নিগ্রোজাতির কর্ম্মবীর (১৯১৪)/নবম অধ্যায়
নবম অধ্যায়
অর্থচিন্তা ও বিনিদ্র যামিনী
টাস্কেজীবিদ্যালয়ের কার্য্য অগ্রসর হইতে লাগিল। প্রথম বৎসরের উৎসবে আমি নিগ্রো সমাজকে আরও ভাল করিয়া চিনিবার সুযোগ পাইলাম। আমাদের বাড়ীতে বড়দিনের সময়ে রোজ প্রায় ১০০।১৫০ ছেলে মেয়ে আসিত। তাহারা আমাদের নিকট টাকা পয়সা বক্শিষ উপহার ইত্যাদি পার্ব্বণী চাহিত। রাত্রি দুইটা হইতে সকাল পাঁচটা পর্য্যন্ত বালক বালিকাদিগের ভিড় কমিত না। আজও দক্ষিণ অঞ্চলে বড়দিনের আগমনী উপলক্ষ্যে শিশুরা এইরূপ করিয়া থাকে।
গোলামীর যুগে বড়দিনের উৎসবের জন্য নিগ্রোরা সপ্তাহকাল ছুটি পাইত। সেই সময়ে পুরুষেরা মদ খাইয়া পড়িয়া থাকিত। টাস্কেজীতেও দেখিলাম, বড়দিনের একদিন পূর্ব্ব হইতেই নিগ্রোরা কাজ ছাড়িয়াছে। নববর্ষ আরম্ভ না হওয়া পর্য্যন্ত তাহারা কাজে আর ফিরিল না। যাহারা বৎসরে অন্য কোন দিন মদ খাইত না তাহারাও ধর্ম্মের দোহাই দিয়া এ কয়দিন বেশ মাতলামী করিল। পল্লীময় উৎসব, আনন্দ, নৃত্যগান;—কোথায়ও সংযম বা শ্লীলতা কিছুই দেখিলাম না। কেহ কেহ বন্দুক পিস্তল লইয়া শিকারেও বাহির হইল। হায়, ভগবানের জন্মতিথি কি এইরূপ উদ্দামতা উচ্ছৃঙ্খলতা, এবং নির্দ্দয়তার অভিনয়ে উপলক্ষ্যমাত্রে পরিণত হইয়াছে!
সহর ছাড়িয়া জেলার ভিতরকার পল্লীগ্রামের মধ্যে ‘বড়দিন’ দেখিতে গেলাম। এই দরিদ্র সমাজ যীশুর শুভাগমনে কিরূপ উৎসবের অনুষ্ঠান করিয়া থাকে জানিতে ইচ্ছা হইল। কোন কামরায় যাইয়া দেখি কতকগুলি ভূঁই পট্কা ছেলেদের মধ্যে ভাগ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। তাহারা সেইগুলি মাটিতে আছড়াইয়া আওয়াজ করিতেছে। কোন কামরায় গোটা কয়েক কলা ঝোলান আছে। সেইগুলি আট দশ জনে মিলিয়া খাইতে বসিবে। কাহারও ঘরে কয়েকটা আখ দেখিতে পাইলাম। আর এক গৃহস্থ সস্তায় এক বোতল মদ কিনিয়া আনিয়াছে। স্বামী ও স্ত্রী দুই জনে এক সঙ্গে বসিয়া উহা পান করিতেছে। অথচ সেই ব্যক্তি ঐ পল্লীর একজন ধর্ম্মগুরু! কোন কোন গৃহে ছেলেরা নানারংএর ছাপান “কার্ড” লইয়া খেলা করিতেছে। সেই কার্ডগুলি বিশেষ কিছু মূল্যবান্ জিনিষ নয়। বড় বড় সহরের ব্যবসাদারেরা নিজেদের মাল প্রচার করিবার, জন্য ঐরূপ কার্ড ছাপাইয়া নানা স্থানে বিলি করিয়া থাকে। কেহ বা একটা নূতন পিস্তল কিনিয়া পাড়ার মধ্যে তাহা জাহির করাইয়া বেড়াইতেছে।
