হাইপেসিয়া

 অনুমান, খৃষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর অন্তে মিসর দেশের অন্তঃপাতি সেকেন্দ্রিয়া নগরে হাইপেসিয়ার জন্ম হয়। তাঁহার পিতা থিয়ন্‌, দর্শনশাস্ত্রে এক জন সুপ্রসিদ্ধ পণ্ডিত ছিলেন। হাইপেসিয়া শৈশবকালাবধি সুচতুরা ও মেধাবিনী ছিলেন বলিয়া, উত্তরকালে একজন অসামান্য ও অদ্বিতীয় নারী রূপে গণ্য হইবেন, ইহা অনেকেই বিবেচনা করিতেন। থিয়ন্‌ আপন কন্যার ঐরূপ মেধা ও বিদ্যানুরাগ দেখিয়া আহ্লাদিত চিত্তে স্বয়ং তাঁহার শিক্ষকতা কার্যের ভার গ্রহণ করেন। পরে অল্প কাল মধ্যেই হাইপেসিয়া যথাযোগ্য অধ্যয়ন করিলে; তাঁহার পিতা তাঁহাকে গণিত বিদ্যা-শিক্ষায় নিযুক্ত করিয়া দিলেন। ক্রমে ক্রমে ক্ষেত্রতত্ত্ব ও জ্যোঃতিষশাস্ত্রে তাঁহার এরূপ দক্ষতা জন্মিল, যে পণ্ডিত সমাজে তিনি একজন প্রধান বিদ্যাবতী বলিয়া প্রসিদ্ধা হইলেন। স্বাভাবিক সদ্‌গুণে স্ত্রীজাতির মধ্যে তৎকালে, তিনিই গৌরবান্বিতা ও সর্ব্বশ্রেষ্টা বলিয়া পরিগণিত হইয়াছিলেন। স্ত্রীলোকের কথাদুরে থাকুক, এমন কি, সে সময়ে কোন পুরুষও তাঁহার উপমাস্থানীয় হইতে পারেন নাই।

 পূর্ব্বকালে সেকেন্দ্রিয়ানগর বিদ্যালোচনার এক প্রধান স্থান ছিল। তথায় প্রধান প্রধান বিদ্যামন্দির ও সুপ্রসিদ্ধ পণ্ডিত সকল থাকাতে, বিদ্যার্থিগণ নানাদেশ হইতে আগমন করিয়া অধ্যয়ন করিত। তদ্দেশে আগন্তুক পণ্ডিতবর্গের সহিত, হাইপেসিয়ার বিলক্ষণ সদ্ভাব হয়, সুতরাং তিনি তাঁহাদের সহিত কথোপকথনে, সকলেরি মতামত সুন্দর রূপে অবগত হইয়াছিলেন। যিনি ষে বিদ্যার যতদূর উৎকর্ষ সাধন করিয়াছিলেন, হাইপেসিয়া তাঁহার নিকট হইতে সেই বিদ্যা শিক্ষা করিতে ত্রুটী করেন নাই। বাস্তবিক সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও লেখাপড়া শিখিবার ইচ্ছা থাকিলে সকল বিদ্যাই শিখিতে পারা যায়, হাইপেসিয়া তাহার দৃষ্টান্ত স্থল। লেখা পড়া ব্যতীত তাঁহার আর কোন কার্য্যে মনোনিবেশ ছিল না; তিনি অন্যান্য সমুদায় কর্ম্মে একেবারে জলাঞ্জলিঞ্জলি দিয়া অতিশয় যত্ন সহকারে গ্রীস দেশীয় পণ্ডিত প্রধান এরিষ্টট্‌ল কৃত ন্যায়শাস্ত্র ও প্লেটো প্রণীত দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়নে কয়েক বৎসর অতি বাহিত করেন; এবং তাহাতে, তাঁহার এরূপ বুৎপত্তিলাভ হইয়াছিল যে তৎকালীয় পণ্ডিতবর্গ, উক্ত শাস্ত্রের যে সকল অংশ দুরূহ বলিয়া জ্ঞান করিতেন, তিনি অনায়াসে তাহার তাৎপর্য্য ব্যাখ্যা করিতে পারিতেন। কেবল তিনি উক্ত শাস্ত্রদ্বয়েই যে বুৎপন্না হইয়া ছিলেন, এমন নহে, অন্যান্য দর্শনশাস্ত্রেও তাঁহার বিলক্ষণ জ্ঞান জন্মিয়াছিল। এতদ্ভিন্ন সুকুমার বিদ্যা ও বক্তৃতা বিষয়ে এরূপ অধিকার লাভ করিয়াছিলেন, মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিতগণ তাঁহাকে বিদ্যার কল্পতরু বিশেষ জ্ঞান করিতেন। মনুষ্য, যতদুর বিদ্যা উপার্জ্জন করতে পারে তাহার সহিত মনোহর বক্তৃতাশক্তি মিলিত হইলে, সমধিক শোভা পায় সুতরাং যখন তিনি দর্শন ও অন্যান্য শাস্ত্র বিষয়ক বক্তৃতা করিতেন, তখন সহস্র সহস্র লোক এককালে মোহিত হইয়া থাকিত, তন্নিমিত্তে তিনি যে কেবল সাধারণের প্রশংসার পাত্রী হইয়াছিলেন এরূপ নহে, সমস্ত কৃতবিদ্য ও সুবিখ্যাত দর্শনবেত্তাদিগের নিকটেও তিনি সম্পূর্ণ যশঃ ও খ্যাতিলাভ করিয়াছিলেন।

