নারী-চরিত/রুসিয়াধীশ্বরী ক্যাথারিন

রুসিয়াধীশ্বরী ক্যাথারিন।

 ১৬৮৯ খৃষ্টাব্দে রুসিয়ার অন্তর্ব্বর্ত্তী নিভোনিয়া প্রদেশের ডারপট্‌ নামক এক ক্ষুদ্র নগরে এনেক্‌জোনা ক্যাথারিনের জন্ম হয়। তদীয় দীন হীন জনক জননী কৃষি কার্য্য অবলম্বন করিয়া সংসার যাত্রা নির্ব্বাহ করিতেন। তাঁহারা প্রতিনিয়তই ধর্ম্মানুশীলন, জ্ঞানালোচনা এবং সংসারের সমুন্নতি বিষয়ে একান্ত যত্নবান্ ছিলেন বলিয়া ক্যাথারিন্ও শৈশব কালাবধি সাধুতা, সুশীলতা ও ধর্ম্মপরায়ণতা প্রভৃতি পৈতৃক সদ্গুণ সমূহের অধিকারিণী হইয়াছিলেন। শৈশব কালেই তাঁহার পিতার মৃত্যু হয়। পিতার এরূপ কোন সংস্থান ছিল না, যে তদ্বারা সংসার যাত্রা নির্ব্বাহ হইতে পারে। অধিক বয়স হওয়াতে তাঁহার জননীও আয়াসসাধ্য কোন কার্য্য করিতে সমর্থ ছিলেন না; সুতরাং ক্যাথারিনের উপরই সংসার নির্ব্বাহের সমুদায় ভার পড়িল। প্রতি দিবস সূতা কাটিয়া যে কিছু উপার্জ্জন হইত তদ্দ্বারা কোন প্রকারে আপনাদিগের দিন পাত করিতেন।

 ক্যাথারিন্ যখন গৃহে বসিয়া কাট্‌না কাটিতেন, তৎকালে তাঁহার বর্ষীয়সী মাতা নিকটে উপবিষ্ট হইয়া ধর্ম্মপুস্তক পাঠ করিতেন এবং কন্যাকে নানা প্রকার নীতিশিক্ষা দিতেন। দিবাবসানে উভয়ে প্রফুল্ল চিত্তে শাকান্ন ভোজন করিয়াই পরম সন্তোষ প্রকাশ করিতেন। ফলতঃ অসন্তোষ কাহাকে বলে, তাহা তাঁহাদিগের হৃদয়ঙ্গম ছিল না। বিদ্যানুশীলন ব্যতিরেকে কুসংস্কার দূরীভূত হইয়া জ্ঞানোদয় হইবার উপায়ান্তর নাই; ইহা ক্যাথারিনের মাতা বিলক্ষণ অবগত ছিলেন; সুতরাং যাহাতে কন্যার শিক্ষাকার্য্য নির্ব্বাহ হয় তজ্জন্য তিনি বিশেষ রূপে যত্নবতী থাকিতেন। ক্যাথারিন্ প্রথমতঃ মাতৃসন্নিধানে স্বদেশীয় ভাষা শিক্ষা করিতে আরম্ভ করেন। পরে ধর্ম্মশিক্ষা করাইবার নিমিত্ত, তাঁহার মাতা এক বৃদ্ধ ধর্ম্মাধ্যক্ষের নিকট তাঁহাকে নিযুক্ত করিয়া দিলেন। কাল প্রভাবে অপূর্ব্ব লাবণ্যের সহিত ক্যাথারিনের মনোবৃত্তি সকলও ক্রমশঃ বিকশিত হইল। তদীয় অলৌকিক সৌন্দর্য্য ও অসাধারণ গুণগ্রাম দর্শনে অনেকানেক সমৃদ্ধিশালী কৃষককুমারেরা পাণিগ্রহণ লালসায় গমনাগমন করিতে লাগিল। ক্যাথারিন্‌ বৃদ্ধ মাতাকে অতিশয় ভাল বাসিতেন, বিবাহ করিলে পাছে তাঁহার সহিত স্বতন্ত্র হইতে হয়, এই ভাবিয়া তিনি তৎকালে পরিণয় বিষয়ে ক্ষান্ত হইলেন।