মোটের উপরে, বুঝিলাম, ইহারা সকলেই কাজ বন্ধ করিয়াছে। যাহার যেরূপ প্রবৃত্তি এবং আর্থিক অবস্থা সে সেইরূপ পান-ভোজন ও আনন্দ উৎসবের উদ্যোগ করিতেছে। রাত্রিকালে সকলে মিলিয়া একটা বাড়ীতে নাচ গান করিবে। সেখানে মদ খাওয়ারও সবিশেষ আয়োজন আছে। শুনিয়াছি এই উদ্দামনৃত্যগীতের আসরে অনেক সময়ে মারপিট এবং রক্তারক্তি পর্য্যন্ত ঘটিয়া থাকে।
বড়দিনের সফর করিতে করিতে এক বৃদ্ধ স্বজাতির সঙ্গে দেখা হইল। সে বলিল, “বুঝিলেন, ইডন উদ্যানে আদমের জীবন লক্ষ্য করিলেই জানা যায় যে, ভগবান্ কাজ কর্ম্ম ভালবাসেন না। এইজন্য আজকাল বড়দিনের সময় সর্ব্বত্রই দিবসব্যাপী উৎসব। কোথায়ও কাজ কর্ম্ম কিছুই দেখিতে পাইবেন না। বাঁচিয়াছি, এ কয়দিন খাটিতে হইতেছে না, হাড় জুড়াইল।” সে আরও বলিল “এক বৎসর কি পাপেই না জীবন কাটিয়াছে—কেন না একদিনও যথার্থ বিশ্রাম পাই নাই। আজ আমার কি পুণ্যের দিন—কিছুই কাজ করিবার ভাবনা নাই।”
নিগ্রোসমাজের ধর্ম্মমত এবং লোকচরিত্র দেখিয়া শুনিয়া আমার কর্ত্তব্য স্থির করিয়া লইলাম। আমার স্কুলে ছাত্রদিগকে বড়দিনের সার্থকতা বুঝাইতে চেষ্টা করিলাম। আমাদের চেষ্টায় পল্লীতে পল্লীতে যথেষ্ট সুফল ফলিয়াছে। আজ ১৫।২০ বৎসর কার্য্যের ফলে দেখিতে পাইতেছি যে, নিগ্রোরা বড়দিনের উৎসবে যথেষ্ট সংযম, শৃঙ্খলা, চরিত্রবত্তা এবং ধর্ম্মভাব রক্ষা করিয়া চলে।
টাস্কেজীবিদ্যালয়ের ছাত্রেরা আজকাল বড়দিনের সময়ে বিশেষভাবে সমাজ-সেবা লোক-হিত এবং পরোপকারের কর্ম্মে লাগিয়া যায়, দুঃখী ও দরিদ্র লোকদিগকে সুখ দিতে তাহারা যথাসাধ্য চেষ্টা করে। সেদিন তাহারা একজন দরিদ্র বৃদ্ধা নিগ্রোরমণীর কামরা নিজ হাতে তৈয়ারী করিয়া দিয়াছে। একজন লোক শীতে জামা অভাবে কষ্ট পাইতেছিল। একথা আমি আমার ছাত্রদিগকে জানাইবামাত্র তাহাদের নিকট দুইটা জামা-পাইলাম।
পূর্ব্বে একবার বলিয়াছি যে, টাস্কেজীর শ্বেতাঙ্গেরাও আমাদের অর্থসংগ্রহের চেষ্টায় সাহায্য করিতেন। আমাদের মুষ্টি ভিক্ষা তাঁহাদের নিকটও আদায় হইত। নগদ টাকাও মাঝে মাঝে তাঁহারা দিতেন। তাহা ছাড়া কুমারী ডেভিড্সন যখনই তাঁহাদের নিকট ভিক্ষার ঝুলি লইয়া হাজির হইতেন তখনই কিছু না কিছু পাইতেন।
