নারী-চরিত/লেডি জেন্ গ্রে
লেডি জেন্ গ্রে।[১]
১৫৩৬ খৃষ্টাব্দের প্রারম্ভে, ইংলণ্ড দেশে লেডি জেন্গ্রে শরীর পরিগ্রহ করেন। তাঁহার পিতার নাম হেন্রি গ্রে, এবং মাতা ইংলণ্ডাধিপতি সপ্তম হেন্রির পৌত্রী। জেন্গ্রে বাল্যকালাবধি উন্নত অন্তঃকরণ ও সুশীলা ছিলেন। শারীরিক কমনীয়—লাবণ্য অপেক্ষা তদীয় মানসিক সৌন্দর্য্য অতীব উৎকৃষ্ট ছিল। প্রথম পঠদ্দশাতেই স্ত্রীলোকের শিক্ষণীয় সমস্ত বিষয়ে তাঁহার অতি সত্বরেই ব্যুৎপত্তি জন্মে; বিশেষতঃ শিল্পবিদ্যায় তাঁহার অতিশয় নৈপুণ্য থাকাতে তিনি তদ্বিষয়ক নানাবিধ প্রবন্ধ লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন। তাঁহার পিতার দুই জন ধর্ম্মোপদেশক তদীয় অধ্যাপনা কার্য্যের ভার গ্রহণ করিয়া এরূপ শিক্ষা প্রদান করেন যে, তিনি ইংরাজী ফরাসিস, ইটালী ও গ্রীক প্রভৃতি ভাষায় বিশুদ্ধ রূপে লিখিতে এবং পড়িতে পারিতেন। অতি প্রাচীন ভাষা হিব্রু ও আরবিতেও তাঁহার এরূপ অধিকার জন্মিয়াছিল যে কথোপকথন কালে লোকে উক্ত ভাষাকে তাঁহার মাতৃ ভাষার ন্যায় জ্ঞান করিত। অসাধারণ ধীশক্তি ও সুগভীর বিবেচনা শক্তি থাকাতে, জন সমাজে তিনি সবিশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিলেন। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে এবম্বিধ গুণসম্পন্না হইয়াও তিনি স্বকীয় গুণগ্রামের কিঞ্চিন্মাত্র অহঙ্কার করিতেন না বরং অত্যন্ত নম্রশীলা ছিলেন।
সম্রাট্ ষষ্ঠ এড্ওয়ার্ডের সহিত আলাপ থাকাতে, জেন্গ্রে মধ্যে মধ্যে রাজ সভায় ও রাজভবনে গমন করিতেন। সম্রাটেরও তাঁহার প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ ছিল। তিনি রাজ ভবনে অধিক কাল না থাকিয়া পল্লিগ্রামে পিত্রালয়েই বাস করিতেন। তথায় ১৫৫০ খৃষ্টাব্দে সেই গ্রামবাসী রজর আস্কাম নামক এক বিখ্যাত ব্যক্তি জর্ম্মনি দেশে যাইবার সময়, জেনগ্রের সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়া উভয়ের যে কথোপকথন হয়, তাহার সংক্ষেপ বিবরণ রজর সাহেবের ভ্রমণবৃত্তান্ত হইতে প্রকাশ করা যাইতেছে—জর্ম্মনি দেশ গমন করিবার পূর্ব্বে আমি লেডি জেন্গ্রের নিকট বিদায় লইয়াছিলাম। তাঁহার পিতা মাতা, অপরাপর লোকের সহিত মৃগয়ার্থ গমন করিলে আমি তাঁহাকে পাঠাগারে গ্রীক ভাষা অধ্যয়ন করিতে দেখিলাম। অনন্তর কথঞ্চিৎ কথোপকথন হইলে পর, তাঁহাকে