 ক্যাথারিনের পঞ্চদশ বৎসর বয়ঃক্রম কালে, তদীয় মাতা পরলোক যাত্রা করেন, তাহাতে তিনি একেবারে নিরুপায় ও অসহায় হইয়া পড়িলেন। একাকী বাস করা অতিশয় কষ্টসাধ্য ভাবিয়া, আপন পর্ণকুটীর পরিত্যাগ পূর্ব্বক, সেই বৃদ্ধ যাজকের বাটীতে গিয়া অবস্থিতি করিলেন। বৃদ্ধ যাজকের কএকটী কন্যা ছিল, ক্যাথারিন্ তাহাদের তত্ত্বাবধায়কতা পদে নিযুক্ত হইয়া যথানিয়মে শিক্ষা দিতে লাগিলেন। ধর্ম্মাধ্যক্ষ তাঁহাকে কন্যার ন্যায় স্নেহ করিতেন, ওঅবসর কালে ধর্ম্ম বিষয়ে নানা প্রকার উপদেশ দিতেন। কিছুকাল পরে সেই দয়ালু ধর্ম্মাধ্যক্ষের পরলোক প্রাপ্তি হইলে ক্যাথারিন্ বিষম বিপদে পতিত হইয়া পুনর্ব্বার উদরান্নের নিমিত্ত লালায়িত হইলেন।

 এই সময়ে রুসিয়াধীশ্বরের সহিত সুইডিস্ জাতির ঘোরতর সংগ্রাম উপস্থিত হয়। উভয় দলের যুদ্ধ ও লুণ্ঠন দ্বারা নিভোনিয়া নগর উৎসন্ন হইবার উপক্রম হইল; খাদ্যদ্রব্য সকল দুর্ম্মূল্য ও দুষ্পাপ্য হওয়ায় নগরবাসিদিগের অত্যন্ত ক্লেশ ঘটিয়া উঠিল। বিশেষতঃ দুঃখীলোকদিগের দুঃখের আর পরিসীমা রহিল না। ক্যাথারিনের এমন কোন সংস্থান ছিল না, যে এই ভয়ানক সময়ে তথায় বাস করিয়া, কোন রূপে জীবিকা নির্ব্বাহ করেন। যে কিছু সঞ্চয় হইয়াছিল, তাহা ক্রমে ক্ষয় পাওয়াতে কয়েক খানি পুরাতন বস্ত্র এক পেটীকামধ্যে লইয়া তিনি সাহায্য প্রাপ্তির প্রত্যাশায় মেরিয়েন বর্গ নগরে পদব্রজে যাত্রা করিলেন। অনন্তর যাইতে যাইতে পথিমধ্যে এক সুবিস্তীর্ণ প্রান্তরে উপনীত হন। তথায় রুসীয় ও সুইডিস্‌ লোকেরা, উভয়েই আপনাদিগকে তৎপ্রদেশের অধিকার জানিয়া, পলায়িত পথিকদিগের সর্ব্বস্ব লুণ্ঠন ও তাহাদিগের প্রতি নিতান্ত অত্যাচার করিতে আরম্ভ করিয়াছিল। ক্যাথারিন্ তৎকালে ক্ষুধাতৃষ্ণায় এরূপ কাতর ও উম্মনা হইয়াছিলেন; যে সেই দুরাত্মাদিগের মধ্য দিয়া গমন করিতে অণুমাত্র ভীত হন নাই।

