নিগ্রোজাতির কর্ম্মবীর (১৯১৪)/দশম অধ্যায়

দশম অধ্যায়

অসাধ্য সাধন

 প্রথম হইতেই-টাস্কেজী-বিদ্যালয়ের ছাত্রদিগকে আমি আমার নূতন আদর্শে তৈয়ারী করিতে চেষ্টা করিয়াছিলাম। আমার মতে বিদ্যালয়ের সকল প্রকার কাজই ছাত্রদের নিজ হাতে করিতে চেষ্টা করা কর্ত্তব্য। বোর্ডিং-গৃহের ঘরঝাড়া, কাপড় ধোয়া, রান্নাকরা ইত্যাদি সকল কাজই ছাত্রদের করা উচিত। তার পর স্কুলঘরের টেবিল চেয়ার মেজে পরিষ্কার রাখা, এবং আসবাবপত্র সাজান এ সবও ছাত্রদেরই কর্ত্তব্য। অধিকন্তু বিদ্যালয়ের উঠান মাঠ ও জমির শ্রীবিধান সম্বন্ধে ছাত্রদেরই দৃষ্টি থাকা বাঞ্ছনীয়। তাহা ছাড়া পশুপালন, কৃষিকার্য্য, চাষবাস, মাটিকাটা ইত্যাদি কর্ম্মের জন্যও বাহিরের মজুর লাগান উচিত নয়। বিদ্যালয়ের ছাত্রদেরই এই সকল কাজ সম্পন্ন করা আবশ্যক। কেবল তাহাই নহে—বাড়ীঘর মেরামত, নূতন নূতন গৃহ-নির্ম্মাণ, করাতে কাঠ চেরা, ইঁট তৈয়ারী করা, চূণ শুরকি প্রস্তুত করা—এই সমুদয় ঘরামি ও মিস্ত্রিগিরির কাজও ছেলেদেরই করা প্রয়োজন।

 সকল প্রকার গৃহস্থালী, কৃষি ও শিল্পকর্ম্মে অভ্যস্ত হইতে থাকিলে ছাত্রেরা বেশ পাকা মানুষ হইয়া উঠিতে পারে। নানাবিধ কারিগরি এবং শিল্পিমহলের নূতন নূতন আবিষ্কারগুলি তাহাদের ‘হাতে কলমে’ শিক্ষা হইয়া যায়। অধিকন্তু তাহারা শারীরিক পরিশ্রমের ফলে স্বাস্থ্য অর্জ্জন করে ও কর্ম্মঠ হইতে থাকে; এবং নৈতিক চরিত্র বিষয়েও যথেষ্ট উন্নতি লাভ করে। খাটিয়া খাওয়া নিন্দনীয় কাজ নয়। লেখা পড়া শিখিলেই ‘বাবু’ হইয়া যাইতে হয় না। শিক্ষিত লোকদেরও স্বহস্তেই চাষ করা উচিত এবং নিজের ঘর বাড়ী নিজেই প্রস্তুত করিতে চেষ্টা করা কর্ত্তব্য। এক কথায়, সকলেরই নিজ অভাবগুলি যথাসম্ভব নিজেই মোচন করিয়া লওয়া উচিত। খাওয়া দাওয়া, চলা ফেরা ইত্যাদি কোন বিষয়েই পরের উপর নির্ভর করা শিক্ষিত ও সভ্য লোকের লক্ষণ নয়। এই সকল ধারণা আমার শিক্ষাপ্রণালী অনুসারে ছাত্রদের মাথায় সহজেই বসিতে পারে।

 শারীরিক পরিশ্রম এবং স্বাবলম্বন এই দুইটি গুণই আমি প্রকৃত শিক্ষালাভের চিহ্ন মনে করি। যথার্থ শিক্ষিত ব্যক্তি শারীরিক পরিশ্রমকে কখনই অগ্রাহ্য করিতে পারেন না। নিজে খাটিলে অনেক বিষয়ে খরচ কম হয়—তাহা সকলেরই জানা আছে। শিক্ষিত ব্যক্তি মাত্রেই তাহাও বুঝেন। কিন্তু একমাত্র এই জন্যই তাঁহারা শারীরিক পরিশ্রমের আদর করেন না। তাঁহারা খাটিয়া খাওয়াকেই জীবনের প্রধান লক্ষ্য ও ধর্ম্মের মধ্যে গণ্য করেন। পরিশ্রমের অন্য কোন মূল্য থাকুক বা না থাকুক, তাঁহারা পরিশ্রম করিতে পারিলেই সুখী ও আনন্দিত হন। পরিশ্রম করিতে পারাটাই একটা মহাগুণ—পরিশ্রমী ব্যক্তিমাত্রই গুণবান্ এবং সকলের প্রশংসাযোগ্য। যথার্থ শিক্ষিত ব্যক্তি এইরূপ ভাবিয়া থাকেন।

 এই ধর্ম্মভাবে পরিশ্রম করিতে আরম্ভ কর, দেখিবে খাটিয়া খাওয়ায় কোন অপমান, কষ্ট ও লজ্জাবোধ হইতেছে না। কারণ পরিশ্রম করা তখন অপর লোকের কোন উদ্দেশ্য সাধনের উপায় মাত্র মনে হইবে না। উহার দ্বারা নিজেরই উপকার হইতেছে ভাবিতে পারিবে। উহা নিজ জীবনেরই সার্থকতা লাভের অঙ্গস্বরূপ বিবেচিত হইবে। পরিশ্রমের ফলে তুমি প্রকৃত মানুষ হইতেছ এই জ্ঞান থাকিবে। কাজেই পরিশ্রম গৌরবজনক পুণ্যের কাজরূপেই আদর পাইতে পারিবে—কোন মতেই ঘৃণ্য বা কষ্টকর বোধ হইবে না। নিজের আত্মার যাহাতে উন্নতি হয় তাহাতে কেহ কখনও কষ্টবোধ করে কি?