মৃগয়া বিমুখতার বিষয় জিজ্ঞাসিলাম। তিনি ঈষৎ হাস্য বদনে উত্তর করিলেন, মহাশয়! অধ্যয়ন জনিত সুখের সহিত তুলনা করিলে, বন—বিহার সুখ অতি অকিঞ্চিৎকর বোধ হয়; ফলতঃ উহাতে পারমার্থিক সুখ কিছুমাত্র নাই। আমি কহিলাম বৎসে! তুমি কি রূপে এপ্রকার গম্ভীর বিদ্যারসে নিমগ্না হইলে তিনি বলিলেন আপনি শ্রবণ করিলে আশ্চর্য্য হইবেন, পরমেশ্বর প্রদত্ত সমস্ত হইতে আমি জনক জননী ও শিক্ষককে সর্ব্ব প্রধান বলিয়া গণ্য করি। আমার প্রতি পিতামাতার সুশাসন ও শিক্ষকের স্নেহ আমার বিদ্যাভ্যাসের মুখ্য হেতু হইয়াছে। এই কথোপকথনের পর আমি তথা হইতে প্রস্থান করিয়াছিলাম।
পরে ১৫৫১ খৃষ্টাব্দে জেন্গ্রের মাতুলদ্বয় পরলোক গমন করিলে তাঁহার পিতা ফোক্স নগরের ডিউক (তদ্দেশীয় কুলিনের উপাধি বিশেষ) উপাধি প্রাপ্ত হইলেন। নৃপতির বার্দ্ধক্য দশায় জেন্গ্রের পিতা ও নর্থম্বর্লণ্ডের ডিউক ভাবিয়াছিলেন যে উত্তর কালে যিনি রাজ পদে অভিষিক্ত হইবেন, তিনি আমাদিগের পদের হানি করিলেও করিতে পারেন; অতএব ভূপতির লোকান্তর হইলে যে কোন প্রকারে পারি আমরা সমস্ত সম্পত্তি অধিকার করিব। এই রূপে কিছুকাল গত হইলে: লেডি জেন্গ্রের সহিত ঐ নর্থম্বর্লণ্ডের ডিউকের পুত্র লর্ড গিণ্ড ফোর্টের বিবাহ প্রদত্ত হইল, কিন্তু এই বিবাহের নিগূঢ় অভিপ্রায় জ্ঞাত হওয়া অন্যের পক্ষে দুরূহ হইয়াছিল; ফলতঃ নববিবাহিত দম্পতী, ইহার বিন্দু বিসর্গও অবগত ছিলেন না। এই বিবাহ উপলক্ষে রাজ ভবনে মহাসমারোহ হইয়াছিল।
অনন্তর অল্প কাল মধ্যে ভূপাল পীড়াক্রান্ত হইলে নর্থম্বর্লণ্ডের ডিউক আপন অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য রাজসমক্ষে উপস্থিত হইয়া কহিলেন, লেডি জেনগ্রে ভিন্ন, আপনার বৈমাত্রেয় ভগিনীদ্বয় রাজ্যের উত্তরাধিকারিণী হইতে পারিবেন না; কারণ জেন্গ্রে আপনার বংশ সম্ভূতা ও নানা গুণে বিভূষিতা; আপনি যদি রাজ্যের মঙ্গল কামনা করেন, তবে আত্মীয়দিগের অনুরোধ পরিত্যাগ করিয়া যোগ্য পাত্রে রাজ্য প্রদান করুন, ইহাতে সর্ব্বসাধারণের সম্মতি আছে। অতঃপর ডিউক এরূপ কয়েক ব্যক্তিকে রাজ সমীপে নিযুক্ত করিয়াদিলেন, যে তাঁহাদের সদ্বক্তৃতায় ও কুহকে পড়িয়া, সম্রাট পিতৃদত্ত দান পত্রের উপেক্ষা এবং ভগিণীদ্বয়কে বঞ্চিত করত নববিনিয়োগ পত্র লিখিয়া লেডি জেন্গ্রেকে রাজ্যাধিকারিণী করিলেন।