 একদা সায়ংকালে ক্যাথারিন্‌ অনতিদূরে এক কুটীর দেখিতে পাইয়া, রাত্রিযাপন মানসে তথায় যাইতেছেন এমন সময়ে দুই দুর্ব্বৃত্ত সৈনিকপুরুষ তাঁহাকে আক্রমণ করিতে উদ্যত হইল। সৌভাগ্যক্রমে সহসা এক জন সেনানায়ক সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন। সেনাপতি এই সহায়হীনা বালিকার দুরাবস্থা দর্শনে দয়ার্দ্রচিত্ত হইয়া তাঁহার নিকট আগমন করিলে, দুর্ব্বৃত্তেরা ভীত হইয়া, পলায়ন করিল। সুশীল ক্যাথারিন্ এই উপস্থিত বিপদ হইতে মুক্ত হইয়া, স্বীয় উদ্ধারকর্ত্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করিবার জন্য শশব্যস্ত এবং কি করিয়াই বা সেই সদয়হৃদয় সেনাপতিকে পরিতুষ্ট করিবেন, তাহা স্থির করিতে না পারিয়া, নিতান্ত সঙ্কুচিত হইতেছিলেন। পরে পরিচয় পাইয়া অবগত হইলেন, যে তিনি তাঁহার পূর্ব্ব প্রতিপালক বৃদ্ধধর্ম্মাধ্যক্ষের পুত্র। তখন তাঁহার আর আনন্দের পরিসীমা রহিল না। ক্যাথারিনের যাহা কিছু অর্থ ছিল, ক্রমশঃ নিঃশেষ হওযাতে প্রায় রিক্তহস্ত হইয়াছিলেন। পথিমধ্যে যে যে স্থানে কিঞ্চিম্মাত্র উপকৃত হন, তত্রত্য অতিথিসেবকদিগের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের চিহ্ন স্বরূপ, আপন জীর্ণ বস্ত্র দিয়াছিলেন, সুতরাং তাঁহার আর দ্বিতীয় পরিধেয় বসনও ছিল না। যুবক সেনানায়ক, তাঁহার দুরবস্থা দর্শনে দয়ার্দ্র হইয়া কতিপয় মুদ্রা, কএক খানি বস্ত্র ও মেরিয়েনবর্গনগরের অধ্যক্ষ, আপন পিতৃ বন্ধুকে এক খানি অনুরোধ পত্র লিখিয়া দিলেন।

 ক্যাথারিন্‌, মেরিয়েনবর্গ নগরে উপস্থিত হইয়া তথাকার অধ্যক্ষকে পত্র প্রদান করিলেন। তিনি সাতিশয় সমাদর সহকারে আপন বাটীতে অবস্থিতি করিতে তাঁহাকে অনুমতি করেন। অনন্তর ক্রমে ক্রমে তাঁহার অসামান্য গুণের পরিচয় পাইয়া সন্তোষ প্রদর্শন পূর্ব্বক আপন দুহিতা দ্বয়ের পাঠনা কার্য্যে নিযুক্ত করিলেন। ক্যাথারিন্ তাহাদিগকে শিক্ষাদান করিয়া সবিশেষ সুখ্যাতি লাভ করিয়াছিলেন।

 অনন্তর তাঁহার বিপদবান্ধব, সেই সেনানায়ক তথায় উপস্থিত হইলে, তাঁহার সহিত ক্যাথারিনের বিবাহ কার্য্য সমাধা হইল। দুরবস্থার সময়ে সহসা সৌভাগ্যের উদয় হওয়া, অসাধারণ আনন্দের বিষয় সন্দেহ নাই; কিন্তু ক্যাথারিনের পক্ষে তাহার সম্পূর্ণ বৈলক্ষণ্য সঙ্ঘটন হইল। যে দিনে তাঁহাদিগের পরিণয় কার্য্য সমাধা হয়, সেই দিবসই রুসিয়ানেরা মেরিয়েনবর্গ নগর আক্রমণ করাতে, সেনাপতি আপন সৈন্য সমভিব্যাহারে রণক্ষেত্রে গমন করিলেন, কিন্তু আর প্রত্যাগত হইলেন না। তখন ক্যাথারিন্ কি করিবেন, কোথায় যাইবেন কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, পুনর্ব্বার সেই নগরাধ্যক্ষের বাটীতে গমন করিয়া আশ্রয় যাচ্‌ঞা করিলেন। ইতিমধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। কি দীন, কি ধনী, কি সৈনিক, সকলেই এক দশা প্রাপ্ত হইয়া আপন আপন জীবন রক্ষা বিষয়ে নিতান্ত ব্যাকুল।