আমি প্রথম হইতেই বিদ্যালয়টিকে সমগ্র পল্লীর জীবন-কেন্দ্ররূপে গড়িয়া তুলিতেছিলাম। পল্লীর সকল কাজ কর্ম্মেই বিদ্যালয়ের সম্বন্ধ রাখিতাম। গ্রামের লোকেরা সহজেই বুঝিতে পারিত যে, বিদ্যালয়ের সাহায্যে তাহাদের নানা বিষয়ে উপকার হইতেছে। তাহা ছাড়া উহা সকলেরই সম্পত্তি—টাস্কেজীর সাদা কাল সকলেই উহার মালিক ও কর্ত্তা। সাধারণ জনগণের সৎপ্রবৃত্তিতেই উহার ভিত্তি। কেহই যেন না বুঝিতে পারে যে, কয়েকজন বাহিরের লোক আসিয়া গ্রামের উপর একটা বোঝা চাপাইয়াছে। এই ভাব মনে রাখিয়া আমি বিদ্যালয় চালাইতাম। গ্রামের লোকের উৎসাহ, কর্ত্তব্যজ্ঞান, কর্ত্তৃত্ব ও দায়িত্ববোধ আমি সর্ব্বদাই নানা উপায়ে জাগাইয়া রাখিতাম। জমির মূল্য দিবার জন্য সকলের নিকটই চাঁদার খাতা লইয়া যাইতাম। ইহাতেও তাহারা বিদ্যালয়কে নিজের জিনিষ বলিয়া আদর করিতে অভ্যস্ত হইত। জমির দাম শোধ করিবার জন্য তাহাদিগকেই চেষ্টা করিতে হইবে ইহা জানিবামাত্র তাহারা বিদ্যালয়ের জন্য নূতনভাবে আত্মীয়তার সম্বন্ধ পোষণ করিতে লাগিল। সাদা কাল চামড়ার ভেদ ভুলিয়া যাইয়া সকলেই বিদ্যালয়কে সমস্ত টাস্কেজীর যৌথ প্রতিষ্ঠানরূপে ভাবিতে থাকিল।
শ্বেতাঙ্গদিগের মধ্যে আজ টাস্কেজীর অনেক বন্ধু রহিয়াছেন। আমি প্রথম হইতেই ইহাঁদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্বন্ধ রক্ষা করিয়া আসিয়াছি। দক্ষিণ প্রান্তের নিগ্রোগণকেও আমি এই বন্ধুত্বের সম্বন্ধে শ্বেতাঙ্গদিগের সঙ্গে ব্যবহার করিতে চিরকাল উপদেশ দিয়াছি।
আমরা টাকা তুলিতে লাগিলাম। মেলা, প্রদর্শনী, মুষ্টিভিক্ষা, চাঁদা ইত্যাদি নানা উপায়ে আমরা তিন মাসের মধ্যেই মার্শালের ৭৫০৲ দেনা শোধ করিলাম। তার পর দুই মাসের ভিতর অবশিষ্ট ৭৫০৲ জোগাড় করিয়া জমির মালিককে দিয়া ফেলিলাম। জমিটা সম্পূর্ণরূপেই আমাদের সম্পত্তি হইয়া গেল। সুখের কথা এই সমস্ত টাকাই টাস্কেজী নগরের শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ লোকদের নিকট হইতেই উঠিয়াছিল।
এখন আমরা জমি চষিবার সুব্যবস্থা করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। আমাদের উদ্দেশ্য ত্রিবিধ। প্রথমতঃ, এই চাষবাস করিলে বিদ্যালয়ের জন্য কিছু লাভ হইবে। দ্বিতীয়তঃ, ছাত্রেরা ক্ষেতে কাজ করিয়া কৃষিকর্ম্মে অভিজ্ঞতা লাভ করিবে। তৃতীয়তঃ, আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক খাওয়ার সুখও বেশ হইবে।
আমরা সব কাজই এক সঙ্গে আরম্ভ করিতাম না। ভাল কাজ হইলেও তাহা যখন তখন আমাদের কর্ম্মকেন্দ্রে প্রবর্ত্তন করিতে চেষ্টিত হইতাম না। আমাদের যখন যেরূপ অভাব হইত তখন ঠিক সেইরূপ ব্যবস্থাই করিতাম। আমাদের সর্ব্বপ্রথম অভাব হইয়াছিল—বিদ্যালয়ের ছাত্রদিগের জন্য ভাল শাক শব্জীর। এইজন্য সর্ব্বপ্রথমেই আমরা চাষে লাগিয়া গেলাম।