 আমার নূতন আদর্শের শিক্ষাপ্রণালী অনুসারে ছাত্রেরা শারীরিক পরিশ্রমের এইরূপ মর্য্যাদা ও গৌরব দান করিতে শিখে। তাহা ছাড়া বিদ্যালয় চালাইবার পক্ষেও খুব সুবিধা হয়। কারণ এই উপায়ে প্রায় সকল খরচই কমাইয়া ফেলান যায়। ছাত্রদের পরিশ্রমেই ঝাড়ুদার ধোপা নাপিত মিস্ত্রী ছুতার কামার কুমার চাষী ইত্যাদি সকল প্রকার মজুরের কাজ চলিয়া থাকে। এজন্য অর্থব্যয় প্রায় হয়ই না বলিলে চলে। সঙ্গে সঙ্গে, পূর্ব্বেই বলিয়াছি, ছাত্রেরা নূতন নূতন শিল্পবিদ্যা শিখিতে থাকে। জল, বায়ু, বাষ্প, তড়িৎ, জীবজন্তু ইত্যাদি জগতের সকল শক্তি মানুষকে নানা উপায়ে সাহায্য করিতেছে। কৃষিকর্ম্মে এবং শিল্পকার্য্যে লাগিয়া থাকিলে অতি সহজেই এ বিষয়ে ধারণা জন্মে। বস্তুজ্ঞান, ব্যবহারিক বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয় ছাত্রদিগকে আর নূতন করিয়া শিখাইতে হয় না। তাহারা বিশ্বশক্তিগুলি প্রতিদিনকার নানা কাজে লাগাইতে লাগাইতে উদ্ভিদ্‌বিজ্ঞান, জীববিদ্যা, পদার্থ তত্ত্ব ইত্যাদি আয়ত্ত করিয়া ফেলে।

 আমার প্রবর্ত্তিত নূতন শিক্ষা প্রণালীর সুবিধাগুলি বর্ণনা করিলাম! এই আদর্শে আমি টাস্কেজী বিদ্যালয় চালাইতে চেষ্টা করিয়াছিলাম। সুতরাং যখন নবগৃহ নির্ম্মাণের সুযোগ আসিল আমি ছাত্রদিগকেই এই কাজে লাগাইতে চাহিলাম। কেহ কেহ বলিলেন “ছাত্রেরা এখন মিস্ত্রীর কাজ জানেই না। কাঠ কাটিতেও তাহারা তত পটু নয়। ঘরামিগিরি করিবে কিরূপে? এত বড় ইমারত তৈয়ারী করা কি ইহাদের সাধ্য? পারিলেও যে, বাড়ীটা অতি বিশ্রী ও কদাকার দেখাইবে! আপনার এ পরামর্শ ভাল হয় নাই। সহর হইতে পাকা মিস্ত্রী ডাকিয়া আনাই উচিত। ছাত্রেরা না হয়, ইহাদের কাজে সাহায্য করিবার জন্য জল, হাতিয়ার, চূণ, সুরকি ইত্যাদি বহিয়া দিবে।”

 আমি আমার বন্ধুগণকে বলিতাম, “দেখুন, আমি বুঝিতেছি যে আমাদের বাড়ীটা ছেলেরা প্রস্তুত করিলে নিতান্তই কদাকার দেখাইবে। কিন্তু গৃহের সৌন্দর্য্যবিধানই কি আমাদের একমাত্র কর্ত্তব্য? নাই বা হইল বাড়ীটা দেখিতে সুশ্রী! কিন্তু ছেলেরা ত এতগুলি কাজ শিখিয়া ফেলিবে। তাহারা স্বাবলম্বী হইতে অভ্যস্ত হইবে। আর, এত বড় ইমারতের জন্য মাটি খুঁড়া হইতে আরম্ভ করিয়া চূণকাম ও রংকরা পর্য্যন্ত সকল কাজ নিজহাতে সম্পূর্ণ করিবার সুযোগ পাইবে। তাহাতে শিল্পশিক্ষা ও নৈতিক চরিত্রগঠন যথেষ্টই হইতে থাকিবে। অধিকন্তু, আনুষঙ্গিকভাবে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের অশেষবিধ উৎকর্ষ এবং সাধারণ সভ্যতা বিষয়েও ইহাদের ধারণা পরিষ্কার হইবে। এইগুলি কি কম লাভ? আমার বিবেচনায় এজন্য ঘরবাড়ীগুলি যদি অতি বিশ্রী ভাবেই তৈয়ারী হয় তাহাতেও দুঃখ করা উচিত নয়।”

 আমি আরও বলিতাম, “আমাদের ছেলেরা সকলেই গরিব। ইহারা পল্লীগ্রামে বাস করে। ইহাদের গৃহসম্পত্তির মধ্যে একটা করিয়া কাঠের কামরা আছে মাত্র। তূলা, চিনি ও চাউলের আবাদে ইহাদিগকে সারা দিন খাটিতে হয়। বলা বাহুল্য, ইহারা যদি আমাদের বিদ্যালয়ে প্রথমেই একটা প্রকাণ্ড রাজপ্রাসাদের মত বাড়ীতে থাকিতে পায় তাহাহইলে ইহাদের আনন্দের ও গৌরবের সীমা থাকিবে না। ইহা স্বাভাবিক, কারণ কষ্টের পর সকলেই সুখ আশা ও ইচ্ছা করে। কিন্তু আমরা যদি এই অবস্থায় ইহাদিগকে কিছু নূতন আদর্শ ও জীবনের নূতন লক্ষ্য না দিতে পারি তাহা হইলে আমরা ইহাদের জন্য কি করিলাম? পূর্ব্বে ইহারা যে চিন্তা ও যে ধারণা লইয়া লেখা পড়া শিখিতে আসিয়াছিল গৃহে ফিরিবার সময়েও ইহাদের সেই চিন্তাও ধরিয়া থাকিয়া যাইবে না কি?