মেরিয়েনবর্গ নগর হস্তগত হইলে, জয়কারীরা দুর্গমধ্যেই যে কেবল অত্যাচার করিতে আরম্ভ করিল এমত নহে, নগরবাসি আবালবৃদ্ধ, যাহাকে সম্মুখে পাইল, তাহাদিগেরই রুধিরধারে পৃথিবী প্লাবিত করিল। ক্যাথারিন্‌ এই দুর্দ্দৈব সময়ে এক রুটিবিক্রেতার তন্দুর মধ্যে লুক্কাইত হইয়াছিলেন। বিদ্রোহ নিবৃত্তি ও উপদ্রব শান্তি হইলে, তিনি তথা হইতে বহির্গত হইলেন।

 দুঃখ, দুর্ভাগ্যের অনুগামী। ক্যাথারিন্‌ একাল পর্য্যন্ত অতিশয় হীন অবস্থায় কাল যাপন করিতেছিলেন; কিন্তু কখনই স্বাধীনতা রূপ অনুপম সুখে বঞ্চিত হন নাই, এক্ষণে, তন্দুর মধ্য হইতে বহির্গত হইবামাত্র, এক সৈনিকপুরুষ কর্ত্তৃক ধৃত হইয়া অবিলম্বে দাসত্ব শৃঙ্খলে বদ্ধ হইলেন। তখন তিনি উপায়বিহীনা হইয়া সেই সৈনিক পুরুষের বাটীতে, পিঞ্জর বদ্ধ বিহঙ্গের ন্যায় কালহরণ করিতে লাগিলেন। তিনি, এরূপ জ্ঞানালোকসম্পন্না ছিলেন, যে এই অভিনব দুরবস্থায় পতিত হইয়াও এক মুহূর্তের জন্যে তাঁহার অন্তঃকরণ বিচলিত বা দুঃখিত হয় নাই। নিয়ত কর্ত্তব্য সাধন ও ধর্ম্ম চর্চ্চায় নিবিষ্ট থাকাতে, তিনি আপন প্রভুর যথেষ্ট অনুগ্রহ লাভ করিয়াছিলেন। ক্রমে ক্রমে তাঁহার সুখ্যাতি প্রচারিত হইলে রুসীয় সেনাপতি মেঞ্জিকফ্‌ তদীয় প্রভুর নিকট হইতে তাঁহাকে ক্রয় করিয়া আপন সহোদরার সেবায় নিযুক্ত করিয়া দেন।