ক্রমশঃ দেখিতে পাইলাম, আমাদের ছাত্রেরা এতই দরিদ্র যে বৎসরে তিন মাসের বেশী পয়সা খরচ করিয়া স্কুলে থাকিবার ক্ষমতা তাহাদের নাই। তাহাদের অন্যান্য মাসের খরচ চালাইবার জন্য আমাদের নূতন ব্যবস্থা করিবার প্রয়োজন হইল। এজন্যও চাষের ব্যবস্থা ভাল করিয়াই করা গেল। সঙ্গে সঙ্গে সূত্রধরের কার্য্য, কর্ম্মকারের কার্য্য ইত্যাদি নানাবিধ শিল্প-কর্ম্ম খুলিবার আয়োজন করিতে লাগিলাম।
আমাদের টাস্কেজীতে একটা কাণা ঘোড়া লইয়া পশু পালন আরম্ভ হয়। ঘোড়াটা একজন শ্বেতাঙ্গ আমাদিগকে দান করিয়া ছিলেন। আজকাল আমাদের বিদ্যালয়ের পশুশালায় ২০০ ঘোড়া, খচ্চর, গরু, বাছুর, বলদ ইত্যাদি, ৭০০ শূকর এবং কতকগুলি মেষ ও ছাগল রহিয়াছে।
ছাত্রসংখ্যা বাড়িয়াই চলিল। পুরাতন বাড়ীতে আর কোন মতেই কাজ চলে না। তখন একটা নূতন গৃহ নির্ম্মাণের প্রস্তাব করিলাম। প্রায় ২০,০০০৲ টাকার আনুমানিক ব্যয়ে এই গৃহ নির্ম্মিত হইবে হিসাব করিয়া দেখিলাম। এত টাকা আমাদের চিন্তার অতীত বোধ হইল। কিন্তু আমরা যে অবস্থায় আসিয়া পৌঁছিয়াছি তখন হয় আমাদিগকে ঐরূপ গৃহ নির্ম্মাণ করিতেই হইবে, না হয় পুরাতন অবস্থায়ই পচিতে হইবে। বিশেষতঃ আমরা ছাত্রদিগকে এক সঙ্গে এক জায়গায় রাখিয়া আমাদের আদর্শ অনুসারে গড়িয়া তুলিতে চাহিয়াছিলাম। সে উদ্দেশ্যে অতি সত্বরই কার্য্য আরম্ভ করা আবশ্যক। এজন্য বিলম্বের আর সময় ছিল না। কাজেই এত ব্যয়ে প্রকাণ্ড বাড়ীর ব্যবস্থা করা আমাদের অবশ্য কর্ত্তব্যের মধ্যে পরিগণিত হইয়া পড়িল।
ক্রমশঃ সংবাদ রটিয়া গেল যে, এক বৃহৎ ব্যাপার টাস্কেজীর কর্ত্তারা আরম্ভ করিয়াছেন। এক দিন সকালে দক্ষিণ প্রান্তের একজন শ্বেতকায় কাঠের সওদাগর আসিয়া আমায় বলিলেন, “শুনিতেছি, আপনারা নূতন বিদ্যালয় গৃহের প্রস্তাব করিয়াছেন। আমি আপনাদিগকে সমস্ত কাঠ জোগাইতে প্রস্তুত আছি। এক্ষণেই মূল্য দিতে হইবে না। আপনাদের যখন সুবিধা হয় তখন দিবেন।” আমি বলিলাম “আমাদের হাতে কিন্তু সম্প্রতি এক কড়িও নাই।” তিনি বলিলেন “তাহা আমি জানি। তথাপি আমি আপনাদের জমিতে কাঠ পৌঁছাইয়া দিব।” আমি বলিলাম “মহাশয়, কিছু অপেক্ষা করুন। আগে আমাদের হাতে কিছু টাকা জমা হউক। তাহার পর আপনাকে জানাইব।”
এই ঘটনায় আমি অতিশয় আশান্বিত হইলাম। ভাবিলাম— সৎকার্য্যে অর্থাভাব হয় না।