তদনন্তর রাজার মৃত্যু হইলে, জেন্গ্রের পিতা ও সেই ডিউক স্থির করিয়াছিলেন যে, যে পর্য্যন্ত সমস্ত রাজ্য নবরাজেশ্বরীর হস্তগত না হয় সেই পর্য্যন্ত রাজ মৃত্যু গোপন করিতে হইবে। তজ্জন্য তাঁহারা মৃত রাজার ভগিনী লেডি মেরিকে প্রবঞ্চনা পূর্ব্বক কারাগার দিবার মানসে সম্রাটের নাম স্বাক্ষর করিয়া এক পত্র প্রেরণ করিলেন। তাহার মর্ম্ম এই—তুমি অতি ত্বরায় আমার গৃহে আসিবে, বিশেষ প্রয়োজন আছে। এই পত্র প্রাপ্তি মাত্র লেডি মেরি অতি সত্বরে যাত্রা করিলেন; কিন্তু রাজা তনুত্যাগ করিয়াছেনয়াছেন, এই সংবাদ পাইয়া অর্দ্ধপথ হইতে প্রত্যাগমন করাতে তাঁহাদের কৌশল হইতে মুক্তি পাইলেন। অতঃপর ঐ ডিউকেরা স্ব স্ব অভীষ্ট সাধন জন্য রাজ্যের সমস্ত প্রজার সহায়তা ও লেডি জেন্গ্রের সম্মতির নিমিত্ত, আরও কিছু কাল রাজ—মৃত্যু গোপন রাখিলেন। পরে জেন্গ্রের নিকট গমন করিয়া কহিলেন আপনি মৃত—রাজ কর্ত্তৃক রাজ্যেশ্বরী হইয়াছেন; রাজমন্ত্রী ও বিচারপতি প্রভৃতি প্রধান প্রধান রাজপুরুষেরা আপনাকে সিংহাসনারোহণের অনুমতি দিয়াছেন অতএব আপনি স্বীয় কোমল করে রাজ্য ভার গ্রহণ করুন। নিরপরাধিনী জেন্গ্রে এই বিষয়ে কিছু মাত্র জানিতেন না, এই অসম্ভবনীয় বার্ত্তা শ্রবণে আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া নিরহঙ্কৃত চিত্তে কহিলেন রাজ-বিধি ও ধর্ম্মশাস্ত্রানুআরে মৃত সম্রাটের ভগিনীরা রাজ্যাধিকার পাইতে পারেন, অতএব অপরের প্রাপ্য বিষয় অপহরণ করিয়া আমি ঈশ্বর ও মনুষ্যের নিকট ঘৃণাস্পদ হইতে ও আপন নামে কলঙ্ক আরোপ করিতে ইচ্ছা করি না। রাজ্য অপহরণ করিয়া সুখজনক ভোগ বিলাস ও বহুমুল্য রাজভূষণ গ্রহণে লোলুপ হইলে শান্তিকে বিনষ্ট করা হয়, বস্তুতঃ আমার জ্ঞানে এক কপর্দ্দক অপহরণ করিলেও মহাপাপ অর্শে, সুতরাং আপনাদিগের দত্ত রাজত্ব রূপ সুবর্ণ শৃঙ্খলে স্বাধীনতাকে আবদ্ধ করিতে আমার অভিলাষ হয় না। যদি আমার প্রতি আপনাদের স্নেহ থাকে, তবে মহাবিপদের মূলীভূত রাজ্যভার না দিয়া আমাকে নিরাপদে ও কুশলে রাখুন।
