই, সত্য কথা বলিতে কি—ঐ যে লাট বেলাটগুলো, উহারা সোজা চিজ্ নয়, ও সকল কুসংসর্গে না মেশাই ভাল। লাট সাহেব কি মৎলবে তোমায় ডাকিয়াছিল বল ত।”
ডড্লে হাসিয়া বলিলেন, “টর্পেডো লেফ্টেনাণ্টের পদটি এবালিস্ করা উচিত কি না সেই কথা জিজ্ঞাসা করিতে ডাকিয়াছিলেন। আমাদের বড় কর্ত্তার বিশ্বাস—ঐ পদটি না থাকিলেও নৌ-যুদ্ধে জয়লাভের ব্যাঘাত ঘটিবে না।”
টর্পেডো লেফ্টেনাণ্ট বলিলেন, “আমার পদের কোনও মূল্য আছে কি না তা সুযোগ পাইলে এক সময় তোমাকে বুঝাইয়া দিব। সমুদ্রের মধ্যে তোমাকে একবার পাইলে হয়, ডাঙ্গায় বসিয়া আমার পদের মহিমা তুমি বুঝিতে পরিবে না, বিশেষতঃ শান্তির সময়। সে কথা থাক, এটর্ণি-জেনারেলের হাত ধরিয়া পরীর মত সুন্দরী যে মেয়েটি আসিতেছে—উহাকে চেন কি? কেপ্ টাউনের সকল সুন্দরীকেই ত আমি চিনি, কিন্তু উহাকে ত চিনিতে পারিতেছি না। পূর্ব্বে কোন দিন উহাকে দেখিয়াছি বলিয়াও মনে হইতেছে না। কি সুন্দর মুখখানি, কি চমৎকার অঙ্গসৌষ্ঠব। এরূপ সুন্দরী আজিকার এই মজলিসে আর একটিও নাই, উহার সহিত পরিচয় করিতে ইচ্ছা হইতেছে।”
টর্পেডো লেফ্টেনাণ্ট ডড্লেকে ছাডিয়া আলোকরশ্মি কর্ত্তৃক আকৃষ্ট পতঙ্গের ন্যায় সেই যুবতীর দিকে অগ্রসর হইলেন। যুবতীও ধীরে ধীরে ডড্লের দিকে আসিতে লাগিলেন। ডড্লে বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্রে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। সত্যই এমন অপরূপ রূপ তিনি জীবনে কখন দেখেন নাই। সেই দুর্লভ রূপরাশি দেখিয়া দেখিয়া তাঁহার—“নয়ন না তিরপিত ভেল।”
কিন্তু অধিককাল সেই যুবতীর দিকে একদৃষ্টিতে চাহিয়া থাকিলে পাছে রূঢ়তা প্রকাশিত হয়, এই ভয়ে ডড্লে চক্ষু ফিরাইয়া লইয়া, যাঁহার সহিত তাঁহার নাচিবার কথা—তাঁহারই সন্ধানে চলিলেন। ইতিমধ্যে সেই সুন্দরীর সঙ্গী এটর্ণি জেনারেল ডড্লেকে ডাকিয়া বলিলেন, “ডড্লে, একটা কথা শুনিয়া যাও, কিন্তু সর্ব্বাগ্রে তোমাকে আমার সঙ্গিনীর সহিত পরিচিত করাই। ইনি মিস্ এরস্কাইন। মিস এরস্কাইন, লেফ্টেনাণ্ট ডড্লে আধুনিক নূতন নূতন ফ্যাসানের নৃত্যে অসাধারণ পারদর্শী, বিশেষতঃ প্রেমের অভিনয়ে ইঁহার মত সুযোগ্য ও সুরসিক অভিনেতা নৌ-কর্ম্মচারিগণের মধ্যে আর কেছ আছেন কি না তাহা জানি না।”
এইরূপে মিস্ এরস্কাইনের সহিত লেফ্টেনাণ্ট ডড্লের প্রথম পরিচয় হইল।—এটর্ণি-জেনারেলের রসিকতায় ডড্লে যে বিশেষ দুঃখিত হইলেন এ কথা বলা যায় না, তবে তিনি একটু লজ্জিত হইলেন বটে। কিন্তু এই ভদ্র লোকটির রসিকতা একটু স্থূল হইলেও তিনি বড় সহৃদয় ও খোলা মেজাজের লোক—ইহা ডড্লের অজ্ঞাত ছিল না, সুতরাং তাঁহার প্রগলভতায় তিনি বিরক্ত হইলেন না।