 পূর্ব্বে উল্লেখ করা গিয়াছে যে সেকেন্দ্রিয়ানগরে অতিশয় বিদ্যার চর্চ্চা হইত। ছাত্রগণের জ্ঞানালোচনার নিমিত্ত তথায় বিবিধ বিদ্যালয় সংস্থাপিত হয়; হাইপেসিয়ার পিতা পণ্ডিতবর থিয়ন্‌, তাহার অন্যতম বিদ্যালয়ের এক জন দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি আপন কর্ম্ম হইতে অবসর গ্রহণ করিলে, বিদ্যাবতী হাইপেসিয়া সেই উচ্চপদে অভিষিক্ত হইলেন। যৎকালে তিনি আপন পদে সন্নিবিষ্টা হইয়া শিষ্যগণকে দর্শন শাস্ত্রের উপদেশ দিতেন, সেই সময়ে তদীয় জ্ঞানপূর্ণ সুমধুর উপদেশ শ্রবণের অভিলাষী হইয়া, তথায় বহুপ্রদেশীয় পণ্ডিতগণ সমাগত হইত। এইরূপে ক্রমে ক্রমে তাঁহার সমুজ্জ্বল যশঃপ্রভা, সর্ব্বত্র প্রতিভাত হইলে, পৃথিবীর সমস্ত সভ্য জনপদের বিদার্থিগণ সেকেন্দ্রিয়ানগরে উপস্থিত হইতে লাগিল। ইউরোপ ও আসিয়া হইতে কত ছাত্র যে তাঁহার নিকট অধ্যয়ন করিতে আসিত, তাহার সংখ্যা হয় না। তিনি যেমন বিদ্যাবতী তেমনি সচ্চরিত্রা ও নিরুপম রূপবতী ছিলেন; তাঁহার বিশুদ্ধ চরিত্র ও সদ্গুণ সকল না থাকিলে, তদীয় সৌন্দর্য্যের কথা উল্লেখ করা কখনই সংগত হইত না, কারণ যে নগরে পৃথিবীর নানাপ্রকার লোক মিলিত হইয়াছিল, যে স্থানে দুই প্রধান পক্ষের (পৌতলিক ও খৃষ্ট ধর্ম্মাবলম্বীদিগের) দলাদলি চলিতে ছিল, যথায় হিংসা দ্বেষাদিরও অভাব ছিল না, অবশ্যই তথায় মনুষ্যের চরিত্রে দোষ ঘটিবার সম্ভাবনা, কিন্তু তদীয় বিশুদ্ধ স্বভাবে অনুমাত্র দোষ স্পর্শ হয় নাই। তাঁহার জীবনচরিত লেখক খৃষ্টীয়ান্ ও ভিন্ন ধর্ম্মাবলম্বিগণ এক বাক্যে তদীয় অনুপম উৎকৃষ্ট চরিত্রের বিষয় বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন। ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোকেরা তাঁহার জীবন বৃত্তান্ত এরূপে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, যে যদি তাঁহারা বিশেষ করিয়া না লিখিয়া যাইতেন, তাহা হইলে হাইপেসিয়া কোন্ ধর্ম্মাবলম্বিনী ছিলেন, অদ্যাপিও তাহা নির্ণয়করা দুরূহ হইত, ফলতঃ তাহাদিগের বাক্যানুসারেই তাঁহার পৌত্তলিক ধর্ম্ম সপ্রমান হইয়াছে।

 অশেষ গুণ সম্পন্না হাইপেসিয়া যে জ্ঞান ও বিদ্যার নিমিত্ত সর্ব্বত্র যশস্বিনী হন; এবং যে জন্য দেশের ভূপতিও তাঁহার সহিত বন্ধুত্ব করিতে অসম্মানের বিষয় বোধ করেন নাই, অবশেষে তাহাই তাঁহার বিনাশের হেতু হইল। এতক্ষণ আমরা যাঁহার গুণকীর্ত্তন ও জীবন চরিত পাঠে যথেষ্ট আনন্দ অনুভব করিতেছিলাম, এক্ষণে সেই অসামান্যা কামিনীর মৃত্যুর বিষয় উল্লেখ করিয়া ততোধিক দুঃখিত হইতেছি। তিনি কোন পীড়ায় আক্রান্ত হন নাই, তদীয় নির্ম্মল স্বভাবে এরূপ কোন উৎকট দোষ ঘটিবার সম্ভাবনা ছিল না, যে কোন প্রকারে তিনি দণ্ডনীয় হইতে পারেন। কতকগুলি লোক বিবেচনা করিয়াছিল, যে হাইপেসিয়া রাজাকে কুমন্ত্রণা দিয়া আমাদিগের অপকার চেষ্টা করিতেছেন, এই শঙ্কা প্রযুক্ত, একদা তাহারা দলবদ্ধ হইয়া অকস্মাৎ তাহাকে আক্রমণ করত একেবারে শস্ত্র দ্বারা খণ্ড বিখণ্ড করিল। এই রূপে নারীকুলের গৌরব স্বরূপা হাইপেসিয়া খৃষ্টীয় পঞ্চশতাব্দি প্রারম্ভে প্রাণত্যাগ করেন।