অবশেষে পিতামাতার উপদেশ ও আত্মীয়গণের যথেষ্ট অনুরোধের বশবর্ত্তিনী হইয়া মহাসমারোহে দুর্গমধ্যে প্রবেশ পূর্ব্বক তাঁহাকে রাজোপাধি গ্রহণ করিতে হইল। কিন্তু অশাস্ত্রীয় বলিয়া এ বিষয়ে তাঁহার অন্তঃকরণে আহ্লাদ জন্মে নাই। তিনি রাজ্যেশ্বরী হইলেন বটে কিন্তু মেঘছায়ার ন্যায় অতি অল্পকাল মধ্যে তাঁহার রাজ্য বিলুপ্ত হইল। যে দিবস জেন্গ্রে সিংহাসনে আরোহণ করেন, তাহার ত্রয়োদশ দিবস পরে মন্ত্রিগণ ও অপরাপর রাজপুরুষেরা মৃত নৃপতির বৈমাত্রেয় ভগিনী লেডি মেরিকে রাজ্যাভিষিক্ত করিলেন। এদিকে জেন্গ্রের পিতা আপন কন্যাকে এই বিষয়ের সংবাদ দিলেন। তাহাতে তিনি নিতান্ত বিষন্ন না হইয়া ধীরভাবে উত্তর করিলেন পিতঃ! আমার পক্ষে পূর্ব্ব বার্তা অপেক্ষা এই সংবাদ অতি আনন্দজনক। এক্ষণে আমি ঈশ্বর ও মনুষ্যের দৃষ্টিতে মহাপাপ হইতে মুক্ত হইলাম। আমি আপনাদিগের বাক্যে এবং আত্মীয়গণের অনুরোধে আপন মনের বিরুদ্ধে, যে অসৎকর্ম্ম করিয়াছিলাম, এক্ষণে প্রফুল্লচিত্তে সেই রাজ-মুকুট পরিত্যাগ করিতেছি। আমি আপন দোষ মোচনে উদ্যোগিনী আছি, ঈশ্বর সন্নিধানে প্রার্থনা করি, যেন আপনাদিগের দোষেরও ক্ষমা হয়।
এই রূপে জেন্গ্রের রাজত্ব ত্রয়োদশ দিবসেই সমাপ্তি, হইল, কিন্তু দুঃখের শেষ হইল না। তাঁহার রাজ্যাভিষেকের সহায়তাকারী ও আত্মীয়-স্বজনগণের সহিত তিনি কারারুদ্ধ হইলেন। তন্মধ্যে কতকগুলির সেই দিবসেই প্রাণদণ্ড হইল। কয়েক দিন পরে তিনি, তাঁহার স্বামী ও এক জন ধর্ম্মাধ্যক্ষ, কারাগার হইতে বিচারালয়ে আনীত হইলেন। অতঃপর বিচারপতি রাজ-বিদ্রোহী অপরাধ জন্য প্রাণদণ্ডের আজ্ঞা দিয়া পুনর্ব্বার তাঁহাদিগকে সেই কারাগারে প্রেরণ করিলেন। যে কয়েক দিন তথায় ছিলেন, তাঁহাদের স্ত্রীপুরুষকে অতিকষ্ট সৃষ্টে কালযাপন করিতে হইয়াছিল। ইতিমধ্যে নবরাজ্ঞী মেরি, তাঁহাদিগকে তত্রস্থ উদ্যানে পাদ বিহারের অনুমতি দেন (আর আর কয়েক বিষয়েও রাজ্ঞা দয়া প্রকাশ করিয়াছিলেন) তাহাতে সাধারণে অনুমান করিয়াছিলেন যে তাঁহাদের উভয়ের প্রাণদণ্ড না হইলেও হইতে পারে। কিন্তু সে আশা ফলবতী হইল না, কয়েক দিবস পরেই তাঁহাদের প্রাণ সংহারের দিন-স্থির হইল। লেডি জেন্গ্রে ইহা শ্রবণ করিয়াও দুঃখিতা বা ব্যাকুলা হন নাই, বরং আপন উন্নত অন্তঃকরণকে ঈশ্বরের দিকে ধাবিত করিয়া ছিলেন। তিনি যে কেবল তৎকালে আপন পারলৌকিক বিষয় চিন্তা করিয়া নিরস্ত হন এমত নহে, কারাগারস্থ অন্যান্য বন্দীগণকেও তদ্বিষয়ক উপদেশ দিয়া ছিলেন। তাঁহার নিধনের দুই দিবস পূর্ব্বে মহিষী মেরি জেন্গ্রেকে এক ধর্ম্মাধ্যক্ষের নিকট মৃত্যু কালীয় বিদায় লইতে পাঠান। তাঁহাদিগের উভয়ের, ধর্ম্ম বিষয়ক যে কথোপকথন হয় তাহা পাঠ করিলে অতি পাষণ্ডেরও হৃদয়ে ধর্ম্ম সঞ্চার হইতে পারে, তাহা খৃষ্টধর্ম্ম মূলক ও অতি বিস্তার।