ডড্লে মিস্ এরস্কাইনকে বলিলেন, “মিস্ এরস্কাইন, আমার বোধ হয় আপনি এখন খুব ব্যস্ত। কিন্তু যদি আপনার বিশেষ অসুবিধা না হয়,—তাহা হইলে আপনার সঙ্গে আমাকে একবার নাচিবার অনুমতি দান করিলে আমি কৃতার্থ হই।”
মিস্ এরস্কাইন বলিলেন, “আমি এইমাত্র নাচের মজলিসে উপস্থিত হইয়াছি, এখন পর্য্যন্ত আর কেহ আমার সঙ্গে নাচিবার জন্য দরখাস্ত করে নাই, সুতরাং আপনার সঙ্গে নাচিয়া আপনাকে কৃতার্থ করিতে আমার আপত্তি নাই। কেপ্ টাউনে আমি তেমন পরিচিত নহি।”
তৎক্ষণাৎ নাচের বন্দোবস্ত হইল। ডড্লে মিস্ এরস্কাইনের কার্ডে নিজের নাম লিখিয়া বন্দোবস্তটি পাকা করিলেন, তাহার পর তিনি মিসের নিকট বিদায় লইলেন।
ডড্লে তৎপূর্ব্বে যে মহিলাটির সহিত নাচিবার অঙ্গীকারে আবদ্ধ হইয়াছিলেন, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইলে তিনি তাঁহাকে মিস্ এরস্কাইনের পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলেন। এই যুবতী মিস্ এরস্কাইনকে চিনিতেন, তিনি বলিলেন, “এই যুবতাটির পিতা মাতা উভয়েরই মৃত্যু হইয়াছে, প্রায় ছয় মাস পুর্ব্বে সে ইংলণ্ড হইতে কেপ্ কলোনিতে আসিয়াছে। তাহার পিতা গবর্মেণ্টের অধীনে কনট্রাক্টরের কার্য্য করিতেন। এই কার্য্যে তিনি ক্রমে লক্ষপতি হইয়া উঠিয়াছিলেন। মিস্ এরস্কাইন এদেশে আসিয়াই তাহার একটি সখীর সহিত দেখা করিতে উত্তরাঞ্চলে গিয়াছিল। সেখান হইতে ফিরিয়া আসিয়া তাহার মামা ডাক্তার ল্যাম্পিয়নের গৃহে বাস করিতেছে। এই মামা ভিন্ন সংসারে তাহার আপনার বলিতে আর কেহই নাই।—আপনি বোধ হয় ডাক্তার ল্যাম্পিয়নকে জানেন?
ডড্লে বলিলেন, “তাঁহার সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানি না। একরাত্রে তিনি জাহাজের উপর আমার সহিত এক টেবিলে আহার করিয়াছিলেন; এদেশে আসিয়াও তাঁহার সহিত আমার কয়েকবার সাক্ষাৎ হইয়াছে।
যুবতী বলিলেন, “লোকটাকে বোধ হয় আপনার মনে ধরে নাই, সত্য কি না—ঠিক বলুন।” ডড্লে বলিলেন, “তাঁহার সম্বন্ধে যখন বিশেষ কিছু জানি না, তখন তাঁহাকে মনে ধরিয়াছে কি না কি করিয়া বলি? তাঁহাকে অপছন্দ করিবার কি কোন কারণ আছে?”
যুবতী বলিলেন, “এ আপনার মনের কথা নয়। দেখুন, আমি লোকের মনের কথা বলিয়া দিতে পারি।—আমার গণনা করিবার শক্তি আছে, আপনারও অদৃষ্ট-ফল গণিয়া বলিয়া দিতে পারি, আপনি কি তাহা জানিতে চাহেন?