 সেনাপতি ও তদীয় ভগিনী, ক্রমে ক্রমে তাঁহার সদ্গুণ সমূহের পরিচয় পাওয়াতে, তাঁহার প্রতি অত্যন্ত স্নেহ করিতে লাগিলেন। এইরূপে প্রধান সেনানীর বাটীতে এক প্রকার সুখে থাকিয়া কাল যাপন করেন; একদা রুসিয়াধিপতি মহান্ পিতর[] নিমন্ত্রিত হইয়া সেনাপতির বাটীতে মধ্যাহ্ন ভোজনে বসিয়াছেন; এমন সময়ে ক্যাথারিন্ কতকগুলি শুষ্ক ফল হস্তে লইয়া, সম্মুখে দণ্ডায়মানা হইলে সম্রাট্‌ তদীয় নিরুপম রূপলাবণ্য সন্দর্শনে অত্যন্ত চমৎকৃত হন। অনন্তর আহারাদি ক্রিয়া সমাপিত হইলে মহারাজ আপন ভবনে প্রতিগমন করেন। পর দিবস সম্রাট্‌ কর্তৃক দূত প্রেরিত হইলে ক্যাথারিন্ অবিলম্বে রাজ সন্নিধানে গমন করিলেন। রুসিয়াধিপতি, তাঁহাকে যথেষ্ট সমাদর সহকারে অভ্যর্থনা করত তদীয় জন্ম ও অবস্থাদির বিবরণ জিজ্ঞাসা করিলেন। তাহাতে ক্যাথারিন্ এরূপ সুশীলতা, বিনয় ও নম্রতা প্রদর্শন পূর্ব্বক আপনার সমুদায় বৃত্তান্ত বর্ণন করিয়াছিলেন যে সম্রাট্‌, বাহ্য সৌন্দর্য্য অপেক্ষা তদীয় আন্তরিক উৎকৃষ্টতর গুণ গরিমার পরিচয় প্রাপ্ত হইয়া অতিশয় আশ্চর্য্যান্বিত হন এবং মনে মনে তাঁহার পাণিগ্রহণের অভিলাষ করেন। ইতিপূর্ব্বে যিনি উদ্বাহ বিষয়ে সমস্ত সভাসদের অনুরোধ উপেক্ষা করিয়াছিলেন; তিনিই অধুনা ক্যাথারিনের আন্তরিক গুণের বশীভূত ও একান্ত অনুরাগী হইয়া অবাধে তাঁহার পাণি পীড়ন করিতে কৃতসঙ্কল্প হইলেন। ক্যাথারিন্‌ নীচবংশসম্ভূতা বলিয়া, মহারাজ তাঁহার করগ্রহণে কোন অপমানের বিষয় বিবেচনা করেন নাই, বরং এরূপ গুণবতী কামিনী সহধর্ম্মিণী হইল, ইহা মনোমধ্যে আন্দোলন করত প্রতিক্ষণেই আনন্দ অনুভব করিতে লাগিলেন।

 ১৭১২ খৃষ্টাব্দে রুসিয়ার রাজধানী সেণ্টপিতরবর্গ নগরে মহাসমারোহ পূর্ব্বক তাঁহাদিগের বিবাহ কার্য্য সমাধা হয়। যে দিবস মহানপিতর উদ্বাহ সূত্রে বদ্ধ হইলেন, সেই দিবসেই তাঁহাকে তুরস্কদিগের সহিত যুদ্ধ যাত্রা করিতে হইয়াছিল। এই যুদ্ধে ক্যাথারিন্ অপরিসীম সাহসিকতা সহকারে মহারাজের মন্ত্রীকার্য্য সম্পাদন করিলেন। একদা রুসিয়াধিপতির সৈন্যগণ, কোন বিপদ্‌ সঙ্কুল স্থানে উপস্থিত হয়; সেই স্থান এরূপ দুর্গম ও ভয়াবহ যে অবিলম্বে সকলের প্রাণনাশের সম্ভাবনা হইয়া উঠিল। তখন যাবতীয় সেনাপতি একত্র হইয়া নানাবিধ উপায় কল্পনা করিয়াওয়াও উদ্ধার বিষয়ে কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না কিন্তু ক্যাথারিন্ তাহাতে হতাশ না হইয়া তৎক্ষণাৎ কতকগুলি বহুমূল্য রত্ন, তুরস্কপতির নিকট প্রেরণ পূর্ব্বক সন্ধি স্থাপন করত সেই দুর্গম স্থান হইতে সকলের প্রাণ রক্ষা করিলেন। অসাধারণ ধীশক্তি সম্পন্না ক্যাথারিনের এইরূপ বুদ্ধি কৌশলে, সেনাসমূহের জীবন রক্ষা হওয়াতে, জন সাধারণ প্রফুল্ল চিত্তে তাঁহার গুণকীর্ত্তন করিতে লাগিল। মহান্‌পিতর, তাঁহার অপরিসীম বিবেক শক্তির ভূরি ভূরি প্রশংসা করিয়া ১৭২৪ খৃষ্টাব্দে প্রাচীন রাজধানী মস্কাউ নগরে মহাসমারোহ পূর্ব্বক তাঁহাকে আপন সিংহাসনে উপবিষ্ট করাইলেন।