 এইজন্যই আমি মনে করিয়াছি যে, ইহারা ইটের ঘরে থাকিয়া সুখভোগ করিবার পূর্ব্বে নিজ হাতে ইট তৈয়ারী করিতে শিখুক। তারপর সেই ইট দিয়া ইহারাই ঘর প্রস্তুত করিবে। নিজ বসবাসের জন্য নিজহস্তে গৃহনির্ম্মাণ করাও মানুষের স্বাভাবিক লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়? আর ছাত্রগণ ইহাতে গৌরব এবং আনন্দও কি কম পাইবে? অধিকন্তু নিজহাতে গড়া জিনিষ সর্ব্বদা চোখের সম্মুখে থাকিলে তাহাই শিক্ষালাভের একটি প্রধান উপায় হইবে। কারণ তাহা দেখিয়াই ছাত্রেরা অতীতের ভুলগুলি বুঝিতে পারিবে। তাহারা সেইগুলি সহজেই সংশোধন করিবার উপায় বুঝিয়া লইবে, এবং ভবিষ্যতের জন্য উন্নতি বিধানের পথও খুলিতে থাকিবে। ছাত্রেরা এইরূপে নিজেই নিজেদের শিক্ষক হইয়া পড়িবে। এই ‘আত্মশিক্ষা’র সুযোগ আর কোন উপায়ে পাওয়া যাইতে পারে কি?”

 টাস্কেজী বিদ্যলয়ের প্রথম গৃহ ছাত্রেরাই নির্ম্মাণ করিয়াছিল। তাহার পর হইতে আজ পর্য্যন্ত এই ১৯ বৎসরের ভিতর বিদ্যালয়ের জন্য যতগুলি গৃহ নির্ম্মিত হইয়াছে প্রায় সকলগুলিই আমাদের ছাত্রগণের প্রস্তুত। আমি আমার শিক্ষাপ্রণালী কোন সময়েই বর্জ্জন করি নাই। আজ আমাদের সর্ব্বসমেত ছোট বড় ৪০ টা গৃহ। এইগুলির মধ্যে কেবলমাত্র ৪ টার জন্য ছাত্রদের খাটান হয় নাই। অবশিষ্ট ৩৬ টা গৃহই ছাত্রেরা নিজহাতে তৈয়ারি করিয়াছে। বাহিরের মিস্ত্রির সাহায্য একেবারেই লওয়া হয় নাই বলা যাইতে পারে।

 এই বিশ বৎসরের কার্য্যফলে দেখিতে পাই, যে আমেরিকার দক্ষিণ প্রান্তের জেলায় জেলায় লোকেরা আজকাল সকলেই ঘরবাড়ী তৈয়ারী করিতে শিখিয়াছে। টাস্কেজী বিদ্যালয়ের জন্য প্রায় ৪০ টা গৃহ নির্ম্মাণে সাহায্য করিয়া ছাত্র ও শিক্ষকগণ ঘরামি মিস্ত্রী ও ছুতারের কাজে ওস্তাদ হইয়া গিয়াছে। তাহাদের সংস্পর্শে আসিয়া অন্যান্য লোকেরাও কিছু কিছু গৃহনির্ম্মাণ কার্য্য শিখিয়া ফেলিয়াছে। আর আমাদের বিদ্যালয়ের উপকারই কি হইয়াছে কম? বৎসরের পর বৎসর ছাত্র আসে যায়—কিন্তু গৃহনির্ম্মাণ বিদ্যা আমাদের স্কুলের স্থায়ী আবহাওয়ার মধ্যে দাঁড়াইয়া গিয়াছে। পূর্ব্বতন ছাত্রদের উত্তরাধিকারের সূত্রে নূতন নূতন ছাত্রেরা মাটি কাটা, গর্ত্ত খুঁড়া, কাঠ চেরা, ইট গড়া, গৃহের চিত্র অঙ্কন করা, এবং আনুমানিক ব্যয়ের হিসাব করা হইতে আরম্ভ করিয়া গ্যাসের কল লাগান ইলেক্টিক বাতীর ব্যবস্থা করা সবই শিখিয়া লয়, এখন আমরা গৃহনির্ম্মাণ সংক্রান্ত কোন বিষয়েই বাহিরের লোকের সাহায্য চাই না।

 কোন সময়ে একজন নূতন ছাত্র ছেলেমানুষী করিয়া দেওয়ালে পেন্সীলের দাগ দিতে থাকে অথবা টেবিলে ছুরি দিয়া নাম লিখিতে থাকে, অমনই পুরাতন ছাত্রেরা তাহাকে সাবধান করিয়া দেয়। তাহাদের তিরস্কার আর কিছুই নয়—এইমাত্র “ওহে, ও দেওয়ালটা আমরাই প্রস্তুত করিয়াছি, এই টেবিলটাও আমাদের হাতে গড়া। নষ্ট করিলে আমাদিগকেই সারিতে হইবে।”