ডড্লে কৌতূহলভরে বলিলেন, “আপনি অদৃষ্টের ফলাফল বলিতে পারেন?—আমার ভাগ্যে কি আছে তাহা জানিবার জন্য অত্যন্ত আগ্রহ হইয়াছে। আপনি কি হাত দেখিয়া গণনা করেন? না, অন্য কোন উপায়ে ভাগ্যফল পরীক্ষা করেন?”
যুবতী বলিলেন, “আমি করতলের রেখা দেখিয়া অদৃষ্ট ফল-গণনা করি, আপনার হাত দেখি।”
ডড্লে যুবতীর সম্মুখে দক্ষিণ করতল প্রসারিত করিলেন।
যুবতী মিনিট-দুই তাঁহার কররেখা পরীক্ষা করিয়া হাসিয়া বলিলেন, আপনার বয়স অল্প, আর আপনি উচ্চাভিলাষী, দেশ ভ্রমণেও আপনার অতান্ত অনুরাগ।”
ডড্লে হাসিয়া বলিলেন, “আপনি ত ভারি গণনা করিলেন। ওকথা না গণিয়াই যে-সে বলিতে পারিত। আমার মুখ দেখিয়াই বলিতে পারা যায় আমার বয়স অল্প, আমি যে উচ্চাভিলাষী, তাহ আমার সামরিক পরিচ্ছদেই প্রকাশ। উচ্চাভিলাষ না থাকিলে কে নৌ-বিভাগে চাকরী করিতে যায়? আর যাহারা এই চাকরী করে, তাহাদিগকে সমুদ্রে-সমুদ্রে ঘুরিয়া বেড়াইতে হয় ইহাই বা কে না জানে?—না, আপনার গণনার সিদ্ধান্তে আমি সুখী হইতে পারিলাম না।”
যুবতী বলিলেন, “কিন্তু আমার গণনা এখনও ত শেষ হয় নাই। দেখিতেছি ছদ্মবেশ ধারণে আপনার বেশ দক্ষত আছে, কিন্তু এখনও আপনি সেই দক্ষতা প্রদর্শনের সুযোগ লাভ করেন নাই। আপনি সহজে নিরুৎসাহ হন না, আপনি যে কার্য্যে হস্তক্ষেপণ করেন—তাহা শেষ না করিয়া ছাড়েন না।”
ডড্লে বলিলেন, “আপনি অন্ধকারে ঢিল ছুড়িলেন। এই দৈববাণীতে আপনার শক্তির কোন পরিচয় পাইলাম না। ভবিষ্যতে ঘটিবে—এমন বিশেষ কোন ঘটনার উল্লেখ করিতে পারেন?”
যুবতী আরও দুই মিনিট ডড্লের করতলে দৃষ্টি সংস্থাপিত করিয়া বলিলেন, “আপনি ইতিপূর্ব্বে কয়েকবার প্রেমে পড়িয়াছিলেন, কিন্তু ফাঁদে পা দেন নাই, শক্ত জাল ছিঁডিয়া বাহিরে আসিয়াছেন। এখন আপনি বেশ নিশ্চিন্ত আছেন, কিন্তু আপনার জীবনের গতি শীঘ্রই পরিবর্ত্তিত হইবে। আপনি একটি দীর্ঘাকৃতি সুন্দরী যুবতীর প্রেমে পড়িয়া হাবুডুবু খাইবেন। আপনার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হইয়া উঠিবে, কিন্তু আপনি অশেষ মনোকষ্ট পাইলেও সেই যুবতীর প্রণয়লাভে সমর্থ হইবেন। প্রথম দর্শনের পর বিরহ, বিরহান্তে অদূরেই মিলন। তাহার পর প্রাণের আশঙ্কা, কিন্তু আপনি মরিবেন না। তবে পৃথিবীতে কেহই অমর নহে, আপনিও একদিন মরিবেন, কিন্তু খুব বড় লোক হইয়া অত্যন্ত ধুমধাম করিয়া মরিবেন।”
ডড্লে বলিলেন, “আপনার শেষ গণনাটি শ্রুতিসুখকর বটে। যদি মরিতেই হয়—তবে বড়লোক হইয়া মরাই প্রার্থনীয়। কিন্তু তাহার পর?—আপনার বিদ্যা বুঝি ঐ পর্য্যন্ত। আর কিছু গণিতে পারেন না?”