এই উৎকৃষ্ট কামিনীর জীবন বৃত্তান্ত সমাপ্ত করিবার পুর্ব্বে, তিনি যে একটি প্রার্থনা, রচনা করিয়া আপন ভগিনীকে প্রেরণ করিয়াছিলেন; তাহা এস্থলে প্রকাশ করা গেল—হে ঈশ্বর! আপনি আমার পিতা স্বরূপ এবং সর্ব্বাপেক্ষা মহান্। এই হতভাগিনী দুঃখে পতিত হইয়া আপনার শরণাগত হইতেছে। হে বিশ্বনাথ! যাহারা আপনাকে বিশ্বাস করে আপনি তাহাদের রক্ষাকর্ত্তা, আমি পাপমগ্না, দুঃখ ভারাক্রান্তা, যন্ত্রণায় অস্থিরা ও শোকে আচ্ছন্না হইয়াছি। কর্দ্দম নির্ম্মিত এই কারাগারে অধিক কাল অবস্থিতি, ক্লেশকর বোধ করিয়া আপনকার আশ্রয় প্রার্থনা করিতেছি। হে করুণাময়! আপনি ব্যতীত আমার আর কেহই নাই। আমাদিগের জীবন বহুবিধ পরীক্ষাতে পরিপূর্ণ, আমরা দুঃখার্ণবে মগ্ন হইয়া যত পরীক্ষিত হই, ততই আমরা পারমার্থিক মঙ্গল লাভ করিয়া থাকি। আপনকার প্রত্যাদেশ শাস্ত্রে লিখিত আছে যে, আমাদিগের শক্তির অতিরিক্ত পরীক্ষাতে পতিত হইতে দিবেন না, অতএব আর বিলম্ব না করিয়া এই হতভাগিনীর প্রতি করুণা বিতরণ করুন। ইস্রায়েল বংশীয় মহারাজ সুলেমানের ন্যায় আমি বিনীত ভাবে বিনয় করিতেছি যে আমাকে ধনাঢ্য করিও না; তাহা হইলে আপনাকে অস্বীকার করিয়া বলিব, ঈশ্বর কে? কিম্বা দরিদ্র হইলে তন্নিবন্ধন চুরি করিব ও ঈশ্বরের নাম নিরর্থক বলিব,,
হে করুণানিধান ঈশ্বর! আমার কাতরোক্তি শ্রবণ করিয়া এমত শক্তি প্রদান করুন, যেন আর আমি আপনকার আজ্ঞা লঙ্ঘন করিয়া মন্দ কর্ম্মে রত না হই। এই মহা দুঃখার্ণব হইতে উদ্ধার করিয়া দয়া বিতরণ পূর্ব্বক রক্ষা করুন। যেমন ফেরোর দণ্ড যন্ত্রণা হইতে, আপনি ইস্রায়েল বংশ সমূহকে উদ্ধার করিয়াছিলেন (ফেরোরা এই প্রায় ৪৩০ বৎসর অত্যাচার করিয়া যাহাদিগকে দাসত্ব শৃঙ্খলে বদ্ধ করিয়াছিল।) সেই রূপ কারুণিক হইয়া অনাথাকে দুঃখ ভারাক্রান্ত দাসত্ব শৃঙ্খল হইতে মুক্ত করুন। নচেৎ অতি সত্বরেই আমার আত্মাকে আপনি গ্রহণ করুন।