 সর্ব্বপ্রথম গৃহনির্ম্মাণ সময়ে ইট প্রস্তুত করিতেই আমাদিগকে বিশেষ ভুগিতে হইয়াছিল। আমাদের নিজের প্রয়োজন ছাড়া ইট তৈয়ারী করিবার আর একটা কারণও ছিল; আমাদের টাস্কেজী অঞ্চলে সেই সময়ে ইট গড়িবার কোন কারখানা ছিল না। অথচ বাজারে ইটের কাট্‌তি যথেষ্ট। কাজেই ইটের ব্যবসায় বেশ লাভ করা যাইত। এই লাভের আশায়ও আমি বিদ্যালয়ে ইটের কারবার খুলিতে ইচ্ছা করিলাম।

 বাইবেলে পড়িয়াছি—ইজবেলদের শিশুরা বিনা খড় কূটায় ইট তৈয়ারী করিতে বাধ্য হইয়াছিল। আমি দেখিলাম আমাদের কাজ তাহা অপেক্ষা কম কষ্টকর নয়। কারণ প্রথমতঃ এ বিষয়ে আমাদের কাহারও কিঞ্চিৎ মাত্র অভিজ্ঞতা নাই। দ্বিতীয়তঃ তহবিলে এই ব্যবসা চালাইবার জন্য এক পয়সাও মজুত নাই।

 তার পর, ইট গড়া কাজটাও নেহাত সোজা নয়। কাদামাটির গর্ত্তের মধ্যে ২। ৪ ঘণ্টা দাঁড়াইয়া কাজ করা বড়ই দুঃখ জনক। হাঁটু পর্য্যন্ত কাদা লাগিয়া থাকে। ছাত্রদিগকে এ কার্য্যে ব্রতী করিতে বড়ই বেগ পাইতে হইত। এতদিন তাহাদিগকে বুঝাইতে বুঝাইতে জমি চষিবার কাজে লাগান গিয়াছে। কিন্তু যখন এই কাদামাটি ঘাঁটিবার কাজ আসিল তখন তাহাদিগের সহিষ্ণুতা ও ধৈর্য্য রক্ষা করা অসম্ভব হইয়া পড়িল। লেখাপড়া শিখিতে আসিয়া শারীরিক পরিশ্রম করাই ত তাহারা আদৌ পছন্দ করিত না। তাহার উপর এইরূপ জঘন্য ও কষ্টকর কাজ করিতে তাহারা সম্পূর্ণরূপে নারাজ। কষ্টে দুঃখে অপমানে ও লজ্জায় অনেক ছাত্র আমাদের স্কুল ছাড়িয়া গেল।

 আমি পূর্ব্বে ভাবিয়াছিলাম ইট তৈয়ারী করিতে গেলে বেশী বিদ্যা বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। কিন্তু কাজে নামিয়া দেখিলাম, খুব পাকা হাত না হইলে ইট গড়া বড় কঠিন। প্রথমতঃ কাদামাটি প্রস্তুত করিতেও বিশেষ অভিজ্ঞতা চাই। আমরা এজন্য এক জায়গা হইতে অন্য জায়গায় আমাদের মাটির গর্ত্ত সরাইতে বাধ্য হইয়াছিলাম। শেষে একস্থানে বেশ ভাল মাটি পাওয়া গেল। সেইখানে ইট প্রস্তুত হইতে লাগিল। দ্বিতীয়তঃ ইট পোড়ান কাজ খুবই কঠিন। ২৫,০০০ ইট মাটি দিয়া প্রস্তুত করা হইল। কিন্তু এই গুলি পোড়াইতে যাইয়াই মহা বিপদ। আমরা একটা, দুইটা, তিনটা পাঁজা প্রস্তুত করিয়া তিন তিনবার অকৃতকার্য্য হইলাম। আমার কয়েক জন শিক্ষক হাম্পটনে ইট প্রস্তুত করিতে শিখিয়া ছিলেন। তাঁহারা তৃতীয় পাঁজাটা বিশেষ দক্ষতার সহিতই প্রস্তুত করিলেন। এক সপ্তাহ আমাদের ইটগুলি বেশ পুড়িতে লাগিল। ভাবিলাম এ যাত্রায় সফল নিশ্চয়ই হইব। কিন্তু সাত দিন পর রাত্রি ১২। ১ টার সময় পাঁজাটা ভাঙ্গিয়া গেল। আমরা তৃতীয়বার বিফল হইলাম।

 সকলেই বলিতে লাগিলেন, “আর চেষ্টা করিয়া কাজ নাই। ইট গড়া আমাদের দ্বারা হইবে না।” তাহার উপর আমার পয়সাও ফুরাইয়া আসিয়াছে। চতুর্থবার এক্‌স্‌পেরিমেণ্ট বা পরীক্ষা করিতে হইলেও টাকার প্রয়োজন। একে নৈরাশ্য তাহাতে দারিদ্র্য। পুনরায় চেষ্টা করা অসম্ভব মনে হইতে লাগিল। আমার একটা পুরাতন ঘড়ি ছিল। এই সময়ে সেটা একটা দোকানে বাঁধা রাখিয়া ৫০৲ ধার লইয়া আসিলাম। এই টাকার সাহায্যে ইটের পাঁজা তৈয়ারী করিতে যাওয়া গেল। এইবার কৃতকার্য্য হইলাম। এতদিন পর ২৫,০০০ ইট আমাদের কারখানায় তৈয়ারী হইল।