যুবতী বলিলেন, “না, আমি আর কিছু বলিতে পারিব না। আপনার হাত দেখিয়া যাহা যাহা বলিবার ছিল, তাহ বলিয়াছি, এ বিদ্যায় আমার তেমন অধিক পারদর্শিতা নাই।”
ডড্লে বলিলেন, “আমার যে আরও গোটাকত কথা জানিবার ছিল। আপনি বলিলেন না—আমি যে যুবতীর প্রেমে পড়িব—তিনি দীর্ঘাঙ্গী, সুন্দরী?”
যুবতী বলিলেন, “আপনার করচিহ্ন দেখিয়া তাহাই বুঝিয়াছি।”
ডড্লে তাঁহার সঙ্গিনী যুবতীর এই দৈববাণী বিশ্বাস করিলেন কি না বলা যায় না, কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই তিনি এ সকল কথা বিস্মৃত হইলেন।—যথাসময়ে তিনি মিস্ এরস্কাইনের সহিত মহা উৎসাহে নৃত্য করিয়া তৃপ্তিলাভ করিলেন। নৃত্য-শেষে তাঁহারা পরিশ্রান্ত দেহে প্রাসাদ-বারান্দায় নব-নির্ম্মিত একটি কৃত্রিম লতাকুঞ্জে বিশ্রাম করিতে চলিলেন।
ডড্লে মিস্ এরস্কাইনকে বলিলেন, “আপনাকে ধন্যবাদ জানাইবার উপযুক্ত ভাষা আমার নাই, নাচিয়া এত আনন্দ আমি বহুকাল পাই নাই। আপনি বলিয়াছেন—কেপ্ কলোনিতে আপনি অল্পদিন পূর্ব্বে আসিয়াছেন। এদেশে কতদিন পূর্ব্বে আসিয়াছেন জানিতে পারি কি?”
মিস্ এরস্কাইন বলিলেন, “প্রায় ছয় মাস পূর্ব্বে আসিয়াছি। আমি এখানে আমার মামা ডাক্তার ল্যাম্পিয়নের বাঙ্গলোয় আছি।—আপনি বোধ হয় তাঁহাকে চেনেন।”
ডড্লে বলিলেন, “হাঁ, দুই-একবার তাঁহার সহিত আমার সাক্ষাৎ হইয়াছে। চিকিৎসা-বিদ্যায় তাঁহার বেশ সুনাম আছে শুনিয়াছি।”
মিস্ এরস্কাইন বলিলেন, “তিনি যে অসাধারণ বুদ্ধিমান—এ বিষয়ে সন্দেহ নাই, তিনি অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী। রাজনীতিতেও তাঁহার গভীর জ্ঞান। কালে তিনি পার্লিয়ামেণ্টে প্রবেশের চেষ্টা করিবেন—এরূপ আশা করেন।—মিঃ ডড লে, আপনিও বোধ হয় উচ্চাভিলাষী?”
ডড্লে সবিস্ময়ে বলিলেন, “একথা কেন জিজ্ঞাসা করিতেছেন। আজ আর একজনও আমাকে ঠিক এই কথাই বলিতেছিলেন।”
মিস্ এরাইন বলিলেন, “কথাটা নিশ্চয়ই মিথ্যা নহে, আপনার মুখ দেখিয়াই বুঝিয়াছি আপনি উচ্চাভিলাষী। উচ্চাভিলাষ থাকা ভাল। যে সকল যুবক কার্যক্ষেত্রে প্রবেশ করিয়া উচ্চাভিলাষী না হয়, তাহারা তেমন উন্নতি করিতে পারে না। ভবিষ্যৎ-জীবনে খ্যাতিও লাভ করিতে পারে না। জীবন-সংগ্রামে জয়লাভ করা সামান্য সাধনার ফল নহে।সেই গৌরব অর্জন করিতে পারা পরম শ্লাঘার কথা।”
ডড্লে বলিলেন, “মিস্ এরাইন, আমি জীবন-সংগ্রামে জয়লাভ করি আপনি কি ইহা ইচ্ছা করেন? কথাটা আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হয় ত অশোভন হইল, কিন্তু আমার বিশ্বাস, আপনার নিকট অনুকূল উত্তর পাইলে আমার সৌভাগ্যোদয় হইবে।”