 ক্যাথারিন্‌, অতি নম্র ও স্বভাবতঃ দয়াশীলা ছিলেন, অতি সামান্য অবস্থা হইতে সর্ব্ব প্রধান সাম্রাজ্যের অধীশ্বরী হইয়াও কখন অহঙ্কারের বশবর্ত্তিনী হন নাই। মহানপিতর আপন প্রজাপুঞ্জের অবস্থার উন্নতি চেষ্টায় যেরূপ যত্নবান্‌ ছিলেন; ক্যাথারিন্‌ সেইরূপ অধ্যবসায় সহকারে স্বজাতীয় অবলাকুলের মঙ্গল সাধন বিষয়ে একান্ত অনুরাগিণী হইয়াছিলেন। কেবল তাঁহারই প্রযত্নে তদ্দেশীয় কামিনীগণের লৌকিক আচার ব্যবহার সংশোধিত ও পরিচ্ছদ পরিবর্ত্তিত এবং সামাজিক উৎকৃষ্টতর নিয়ম সকল সংস্থাপিত হইয়াছিল। সেই দেশে ‘‘নারীসমাজ” স্থাপন, নারীগণের বিদ্যা ও গুণানুসারে উপাধি প্রদান ও তাহাদিগের মধ্যে ধর্ম্মোন্নতি সংশোধন করিয়া পরিশেষে ১৭২৭ খৃষ্টাব্দে ৪৪ বৎসর বয়ঃক্রম কালে কালগ্রাসে পতিত হন। তদীয় মৃত্যু সংবাদ শ্রবণে রাজ্যের সমস্ত প্রজা অসীম শোক সাগরে নিমগ্ন হইয়াছিল।

 যিনি জন্মাবধি পর্ণ কুটিরে বাস করিয়া আসিতেছিলেন, যাঁহাকে শৈশব কালাবধি উদরান্নের নিমিত্ত লালাইত হইয়া বেড়াইতে হইয়াছিল, যিনি কেবল যৎসামান্য আয়ের দ্বারা জীবিকা নির্ব্বাহ করিতেন, এক্ষণে সৌভাগ্য ক্রমে তিনি এক বিশাল রাজ্যের অধীশ্বরী হইয়া প্রতিদিন অগণ্য দীন জনের যথেষ্ট আহার যোজনা করিতে লাগিলেন। তাঁহার এরূপ উন্নত অবস্থার কারণ কেবল ধার্ম্মিকতা ও সুশীলতা। যদিও তিনি মনুষ্য জীবনের যাবতীয় সুখ—সমৃদ্ধির অধিকারিণী হইয়া ছিলেন, কিন্তু কখন আপনাকে আত্মশ্লাঘা দোষে দূষিত করেন নাই, পূর্ব্বের ন্যায় সর্ব্বদা, আপনাকে সামান্য জ্ঞান করিয়া তিনি সাধারণের সহিত আলাপ পরিচয় করিতেন। “অহঙ্কার, ধন ও উচ্চপদের অনুগামী” এই কথাটা তাঁহার পক্ষে অকিঞ্চিৎকর হইয়াছিল। সিংহাসন আরোহণের পূর্ব্বে তিনি যে সকল সদ্‌গুণের অধিকারিণী ছিলেন তাঁহার অবস্থা পরিবর্ত্তনের সহিত কখন সেই সকল গুণের বৈলক্ষণ্য দৃষ্ট হয় নাই; ফলতঃ তাহারা আজন্মকাল চিরসহচর থাকিয়া তাঁহার দেহের সহিত বিলুপ্ত হইয়াছিল।

  1. পিতর, পরম দেশহিতৈষী ও প্রজারঞ্জন ছিলেন, তিনি ছদ্মবেশে নানা দেশে ভ্রমণ ও প্রজাবর্গের অবস্থা পরিদর্শন করিয়া স্বদেশের সহোন্নতি সাধন করেন, এবং সমস্ত রাজগুণে বিভূষিত থাকায় ‘‘মহনি’’ উপাধি প্রাপ্ত হন।