 আজ ইটের কারবার টাস্কেজী বিদ্যালয়ে খুব জোরের সহিতই চলিতেছে। গত বৎসর আমাদের ছাত্রেরা ১,২০০,০০০ ইট গড়িয়াছিল। এগুলি এত সুন্দর ও নিরেট যে আমি যে কোন বাজারে ফেলিয়া সর্ব্বোচ্চ মূল্য আদায় করিতে পারি। তাহা ছাড়া বিগত বিশ বৎসরের শিক্ষার ফলে, আজ আমেরিকার দক্ষিণ অঞ্চলে গণ্ডায় গণ্ডায় নিগ্রোযুবক ইটের ব্যবসায় করিয়া অন্নসংস্থান করিতেছে।

 ইটের কারবার করিতে করিতে আমার একটা নূতন দিকে দৃষ্টি পড়িল। আমাদের বিদ্যালয়ে বহু শেতাঙ্গ ব্যক্তি ইট খরিদ করিতে আসিত। তাহারা পূর্ব্বে আমাদের সঙ্গে বিশেষ কোন কথাবার্ত্তা বলিত না। কিন্তু অন্যত্র ইট পাওয়া যায় না। কাজেই ইহারা কৃষ্ণাঙ্গের সাহায্য লইতে বাধ্য হইল।

 আর পূর্ব্বে অনেক শ্বেতাঙ্গই ভাবিত যে, লেখা পড়া শিখিয়া নিগ্রোরা বাবু হইয়া পড়িবে। তাহারাও এখন বুঝিল যে, নিগ্রোরা এই জাতীয় বিদ্যালয় খুলিয়া সত্য সত্যই নিজেদের উন্নতি করিতেছে। এবং সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত সহরেরই উপকার হইতেছে। এই উপায়ে কৃষ্ণাঙ্গ সম্বন্ধে শ্বেতাঙ্গের ধারণা বদলাইতে লাগিল।

 ফলতঃ আমাদের দুই সমাজে কর্ম্মবিনিময় ও ভাব-বিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি হইল। আজ দক্ষিণ অঞ্চলে নিগ্রোয় ও শ্বেতাঙ্গে যে সদ্ভাব রহিয়াছে তাহার অন্যতম কারণ আমাদের টাস্কেজীর এই ইটগড়া এবং ইটের কারবার। বহু বক্তৃতা দ্বারা যে কার্য্য করিতে পারিতাম কি না সন্দেহ, ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে তাহা নীরবে ও সহজে সিদ্ধ হইয়া গেল।

 শ্বেতাঙ্গ যে কৃষ্ণাঙ্গকে বাদ দিয়া সংসারে চলিতে পারিবে না—এই ব্যবসায় হইতে তাহারা বেশ বুঝিয়া লইল। কাজেই আজ দুই সমাজই এক বৃক্ষের ফলের ন্যায় পরস্পরসাপেক্ষ। পরস্পর পরস্পরের কথা না ভাবিয়া থাকিতে পারে না। শ্বেতাঙ্গের কার্য্যে কৃষ্ণাঙ্গের উপকার হয়, এবং কৃষ্ণাঙ্গের বিদ্যায় শ্বেতাঙ্গের অভাব মোচন হয়। শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ আজ আমেরিকা জননীর যমজ সন্তানের ন্যায় চলাফেরা করিয়া থাকে। শিল্প ও ব্যবসায় শিক্ষার মূল্য কি কম?

 আমি আমার স্বজাতিগণকে সর্ব্বদা বলিয়া থাকি, “দেখ, গলাবাজী করিয়া কখনও একটা বড় কিছু করা যায় না। তোমরা ভাবিয়াছ যে চেঁচাচেঁচি করিলেই তোমাদিগকে শ্বেতাঙ্গেরা ভাই বলিয়া ডাকিবে, এবং তাহাদিগের সমান ক্ষমতা তোমাদিগকে দিতে থাকিবে? ইহা কখনই সম্ভবপর নয়। কাজ করিতে লাগিয়া যাও। কৃষিকর্ম্মে লাগিয়া যাও, শিল্পকার্য্যে লাগিয়া যাও, ব্যবসায় বাণিজ্যে লাগিয়া যাও। বাড়ী, গাড়ী, রেল জাহাজ, ষ্টীমার তৈয়ার করিতে থাক। এ সকল বিষয়ে তোমাদের ‘হাত’ দেখাও। তাহাদিগকে তোমাদের বিদ্যা বুদ্ধির দৌড় দেখাও। তাহারা বুঝুক যে তোমরাও মানুষ, তোমরাও মাথা খাটাইয়া একটা জিনিষ দাঁড় করাইতে পার। তাহা হইলেই তাহারা তোমাদিগকে সম্মান করিবে—তোমাদের সঙ্গে বসিতে চাহিবে—তোমাদের সঙ্গে খাইতে চাহিবে। দেখিতে পাও না—যে যে অঞ্চলে নিগ্রো শিল্পী ও ব্যবসায়ীরা বেশ দক্ষতার সহিত কারবার চালাইতেছে সেই সকল স্থানে শ্বেতাঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গে বিরোধ বড় বেশী নাই? সেখানে কালচামড়া সাদা চামড়ায় প্রভেদ অল্প মাত্রই দেখা যায়!”