মিস্ এরাইন বলিলেন, “হাঁ, আপনার জীবনের ব্রত সফল হউক, ইহাই আমার আন্তরিক ইচ্ছা। আমার বিশ্বাস-জীবনের যুদ্ধে আপনি জয়লাভ করিবেন। আপনার সম্মুখে বিশাল কার্যক্ষেত্র উন্মুক্ত, অগ্রসর হউন, আপনার আশা পূর্ণ কইবে। কিন্তু ঐ শুনুন গান আরম্ভ হইয়াছে, এইবার আমার নাচের পালা, চলুন ‘বল-রুমে যাই।”
উভয়ে বল-রুমে প্রবেশ করিলে আবার কিছুকাল নৃত্য চলিল। মিস্ এরাইন অন্য একটি যুবকের সহিত নাচিলেন। এবার যাহার সহিত ডড্লের নাচিবার কথা ছিল, নাচিতে-নাচিতে মসৃণ মেঝের উপর পডিয়া তাহার পায়ে বড় আঘাত লাগিয়াছিল, এজন্য তিনি নৃত্যে যোগ দিতে পারিলেন না, ডড্লে এডমিরালের সহিত আলাপ করিতে চলিলেন। এডমিরাল তখন মঞ্চের উপর বসিয়া লাট-পত্নীর সহিত গল্প করিতেছিলেন, ডলকে দেখিয়া এডমিরাল লাট-পত্নীর নিকট বিদায় লইয়া উঠিলেন, এবং ডড্লের সম্মুখে আসিয়া বলিলেন, “ডড্লে, তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে, চল একটু নিরিবিলি যায়গায় গিয়া বসি। আমার কথা শেষ করিতে বেশী সময় লাগবে না, সেজন্য তুমি চিন্তিত হইও না।”
উভয়ে একটি নির্জন স্থানে আসিয়া বসিল এডমিরাল বলিলেন, “কথাটা আজ তোমাকে বলিবার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু লাট সাহেব তোমার পিতার পরম বন্ধু, তিনি আমাকে বলিলেন, কথাটা আজই তোমাকে বলা ভাল—আমি তোমার উপর একটি গুরুতর কার্য্যের ভার দিতে চাই, কিন্তু তুমি সে ভার গ্রহণ করিতে সম্মত কি না, সর্ব্বাগ্রে তাহ জনা আবশ্যক।”
ডড্লে বলিলেন, “আপনার অধীনে এত সুদক্ষ কর্ম্মচারী থাকিতে আমার উপর আপনি কোনও গুরুতর কার্য্যের ভার দিতে ইচ্ছুক হইয়াছেন। আমার পক্ষে ইহা পরম সৌভাগ্যের কথা —কিন্তু আমি সেই ভার গ্রহণের যোগ্য কি না তাহা ত জানি না।”
এডমিরাল বলিলেন, “তোমার যোগ্যতার আমার সন্দেহ নাই, আমি অযোগ্য পাত্রে কোনও ভার অর্পণ করি না। আমি তোমার বুদ্ধি-বিবেচনা ও শক্তি-সামর্থ্যের যথেষ্ট পরিচয় পাইয়াছি, তোমার কার্য্যের উপরেও আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আছে।—এখন আমার কথা মন দিয়া শোন। আমার বিশ্বাস, যে কার্য্যে যথেষ্ট বিপদের সম্ভাবনা,—সেরূপ কার্যোর ভার লইতে তোমার অত্যন্ত আনন্দ হয়। তোমার উপর আমি এইরূপ একটি কার্য্যের ভার দিব। তুমি এদেশে অনেক দিন আছ—মুতরাং আমেদ বেন-হাসেনের নাম বোধ হয় তোমার অজ্ঞাত নহে।”
ডড্লে বলিলেন, “সে নিয়াস হ্রদের তীরবর্তী স্থানসমূহে ক্রীতদাসের বাবসায় করে না? আমরা ত তাঙ্কাকে বহুদিন হইতে ধরিবার চেষ্টা করিতেছি। তাহার নাম কে না জানে?”