হে করুণাময় পিতঃ! আমি দয়া পাইতে নিরাশ হইব না, ইহা বিশ্বাস করি; অতএব ধৈর্য্যাবলম্বন পূর্ব্বক আপনকার দয়ার প্রতীক্ষা করিতেছি; নিশ্চিত জানি যে আপনি এই অধীনীকে মুক্ত করিবেন। কারণ আমার প্রতি আপনকার কৃপাদৃষ্টি আছে, এক্ষণে আমার প্রতি যাহা কর্ত্তব্য হয় তাহাই করুন। আপনি যে অবস্থায় রাখিবেন সে অবস্থা আমার পক্ষে সুখকরী হউক কিংবা ক্লেশদায়িনী হউক তাহাতেই আমি সন্তুষ্ট হইব। বোধ করি আপনি আমার মঙ্গল করিবেন, অমঙ্গল কখনই করিবেন না। হে দয়াময়! আমার প্রার্থনা এই। যিনি আমাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত জন্য প্রাণ দান করিয়াছেন, তাঁহার, আপনকার এবং ধর্ম্মাত্মার মহিমা ও গৌরব অনন্তকাল স্থায়ী হউক।
লেডিজেন্, তাঁহার প্রাণদণ্ডের পূর্ব্ব রজনীতে গ্রীক ভাষার ধর্ম্ম পুস্তকের অন্তভাগের একটী সাদা পৃষ্ঠায় পত্র লিখিয়া, সেই গ্রন্থখানি আপন ভগিনী ক্যাথারিন্কে প্রেরণ করেন, তাহাতে এই লিখিয়াছিলেন—হে প্রিয় ভগিনী ক্যাথারিন্! আমি কায়মনে সর্ব্বদা ঈশ্বর সন্নিধানে তোমার মঙ্গল প্রার্থনা করিতেছি। তোমার নিকট এই যে পুস্তক খানি পাঠাইতেছি, যদিও ইহার পৃষ্ঠদেশ স্বর্ণে মণ্ডিত নহে, কিন্তু ইহার অভ্যন্তর মণি মুক্তা অপেক্ষাও উৎকৃষ্টতর পদার্থে পরিপূর্ণ। এই পুস্তকে ঈশ্বরের আজ্ঞা লিখিত আছে, ইহা সর্ব্বস্রষ্টার ধর্ম্মপুস্তক এবং দান পত্র, যাহাতে তুমি অপার আনন্দ পাইতে পারিবে। যদ্যপি সরলান্তঃকরণে পাঠ করিয়া দৃঢ় মানসে ইহার অনুসরণ কর, তাহা হইলে অক্ষয় জীবন প্রাপ্ত হইতে পারিবে। ঈশ্বরের ও মনুষ্যের প্রতি কি করা কর্ত্তব্য, এই বিশ্বরাজ্যে বাস কালে এবং মৃত্যু সময়ে কি রূপ অন্তঃকরণ হওয়া উচিত ইহা শিক্ষা পাইবে। পৈতৃক বিষয়াপেক্ষা ইহাতে তুমি উৎকৃষ্ট বিষয় পাইতে পারিবে অর্থাৎ পরমেশ্বর যদি তোমার পিতার উন্নতি করেন, তাহা হইলে তাহারি তুমি অধিকারিণী হইবে। মনোনিবেশ পূর্ব্বক এই পুস্তক খানি পাঠ করিয়া যদি ঈশ্বরেতেরেতে আত্মা সমর্পণ কর, তাহা হইলে তুমি এমত ধনের অধিকারিণী হইবে, যে তাহা তস্করেরা অপহরণ ও কীটাদিতে বিনাশ করিতে পারিবে না। হে প্রিয় ভগিনি! দরিদ্রের ধনাকাঙ্ক্ষার ন্যায় ঈশ্বরের প্রিয় কার্য্য করিতে তৎপরা হও এবং তরুণ বয়স বলিয়া উপেক্ষা করিও না, কারণ পরমেশ্বর ইচ্ছা করিলেই কি যুবা কি বৃদ্ধ সকলকেই কালের করাল গ্রাসে পাতিত করিতে পারেন। সর্ব্বনিয়ন্তার প্রতি আত্মা সমর্পণ পূর্ব্বক সানন্দ চিত্তে থাক, পাপ করিলে অনুতাপ কর, এবং দৃঢ় বিশ্বাসি হও, কিন্তু দুঃসাহসী হইওনা, পরকালে স্বর্গলাভ হইবে। পরিশেষে ঈশ্বর সন্নিধানে এই প্রার্থনা করি, যে তুমি সত্যপথাবলম্বিনী হইয়া অন্তে অনন্ত জীবনের পাত্রী হও।