 আমি বিশ্বাস করি, গুণ যাহার মধ্যেই থাকুক না কেন, সমস্ত জগৎ‍ই তাহাকে সম্মান করিতে বাধ্য। দুদিন আগে কিম্বা দুদিন পরে—এই যা। গুণ, যোগ্যতা, প্রতিভা, চরিত্রবত্তা এ সকল জিনিষ চাপিয়া রাখা যায় না। কেহ এ গুলিকে কোনদিন ঢাকিয়া রাখিয়া দাবিয়া ফেলিতে পারিবে না। আর একটা কথাও আমি সর্ব্বদা মনে রাখি এবং সকলকে বলিয়া থাকি,—“কথা অপেক্ষা কাজের মূল্য শতগুণ বেশী। একশত জন লোক ঐক্য-বিধান, সুবিচার, অধিকার বিভাগ ইত্যাদি বিষয়ে বক্তৃতা করিয়া সমাজের যে উপকার করিতে না পারে, একজন লোক একটা সুন্দর শিল্প সৃষ্টি করিয়া সেই উপকার করিতে পারে। যখনই শ্বেতাঙ্গেরা রাস্তায় হাঁটিতে হাঁটিতে নিগ্রোনির্ম্মিত একখানা সুন্দর গৃহ দেখিবে তখনই তাহারা নিগ্রোর ক্ষমতায় বিশ্বাস করিবে। সৌন্দর্য্য সৃষ্টি করিবার পরক্ষণ হইতেই কৃষ্ণাঙ্গ শ্বেতাঙ্গের বন্ধু ও পূজার পাত্র হইয়া পড়িবে। কেবল গৃহনির্ম্মাণে কৃতিত্ব কেন, সকল বিষয়েই কৃতিত্ব দর্শক, ও শ্রোতৃমণ্ডলীর শ্রদ্ধা ও ভক্তি আকৃষ্ট না করিয়া যায় না। তখন তাহারা কে গান করিতেছে, কে চিত্র আঁকিতেছে, বা কে মূর্ত্তি গড়িতেছে, বা কে বাগান তৈয়ারী করিতেছে—এ সকল কথা ভুলিয়া গিয়া কৃতিত্বের দাস হইয়া পড়ে। গুণপনার ক্ষমতা অসীম। সুতরাং শ্বেতাঙ্গদিগকে সকল কর্ম্মক্ষেত্রে এখন আমাদের গুণপনা দেখান আবশ্যক। গুণমুগ্ধ হইলে শীঘ্রই তাহারা আমাদিগকে আদর করিতে বাধ্য হইবে। আমাদের কাল চামড়ার জন্য বেশী বাধা পাইব না।”

 ছাত্রেরাই টাস্কেজীর গৃহগুলি নির্ম্মাণ করিয়াছে ঠিক সেই আদর্শের বশবর্ত্তী হইয়াই আমি তাহাদিগের দ্বারা আমাদের বিদ্যালয়ের জন্য গাড়ী জুড়ি ইত্যাদি তৈয়ারী করাইয়াছি। আজ কাল আমাদের এইরূপ গাড়ীর সংখ্যা প্রায় ১২টা। সকল গুলিই ছাত্রদের নিজ হাতে প্রস্তুত। তাহা ছাড়া আরও অনেক গাড়ী তৈয়ারি করিয়া আমরা বাজারে বেচিয়াছি। আমাদের গাড়ীর কারখানার সাহায্যেও শ্বেতাঙ্গ কৃষ্ণাঙ্গে সদ্ভাব অনেক বাড়িয়াছে। আমাদের শিক্ষিত ছাত্রেরা যে অঞ্চলে গাড়ীর কারবার করে তাহারা সেই অঞ্চলের শ্বেতাঙ্গমহলে বিশেষ প্রতিপত্তিই অর্জ্জন করিয়াছে দেখিতে পাই।

 সংসারে লোকের যাহা অভাব তাহা তুমি যদি মোচন করিতে পার, তোমার প্রভুত্ব সেখানে সুনিশ্চিত জানিয়া রাখিও। লোকে চায় শাক শব্জী, ইট কাঠ, লোকে চায় স্বাস্থ্য ও আর্থিক উন্নতি, লোকে চায় বাড়ী ঘর আসবাব গাড়ী ইত্যাদি। তোমরা যদি সেখানে তোমাদের গ্রীকভাষার ব্যাকরণ লইয়া হাজির হও তাহা হইলে তোমাদিগকে তাহারা সম্মান করিবে কেন? বাজারের কাট্‌তি বুঝিয়া মাল জোগান দিতে থাক, দেখিবে সংসার তোমার গোলাম।

 আমার নূতন আদর্শের শিক্ষাপ্রণালী ত প্রবর্ত্তিত হইল। ধনী নির্দ্ধন বিচার না করিয়া সকল ছাত্রকেই শারীরিক পরিশ্রম করিতে বাধ্য করিলাম। সকলকেই শিল্পে, কৃষিকর্ম্মে, গৃহস্থালীতে লাগাইয়া দিলাম। আমার নিয়মগুলি টাস্কেজীময় রাষ্ট্র হইয়া গেল। সকলেই ভাবিতে লাগিল আমি একজন কিম্ভূতকিমাকার লোক। যা খুসী তাই করি। আমার বিদ্যাবুদ্ধি কিছুই নাই। ছেলেগুলির মাথা খাইতে বসিয়াছি। ছাত্রদের অভিভাবকেরা পত্র দিলেন—তাঁহাদের সন্তানদিগকে যেন হাতে পায়ে খাটিতে না বলা হয়। এইরূপ অসংখ্য আপত্তি আসিল। অনেকের বাপ মা স্কুলে স্বয়ংই আসিয়া হাজির। তাঁহারা চাহেন পুস্তকশিক্ষা! যত পুস্তকের সংখ্যা ততই তাঁহাদের ধারণায় পাণ্ডিত্য বৃদ্ধি।