এডমিরাল বলিলেন, “উত্তম কথা —তাহা হইলে তুমি বোধ হয় এ কথাও জনি যে, আফ্রিকাদেশে তাহার ন্যায় দুর্ব্বত্ত নরপশু দ্বিতীয় নাই। চাতুর্য্যে ও ফন্দী-ফিকিরে সে আমাদিগকে বহুবার পরাস্ত করিয়াছে। আজ সংবাদ পাইয়াছি, সে সায়ার নদী দিয়া এক চালান রাইফেল লইয়া যাইবে। প্রথমে সে তাহা জাহাজ হইতে কিলম্যানে নামাইয়া লইবার মনস্থ করিয়াছিল, কিন্তু সে সংবাদ পাইয়াছে—পর্টুগীজরা ইহাতে আপত্তি করিবে। এইজন্য •সে কমোরো দ্বীপের অদূরে স্বয়ং উপস্থিত হইয় গুলি-বারুদ বন্দুক প্রভৃতি তাহার নিজের বোটে তুলিয়া লইবে, এবং গোপনে নিয়াস হ্রদে লইয়া যাইবে। যে জাহাজে ঐ সকল মাল আসিতেছে—সেই জাহাজখানি আটক করিয়া তাহা খানা-তল্লাস করিতে পারিতাম, কিন্তু তাহা যে উহাই মাল, ইহার কোনও অকাট্য প্রমাণ পাই নাই বলিয়া জাহাজখানি আটক করা সঙ্গত মনে করি নাই। এই মালগুলি কখন আমাদের বোটে নামাইয়া দেওয়া হয়, তৎপ্রতি লক্ষ্য রাখিতে হইবে, পরে সেই বোট আমাদের কর্তৃক পরিচালিত হইতে দেখিলেই তাহা দখল করিতে হইবে। কিন্তু এদেশের কোনও লোকের উপর এই কার্যের ভার দেওয়া যায় না, সুতরাং আমার সৈন্যদল হইতেই যোগ্য লোক প্রেরণ করা আবশ্যক। আমি জানি, তুমি ছদ্মবেশধারণে অসাধারণ দক্ষ, এতদ্ভিন্ন তুমি খাটী আরবের মতই আরবী কথা বলিতে পার, এইজন্য এ ভার আমি তোমার উপরেই দিতে চাই। তুমি কার্যোদ্ধার করিতে পারিবে-এটুকু আমার বিশ্বাস আছে। যদি আমার যৌবন থাকিত, তাহা হইলে আমি স্বয়ংং সানন্দে এই কার্য্যভার গ্রহণ করিতাম।”
ডড্লে বলিলেন, “আমি আনন্দের সহিত এই ভার গ্রহণে সম্মত আছি, আপনি এইভাবে আমাকে সম্মানিত করিলেন, এজন্য আমি আপনার নিকট আন্তরিক কৃতজ্ঞ রহিলাম। এরূপ বিপদের কার্যে প্রবৃত্ত হইতে আমার বড়ই আনন্দ। আমি কার্যোদ্ধারের জন্য চেষ্টা-যন্ত্রের ক্রটি করিব না, তবে কৃতকার্য্য হইতে পারিব কি না বলিতে পারি না।”
এডমিরাল বলিলেন, “সেজন্য তুমি চিন্তিত হইও না, তবে কাজটা কঠিন বটে। কতবার সেই দুর্বত্তকে ধরি-ধরি করিয়াও ধরিতে পারি নাই, আশা করি এবার আর সে পলাইতে পারিবে না। তাহাকে ধরিবার জন্য সাধু বা অসাধু কোন উপায়ই উপেক্ষা করিলে চলিবে না। আমাদের যদি হ্রদ সন্নিহিত প্রদেশে গুলি-বারুদ বন্দুক প্রভৃতি লইয়া যাইতে সমর্থ হয়—তাহা হইলে আমাদের সেখানে স্বার্থরক্ষা করা কঠিন হইবে, গত পাঁচ বৎসর কাল জামিয়া সেখানে যে কিছু কার্য করিয়াছি, সমস্তই পণ্ড হইবে।” ডড্লে বলিলেন, “আমাকে কালই যাত্রা করিতে হইবে?”