কুমারী ডেভিড্সন আবার নানা কৌশলে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ সমাজ হইতে টাকা তুলিতে চেষ্টিত হইলেন। নিগ্রোরা এই গৃহের কথা শুনিয়া সর্ব্বাপেক্ষা অধিক আনন্দিত হইয়াছিল। আমরা একদিন টাকা তুলিবার জন্য একটা সভা আহ্বান করিয়াছিলাম। সভার কার্য্য চলিতেছে, এমন সময়ে এক প্রৌঢ় নিগ্রো দাঁড়াইয়া উঠিল। সে প্রায় ১২ মাইল দূর হইতে আসিয়াছে—সঙ্গে একটা বড় শূকর বহিয়া আনিয়াছে। সে বলিতে লাগিল, “ভাই সকল আমার টাকা পয়সা নাই। আমার সম্পত্তির মধ্যে দুইটা বড় শূকর আছে। তাহাদের একটি আমি এই বিদ্যালয়ের গৃহনির্ম্মাণ-তহবিলে দান করিবার জন্য আনিয়াছি। আমি আপনাদিগকে করুণভাবে নিবেদন করিতেছি যে, যদি স্বজাতির জন্য আপনাদের হৃদয়ে বিন্দুমাত্র ভালবাসা থাকে, অথবা আপনাদের চিত্তে যদি বিন্দুমাত্র আত্মসম্মান ও আত্ম-গৌরব বোধ থাকে, তাহা হইলে আপনারা সকলেই একটি করিয়া শূকর এই বিদ্যালয়ের জন্য দান করুন। আমার বিশ্বাস আপনারা আমার এই অনুরোধ অগ্রাহ্য করিবেন না।” আর কয়েক জন নিগ্রো এই সঙ্গে দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল, “আমি আমার স্বজাতির সম্মুখে প্রতিজ্ঞা করিতেছি, যে এই বিদ্যালয়ের গৃহনির্ম্মাণ কার্য্যে আমি দুই সপ্তাহ শারীরিক পরিশ্রম করিয়া সাহায্য করিব!”
দক্ষিণ অঞ্চল হইতেই ২০,০০০ টাকা উঠা অসম্ভব। কুমারী ডেভিড্সন উত্তর প্রান্তের ইয়াঙ্কি মহলে চাঁদা আদায় করিতে বাহির হইলেন। সেখানে নানা গির্জ্জায় যাইয়া এজন্য বক্তৃতা করিতে হইল। বিভিন্ন বিদ্যালয়-গৃহে এবং সভা সমিতির সম্মুখেও তিনি টাস্কেজীর বৃত্তান্ত জানাইলেন। বড়ই কঠিন কার্য্য। কেহই উহার নাম পর্য্যন্ত শুনে নাই। এদিকে লোকের উৎসাহ আকৃষ্ট করা অল্প পরিশ্রমের ব্যাপার নহে। যাহা হউক, ডেভিড্সন ধীরে ধীরে উত্তর প্রান্তের ভালবাসা পাইতে লাগিলেন।
ডেভিড্সন একদিন এক ষ্টীমারে নিউইয়র্ক যাইতেছিলেন। সেখানে একটি ইয়াঙ্কি রমণীর সঙ্গে তাঁহার আলাপ হয়। রমণী ষ্টীমার ত্যাগ করিবার সময়ে ডেভিসনকে ১৫০৲ টাকার একটা ‘চেক্’ লিখিয়া দিলেন।
ডেভিড্সনকে অর্থসংগ্রহের জন্য যারপর নাই খাটিতে হইয়া ছিল। এজন্য তিনি এত দুর্ব্বল ও ক্লান্ত হইয়া পড়িতেন যে অনেক সময় তাঁহার চলিবার ক্ষমতা থাকিত না। একদিন বোষ্টন নগরে একটি রমণীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইয়া ডেভিড্সন তাঁহার ‘কার্ড’ পাঠাইলেন। কার্ড পাইয়া রমণী বৈঠকখানায় আসিলেন। আসিয়াই দেখেন ডেভিড্সন ক্লান্ত হইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন।