 দেখিতে দেখিতে আমার বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে, আমার শিক্ষাপ্রণালীর বিরুদ্ধে এবং আমার নিজের বিরুদ্ধে বেশ একটা বিদ্রোহ বাধিয়া উঠিল। পাড়ার লোকেরা, সহরের লোকেরা, জেলার লোকেরা, ছাত্রদের অভিভাবকেরা এবং ছাত্রেরা একাকী বা দলবদ্ধভাবে আমার নিন্দা ও অপমান করিতে লাগিল। তাহারা আমার ঐরূপ নূতন নিয়মে শিক্ষাপ্রচার চাহে না। আমি কিন্তু অটল অচল ও গম্ভীরভাবে রহিলাম। আমার মত পরিবর্ত্তন করিলাম না। অনেক ছাত্র নাম কাটাইয়া চলিয়া গেল। অনেকে বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন সৃষ্টি করিল। তথাপি আমি নড়িলাম না—আমার মত ধীরভাবে সকলকে বুঝাইতে চেষ্টা করিলাম। আমি নানাস্থানে যাইয়া অভিভাবকগণকে ডাকিয়া পরামর্শ করিলাম। ক্রমশঃ লোকজনেরা কিছু কিছু বুঝিতে পারিল। দুই বৎসরের মধ্যে আমার ছাত্রসংখ্যা ১৫০ হইল। দেখা গেল আলাবামা প্রদেশের সকল জেলা হইতেই টাস্কেজীতে ছাত্র আসিয়াছে। অন্যান্য প্রদেশ হইতেও দুই চারিজন আসিয়াছে। মোটের উপর টাস্কেজী বিরোধ কাটাইয়া উঠিয়া উন্নতির পথে দাঁড়াইল। আমার একটা অগ্নিপরীক্ষা হইয়া গেল। আমার শিল্পশিক্ষা-নীতির জয় হইল।

 “পোর্টার হল” নির্ম্মিত হইয়া গেল। সম্পূর্ণরূপে ব্যবহারের উপযোগী হইবার কিছু বাকি থাকিল। তথাপি আমরা শীঘ্র শীঘ্র গৃহপ্রবেশ উৎসব সম্পন্ন করিয়া লইলাম। উত্তর অঞ্চলের একজন শ্বেতাঙ্গ ধর্ম্মগুরুকে এই উপলক্ষ্যে সভাপতির আসনে নিমন্ত্রণ করা হইয়াছিল। তাঁহার নাম রেভারেও রবার্ট সি বেড্‌ফোর্ড। তিনি আমার নাম পূর্ব্বে কখনও শুনেন নাই। যাহা হউক তিনি একজন অতিশয় সহৃদয় ব্যক্তি—আমাদের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়া নিগ্রোজাতিকে উৎসাহিত করিলেন। তাহার পর হইতে তিনি আমাদের বিদ্যালয়ের অন্যতম ট্রাষ্টী বা অভিভাবক ও রক্ষকরূপে কার্য্য করিতেছেন।

 ইহারই কিছুকাল পরে টাস্কেজী বিদ্যালয়ে একজন কর্ম্মী পুরুষ হ্যাম্পটন হইতে আসিলেন। তখন হইতে বিগত ১৭ বৎসর কাল তিনি আমাদের হিসাব রক্ষকের কার্য্য করিতেছেন। ইহাঁর নাম ওয়ারেণ লোগান। এই অধ্যবসায়ী ও বিচক্ষণ যুবকের সাহায্যে আমাদের আর্থিক অবস্থা যৎপরোনাস্তি উন্নত হইয়াছে।

 আমরা “পোর্টার হলে” কাজ কর্ম্ম আরম্ভ করিয়া দিলাম। এইবার আমরা ছাত্রাবাস সম্বন্ধে সবিশেষ উদ্যোগী হইলাম। দেড় বৎসর হইল টাস্কেজীর কার্য্য আরম্ভ হইয়াছে। ইতিমধ্যে বহুদূর দেশ হইতেই ছাত্র আসিতে আরম্ভ করিয়াছে। ছাত্রসংখ্যাও দিন দিন বাড়িয়াই চলিয়াছে। সুতরাং ইহাদিগের গতিবিধি স্বভাব চরিত্র বুঝিবার জন্য বড় রকমের ছাত্রাবাসের আয়োজন করা অত্যন্ত আবশ্যক। এই বুঝিয়াই আমরা এত বৃহৎ গৃহনির্ম্মাণে উৎসাহী হইয়াছিলাম। এতদিনে তাহার সুযোগ সত্যসত্যই আসিল।

 পোর্টার হল তৈয়ারী করিবার সময়ে তাহাতে রান্নাঘর এবং ভোজন শালার কামরা রাখা হয় নাই। কাজেই নূতন করিয়া প্রস্তুত করিতে হইল। আবার ছাত্রদিগকে ডাকিয়া পরামর্শ করা গেল। স্থির করিলাম যে, গৃহের নীচে একটা গর্ত্ত করিতে হইবে। মেজে কাটিয়া মাটি তোলান হইল। একটা বড় গর্ত্তের মত জায়গা প্রস্তুত করিলাম। সেই স্থানেই রন্ধন ও ভোজনের ব্যবস্থা হইবে।