এডমিরাল বলিলেন, “আগামী শনিবারের মধ্যে রওনা হওয়াই চাই, মধ্যে এখনও তিন দিন আছে। তুমি এ ভার লইতে রাজী আছ ত? তুমি মনে করিও না—আমি তোমাকে এই কার্যে বাধ্য করিতেছি। ইচ্ছা করিলে তুমি ইহা প্রত্যাখ্যান করিতেও পার। তুমি এ ভার গ্রহণ না করিলে আমি বিন্দুমাত্র দুঃখিত হইব না।”
ডড্লে বলিলেন, “আমি স্বেচ্ছায় এ ভার গ্রহণ করিলাম, আমার অসম্মতির কোনও কারণ নাই। আপনি যেদিন বলিবেন, সেই দিনই যাত্রা করিব, কিন্তু একটা কথা এখনও বুঝিতে পারি নাই, মনে করুন, আমি সৌভাগ্যক্রমে আমাদের বোটের উপর চড়াও করিলাম, কিন্তু আমাদের ত চারিদিকে দৃষ্টি রাখিয়া কার্য্য করিবে, বোটের মাঝি-মাল্লারাও তাহার অনুগত। এ অবস্থায় কি কৌশলে বোটখানি দখল করিব?”
এডমিরাল বলিলেন, “আমি তাহার ব্যবস্থা করিব। তুমি মোজাম্বিকে উপস্থিত হইয়া সেখানকার ব্রিটীশ কন্সলের সহিত সাক্ষাৎ করিবে, সে তোমাকে যথাযোগ্য সাহায্য করিবে। তবে তোমাকেও অত্যন্ত সতর্ক থাকিতে হইবে, যেন হাসেন সন্দেহের কোনও অবকাশ না পায়। কাল এ সম্বন্ধে তোমার সঙ্গে আরও অনেক কথা হইবে, আজ আর তোমাকে আটকাইয়া রাখিব না, আজ প্রাণ ভরিয়া স্ফুর্তি করিয়া লও,মোজাম্বিকে এ সকল আমোদ-প্রমোদের সুবিধা নাই।”
ডড্লে এডমিরালকে ধন্যবাদ দিয়া নাচের মজলিসে প্রবেশ করিলেন। তখন মিস এসকাইন অন্য একটি যুবকের সহিত নাচিতেছিলেন। নৃত্য শেষ হইলে ডড্লে তাহার সহিত পুনর্বার বারান্দায় আসিয়া একটি নির্জন কোণে বসিয়া গল্প আরম্ভ করিলেন।
কথা প্রসঙ্গে ডড্লে বলিলে, “মিস্ এসকাইন, আপনার সহিত আজ দৈবক্রমে আমার সাক্ষাৎ হইয়াছে। আবার কখন আমাদের দেখা হবে কি না, কে বলিতে পারে? আপনি বোধ হয় শীঘ্রই ইংলণ্ডে ফিরিয়া যাইবেন" মিস্ এরাইন বলিলেন, “হাঁ, দুই সপ্তাহের মধ্যেই ইংলণ্ডে যাত্রা করিব।
ডড্লে বলিলেন, “আমি তিন দিনের মধ্যেই কেপ টাউন ত্যাগ করিতেছি।”
মিস এরাইন বলিলেন, “বটে। আপনাদের নৌ-বহর কি তবে দক্ষিণ-আফ্রিকা ত্যাগ করিতেছে?”
ডড্লে বলিলেন, “না, আমি বিশেষ কোনও কার্যভার লইয়া স্থানান্তর যাইতেছি। ফিরিয়া আসিয়া আর বুঝি আপনাকে দেখিতে পাইব না।” .
মিস্ এরাইন বলিলেন, “আশা করি, আপনার সময়টা বেশ আনন্দে কাটিবে।”
ডড্লে বলিলেন, “আমি আমোদ করিতে যাইতেছি না, গুরুতর কার্য্যের ভার লইয়া যাইতেছি, কিন্তু আপনার সহিত পুনর্ব্বার দেখা করিবার জন্য আমার হৃদয় ক্রমাগত হাহাকার করিবে।—আপনার সহিত পুনর্বার সাক্ষাৎ হইলে যে কত সুখী হইব—তাহা কি করিয়া বুঝাইব?”