ডেভিড্সন যে সময়ে অর্থসংগ্রহ করিতেছিলেন সেই সময়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার কার্য্যও তাঁহার ছিল। তাহা ছাড়া তিনি টাস্কেজীর রমণী মহলে ঘুরিয়া ঘুরিয়া শিক্ষা দিতেন, এবং শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ সমাজের মধ্যে সদ্ভাব বর্দ্ধনের চেষ্টা করিতেন। অধিকন্তু একটি রবিবারের বিদ্যালয়ের ভারও তিনি লইয়াছিলেন।
তিনি আমাদের সাহায্যকারী বন্ধুগণের সঙ্গে সর্ব্বদা চিঠিপত্রের সাহায্যে আলাপ রাখিতেন। সময়ে সময়ে তাঁহাদিগকে বিদ্যালয়ের অবস্থা জানাইতে চেষ্টাও করিতেন। এইরূপে টাস্কেজীর জন্য নানা স্থানে স্থায়ী বন্ধুর সৃষ্টি হইয়াছিল।
গৃহনির্ম্মাণ আরম্ভ হইয়া গেল। ঘরের নাম রাখা হইয়াছিল “পোর্টার হল”। পোর্টার নিউইয়র্কের ব্রুক্লিন নগরের একজন সহৃদয় ইয়াঙ্কি। ইনি কিছু বেশী টাকা দিয়াছিলেন—এজন্য গৃহের নাম ইহাঁর সঙ্গে সংযুক্ত রাখিয়াছিলাম। এই ঘর তৈয়ারী করিবার সময়ে টাকার অভাব খুব বোধ করিতে লাগিলাম। একজন পাওনাদারকে কথা দিয়াছিলাম, অমুক তারিখে তাঁহার প্রাপ্য ১২০০৲ দিব। সেই তারিখ আসিল। সকালে একটিমাত্র টাকাও হাতে নাই দেখিলাম। দশটার সময়ে ডাক পাইলাম। সেই সঙ্গে কুমারী ডেভিড্সনের একখানা চিঠি ছিল। তাহার মধ্যে একটা ১২০০৲ টাকার চেক্! আমি অবাক্ হইয়া গেলাম। আরও অনেক সময়েই এইরূপ অবাক্ হইয়াছি। এই ১২০০৲ বোষ্টনের দুই জন রমণী দান করিয়াছিলেন। এই দুই রমণী এক বৎসর পরে আরও ১৮,০০০৲ দান করিয়াছিলেন। বিগত ১৪ বৎসর ধরিয়া এই দুইটি রমণী ১৮,০০০৲ করিয়া প্রতি বৎসর দিয়া আসিতেছেন।
গৃহ নির্ম্মাণ করিবার পূর্ব্বে মাটি কাটা আরম্ভ হইল। ছাত্রেরাই এই কাজ করিল। অবশ্য এখন পর্য্যন্ত তাহারা নবভাবে সম্পূর্ণরূপে মজিয়া উঠে নাই। এখন ত তাহাদের সেই পুরাতন বাবুগিরির ভাব কিছু কিছু ছিল। “আমরা লেখা পড়া শিখিতে আসিয়াছি, মাটি কাটিব বা ইট গড়িব কেন?”— অনেকেরই এই ভাব! যাহা হউক, ক্রমে ক্রমে শারীরিক পরিশ্রমের উপকারিতা ইহারা বুঝিতে পারিয়াছে।
মাটি কাটা হইয়া গেলে—দেওয়ালের ভিত্তি গুলি প্রস্তুত হইয়া গেল। এখন সমারোহ করিয়া প্রকাশ্যভাবে ‘ভিত্তি প্রতিষ্ঠা’ উৎসবের আয়োজন করিলাম।