 এখন ছাত্রাবাস চালান যায় কি করিয়া? কাজ আরম্ভ করিতে পয়সার প্রয়োজন। থালা বাটি টেবিল চেয়ার ইত্যাদি না হইলে ছাত্রদিগকে শৃঙ্খলা ও ভোজনের রীতি শিখাইব কি করিয়া? বাজারে ধার পাওয়া সহজ নয়। স্টোভও নাই যে ভাল রান্না করা যাইবে। অগত্যা বাহিরেই কাঠ জ্বালাইয়া সেকেলে নিয়মে রান্না করান যাইতে লাগিল। বাড়ী তৈয়ারী করিবার সময়ে যে সকল বেঞ্চের উপর রাখিয়া কাঠ পালিশ করা হইত সেই বেঞ্চগুলিকে খানা খাইবার টেবিল করা গেল। আর থালা, বাটি বেশী সংগ্রহ করিয়া উঠা গেল না।

 গৃহস্থালী চালাইতে কেহই জানে না বুঝিলাম। নিয়মিত সময়ে খাইতে হয় তাহাই ছাত্রদের জানা নাই। তারপর সকল দিক দেখিয়া শুনিয়া সকল ছাত্রের সুখ সুবিধা বুঝিয়া কাজ করা সেত আরও কঠিন। প্রথম দুই তিন সপ্তাহ সকল বিষয়েই হট্টগোল চলিল—কেহ খাইতে পাইল, কেহ পাইল না। কেহ এক তরকারী কম, কেহ বা বেশী পাইল। কোন খাদ্যে নুন বেশী, কোন খাদ্য বেশী পুড়িয়া গিয়াছে। বিশৃঙ্খলার চূড়ান্ত।

 আমি এই সব দেখিতাম তথাপি উন্নতির জন্য চেষ্টিত হইতাম না। ভাবিতাম দেখা যাউক, আপনা আপনি শৃঙ্খলা গড়িয়া উঠে কি না। এক দিন সকাল বেলার খাওয়া চলিতেছে। আমি ঘরের কোণে দাঁড়াইয়া চুপি চুপি শুনিতে লাগিলাম। ছাত্রছাত্রীরা মহা হাল্লা আরম্ভ করিয়াছে। সকলের মুখেই বিরক্তির ভাব। কারণ সে বেলা কাহারই কপালে খাওয়া জুটিল না সমস্ত রান্নাটাই পুড়িয়া অখাদ্য হইয়া গিয়াছে। একজন ছাত্রী বকিতে বকিতে কূপের নিকট গেল। ভাবিয়াছিল কূপ হইতে জল তুলিয়া খাইবে এবং জল পান করিয়াই সকাল বেলার ভোজন শেষ করিবে। যাইয়াই দেখে কূপের দড়ি ছেঁড়া। তাহার জল পান করা হইল না। মহা বিরক্ত হইয়া বলিতে লাগিল “আঃ, এই স্কুলে একটুকু জল খাইতেও পাই না!” আমি নিকটেই ছিলাম সে আমাকে দেখিতে পায় নাই।

 একসময়ে আমাদের নূতন বন্ধু বেড্‌ফোর্ড টাস্কেজী বিদ্যালয়ের অতিথি হইয়াছিলেন। ভোর রাত্রে তিনি শুনিতে পাইলেন তাঁহার নীচের ঘরে মহা গোলযোগ হইতেছে। ব্যাপার কি? ছাত্রদের প্রাতরাশ চলিতেছে। দুইজনের মধ্যে ঝগড়া বাঁধিয়াছে পেয়ালায় কাফি খাওয়া আজ কা’র পালা? আগেই বলিয়াছি আমাদের তখনও বাসন কোসন থালা বাটি বেশী জুটে নাই। কাফি পান করিবার জন্য পেয়ালা সকলেই রোজ পাইত না। তিন চারিদিন পর এক এক জনের ভাগ্যে পেয়ালা পড়িত।

 ছাত্রাবাসের এই দুর্দ্দশা অবশ্য বেশী দিন ছিল না। ক্রমশঃ আমাদের শৃঙ্খলা আসিল। এই সকল অসুবিধা, বিরক্তি, এবং দুঃখ ভোগের পর আমরা এখন অনেকটা সুখের মুখ দেখিতে পাইয়াছি। পূর্ব্ব হইতে এইরূপ কষ্টের মধ্যে না পড়িয়া উঠিলে আজ কি এত নির্ম্মল আনন্দ উপভোগ করিতে পারিতাম?

 আজ সেই পুরাতন ছাত্রেরা টাস্কেজীতে আসিয়া কি দেখে? অনেকগুলি বড় বড় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন গৃহ। চক্‌চকে টেবিল চেয়ার আস্‌বাব পত্র। পরিপাটি গৃহস্থালী রন্ধন ও ভোজনের সুব্যবস্থা। যথাসময়ে ভোজন শয়ন। এইসব দেখিয়া অনেকেই আমাকে বলিয়াছে—“আমরা পূর্ব্বে এই বিদ্যালয়ে দুঃখে কাটাইয়াছি। তাহারই স্বাভাবিক ক্রমবিকাশে দেখিতেছি এই সুন্দর প্রতিষ্ঠান গড়িয়া উঠিয়াছে। আজ বুঝিতেছি, অগ্রগ্রামীদিগের দুঃখ স্বীকারেই ভবিষ্যৎ সমাজের সুখের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহাই টাস্কেজীর নিকট আমাদের শেষ শিক্ষা।”