১৫৫৪ খৃষ্টাব্দের ১২ ই ফেব্রুয়ারিতে তাঁহাদিগের প্রাণ দণ্ডের দিনস্থির হইল। লেডি জেনের স্বামী তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার অভিলাষ জানাইলে, তিনি অস্বীকৃত হইয়া উত্তর করিলেন, যে এসময়ে সাক্ষাৎ করিলে যন্ত্রণা বৃদ্ধি এবং পরলোকে গমন করিবার জন্য আমাদিগের আত্মা যেরূপ প্রস্তুত আছে, তাহার বৈলক্ষণ্য ঘটিবে অতএব আপনি সাহস ও দৃঢ়তা অবলম্বন করুন। যদ্যপি আপনি স্থির ও দৃঢ় চিত্ত না হন, তাহা হইলে আমার সন্দর্শন ও মধুর বচন আপনাকে সান্ত্বনা দিতে পারিবে না। স্বর্গেতে আমি আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া এই তাপিত জীবন শীতল করিব ও তথায় নিষ্কণ্টকেণ্টকে বন্ধুত্ব করিতে পারিব। পরে তাঁহার স্বামী, প্রাণ দণ্ড স্থলে গমন করিবার সময়, তিনি গবাক্ষ দ্বার হইতে তাঁহার নিকট চির বিদায় লইলেন। তদন্তর স্বামীর মৃত দেহ সন্দর্শন করিয়া দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ পূর্ব্বক সাতিশয় বিলাপ করিয়াছিলেন। এই ঘটনার এক ঘটিকা পরে লেডিজেন্, এক জন ধর্ম্মাধ্যক্ষের সহিত বধ্য-ভূমিতে আনীত হইলেন। তাঁহাদের স্ত্রীপুরুষেরি একত্রে প্রাণদণ্ড হইত কিন্তু পাছে দেশস্থ সমস্ত লোকে হাহাকার ও মহাবিলাপ করে, এজন্য রাজপুরুষেরা বিভিন্ন স্থানে ও সময়ে তাঁহাদিগের নিধন সাধন করিতে বাধ্য হইলেন। যাহা হউক মৃত্যুর অল্পকাল পূর্ব্বে তিনি, সমাগত রোরুদ্যমান ব্যক্তি সমুহকে সম্বোধিয়া এই সকল কথা বলিয়াছিলেন—হে সাধুমণ্ডলি! পিতা মাতা কর্ত্তৃক আমি মহারাণীর মহিমার বিরুদ্ধে অবৈধ কর্ম্ম করিতে স্বীকৃতা হইয়াছিলাম, যদ্যপি আমার ইচ্ছাবশতঃ এই মহাপাপে লিপ্ত হইয়া থাকি তাহা হইলে পরমেশ্বরের এবং তোমাদিগের নিকট আমি ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি। হে সহধর্ম্মাবলম্বি ভ্রাতৃগণ! আমি সত্য ধর্ম্মে বিশ্বাস পুর্ব্বক প্রাণত্যাগ করিতেছি, যিনি আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত জন্য এই দণ্ড প্রদান করিয়াছেন এক্ষণে তাঁহার নিকট কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিতেছি, কারণ তিনি অনুতাপ করিবার জন্য আমাকে সময় দিয়াছিলেন। হে প্রিয় দর্শকগণ! যদবধি আমি জীবিত আছি, আপনারা আমার সহিত সেই পর্য্যন্ত প্রার্থনা