১৬ বৎসর পূর্ব্বে আমরা কেনা গোলাম ছিলাম। দক্ষিণ প্রান্তের এই অঞ্চলেই গোলামাবাদ বেশী ছিল। এই বিভাগের নামই “কৃষ্ণ বিভাগ।” গোলামী যুগে এই বিভাগে নিগ্রোকে লেখাপড়া শিখান মহাপাপের কার্য্য বিবেচিত হইত। যে শিক্ষক নিগ্রোকে শিখাইতে চাহিত সমাজে তাহার কুখ্যাতি রটিত, আইনেও সে দণ্ডনীয় হইত। আজ ১৬ বৎসরের ভিতর সেই গোলামাবাদের আবহাওয়ার মধ্যে বিদ্যালয় গৃহের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা, এবং ভিত্তি প্রতিষ্ঠার উৎসব! সর্ব্বত্র আনন্দের মহা কোলাহল—সকলের চিত্তেই স্ফূর্ত্তি। যেন কি এক দেবভাবে টাস্কেজীর শ্বেতাঙ্গ কৃষ্ণাঙ্গ সকলেই সংসার দেখিতে লাগিল।
আলাবামা প্রদেশের শিক্ষাপরিষদের তত্ত্বাবধায়ককে উৎসবের সভাপতি নির্ব্বাচিত করা হইয়াছিল। তিনিই প্রধান বক্তৃতা করিলেন। গৃহের যে কোণে ভিত্তি প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা হইয়াছিল সেখানে শিক্ষক, ছাত্র, অভিভাবক, বন্ধু, আত্মীয়, প্রদেশ-রাষ্ট্রের কর্ম্মচারী, মহাজন, ব্যবসাদার সকলেই সমবেত হইয়াছিলেন। পূর্ব্বে যাঁহারা গোলামখানার মালিক ছিলেন আজ তাঁহারা গোলাম জাতির হাত ধরিয়া এই শিক্ষা মন্দিরের ভিত্তি প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করিলেন। শ্বেতাঙ্গ কৃষ্ণাঙ্গ সকলেই সেই ভিত্তি-প্রস্তরের নীচে কিছু না কিছু চিহ্ন রাখিতে উৎসুক হইল।
গৃহ-নির্ম্মাণের কার্য্য যখন অগ্রসর হইতে ছিল সেই সময়ে বহুবার আমাদের বড়ই দুশ্চিন্তায় দিনরাত্রি কাটাইতে হইত। হাতে পয়সা থাকিত না—অথচ পাওনাদারদিগের টাকা দিবার দিন চলিয়া আসিত। ভুক্তভোগী ভিন্ন এই উদ্বেগ আর কে বুঝিবে? কত রাত্রি বিছানায় পড়িয়া এপাশ ওপাশ করিয়াছি তাহার সংখ্যা নাই।
আমি জানিতাম যে, আমি অসাধ্যসাধনে ব্রতী হইয়াছি। এখন আমাকে কেহই সাহায্য করিবে না। বরং সকলেই বাধা দিবে। আমি বুঝিয়াছিলাম যে, এই অবস্থায় আমাকে একাকীই সকল কার্য্য করিতে হইবে। আমি কষ্টভোগ করিয়া, নীরবে দুঃখ সহিয়া, লোকজনের উপহাসে বিচলিত না হইয়া, দৃঢ়ভাবে কাজ করিতে করিতে যদি সফল হইতে পারি, তবে ভবিষ্যতে আমি সমাজের সাহায্য পাইব। সাধারণ লোকেরা আগে কোন কাজ করিতে চাহে না—তাহারা যখন দেখে যে অন্যের আরব্ধ অনুষ্ঠানটা কৃতকার্য্য হইতে চলিল তখন তাহারা উহার প্রতি অনুরক্ত হয়। সুতরাং সকল দুঃখ নৈরাশ্য ও দুশ্চিন্তার বোঝা এক্ষণে আমাকেই নিজ মাথায় বহন করিতে হইবে। আমার কবরের উপরই নিগ্রোসমাজের জাতীয় বিদ্যামন্দির প্রতিষ্ঠিত হউক।