মিস্ এরাইন বলিলেন, “ইহা আমার পক্ষে বড সৌভাগ্যের কথা, কিন্তু আপনি আমার সহিত পুনর্ব্বার সাক্ষাতের জন্য এত উৎসুক কেন, বুঝতে পারিতেছি না। দুই ঘণ্টা পূর্ব্বে ও আপনার সহিত আমার পরিচয় ছিল না বিশেষতঃ আপনি আমার সম্বন্ধে কিছুই জানেন না।”
ডড্লে বিষন্নভাবে বলিলেন, “তা বটে, কিন্তু তথাপি মনে হইতেছে যেন কত দিনের আলাপ। সময়ে সময়ে এমন শুভ মুহূর্তে দুইজনের পরিচয় হইয়া যায় যে, জীবনে তাহা ভুলিতে পারা যায় না।”—ডড়লে বোধ হয় আরও কিছু হৃদয়োচ্ছাস প্রকাশ করিতেন,—কিন্তু বাড়াবাড়ি করিতে তাহার প্রবৃত্তি হইল না। মিস্ এরসকাইন লক্ষপতির দুহিতা না হইলে আরও দুই-একটি কথা বলা চলিত, কিন্তু পাছে তাহার আগ্রহে কেহ কোনরূপ অভিসন্ধি আরোপ করে—এই ভয়ে তিনি জিহ্বা সংযত করিলেন।
এসকাইন ক্ষণকাল নিস্তব্ধ থাকি। ঘরের দিকে চাহিলেন, তার পর ডড্লেকে বলিলেন, “ঐ যে মামা বোধ হয় আমার খোঁজেই এইদিকে আসিতেছেন। তিনি নৃত্যে যোগ দিতে ভালবাসেন না, বসিয়া বসিয়া তাস খেলিতেছিলেন, শেষে বিরক্ত হইয়া বোধ হয় উঠিয়া আসিতেছেন।
উড়লে ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “মিস এরসকাইন, আমার শেষ কথাটা শুনুন আপনার অধিক সময় নষ্ট হইবে না। আজই আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ, সাক্ষাতের পরই বিদায়। হয় ত জীবনে আর আমাদের সাক্ষাৎ হইবে না। আপনাকে একটি কথা জিজ্ঞাসা করিব, আপনি সরল ভাবে উত্তর দিবেন কি?
মিস্ এরাইন বলিলেন, “এ আর শক্ত কথা কি?”
ডড্লে বলিলেন, “যদি ভাগ্যে থাকে ত ভবিষ্যতে-কখন-না-কখন আপনার সহিত আমার দেখা হইতে পারে।”
মিস্ এরাইন বলিলেন “অসম্ভব কি? মনে করুন দেখা হইল, তাহার পর?
ডড্লে বলিলেন, “যদি আমার সে সোভাগ্য হয়, তাহা হইলে আপনি আমার সহিত আলাপ করিয়া সুখী হইবেন?—আমার সহিত মিশিতে আপত্তি —করিবেন না ত?”
মিস এরাইন বলিলেন, “আপত্তি কি?—আর আপনার মত রসিক সুজনের সহিত আলাপ করিয়া কেনই বা দুঃখিত হইব?—আমার কথা শুনিয়া খুশি হইয়াছেন ত?—ঐ যে মা আসিয়াছেন, এখন বাড়ী যাইব।
ডাক্তার ল্যাম্পিয়ন সেই স্থানে উপস্থিত হইলে মিস এরসকাইন তাকে বলিলেন, “মামা, আপনি মিঃ ডড্লেকে চেনেন কি?”
ডাক্তার বলিল, “হ্যাঁ, উহার সহিত পূর্বে দেখা হইয়াছিল।” উভয়ে পরস্পরের মুখের দিকে চাহিল, কিন্তু উভয়েই পরস্পরকে সন্দেহের চক্ষে দেখিল, যেন তাহাদের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপন অসম্ভব।
মিস এসকাইন ডড্লের নিকট বিদায় লইলেন, যাইবার সময় বলিলেন,, “আশা করি পুনর্বার আমাদের সাক্ষাৎ হইবে, তখন আপনার গল্প শুনিব। আপনি যে কার্যে যাইতেছেন তাহাতে সিদ্ধিলাভ করুন।”