করুন; পরন্তু ভক্তিপূর্ব্বক তিনি জানু অবনত করিয়া ধর্ম্ম পুস্তকের অন্তর্গত গীত সংহিতার ৫১ অধ্যায় পাঠ করিলেন। পরে গাত্র মার্জ্জনী ও দস্তানা দাসীকে প্রদান করত গাত্র বস্ত্র সংযত করিলে, হন্তা নিকটস্থ হইবা মাত্র, তিনি দুইটী ভদ্র মহিলার প্রতি নেত্রপাত করাতে, তাঁহারা এক খানি রুমাল দ্বারা তদীয় চক্ষুরোধ করিয়া দিলেন। অতঃপর কাষ্ঠদণ্ডের উপর দণ্ডায়মানা হইয়া কহিলেন, আশু আমাকে নিপাত কর। তদনন্তর “হে করুণানিধান জগদীশ্বর আপনকার করে আমার আত্মা সমর্পণ করিলাম” অশ্রুপূর্ণ লোচনে ইহা কহিবা মাত্র অম্নি হন্তা কুঠার দ্বারা তাঁহার শিরচ্ছেদন করিল।
এই রূপে তাঁহার মৃত্যু হওয়াতে দেশের সমস্ত স্থানে শোক ও বিলাপে পূর্ণ হইতে লাগিল। ধর্ম্মাধ্যক্ষ বর্ণেট সাহেব লিখিয়াছেন যে লেডি জেনে্র প্রাণদণ্ডের আজ্ঞা দিয়া বিচারপতি মর্গেন সাহেব একেবারে উন্মত্ত হইয়া গিয়াছিলেন। অনন্তর ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে জেন্গ্রের পিতার শিরচ্ছেদন হইল। তাহাতে সাধারণে শোক প্রকাশ করে নাই, কারণ অবলা কূলের তিলক স্বরূপা জেন্গ্রে, উহরি দোষে প্রাণ হারাইয়াছিল।
এই উৎকৃষ্ট কামিনীর অসাধারণ ক্ষমতা এবং ধীর প্রকৃতির বিষয় লিখিতে লেখনী অসমর্থ। ‘‘কথিত আছে তাঁহার ন্যায় সরলচিত্ত বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ এবং রূপবতী, গুণবতী ও দিব্যাবতী রমণী অতি দুর্লভ। এক জন ইতিহাসবেত্তা বলেন, শৈশবের সারল্য, যৌবনের সৌন্দর্য্য, প্রৌঢ়কালের বিজ্ঞতা এবং বৃদ্ধাবস্থার গাম্ভীর্য্য; এই গুণ চতুষ্টয় তাঁহাতে একাধারে সংশ্লিষ্ট হইয়াছিল’’। উক্ত গুণ সমূহ অপেক্ষা তাঁহার ধর্ম্মনিষ্ঠা গুণটী সমধিক উজ্জ্বল এবং প্রধান বলিয়া পরিগণিত। তিনি ঐহিক অপেক্ষা পারলৌকিক চিরসুখকর যশঃ অন্বেষণে তৎপর ছিলেন। অল্প বয়সে নিধন হওয়াতে তাঁহার অধিক গ্রন্থ লিপিবদ্ধ হয় নাই। যে কয়েকটী বিষয় লিখিয়া গিয়াছেন, সে সকল প্রায় তাঁহার জীবন চরিত মধ্যে লিখিত হইয়াছে উক্ত বিষয় গুলি অতিশয় উৎকৃষ্ট এবং ধর্ম্ম সম্বন্ধীয়।
- ↑ ইংলণ্ডের রাজকুলোদ্ভব ও প্রধান প্রধান রাজকর্ম্মচারীদিগকে লর্ড এবং তাঁহাদিগের গৃহিণী বা কন্যাদিগকে লেডি কহে। এক্ষণে কোন মান্যা স্ত্রীতেও ঐ শব্দ ব্যবহার হইয়া থাকে। যথা, লর্ড গিণ্ড ফোর্ট, লর্ড বেকন। লেডি মেরি, লেডি লরেন্স।